কাননে ফুটিল ফুল পর্ব-০৭

0
259

কাননে ফুটিল ফুল — ৭ (১৬৫০+ শব্দ)

এতক্ষনে সাব্বিরের মন শান্ত হয়েছে। সেদিন জ্যোতির সাথে রুড বিহেভ করার পর যখন সাব্বিরের মাথা ঠান্ডা হলো, তখনই ও বুঝতে পেরেছিল অনেক বড় ভুল হয়ে গেছে।

সেই ভুল শুধরে নিতে কত সুযোগ যে খুঁজেছে জ্যোতির সাথে কথা বলার। কিন্তু একা বুঝিয়ে শুনিয়ে ওকে স্যরি বলার মতো অনুকূল পরিবেশ পাচ্ছিল না কোথাও। নিজেদের বাসায় বসে তো এসব কথা বলা অসম্ভব। জ্যোতিদের বাসায় গেলে ওর মা সন্দেহজনক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে সারাক্ষন, একা কথা বলার প্রশ্নই আসে না। রাস্তাঘাটে লোকজনের মধ্যেও সেভাবে ফ্রী মাইন্ডে কথা বলা যায় না। অনেক ভেবে চিন্তে অগত্যা এর চেয়ে ভালো উপায় পেল না সাব্বির। গাড়ি একপাশে পার্ক করে ওর বন্ধুটি সরে গেল। এতক্ষন একটা কথাও বলেনি জ্যোতি, চুপচাপ বসে ছিল। এবার মুখে কথার তুবড়ি ছুটল ওর,
“এবার বলো, কেন নিয়ে এসেছ আমাকে এভাবে?”

“তুই এখন আর আমাদের বাসায় আসিস না কেন? সরাসরি প্রশ্ন সাব্বিরের।

“কেন যাব? তোমাদের মতো ভালোমানুষের বাসায় আমার মতো নষ্ট মেয়ে গেলে সেই বাসা অপবিত্র হয়ে যাবে না? আমি তো খারাপ মেয়ে। টাকাপয়সাওয়ালা বিসিএস ক্যাডার ছেলে দেখে প্রেম করেছি, তাকে চুমু খেয়েছি, তার সাথে শুয়েছিও। কিছুদিন অপেক্ষা করো, তারপর শুনতে পারবে তার বাচ্চা আমার পেটে…।”
সাব্বির ওর মুখ চেপে ধরল।
“অসভ্য মেয়ে। আর একটা কথা বললে আমি তোর গলা টিপে ধরব।”

জ্যোতি মুখ থেকে হাত সরিয়ে বলল,
“ও, আমি বললাম বলে এখন অসভ্য হয়ে গেলাম? অথচ এই কথাগুলোই সেদিন বলা হয়েছিল আমাকে।”

সাব্বির আমতা আমতা করে বলল, “সেজন্য স্যরি। সেদিন মাথায় রাগ উঠে গিয়েছিল। তুই তো জানিসই, আমার নেচার কেমন। রেগে গেলে উচিৎ অনুচিৎ বোধ থাকে না। যা খুশি তাই বলে ফেলি। কিন্তু তাই বলে তুই এমন রেগে থাকবি? তুই তো জানিস এসব কথা আমি সিরিয়াসলি বলি না। এই নাকি আমাকে বুঝিস তুই?”

“সাব্বির ভাই, গত দুই বছর ধরে তোমার সাথে আমার রিলেশন চলছে। এই দুই বছরে একটাদিন তুমি আমার সাথে ভালো করে কথা বলেছ? সারাক্ষন রাগারাগি, উলটোপালটা আচরণ করেছ। ডাইনি, পেত্নি, ভুত, বলদ, গাধী এমন কোনো বিশেষণ নেই যা তুমি আমাকে দাওনি। তারপরেও আমি কখনও তোমার উপরে রাগ করিনি। কারণ আমি জানি তুমি এমনই। কিন্তু তাই বলে তুমি আমার চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তুলবে এটা আমি কিছুতেই মেনে নিতে পারব না। তোমার কথাগুলো শুনে নিজের প্রতিই ঘেন্না হচ্ছিল সেদিন। এরচেয়ে যদি আমাকে ডেকে কয়েকটা চড় থাপ্পড় দিতে, তাও ভালো ছিল।”

“হয়েছে, থাম এবার। বললাম তো স্যরি। তুইও তো আমাকে কত কিছু বলিস। বেকার, অকর্মা, অলস। তাই বলে আমি কি তার জন্য তোকে কিছু বলেছি? কিন্তু আমার সামনে তুই অন্য ছেলেদের প্রশংসা করলে আমার একদম সহ্য হয় না। সেজন্যই তো তখন মেজাজটা তেতে গিয়েছিল।”

“পড়াশোনা শেষ করে মাসের পর মাস ঘরে বসে আছ। তাই তোমাকে জেলাস ফিল করানোর জন্য কথাগুলো বলেছিলাম সেদিন। তবু যদি নিজের ভবিষ্যত নিয়ে একটু সচেতন হও। কাজের কাজ তো কিছুই হলো না, উলটো আমার কতগুলো নোংরা কথা শুনতে হলো।”

“আচ্ছা যা, এই লাস্ট। আর কখনও তোর সাথে রাগারাগি করব না। ব্যাস, মিটমাট হয়ে গেল। অনেক সময় চলে গেছে। এখন তাহলে যাওয়া যাক। আর কাল থেকে আবার আগের মতো বাসায় আসবি৷ ”

সাব্বির গাড়ি থেকে নেমে গেল ওর বন্ধুকে ডাকতে। জ্যোতি হেসে ফেলল। ও জানে, সাব্বিরের এই স্বভাব বদলাবার নয়। এখন নরম সুরে কথা বলছে, কিন্তু আজকের রাতটা পোহালে কাল সকালেই আবার আগের সাব্বির হয়ে যাবে ও। তবুও সাব্বিরকে জ্যোতির ভালো লাগে। সাব্বিরের দোষ গুন সবটা নিয়েই ভালো লাগে। এই যে পাশাপাশি নির্জনে বসে এতক্ষন কথা বলল ওরা। সাব্বির চাইলেই পারতো একবার হাতটা শক্ত করে ধরতে কিংবা একটা চুমু খেতে। কিন্তু সাব্বির সেটা করবে না। জ্যোতি জানে, যদি কখনও বৈধভাবে সাব্বিরের স্ত্রী হিসেবে ও স্বীকৃতি পায়, তাহলেই কেবল সাব্বিরের আদরমাখা স্পর্শগুলো পাবে। নইলে কখনও নয়৷ সাব্বিরের এই সংযম, ধৈর্য জ্যোতিকে আরও বেশি টেনে নিয়ে যায় ওর দিকে।

দুজনের বোঝাপড়া হওয়ার পরে সাব্বিরদের বাসায় জ্যোতির আনাগোনা বাড়তে লাগল। জ্যোতির হঠাৎ করে বাসায় আসা বন্ধ হওয়ার এতদিন পরে আবার ঘনঘন যাতায়ত, আর সাব্বিরের সাময়িক সময়ের জন্য তৈরি হওয়া খিটখিটে মেজাজ আবার ঠিক হয়ে যাওয়া, সব মিলিয়ে নৈশী মনে মনে অনেক কিছুই আন্দাজ করে ফেলল। নিজের আন্দাজ ঠিক কিনা, সেটা পরখ করে নেওয়ার জন্য তক্কেতক্কে ছিল ও। কয়েকদিন পরে সাব্বিরকে একা পেয়ে সত্য উদঘাটনে নেমে গেল নৈশী। কোনোরকম গৌরচন্দ্রিকা নয়, সরাসরি প্রশ্ন করল নৈশী সাব্বিরকে,
“জ্যোতির সাথে তোমার কতদিনের রিলেশন?”

সাব্বির ছাদে হাঁটতে হাঁটতে মোবাইল স্ক্রল করছিল। নৈশীর মুখ থেকে হঠাৎ এমন প্রশ্ন শুনে ওর হাত ফসকে ফোনটা পড়েই যাচ্ছিল প্রায়। সাব্বিরের বুক ধরফর করে উঠল, হঠাৎ করে তেষ্টা পেল খুব, শুধু একটা প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেই মনে সাইক্লোন বয়ে যাচ্ছে। সাব্বির বিরবির করে সেই প্রশ্নটাই আবার করল নিজেকে,
“নৈশী আপু এই ব্যাপারে কীভাবে জানল?”

নৈশী চুপচাপ দাঁড়িয়ে দেখছিল সাব্বিরের অস্থিরতা। ওর ফাটা বেলুনের মতো চুপসে যাওয়া মুখটা দেখে আরেকটু নিশ্চিত হলো নৈশী।

“এভাবে মিনমিন করে কী বলছ সাব্বির? একটু জোরে বলো, শুনতে পাচ্ছি না।”

“ইয়ে মানে আপু, এসব তুমি কী বলছ? আমার মতো একটা ছোট বাচ্চা ছেলে…।”

“একদম কথা ঘোরাবে না সাব্বির। তুমি মোটেও বাচ্চা নও, তোমার বয়সে অনেকে বাচ্চার বাপ হয়ে যাচ্ছে। জ্যোতি আমার কাছে সব স্বীকার করেছে, এবার তুমিও সেটাই করো।”

সাব্বিরের ইচ্ছে হলো এক্ষুনি গিয়ে জ্যোতিকে কতক্ষন থাপড়ে আসতে। এজন্যই বলে মেয়ে মানুষের পেটে কথা থাকে না। বারবার করে বারণ করল মেয়েটাকে সারজিম ভাই বিয়ে না করা অব্দি কাউকে এসব না বলতে। অথচ ঠিক সেই বলে দিল। এবার তো অস্বীকার করার কোনো উপায়ই রইল না। সাব্বির প্যাঁচার মতো মুখ করে জবাব দিল নৈশীর করা প্রথম প্রশ্নের,
“দুই বছর।”

“কে আগে প্রপোজ করেছিল, তুমি নাকি জ্যোতি?”
“আমি।”
“এতদিন জ্যোতি এই বাসায় এলো না কেন? রাগারাগি হয়েছিল?”
“হ্যাঁ।”
“এখন আবার মিটমাট হয়ে গিয়েছে?”
সাব্বির এবার মুখে জবাব দিল না। হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল শুধু।
নৈশী বলল, “ব্যাপারটা খালামনিকে জানাতে হচ্ছে তাহলে।”

সাব্বির কাঁদকাঁদ মুখে বলল, “তুমি কী চাও নৈশী আপু? আমি ঘরবাড়ি ছেড়ে নির্বাসনে চলে যাই?”

“একদমই না। কেন?”
“তাহলে আম্মুর কাছে এসব কিছু বোলো না প্লিজ। আম্মু জানতে পারলে আমাকে জ্যান্ত পুতে ফেলবে।”
“আগেই নেগেটিভ কেন ভাবছ৷ খালামনি খুশিও তো হতে পারে।”
“তুমি পাগল হয়েছ! সারজিম ভাই এখনও বিয়ে করেনি। এরমধ্যে আমার রিলেশনের কথা জানাজানি হলে ঘরে কুরুক্ষেত্র হয়ে যাবে। এমনিতেই মায়ের কাছে তার বড় ছেলে ভদ্র আর আমি বদের হাড্ডি।”
“আচ্ছা, সে নাহয় বুঝলাম। কিন্তু সারজিম ভাই এখনও বিয়ে করছে না কেন? তারও কি কোথাও রিলেশন আছে?”
“আরে না। সারজিম ভাই বিয়ের আগে রিলেশনে যাওয়াটা পছন্দই করে না। তবে সম্ভবত ভাইয়ার পছন্দের কেউ আছে যাকে সে বিয়ে করতে চায়।”

“তাহলে করছে না কেন?”

“সেটা আসলে ভালো করে আমি জানি না৷ ভাইয়া শেয়ার করেনি কখনও।” সব জানা স্বত্বেও মিথ্যেটাই বলল সাব্বির।

“ও। যাই হোক, জ্যোতির সাথে আবার নতুন করে রাগারাগি করার দরকার নেই। কারণ জ্যোতি আমাকে কিছুই বলেনি।”

সাব্বির আরেকবার আক্কেলগুড়ুম হলো।
“মানে?”

“মানে তোমাদের দুজনের গত কিছুদিনের এক্টিভিটি দেখে সন্দেহ করেছিলাম যে হয়তো তোমাদের দুজনের মধ্যে কিছু একটা চলছে। তাই আজ আন্দাজে ঢিল মারলাম। আর ঢিলটা ঠিক জায়গাতেই গিয়ে লেগেছে। কী বলো?”

নৈশী হেসে চলে গেল। সাব্বির ভোঁতামুখে দাঁড়িয়ে থাকল ছাদে। নিজের গালে নিজেই চড় মারল ও। তারপর একা একা বল, “সাব্বির, তুই একটা বলদ।”

৯.
বাংলাদেশে আসার প্রতি প্রচন্ড এক অনীহা নৈশীর তৈরি হয়েছিল আগে থেকে। ছোটবেলা থেকেই মাঝেমধ্যে নৈশী দেখত, মা লুকিয়ে কাঁদছে। ও সামনে গেলেই নিজেকে স্বাভাবিক করে ফেলত আবার৷ ওই অল্প বয়সে সাংসারিক জটিলতাগুলো না বুঝলেও এতটুকু বুঝত বাবা মায়ের মধ্যে কোনো মনোমালিন্য নেই। বরং সবসময় তারা খুব স্বতঃস্ফূর্ত। প্রশ্নটা আস্তে আস্তে জোরালো হতে লাগল নৈশীর মনে। এত খুশি, এত আনন্দ, বাবা এত ভালোবাসে মাকে, তারপরেও মা আড়ালে কাঁদে কেন? একটু বয়স হওয়ার পর নৈশীর মা আয়েশা নিজেই সব বলেছিল নৈশীকে। বলেছিল আয়েশা তার পরিবারের কাছে বেঁচে থেকেও মৃত। সেদিন সব শোনার পরে খুব রাগ হয়েছিল নৈশীর। কী করেছে তার মা? নিজের পছন্দের মানুষকে বিয়ে করতে চেয়েছে৷ এটা কী কোনো অপরাধ? এজন্য এতবড় শাস্তি দিল পরিবার৷ আয়েশা বলেছিল রাগে অভিমানে আয়েশার সাথে অমনটা করলেও তারা সবাই আসলে খুব ভালো মনের মানুষ। কিন্তু নানাবাড়ির প্রতি একট অদম্য ক্রোধ নৈশীর মনে তৈরি হতে শুরু করেছিল সেদিন থেকেই। একসময় নৈশী সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, যেই দেশ থেকে তার মাকে একবুক কষ্ট নিয়ে ফেরত আসতে হয়েছে সেই দেশে সে কক্ষনো যাবে না। মায়ের কাছে যখন দেশের গল্প শুনত তখন খুব ইচ্ছে হতো সুজলা, সুফলা, সবুজে ঘেরা দেশটাকে একবার দেখতে যেতে। কিন্তু পরক্ষনেই আবার মনে পড়ত নিজের প্রতিজ্ঞার কথা।

এমনকি বড় হওয়ার পরে আফরোজা বেগম নৈশীকে অনেকবার বলেছিলেন একবার দেশে ফিরতে। নৈশী রাজি হয়নি। নৈশী মনে মনে দেশে না যাওয়ার প্রতিজ্ঞা করলেও আয়েশা খুব করে চাইত নৈশীকে নিয়ে একদিন ফিরে যাবে বাংলাদেশে। আরও চাইত, দেশেরই কোনো একটা ছেলেকে বিয়ে করে নৈশী যেন বাংলাদেশেই সেটেল হয়। নৈশী রাজি হতো না, আয়েশা তবুও বোঝাত।

নৈশী ছিল জায়ানের চোখের মণি। মেয়ে বলতে পাগল ছিল সে৷ কিন্তু তাই বলে স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসায় ভাটা পড়েনি কখনও এতটুকুও। বরং স্ত্রী থেকে মেয়ের মা হওয়ার পর ভালোবাসা বেড়েই চলছিল উত্তোরত্তর। স্ত্রী যেটা চাইত, জায়ান সেটা পূরণ করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ত সবসময়।

জায়ান প্রথম থেকেই বুঝেছিল, নৈশী যখন একবার বলেছে সে কখনও বাংলাদেশে যাবে না, তখন সে সেটাই করবে। এদিকে স্ত্রী যেহেতু চেয়েছে মেয়েকে দেশে ফেরাতে, সেই আবদারটাও সে ফেলতে পারছিল না। অবশেষে অনেক ভেবে চিন্তে একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছিল জায়ান।

আয়েশার মৃত্যুটা ছিল একেবারে আকস্মিক। পাঁচ বছর আগের সেই রাতের কথা নৈশী চাইলেও কখনও ভুলতে পারবে না। জায়ান সেদিন ব্যাবসার কাজে অন্য শহরে গিয়েছিল। বাসায় ছিল শুধু নৈশী আর আয়েশা। নৈশীর এক্সাম চলছিল তখন। রাত জেগে পড়তে হতো খুব। সেদিনও অনেক রাত অব্দি পড়ছিল নৈশী। পড়তে বসে চোখে বারবার তন্দ্রা এসে যাচ্ছিল। নৈশী তাই মায়ের রুমে গেল, ওকে এককাপ কফি বানিয়ে দিতে বলার জন্য। রাত তখন আড়াইটা বাজে প্রায়। নৈশী গিয়ে দেখল মা ঘুমিয়ে পড়েছে। কেমন একটা লাগল নৈশীর। ও রাত জেগে পড়লে আয়েশাও জেগে থাকে ওর সাথে। অথচ আজ কিনা ঘুমিয়ে পড়ল। মাকে ডাকার জন্য তার শরীরে হাত দিল নৈশী, পরক্ষনেই শীতল শরীরের স্পর্শ পেয়ে ছিটকে সরে গেল। আবার অপ্রকৃতস্থ হয়ে এগিয়ে গেল মায়ের দিকে। এত ঠান্ডা শরীর! অবচেতন মনেই নৈশী মায়ের হাতের কবজি ধরে পালস চেক করল। পালস পাওয়া যাচ্ছে না। নৈশী নিজের মনকে বুঝ দিল, অতিরিক্ত টেনশন করছে বলে হয়তো এমন মনে হচ্ছে। ঘোরের মধ্যেই ওর হাত চলে গেল মায়ের নাকের কাছে। শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ৷ এবার কঠিন সত্যিটা নৈশীর সামনে স্পষ্ট হয়ে গেল। কিন্তু ও এটা মেনে নিতে পারল না কিছুতেই। কিছুক্ষন স্থবির হয়ে মায়ের পাশে বসে থেকে এপিলেপ্সি রোগীর মতো কাঁপতে কাঁপতে মায়ের পাশেই সেন্সলেস হয়ে পড়ে গেল ও।

বাকি রাতটুকু এভাবেই কাটল। জায়ান বাসায় ফিরল পরেরদিন ভোর ভোরই। অনেকক্ষন বেল দেওয়ার পরে যখন কেউ দরজা খুলল না তখন বাধ্য হয়ে দরজা ভেঙে ফেলল জায়ান। রুমে ঢুকে স্ত্রী আর মেয়েকে আলুথালু হয়ে বিছানায় পড়ে থাকতে দেখে আত্মা কেঁপে উঠল ওর।

মায়ের এরকম অপ্রত্যাশিত মৃত্যু মেনে নিতে পারেনি নৈশী। ট্রমাটাইজড হয়ে পড়েছিল। ওর মেন্টাল হেলথ এতটাই ড্যামেজ হয়েছিল যে কয়েকদিন অপ্রকৃতস্থের মতো আচরণ করছিল। শেষে তাই ডাক্তারের অবজার্ভেশনে রাখতে হলো ওকে কয়েকদিন।

(চলবে ইনশাআল্লাহ)

————
ভোররাত থেকেই বৃষ্টি। ফজরের নামাজ আদায় করে মাহবুব তাই বাইরে না বেরিয়ে, আবার বিছানায় গা এলিয়ে দিল। তারপর ওর ঘুম ভাঙল বেশ বেলা করে। আধোঘুমেই কানের কাছে বাজল কাঁচের চুরির রিনিঝিনি শব্দ। মাহবুব ঘাপটি মেরে শুয়ে থাকল আরও কিছুক্ষন। ও জানে, ঘুম থেকে উঠতে উঠতে এই আওয়াজ মিলিয়ে যাবে। গত পাঁচ বছর যাবত এরকম মতিভ্রম ওর প্রায়ই হয়। পুরোপুরি ঘুম ভাঙতেই মাহবুব উঠে বসল। ঘুম থেকে উঠে স্মৃতিচারণ করতে শুরু করল ও।

চুড়ির শব্দটা অবচেতন মনে গেঁথে গিয়েছিল অনেকদিন আগে। মাহবুবের মনে পড়ে যায় সেই দিনটির কথা। প্রতিবেশী নাভিদের জন্মদিন ছিল সেদিন। নাভিদের মায়ের নিমন্ত্রনে সেদিন অফিস শেষে রাতে ওদের বাসায় গিয়েছিল মাহবুব৷ কয়েকবার কলিংবেল চাপার পরে দরজা খুলল কেউ। সেদিন সবার আগেই মাহবুবের চোখ গিয়েছিল সামনে দাঁড়ানো রমণীর হাতের দিকে। সাদা আর আকাশী নীলের কম্বিনেশনে হাতভর্তি কাঁচের চুরি রিনিঝিনি শব্দে বাজছিল। মাহবুব কয়েক সেকেন্ড মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে ছিল সেই হাতের দিকে। তারপর হাত ছেড়ে মুখের দিকে তাকাতেই মাহবুবের চোখের মুগ্ধতা সরে গিয়ে সেখানে জড়ো হয়েছিল একরাশ বিরক্তি আর ক্রোধ।

সেই দিনগুলোর কথা ভাবলে মাহবুবের এখন আফসোসে মরে যেতে ইচ্ছে করে। তখন শুভ্রতাকে সহ্য হতো না একদন্ড, অথচ এখন একটুখানি দেখার তৃষ্ণায় ছটফট করতে থাকে মন। গত পাঁচটা বছর ধরে সে দৃষ্টির আড়ালেই রয়ে গেল।

🔴পড়ুন ই-বই “বিষাদবেলা ফুরায়ে যায়” এই লিংকে
https://link.boitoi.com.bd/VWDt