#তোমার_আমার_প্রেম (কপি নিষিদ্ধ)
#পর্ব_৮
#প্রিমা_ফারনাজ_চৌধুরী
টুসু হাতের ভর দিয়ে কোনোমতে উঠে দাঁড়াল। মনে হলো শরীরের প্রতিটি হাড়গোড় ভাঙছে একটু একটু করে। সে টালমাটাল পায়ে হেঁটে বিবেক ভাইয়ের ঘরে গেল। বিবেক ভাই তন্ময় হয়ে বসে আছেন। টুসুর উপস্থিতি বুঝতে পারল কিন্তু তাকাল না। টুসু তার পায়ের কাছে গিয়ে বসল। কিছুক্ষণ বিবেক ভাইয়ের মুখের দিকে চেয়ে কান্নাভেজা কন্ঠে জানতে চাইল,
“এখন সুস্থবোধ করছো?”
“হ্যাঁ।”
“কেন মারলে আমার আপাকে?”
“তোর আপা একটা বেঈমান প্রতারক।”
“কি করেছে?”
“আমাকে ঠকিয়েছে।”
“কিভাবে?”
বিবেক টুসুর দিকে তাকালো এবার। কড়া মেজাজে বলল,
“ও তুই সেজে আমার অভিনব শারাফের সাথে কথা বলছিল। কিছুক্ষণ রাইদা কিছুক্ষণ রাইমা। পঁচিশে বৈশাখ ওর জন্মদিন ছিল। অথচ অভিনবকে বললো ওর জন্মদিন চলে গেছে। আঠারোই ফাল্গুন ওর জন্মদিন। একবার বলে ও অনার্সে পড়ে। আরেকবার বলে ওর নাম টুসু। মোটকথা তুই সেজে কথা বলতে চেয়েছিল। কিন্তু মাঝখানে সব ঘেঁটে ঘ হয়ে গেছে।”
“অভিনব শারাফ কে?”
বিবেক ভাই রাগ সামলাতে নিজের ঠোঁট কামড়ে ধরলো। তারপর বলল,
“আমি।”
টুসুর চোখ থেকে আরও একফোঁটা জল পড়লো। বিবেক ভাই ধমকে উঠলেন,
“তুই কাঁদছিস কেন? ওর মারটা প্রয়োজন ছিল।”
টুসু বাহাত দিয়ে চোখ মুছে বলল,
“তুমি অভিনব শারাফ হয়ে আপার সাথে অভিনয় করেছ?”
“হ্যাঁ অভিনয়ই তো।”
টুসু ঠোঁট বাঁকিয়ে কাঁদলো। বলল,
“তুমি আপাকে কত্ত ভালোবাসো। অথচ আঘাত করতে তোমার হাত কাঁপলোনা?”
“তোর আপাও আমাকে আঘাত দিয়েছে। ঠকানোটা আঘাত নয়? যা ওকে গিয়ে জ্ঞান দে। আমি দেখতে চাইছিলাম ও ঠিক কতটা নীচে নামতে পারে। ওর কাছে সম্পর্ক এত ঠুনকো যে কিছুদিন কথা বলেই প্রেমে পড়ে গেল। তুই জানিস ওর মেসেজের ধরণ কেমন? সদ্য প্রেমে পড়া কিশোরীর মতো। ওর মুখে কোনোদিন মিঠে কথা, আবেগি কথাবার্তা শুনেছিস তুই? অথচ মেসেজে? তুই সেজে কথা কথা বলছিল আমার সাথে। আমাকে এও বলছিল সে বাড়ির সব কাজ করে। দাদীর সেবা করে। ঠিক আমি বাড়িতে থাকলে কাজ নিয়ে যেভাবে মিথ্যে বলতো ঠিক সেরকম। ওর কথা শুনে মনে হচ্ছিল ও সারাদিন বাড়ির কাজ করে। অথচ কাজ যতটা না করে ততটা বলে বেড়ায় তা আমি ছাড়া কে জানে? ওর মতো কাজচোর আর আছে?
আরও একটা কথা বল। আমার সাথে তোর বোন ঝগড়া ছাড়া কোনোদিন দুটো কথা বলেছে? আমি লাল রঙের পোশাক পরতে বললে ও নীল রঙের পরেছে। এটা করতে বললে সেটা করেছে। বরাবরের মতো ত্যাড়ার মতো চলাফেরা করেছে। আর অভিনব শারাফ যা বলেছে ও তাই তাই করেছে। যেন ও বাধ্য। তোর বোনের জন্য কি আমি মরে যাচ্ছিলাম? না তো। তাহলে আমাকে বলে দিত। আমিও সম্পর্কের ইতি টানতাম। ওরকম চরিত্রহীন মেয়েকে কে বিয়ে করবে? বাড়িতে একজন, মেসেঞ্জারে একজন, আবার বিয়ে করছে আরেকজনকে। কতটা দুশ্চরিত্র মেয়ে ও।”
টুসু হাঁ করে শুনছে। বিবেক রাগে ফোঁসফোঁস করছে। তখুনি তার চোখ টুসুর দিকে পড়লো। একটু অস্বস্তি হলো। ওর সামনে এতকিছু বলাটা ভালো হচ্ছে না। বিবেক শান্ত কন্ঠে বলল,
“তুই যা এখন। পরে ডেকে নেব। বাড়ির কাউকে এসব বলিস না। কান্না থামা।”
টুসু নিজেকে সামলালো। তাকে কিছু একটা করতে হবে। এই ভুল বোঝাবুঝি দূর করতে হবে। তার আপা ফুলের মতো নিষ্পাপ। একটুও পাপ করেনি। পাপ তো সে করেছে। আপা কত্তগুলো মার খেল তারজন্য। এটা তো হওয়ার কথা ছিল না। পঁচিশে বৈশাখ আপার জন্মদিন একথা টুসুর নিজেরও মনে নেই। অথচ বিবেক ভাই ঠিক জানে। ঠিক মনে করে বার্থডে সেলিব্রিটি করেছে।
অভিনব শারাফ!
কান্নারা উথলে এল। অভিনব শারাফ বলতে কেউ নেই তাহলে। কেউ না। কোনো অস্তিত্ব নেই অভিনবের। ওইসব আবেগি মুহূর্তগুলোর কোনো মানে নেই। সব মিথ্যে। সব ছলনা। সব অভিনয়। সব একটা পরীক্ষা। এত নিখুঁত অভিনয়? এত?
টুসু ধীরেধীরে দাঁড়িয়ে পড়লো। বিবেক ভাই চেয়ারে পিঠ হেলান দিয়ে চোখ বুঁজে রেখেছে। টুসু আবারও বুকের দিকে তাকালো। ক্ষতচিহ্নটা অনেকটা ঢেকে গিয়েছে। অল্প দেখা যাচ্ছে। টুসু কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর চোখ সরিয়ে নিল। আপাকে হাসপাতালে আনার আগেই যা করার করতে হবে। তাকে কিছু একটা করতে হবে। কিন্তু কি?
টুসু দৌড়ে দৌড়ে তার ঘরে চলে গেল। ফোনটা খুঁজে নিল। খালাম্মার নাম্বারে ডায়াল করল।
খালাম্মা ফোন তুললেন। বললেন,
“হ্যাঁ রে বল।”
টুসু হাউমাউ করে কেঁদে ডাকলো,
“খালাম্মা শুনো..
” মা আমার কাঁদছিস কেন? ও টুসু।”
টুসু হাতের উল্টোপিঠে চোখ মুছে বলল,
“আমি তোমার কাছে চলে যাব। আর কোনোদিন এই বাড়িতে আসবো না। কাউকে মুখ দেখাবো না। আমাকে এমন জায়গায় পাঠিয়ে দিতে পারবে যেখানে চলে গেলে এই বিবেক ভাই আর আপা আমাকে দেখবে না?”
“কি বলিস এসব? আচ্ছা আয়। তোকে লুকিয়ে রাখবো। আবার কি দোষ করেছিস?”
টুসু বলল,”এখন চলে যাব। নইলে এরা মেরে ফেলবে আমায়। আমাকে এখন নিয়ে যাও।”
“ওমা কি বলিস? ট্রেন তো কাল সকালে পাবি। শোন তুমি কাল ট্রেনে উঠে যা। আমি তোর বাপকে বলছি টিকেট কাটতে। একা একা তো ছাড়বে না তোর বাপ।”
“ছাড়বে ছাড়বে। আমি রাজী করাবো। তুমি খালুকে পাঠিও যাতে আমাকে রিসিভ করে। আমি একা যেতে পারবো। কোনো ভয় নেই।”
“আচ্ছা মা। কাঁদিস না। অত ভয় পেলে চলে ভাইবোনকে? কাঁদিস না।”
টুসু ফোন রেখে দ্রুত একটা ব্যাগ বের করে সেখানে তার কাপর-চোপর ভরতে লাগলো। আবারও চোখ মুছলো। দরজার দিকে তাকালো। পায়েল আপা যেন না দেখে। বিবেক ভাই চলে এলে সব বুঝে যাবে। সে দরজা বন্ধ করে গোছগাছ করে নিল। দাদীমার ছবি ছিল ওটাও ব্যাগে ভরলো। তার প্রিয় সাদা ফ্রকটা গায়ে চাপালো। ওটার সামনে বড় ঝালর দেয়া থাকায় ওড়না নিতে হলো না।
টুসু চুলগুলো কিছুদিন আগেই আপা কেটে দিয়েছে সুন্দর করে। পিঠের নীচে গড়ায়নি এখনো। চুলগুলো দুভাগ করে বেণী করে নিল সে। একজোড়া জুতো বের করে পালঙ্কের নীচে রেখে দিল। তার মাটির ব্যাংকটা ভাঙলো।
অনেকগুলো পয়সা ছড়িয়ে পড়লো মাটিতে। টাকাগুলোর দুভাগ করলো। একহাজার টাকা নিজের কাছে রেখে বাকিগুলো আলাদা পুটলি বাঁধলো। আব্বাকে দেবে টাকাগুলো আপার বিয়েতে খরচ করার জন্য। সেখানে আড়াই হাজারের মতো হবে।
কাজ করার বিনিময়ে দাদী, জেঠু, কাকা, বাবা আর বিবেক ভাই তাকে বিশ ত্রিশ টাকা দিত। সে সেগুলো জমিয়ে রেখেছে।
তারপর ঘরময় পায়চারি করতে থাকলো। যদি আপাকে এখনি হাসপাতাল থেকে নিয়ে আসা হয়? তাহলে তো ধরা পড়ে যাবে তার আগেই। আপা এখন না আসুক। কাল সকালে সে চলে যাওয়ার পর আসুক। ও চলে যাওয়ার পর এখানে যা হওয়ার হোক। সে আর কোনোদিন খালাম্মার বাড়ি থেকে আসবে না। বিবেক ভাইয়ের মুখোমুখি হবে না।
টুসু পায়চারি করতে করতে আপার ঘরে গেল। পায়েল আপা হয়ত রান্নাঘরে। টুসু আপার ফোনটা খুঁজে বের করলো। রাগিনী আইডিতে লগইন করলো। মেসেঞ্জারেও লগইন করলো। সব মেসেজ মুছে দিল।
তারপর কম্পিত বুকে দরজার দিকে তাকাতে তাকাতে তার ফোন থেকে রাগিনী আইডিটা মুছে দিল। নিজের ঘরে এসে চুপচাপ শুয়ে পড়লো। ছোট্ট শরীরটা আপাদমস্তক কাঁপতে লাগলো কান্নার দমকে দমকে। চোখজোড়া লাল হয়ে এল। এত পাপ কে সইবে? কিভাবে সইবে?
কিছুক্ষণ পর আবারও উঠে বসলো। দম ফেলতে পারছেনা। কি করবে? পানি? হ্যাঁ পানি লাগবে। সে জগ থেকে পানি ঢাললো গ্লাসে। ঢকঢক করে পানি খেল। গলাটা শুকিয়ে আসছে। এত তৃষ্ণা কভু লাগেনি।
পানি খাওয়ার পর মুখ মুছে বিছানায় উঠে বসলো। ফোনটা হাতে নিল। গ্যালারি থেকে একে একে সব ছবি ডিলিট করে দিতে লাগলো। তারপর হঠাৎ করে একটা ছবি চোখে পড়লো। অভিনব ভিডিওটা পাঠিয়েছিল। সে সমুদ্রে বেড়াতে গিয়েছিল। সেখানে বালুচরে রাগিনী নামটা আঙুল দিয়ে লিখছে। আঙুলটা বিবেক ভাইয়ের? না টুসুর বিশ্বাস হয় না। অভিনব মিথ্যে নয়। এত মিথ্যে অভিনয় কি করে হয়? সে তো অভিনয় করেনি। টুসু কাঁদতে লাগলো। চিৎকার করে কাঁদতে পারলে বোধহয় শান্তি লাগতো। কিন্তু তার সুযোগ নেই। অভিনব শারাফ তার কান্নার অধিকারটুকু কেড়ে নিয়েছে। অভিনেতা। মারাত্মক অভিনয় তার। মিথ্যুক।
সে ফোনটা বুকে চেপে ধরে কাঁদতে লাগলো হাউমাউ করে। তারপর কান্না সামলাতে সামলাতে ভিডিওটা ডিলিট করে দিল।
জন্মদিনের ভিডিওটা সামনে এল। কানে লাগিয়ে টুসু আবারও ভয়েসটা শুনলো। এজন্যই সে সেদিনও বারবার ভয়েসটা শুনেছিল সে। এত চেনা লাগছিল। এত পরিচিত। ছিহ!
আরও কতকগুলো স্ক্রিনশর্ট সামনে এল। তাদের প্রপোজের সময়গুলো! কত সুন্দর ছিল। সে তুলিকে স্ক্রিনশর্ট পাঠিয়েছিল। খুশিতে সারারাত ঘুমোয়নি। দেয়ালে দেখেছিল কাল্পনিক অভিনবের আঙুল ধরে সে ঘুরছে। একে অপরকে জড়িয়ে ধরেছে। অভিনবের সবল হাত আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরেছিল তার কোমর। বলিষ্ঠ মুখটা ডুবেছিল তার গলদেশে অহর্নিশ। এসব মিথ্যে। সব অভিনয়। সব কল্পনা। ওটা বিবেক ভাই? ছিঃ ছিঃ। লজ্জায়, ঘৃণায় শিরশির করলো টুসুর আপাদমস্তক।
টুসু একে একে সব ডিলিট করে দিল। সব। শুধু একটা ছবি ছাড়া। যেদিন অভিনব প্রথমদিন এক্সিডেন্টের ছবি দিয়েছিল সেদিনকার ক্ষতবিক্ষত বুকের ছবিটা। আর কিচ্ছু না। আজ টুসুর হৃদয়টা এর চাইতে বেশি ক্ষতবিক্ষত। কিন্তু কেউ দেখার নেই। টুসু ছবিটার উপর আঙুল বুলালো। আল্লাহ তার হাত দিয়ে এত পাপ কেন করালো? সে তো ছোট থেকে বিবেক ভাইকে বড়ো ভাইয়ের জায়গা দিয়ে এসেছে। আপা আর বিবেক ভাইয়ের সম্পর্কের কথা জানার পর থেকে দুলাভাইয়ের জায়গায় বসিয়েছে। তাদের দুষ্টুমিষ্টি টকঝাল সংসারের কথা ভেবে হেসেছে। তাদের ছেলেমেয়ে হলে তার ঘাড়েই ওদের দায়িত্ব চাপবে এটা ভেবে রাগ লেগেছে। কিন্তু কি হলো এসব?
রাত দশটায় বাবা বাড়ি ফিরলো ম্লান মুখে। একটা শব্দও না করে সোফায় বসে রইলো। মা আর জেম্মা কি বাবাকে বলে দিয়েছে আপা আর বিবেক ভাইয়ের সম্পর্কের কথা। টুসু সোফায় গিয়ে বসলো বাবার পাশে। বাবা তার দিকে তাকিয়ে বলল,
“তুমি জানতে ওদের এসব কাহিনী?”
টুসু ভয়ার্ত চোখে তাকালো। বলল,
“তুমি আর জেঠা ছাড়া সবাই জানে।”
বাবা গর্জে উঠলেন।
“চমৎকার। বাড়ির মধ্যে এসব চলে? লজ্জা হয় না ওদের? লজ্জা হয় না?”
টুসু থমকে গেল। বাবা এইটুকু শুনে এমন করছে আর তারটা জানলে? টুসু মনে মনে বলল,”হে আল্লাহ তুমি আমাকে আজ পথ না দেখালে আমি শেষ হয়ে যাব। আমাকে অপমান অপদস্ত করো না বাবার সামনে। পৃথিবীর কেউ না জানুক আমি অভিনব শারাফকে ভালোবেসেছি।”
টুসু বাবার গর্জন তর্জন না শুনে ঘরে চলে গেল। পায়েল আপা কত করে বলল টুসু খেল না। বিবেক ভাইও দরজা বন্ধ করে বসে আছে। বাবা চিৎকার করছে শুনেও বেরিয়ে এল না। টুসু আপার ফোন থেকে একবার মেসেঞ্জারে উঁকি দিল। অভিনব শারাফের চ্যাটবক্সে ঢুকতেই টুসুর বুকটা ধড়ফড়িয়ে উঠলো।
ব্লক করে দিয়েছে বিবেক ভাই। টুসু এবার নিজেকে সামলাতে পারলো না। বিবেক ভাইয়ের হাজারও তাচ্ছিল্য সে মানতে পারবে কারণ বিবেক ভাইয়ের কাছে সে কোনোদিনও অমন কিছু চাইবে না। কিন্তু অভিনব! তার এত তাচ্ছিল্য কিভাবে সইবে সে? গালটা দুহাত দিয়ে মুছলো সে। তারপর ভিজে যাচ্ছে দুগাল। এত জল কোথা থেকে এল খোদা? এত কান্না সে কখনো কাঁদেনি। কেন এত কষ্ট তার?
সে ঘড়ির কাঁটার দিকে তাকালো। আজ রাতটা কত লম্বা? টুসুকে বাবা ডাক পাঠালো তখুনি।
টুসু বাবার ঘরের সামনে যেতেই বাবা বলল,
“তোমার খালাম্মার কথামতো টিকেট কেটে রেখেছি। তোমার রমিজ চাচাও তোমার সাথে যাবে।”
রমিজ চাচা তুলির কাকা হয়। আব্বার দোকানে কাজ করে। খুব বিশ্বস্ত। অত সরল মানুষ আর হয় না। বউটা আরেকজনের সাথে পালিয়ে গিয়েছিল তাকে ঠকিয়ে। সেই থেকে আর বিয়ে করেনি। টুসুকে কত্ত স্নেহ করে।
টুসুর মনেপ্রাণে খুশি হলো। জানতে চাইলো,
“ক’টার ট্রেন?”
“ছ’টায়।”
টুসু মাথা হেলিয়ে চলে এল ঘরে।
রাতটা কিভাবে যেন কেটে গেল। শেষরাত থেকে বৃষ্টি শুরু হলো। আপাকেও তখন বাড়ি নিয়ে আসা হলো। টুসুরও তখন ঘুম ভেঙেছে। কারণ বাবা, জেঠুর মধ্যে তর্ক লেগেছে। আপাকে তার ঘরে শুইয়ে রাখা হয়েছে। বিবেক ভাই বাবা জেঠুর তর্ক শুনছে চুপচাপ দাঁড়িয়ে। পায়েল আপা বারংবার জেঠুকে থামার অনুরোধ করছে। বলছে,
“কাকাকে বলতে দাও। তার মেয়েকে তোমার ছেলে মেরেছে দেখেও কিছু বলবে না? কষ্ট থেকে বলছে। দেখলে না ওকে কিভাবে মারলো।”
জেঠু চেঁচিয়ে উঠে বলল,”ওর মেয়ে ওদের সম্পর্কের কথা লুকোলো কেন? তলে তলে সব ঠিক করে রেখেছে আমাদের জানালো না কেন? লন্ডনওয়ালা দেখে বিয়ে করে ফেলছে পেটাবে না? বেশ করেছে।”
জেম্মা বলল,”তুমি তোমার ছেলেকে আশকারা দিচ্ছ?”
“দেব না কেন? একশো বার দেব। এই তোকে বলছি ওকে বিয়ে করলে কালই করবি। না করলে দু’জনকে ঘাড়ধাক্কা দিয়ে বের করবো আমি।”
বিবেক ভাই বলল,”ওই চরিত্রহীনকে বিয়ে? আমি? পাগল পেয়েছ আমাকে? তোমার ভাইঝিকে ওই লোকটার গলায় ঝুলিয়ে দাও। আমি পারবো না। দরকার পড়লে একা থাকবো। ওরকম বেয়াদবকে আমি বিয়ে করবো না।”
টুসুর ওদের তর্কাতর্কির পাশাপাশি রাইমার কাছে গিয়ে বসেছে। এত ব্যান্ডেজ দেখে গা শিউরে উঠলো তার। দোষ না করেও আপা এত মার খেল। আর তাকে তো মেরেই ফেলবে বিবেক ভাই।
না সে বাঁচতে চায়। একদিন না একদিন অভিনব শারাফ হয়ে কেউ একজন আসবে তার জীবনে। সে সত্যিকারের অভিনব হবে। তার কোনোকিছু মিথ্যে হবে না। সে তাকে পাগলের মতো ভালোবাসবে।
আপা হঠাৎ শোয়া থেকে উঠে বসলো। চোখমুখ খিঁচিয়ে বিছানা থেকে নামতে লাগলো। টুসু বলল,”কোথায় যাচ্ছ?”
আপা জবাব দিল না। হাঁটতে পারছেনা তবুও জেদ ধরে হেঁটে গেল দরজার কাছে। দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে বলল,
“আমিও ওর মতো গোঁয়ারকে বিয়ে করবো না। ও আমাকে এভাবে মেরে মেরে শেষ করে দেবে।”
বিবেক ভাই তেড়ে এসে এল,”ওই তুই গোঁয়ার কাকে ডাকছিস?”
পায়েল আপা আর জেম্মা বিবেক ভাইকে ধরে রাখলো।
আপাকে আম্মা ধরে রাখলো। আপা তাও চোখে জল নিয়ে বলল,
“তুমি গোঁয়ার। তুমি আমায় মারলে কোন সাহসে? আমার আব্বা কোনোদিন একটা চড় দেয়নি আমাকে। কোন অধিকারে তুমি আমায় মারলে? আমি তোমাকে সেই অধিকার দিইনি। তুমি একটা কথা মাথায় রেখো তোমার প্রতি আমার যা যা দুর্বলতা ছিল সব কেটে গেছে। আমি তোমাকে এখন শুধু ঘৃণা করি। আজকের পর থেকে তোমার সাথে আমার কিচ্ছু নেই।”
বিবেক ভাই ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল,”তুই কি শেষ করবি রে? তোর শেষ করা আর শেষ না করায় কি এসে যায় আমার? তোকে মারলাম কারণ তুই চরিত্রহীন। চরিত্র ঠিক কর। এই বাড়িতে থেকে লম্পটামি করতে পারবি না।”
আপা রেগে গেল। আম্মা তার মুখ চেপে ধরে ঘরে ঢুকিয়ে নিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল। আপা আম্মার হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে কাঁদতে কাঁদতে মেঝেতে বসে পড়লো। টুসু আপার পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে মনে মনে বলল,
“কেঁদো না আপা। তোমার সব কষ্ট দূর করে দেব আমি। তুমি অভিমান থেকে এসব বলছো আমি জানি। তোমার আর বিবেক ভাইয়ের সব ঝামেলা চুকিয়ে দেব আমি। তোমাকে আর কোনোদিন কাঁদতে হবে না। আমি খালাম্মার কাছে চলে যাব।”
আপা কাঁদতে কাঁদতে বলল,”আমি কিচ্ছু করিনি। কিচ্ছু করিনি আম্মা।”
মা এসে আপাকে বুকে জড়িয়ে ধরে টুসুকে বলল,
“যা তো ফ্রিজ থেকে কিছু ফ্রুটস নিয়ে আয় তোর আপার জন্য।”
টুসু দৌড়ে দৌড়ে চলে গেল। আপার জন্য কমলা নিয়ে এল। খোসা ছাড়িয়ে আপাকে খাওয়ালো। শেষেরগুলো আপা খেতে চাইলো না। টুসু সেগুলো নিয়ে বিবেক ভাইয়ের ঘরের সামনে চলে গেল। চোখের উপর হাত রেখে বিবেক ভাই ঘুমোচ্ছে। টুসু বলল,”কমলা খাবে? খোসা ছাড়িয়েছি। আসি?”
বিবেক ভাই শোয়া থেকে উঠে বসলো। বলল,
“আয়।”
টুসু তার সামনের কমলার প্লেটটা রাখলো। বলল,
“খাও। সেলাইটা পুরোপুরি শুকিয়ে যাবে। ভাতও খাওনি রাতে। নিশ্চয়ই খিদে পেয়েছে।”
“এত খাব না।”
“আচ্ছা সব না খেলে জেঠুকে দিয়ে আসবো। খাও।”
বিবেক ভাই কমলা খেতে তার দিকে বাড়িয়ে দিল। টুসু হাতে না নিয়ে মুখে নিল। বলল,
“আমি খালাম্মার কাছে চলে যাচ্ছি।”
“কেন?”
“খালাম্মার কোমর ভেঙে গেছে। তোমাকে একটা কথা বলবো?”
“বল।”
“তুমি আপাকে সত্যি বিয়ে করবে না?”
“অভিনব শারাফ করতো। কিন্তু আমি না।”
“কেন?”
“ও অভিনব শারাফের সাথে ভালো করে কথা বলে। বিবেক আহসানের সাথে নয়।”
“অভিনব শারাফের সাথে যেভাবে কথা বলে ওভাবে বললে তুমি ওকে বিয়ে করতে?”
“জানিনা।”
“তুমি আপাকে আরও ভালোবেসেছ অভিনব শারাফ হয়ে, তাই না?”
বিবেক ভাই তার চোখের দিকে কেমন করে যেন তাকালেন। বললেন,
“তুই এত পাকাপাকা কথা শিখেছিস কিভাবে রে?”
টুসু বলল,”এমনও তো হতে পারে যে আপা তোমাকে চিনে। তাই ওভাবে কথা বলেছে। তুমি শুধু এটা বিশ্বাস করো যে আপা তোমাকে ছাড়া আর কাউকে ভালোবাসেনা। তারপর সব উত্তর পেয়ে যাবে তুমি। ধীরেসুস্থে সব খুলে বলো আপা সুস্থ হলে। ঠান্ডা মাথায়। রাগ করবে না। দেখবে সব সমাধান হয়ে যাবে।”
বিবেক ভাইকে তার কথাটা হয়তো ভাবালো। তিনি কেমন ভাবুক হয়ে গেলেন। টুসু এটা বিশ্বাস করে যে যতই অভিনয় বলুক বিবেক ভাই বিবেক আহসান হয়েই আপার সাথে কথা বলেছে। নইলে অমন নির্ভুল প্রেমিক রূপ ধারণ করা অসম্ভব।
বিবেক ভাই তাকে যেতে বললো। টুসু বেরিয়ে গেল। বাকি কমলাগুলো জেঠুকে দিয়ে এল। জেম্মা বলল,
“তুই ঘুমিয়ে পড় তো। কিছুক্ষণ পর ভোর হয়ে যাবে তুই এখনো সবার ঘরে ঘরে কমলা নিয়ে ছুটছিস। বেড়াতে যাবি বলে সেজেগুজেও তো বসে আছিস। চোখমুখ কেমন ফুলেছে দেখ। বোনের জন্য কেঁদেছিস নাকি?”
টুসু হাসার চেষ্টা করলো। জেম্মা তাকে বকাঝকা করে ঘরে পাঠিয়ে দিল।
ভোর হতে হতে বৃষ্টি আরও বাড়লো। রমিজ কাকা চলে এসেছে। টুসু ভেবে ফেলেছে খালাম্মার বাড়িতে যাওয়ার পর খালাম্মাকে ওয়াদা করবে যাতে তাকে কয়েকটা বছর বিবেক ভাই আর আপার কাছ থেকে দূরে থাকতে সাহায্য করে। টুসু অনেক বড় হয়ে একদিন বাড়ি আসবে। তখন তার মধ্যে আবেগ থাকবে না। বিবেক ভাইয়ের সামনে দাঁড়ালে লজ্জা, অস্বস্তিতে পড়তে হবে না।
মা বলল,”রমিজ ভাই পৌঁছে আমাদের ফোন দিয়েন। আপনার ভাইঝিকে চোখে চোখে রাখবেন। ছোট মেয়ে তো। এখনো বুঝ হয়নি অতটা।”
রমিজ কাকা টুসুর ব্যাগ একহাতে নিল অপরহাতে টুসুকে ধরে বলল,
“এই ধরলাম বাঁদরিনীকে। একেবারে ওর খালুর হাতে তুলে দিয়ে ছাড়বো।”
মা হাসলেন। বাবা বলল,”আমিও যাচ্ছি। চলো।”
টুসু রমিজ চাচার হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে মায়ের কাছে এসে জড়িয়ে ধরে ফিসফিস করে বলল,
“আপার বিয়েটা হবে তো আম্মা? বিবেক ভাইয়ের সাথে?”
“আল্লাহ যদি চান।”
টুসু হাসলো। মা তার কপালে চুমু দিয়ে বলল,
“আমার ছোট পাখি বাড়ি ফাঁকা করে চলে যাচ্ছে।”
টুসুর এবার বড্ড মন খারাপ হলো। আপা দোতলায় দাঁড়িয়ে আছে। টুসু আপার দিকে তাকালো। আপা আর পায়েল আপা হাত নেড়ে টা টা দিল। টুসু হাসলো চোখে জল নিয়ে।
তারপর বেরিয়ে যাওয়ার মুহূর্তে বিবেক ভাইকে ব্যস্ত পায়ে সিঁড়ি বেয়ে নামতে দেখা গেল। হাতা গুটাতে গুটাতে নেমে এসে প্যান্টের পেছনের পকেটে হাত গুঁজলো। মানিব্যাগ বের করতে করতে বলল,”সকাল সকাল কই যাস? তোরাও না। সবকিছু একসাথে।”
বাবা কাঠকাঠ গলায় বলে উঠলেন, “আমি টাকা দিয়েছি। তোমার টাকা লাগবে না।”
বিবেক ভাই শান্ত গলায় জবাব দিল, “আমার বোনকে আমি টাকা দিচ্ছি। এই নে, আচার খাস।”
টুসু টাকাগুলো হাসিমুখে নিল। তারপর রমিজ কাকার পিছুপিছু হাঁটা দিল। কিন্তু কয়েক কদম যেতেই হঠাৎ কী যেন মনে পড়ল! পা থমকে দাঁড়াল। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল বিবেক ভাইয়ের দিকে, তারপর এক দৌড়ে ফিরে এসে ঝপ করে তাকে জড়িয়ে ধরল। বুকের পাশে মুখ চেপে ধরে ফুঁপিয়ে উঠল,
“আপাকে বিয়ে করবে তো?”
বিবেক ভাই তার মাথার পেছনে আলতোভাবে হাত বুলিয়ে দিলেন। এক মুহূর্ত চুপ থেকে বললেন,
“করলে দাওয়াত পাবি। আগে তোর বোন নিজেকে প্রমাণ করুক।”
টুসু তখনও তার বুকে মুখ গুঁজে ছিল। বাঁ-পাশে গাল ঠেসে ধরে বলল,
“তোমার আর আপার গায়ে হলুদের দিন আমি বাসন্তী রঙের শাড়ি পরবো।”
বিবেক ভাইয়ের কপাল কুঁচকে গেল। চোখে অনেক প্রশ্ন জমে উঠলো একসঙ্গে।
টুসু কিছু না বলে পিছু হটে চোখের জল গোপন করতে করতে দৌড়ে গিয়ে রমিজ কাকা আর বাবার পাশে গিয়ে দাঁড়াল। তারপর এক পলকে মিলিয়ে গেল ভোরের আবছা আলোয়। বিবেক ঘাড় ফিরিয়ে দোতলায় তাকাতেই রাইমাকে দেখে কপাল কুঁচকে গেল। দুজন দুজনের দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে রইলো।
বিবেক কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে মানিব্যাগটা পকেটে গুঁজতে গুঁজতে উপরে উঠে গেল। কাকা চলে গেছে। এখন সে রাইমার সাথে কথা বলতে পারবে। এতক্ষণ রাইমার আশেপাশে ঘেঁষতে দিচ্ছিল না আবারও ঝগড়া হবে ভেবে।
রাইমার হাত ধরে টানতে টানতে ঘরে নিয়ে গেল। টুসুর মা জেম্মা চেঁচামেচি করতে লাগলো,”আর মারিস না। মরে যাবে। বিবেক!”
টুসুর সবার চেঁচামেচি শুনে নিজের ঘর থেকে জেঠু গর্জে উঠলো।
“ওর বাপ যেতে না যেতেই তুই আবার শুরু করলি। বিবেক!”
বিবেক মা চাচীকে হুমকি দিয়ে বলল,”ওর সাথে কথা আছে। তোমরা যাও। আমি মারবো না ওকে। যাও বলছি। নইলে আমি..”
মা চাচী পিছিয়ে যেতেই রাইমাকে ঘরে ঢুকিয়ে দরজা বন্ধ করলো বিবেক। রাইমা বলল,
“এভাবে কেন ঘরে ঢুকিয়েছ?”
বিবেক বলল,”তুই বুঝতে পারছিস না?”
“পারছি। তোমার খুব রাগ আমার উপর। নিজে ইগো ধরে রাখবে আর আমি ইগো দেখালে দোষ!”
বিবেকের মেজাজ খারাপ। এই মেয়ে এখনো বুঝতে পারছেনা সে তাকে ধরে ফেলেছে।
মেসেঞ্জারে ঢুকে রাগিনী আইডিটাকে আনব্লক করেই দ্রুত মেসেজগুলো খুলে দেখালো রাইমাকে। রাইমা ফোনটা হাতে নিয়ে শেষের মেসেজগুলো অবাক দৃষ্টিতে পড়তে লাগল। চোখে বিস্ময়, ঠোঁট কাঁপছে। হঠাৎই বুকের দিকে তাকিয়ে হাত বাড়িয়ে বলল,
“এক্সিডেন্ট? কবে?”
বিবেকের কপালে ভাঁজ পড়ল। গলার স্বর রাগে শক্ত হয়ে উঠল। হাতটা সরিয়ে দিয়ে বলল,
“মানে? নাটক করছিস?”
রাইমা হাঁ করে তার দিকে তাকিয়ে রইল। মাথার ভেতর কিছুতেই হিসেব মিলছে না। দ্রুত মেসেজগুলো স্ক্রল করতে করতে বলল,
“আইডিটা তো আমি চালাই না! টুসু চালাতো!”
বিবেকের শরীর কেঁপে উঠলো। মাথার ওপর আকাশটা ঝুরঝুর করে ভেঙে পড়ল। চোখমুখ অন্ধকার হয়ে গেল মুহূর্তে।
“কি!”
সে ফোনটা কেড়ে নিয়ে উন্মাদের মতো রাইমার দিকে ধেয়ে গিয়ে এক ঝটকায় ওকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে বলল
“খবরদার মিথ্যে বলবি না! ছোট মেয়েটার কাঁধে সব চাপিয়ে দিবি না!”
রাইমা এক হাত বাড়িয়ে দেয়ালের ভর নিল। কাঁপা কাঁপা গলায় বলল,
“সত্যি বলছি… ফোনটা দাও, আমি বাকি মেসেজগুলো পড়ি… ও তোমার সাথে মজা করেছে?”
বিবেকের চোখের সামনে ধোঁয়াশা। পা মাটিতে গেঁথে গেছে। শরীরের সমস্ত শক্তি কোথায় হারিয়ে গেল, সে ধপ করে চেয়ারটাতে বসে পড়লো। ঘামের দানা ভেসে উঠলো কপালজুড়ে। জোরে জোরে নিঃশ্বাস পড়তে লাগলো। রাইমা পানি নিয়ে এল। পানি খাইয়ে দেয়ার পরও হাঁপাতে লাগলো বিবেক। বুকের পাশে হাত চেপে ধরলো।
ব্যাথাটা বাড়ছে। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। এ অসম্ভব অসম্ভব! টুসু!
রাইমা মা জেম্মাকে ডাকলো। বলল,
“তাড়াতাড়ি এসো সবাই। দেখো ও কেমন করছে। বুকে এখনো ব্যাথা আছে তোমার? কখন এসব হলো? এতবড় আঘাত কবে পেয়েছ? কথা বলো।”
বিবেকের চোখে রক্ত ভাসছে। টুসু কোথায়? ওকে সব জবাব দিতে হবে। ও তো তার চাইতেও বড়ো অভিনেত্রী। তাকে এভাবে ধোঁকা দিল?
সকাল সাতটা তেত্রিশ। তুলি আহসান বাড়িতে এসেছে। ছাতাটা নামিয়ে রেখে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলল,”ও জেঠা। আছ নাকি বাড়িতে?”
জেঠা সাড়া দিল।
“তুলি নাকি? কি হয়েছে?”
“আমার রমু চাচা নাকি পালিয়েছে। টুসুকে গিয়ে নিয়ে আসো দৌলতগঞ্জ স্টেশন থেকে নিয়ে আসো। ও সেখানে একা। আমার সোহম ভাই ফোনে জানালো।”
জেঠা বলল,”দেখেছ কান্ড!”
বিবেক ছুটে এল। পকেটে ফোন গুঁজতে গুঁজতে সোফার পাশ থেকে ছাতা তুলে নিয়ে বেরিয়ে গেল ব্যস্তপায়ে। তার বাবা অবাক চোখে তাকালো। রাইমা মেসেজগুলো পড়ছে ঘরে বসে বসে। তার চোখ ভিজে যাচ্ছে যত পড়ছে তত। এত প্রেম, এত প্রতিশ্রুতি, এত কথা, এত অনুভূতি। তার বুকটা ভরে উঠলো রাগিনীর জায়গায় নিজেকে বসাতেই।
কিন্তু পরক্ষনেই একটা ধাক্কা খেল সে। তাদের মধ্যে তো কোনোদিন এমনটা হয়নি। এত এত প্রেম। এত এত কথা হয়নি কখনো। হালকা অনুভূতিতে জড়িয়ে দুজনেই বিয়ে নামক সম্পর্কে আবদ্ধ হতে চেয়েছিল। কথাবার্তা এতটুকু হয়েছে তাদের মধ্যে। এত প্রেম হয়নি। এত প্রেম তার মধ্যে কোনোদিন জাগ্রতও হয়নি। এত কথা সে জানেও না। এত মিষ্টিসুরে সে কখনো কথা বলেনি। বসন্তরাণী তো সে নয়। টুসু বিবেক ভাইকে না চিনেই এতকথা বলেছে? এ তো অপূর্ণ থেকে যাওয়া একটা সংসারের মতো। রাইমা শুধু কাঁদলো। সে জানেনা কি হবে। জানেনা কিছু।
পায়েল, মা, চাচীরা সবাই মিলে বলাবলি করছে রমিজ চাচাকে নিয়ে। পাগল লোকটার হাতে মেয়েটাকে ছেড়ে লাভ হলো?
বিবেকের মা বলল,”থাক চিন্তা করিস না ছোটো। বিবেক তো গেছে। ও ওর বোনকে নিয়ে ফিরে আসবে।”
________
বিবেককে একা একা দৌলতগঞ্জ স্টেশনের দিকে রওনা দিতে হয়েছে একটা বাসে করে। বুকের ভেতরটা ঢিপঢিপ করছিল। অনেক প্রশ্নের জবাব টুসুকে দিতে হবে। অনেক প্রশ্ন। ফোনটা বেজে উঠতেই বিবেক রিসিভ করলো। টুসুর বাবার ফোন।
“হ্যালো তুই রওনা দিয়েছিস?”
“হ্যাঁ কাকা।”
“আমিও আসছি। মেয়েটা হারিয়ে যাবে না তো?”
“না না। এসব ভেবো না। আমি তো যাচ্ছি। আমার লোকজন আছে ওখানে। চিন্তা করো না।”
কথা বলা শেষ করে বিবেক বাসে সিটে হেলান দিল। টুসুকে পাবে তারপর বাকি কথা। কি কথা বলবে?
তারপর নিজেই অবাক হলো এই ভেবে এমন দিনও এল যে বিবেক আহসানকে ভাবতে হচ্ছে ওইটুকুনি মেয়ের সাথে কি কথা বলবে? সব মনে পড়তে লাগলো একের পর। ওইসব কথোপকথন টুসুর সাথে হয়েছে ভাবতেই কেমন যেন লাগলো। এমন জঘন্য অনুভূতির নাম কি দেয়া যায়? বিবেক আর কিছু ভাবতে পারলো না। টুসুর মুখোমুখি তাকে হতেই হবে। এই এক জীবনে এমন পরিস্থিতিতেও তাকে পড়তে হবে তা কখনোই ভাবেনি বিবেক। চোখ বুঁজে আসতে আসতে সে পৌঁছে গেল দৌলতগঞ্জে।
তুলি যে বললো তার কাকা হারিয়ে গেছে? আসলে তা নয়। ঘটেছে অন্য ঘটনা। বিবেক দৌলতগঞ্জ যাওয়ার পর দেখলো স্টেশনের অনেকটা আগে মানুষের ভীড়। ট্রেন থামার আগেই আগুন লেগে গিয়েছিল। যে আগুন বৃষ্টির পানিও নিভাতে পারেনি। আর রমিজ কাকার লাশটা আগুনে পুড়ে পড়েছিল একপাশে। চিরকাল অবহেলা পাওয়া এই মানুষটা এভাবে পড়েছিল দেখেও তার স্বজনদের চোখে একফোঁটা পানি পড়েনি। কিন্তু টুসু?
মানুষ তার প্রিয়জনদের ভালো রাখতে কত ত্যাগ করে। কতকিছু ছেড়ে দেয়। কত কি বুকের ভেতর চেপে ধরে রাখে। কতকিছু সহ্য করে। টুসু তার আপা বিবেক ভাইকে ভালো রাখতে খালাম্মার বাড়ি যাওয়ার বদৌলতে তার দাদীর কাছে চলে গিয়েছিল একেবারে যাতে কোনোদিন অত অস্বস্তি আর লজ্জা নিয়ে বিবেক ভাই আর আপার সামনে দাঁড়াতে না হয়। সে আপার সংসার কাছ থেকে দেখতে পারতো না কোনোদিন। সহ্য হতো না। ওই বুকে তার মাথা রেখে ঘুমোনোর কথা ছিল। ওটাকে সে বহু যত্ন করে সুস্থ করেছিল। কথার যত্ন দিয়ে।
অন্যদিকে বিবেক ভাইকেও কোনোদিন ভালোবাসতে পারতো না। এত ঘৃণা, লজ্জা, অস্বস্তি নিয়ে বাঁচার চাইতে আগুনে পুড়ে রেললাইনের পাশে ছিটকে পড়ে বৃষ্টিতে ভিজে বিবেক ভাইয়ের মতো অমন পাথরকঠিন হৃদয়ের মানুষের চোখে দুফোঁটা চোখের জল যে দেখতে পেয়েছিল তা কম কীসে?
বিবেক শক্ত হয়ে গিয়েছিল। সাদা ফ্রক পড়া ছোট শরীরটাকে ওভাবে কালো হয়ে পড়ে থাকতে দেখে। টুসু যদি দেখতো তার বিবেক ভাইয়ের সমস্ত আবেগ, সমস্ত চোখের জল সেদিন শুধুমাত্র তার জন্য ঝড়ে পড়েছিল শতশত মানুষের সামনে!
আকাশের চাইতেও খুব কঠিন গর্জন সেদিন বিবেক আহসান করেছিল ছোট্ট পুতুলের গায়ে প্রাণ ফিরিয়ে দেয়ার জন্য। অভিনয়ের পুরস্কার এরচেয়ে আর বেশি কি হতে পারতো?
মাটির নীচে কাফনে মোড়ানো লাশটা রাখার সময় নিজের সমস্ত আবেগকে ওইদিন কবর দিয়ে ফেলেছিল বিবেক আহসান। অবশ্য তার চোখের জল, আবেগ টুসু ব্যতীত সবাই দেখেছে।
সমাপ্ত
একটা বোনাস আসবে।