#সুগন্ধি_ফুল
#পর্ব_১০
#জান্নাত_সুলতানা
আবরাজ ফিজার উপর আধশোয়া ছিলো এতো সময়। অর্ধেক শরীর এতো সময় ফিজার উন্মুক্ত থাকলেও এবার সম্পূর্ণ শরীর আবরাজ এর বলিষ্ঠ শরীর এর নিচে ঢাকা পড়লো। আবরাজ ফিজার এলোমেলো চুল গুলো ঠিক করে দিতে নিলেই বাঁধা দিলো ফিজা। আবরাজ কি থামার পাত্র? সে তো আরো একধাপ উপরে। ফিজার হাত উল্টো করে চেপে ধরে। ফিজা ভ্রু কুঁচকে নিলো। আবরাজ ফিজার চোখে চোখ রাখে।
অতঃপর মুচকি হেঁসে বলে উঠলো,
-“আমার বউ।আ’ম ইম্প্রেসেড বউ।”
ফিজা নাকমুখ কোঁচকে নিলো। মোটেও এসবে গলে যাওয়ার পাত্রী নয়। বিরক্তিকর স্বরে বলে,
-“সরুন তো। আমার ঠান্ডা লাগছে। কম্ফর্টার দিন।”
-“ঠান্ডা লাগলে আমাকে জড়িয়ে ধরো। বাই দ্য ওয়ে তোমায় কিন্তু লিপস্টিক পড়লে দারুণ লাগে সুগন্ধি ফুল।”
ফিজা সচারাচর লিপস্টিক ঠোঁটে লাগায় না। দিলেও খুব অল্পস্বল্প। তবে আজ অনেক বেশি গাঢ় রঙের লিপস্টিক দিয়েছে সে। ফিজা হেয়ালি স্বরে বলে উঠলো,
-“মেয়েদের সাথে ভালো ফ্লার্ট করতে পারেন আপনি।”
-“তুমি তো আমার বউ।”
-“ক্ষুধা পেয়েছে আমার।”
ফিজা বুঝতে পারছে আবরাজ এতো সহজে ছাড়বে না তাকে। বাহানা কোনো টাই কাজে আসছে না। আবরাজ এরমধ্যে আবদার করে বসলো,
-“একটা চুমু খাই? প্লিজ বউ না করো না। আমার ভয়ংকর রকমের ইচ্ছে হচ্ছে একটা চুমু খাওয়ার।”
-“ন,,
ঠোঁট নেড়ে কিছু বলার আগেই বুঝতে পারলো ওষ্ঠদ্বয় আবরাজ নিজের দখলে নিয়েছে। শুধু ই কি ঠোঁট? ফিজার দেহখানা সম্পূর্ণ নিজের আয়ত্তে নেওয়ার তীব্র পায়তারা চালিয়ে যাচ্ছে। ফিজা ছটফট করতে থাকে। সুযোগ পাচ্ছে না মেয়ে টা। কিভাবে জব্দ করবে এই পুরুষ টাকে? একবার নিজের দাঁত কাজে লাগলো। সুযোগ বুঝে দাঁত ফুটাল আবরাজের সিগারেটে পোড়া ঠোঁটে। নোনতা স্বাদ পেতেই বুঝতে পারে রক্ত এসছে। অথচ সামনের মানবের এতে কোনো হেলদোল নেই। সে নিজের খায়েশ মিটিয়ে তবে ছাড়লো৷ ছেড়ে ই বাঁকা হেঁসে বলে উঠলো,
-“সমানে সমানে না হলে খেলে মজা নেই। আই হোপ তুমি আমাদের ফাইনাল ম্যাচে দুর্দান্ত পারফর্ম করবে সুগন্ধি ফুল।”
ফিজা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে শুধু তাকিয়ে দেখে। লজ্জা শরমের বালাই নেই এই পুরুষের মধ্যে। খুব ভালো করে বুঝতে পারছে ফিজা। ফিজা বিরক্তিকর স্বরে আওড়াল,
-“বাড়ি যেতে চাই।”
-“খাবা না?”
আবরাজ জিজ্ঞেস করে। ফিজা আবরাজ কে নিজের উপর থেকে ঠেলে সরিয়ে দেয়। এরপর উঠে বসে নিজের গায়ের পোষাক ঠিকঠাক করে৷ কাঁধ ব্যাগ ঝুলিয়ে কক্ষ ত্যাগ করার উদ্দেশ্যে পা বাড়ালো। আবরাজ কি ভেবে দ্রুত বউয়ের পেছনে ছুটে।
ফিজা ক্লাব থেকে বেরিয়ে আসার আগে একটা হুইস্কির বোতল নিলো। যা দেখে আবরাজ এর চোখ অটোমেটিক বড়ো হয়ে গেলো। দ্রুত কদম ফেলে ফিজার পেছনে এলো। গাড়িতে বসে ফিজা সেটার মুখ খুলতে লাগলো। আবরাজ গম্ভীর স্বরে বলে,
-“এটা খেলে তোমার মাথা ঘুরবে।”
-“নেশা হবে না?”
-“তোমার হবে।”
-“আপনার হবে না?”
আবরাজ জবাব দিলো না। নামি-দামি অ্যালকোহলেও যার নেশা হয় না তার সামন্য হুইস্কি দিয়ে নেশা হবে ব্যাপার টা হাস্যকর। ফিজা এটার ক্যাপ খুলতেই আবরাজ সেটা নিজের কাছে টেনে নিলো। ফিজা চটে গেলো। রাগান্বিত হয়ে বলে উঠলো,
-“দিন আমাকে। আমি খেতে চাই ওটা।”
আবরাজ এটা ফেলে দিতে নিলেই ফিজা ত্বরিতে বলে উঠলো,
-“আমি খাব না। আপনি খান!
আপনার তো নেশা হয় না।”
আবরাজ কিছু ভেবে ঢকঢক করে অর্ধেক বোতল খেয়ে নিলো। কিন্তু খাওয়া শেষ বেচারা বুঝতে পারছে এটা আসলেই সাধারণ নয়। দৃষ্টি তুলে ফিজার দিকে তাকিয়ে একটা দুই টা তিন চার টা ফিজা কে নিজের চোখের সামনে দেখলো। ফিজা আবরাজ এর চোখের দিকে তাকিয়ে বাঁকা হেঁসে সাব্বির কে কল দিলো।
আবরাজ শুধু চোখ বন্ধ করলো। ফিজা তবুও একটু চিন্তিত হলো। আদৌও আবরাজ খান এর নেশা হয়েছে তো!
——-
ইলা বেগম এর বাবা জার্মানির কিন্তু মা বাঙালী ছিলো। এবং উনার বাবা জিং প্রথমবার বিজনেস সুত্রে বাংলাদেশ এসে দেখা হয়েছিল হালিমা ইরিন এর সাথে। দীর্ঘ সময় তারা এক সাথে কোনো একটা প্রজেক্ট নিয়ে কাজ করেন৷ এবং দু’জন এক সাথে এতো সময় থাকার ফলে তাদের মধ্যে ভালো একটা সম্পর্ক তৈরি হয়। এবং সেখান থেকে ধীরেধীরে তাদের প্রেমের শুরু। যদিও হালিমা ইরিন ছিলো একজন সাধারণ এমপ্লয়ি। আর মিস্টার জিং ছিলো একজন সফল বিজনেসম্যান। হালিমা ইরিন গ্র্যাজুয়েশন কমপ্লিট এবং বংশপরিচয় ভালো তারউপর দেখতে ছিলেন চমৎকার সুদর্শনা। সেক্ষেত্রে দু’জন যেহেতু প্রাপ্তবয়স্ক এবং সফল ছিলেন তাই তাদের ভালোবাসা পরিণয় পেয়েছিলো। এবং এটার সূচনা হয়েছিল চমৎকার ভাবে। বছর ঘুরতে কোল জুড়ে এলো মেয়ে ইলা। সে কি আনন্দ দম্পত্তির। কিন্তু সুখ তো সবার কপালে সহে না। তেমনি হালিমা ইরিন এর কপালে ও বেশি দিন স্থায়ী হয় নি সেই সুখ। কঠিন ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে শয্যাশায়ী হোন তিনি। এবং মেয়ের যখন তিন বছর বয়স তখন পরকালের চলে যান তিনি। মারা যাওয়ার আগে অবশ্য নিজে আবার স্বামী বিয়ে দেন। যার নাম ছিলো নিকিতা। এবং ভীষণ ভালো ছিলেন সেই মহিলা। আর তারই ছেলে হচ্ছে জি। যে নিকিতার আগের সংসার এর ছেলে। উনার আগে একটা বিয়ে হয়েছিল তবে স্বামী কার এক্সিডেন্টে মারা যায়।
হালিমা ইরিন এর মৃত্যুর পর সব কিছু ই কেমন বদলে গিয়েছিল। নিকিতা সব কিছু সামলেছে। শুধু নিজের ছেলে কে সামলাতে পারে নি। সে সর্বদাই ইলা বেগম কে অত্যাচার করতো। যা নিয়ে প্রায়ই ঝামেলা হতো জিং এবং নিকিতার মধ্যে। তবে ইলা বেগম তো বুঝে গিয়েছিল নিকিতা ভালো হলেও জি ভালো নয়। এভাবে বড়ো হতে লাগলো দু’জন। এবং জি কে সামলে রাখতো নিকিতা। আর ইলা বেগম কেও অনেক ভালোবাসতো। দু’জন কে কখনো তিনি আলাদা করে দেখে নি। নিজের ছেলেমেয়ে কে নিয়ে বেশ সুখে দিন কাটতে লাগলো।
এদিকে জি বড়ো হওয়ার সাথে সাথে বুঝতে পারে ইলার প্রতি দুর্বল হচ্ছে সে। এবং এক সময় সে উপলব্ধি করে নিজের স্টেপ সিস্টার কে ভালোবেসে ফেলেছে সে। যেটা ছিলো দৃষ্টিকটু এবং ঘৃণিত একটা কাজ। নিকিতা এটা জানার পর ইলা কে বিয়ে দেওয়ার জন্য উঠে পরে লাগলেন। এবং নিজেদের কোম্পানির শেয়ারের এক ছেলের সাথে বিয়ে ঠিক করলেন। আর সেই পাত্র ছিলো মিলন খান।
এ-সব কথা জি এর কানে পৌঁছানো মাত্র সে প্রচুর রেগে যায়। এবং একদিন রাতে অনেক বেশি ড্রিংক করে বাড়ি ফিরে ইলার রুমে যায়। আর বাজে কিছু করার জন্য জোরজবরদস্তি করে। কিন্তু জিং এবং নিকিতা বাড়ি ছিলো সেদিন। আর তারা জি কে আটকাতে এলে জি এর হাতে সেদিন ধস্তাধস্তিতে মৃত্যু হয় মিস্টার জিং এর। এবং নিকিতা নিজে খুন এবং ধর্ষণের চেষ্টায় ছেলের বিরুদ্ধে কেস করেন। এতে জি জেলে চলে যায়। কিন্তু ততদিনে জি নিজে যে গ্যাংস্টার হয়ে গিয়েছিল কেউ সেটা জানতো না। যার জন্য তাকে জেলে নিলেও নিজের ক্ষমতায় সে জেল থেকে বেরিয়ে আসে।
কিন্তু সব খারাপ এর মধ্যে ও নিকিতা ততদিনে একটা ভালো কাজ করে ফেলেছিলো। আর সেটা হচ্ছে মিলন এবং ইলার বিয়ে দিয়ে দিয়েছিলো। আর তিনি নিজেও মারা গিয়েছিলেন। দুই দুই বার এতো বড়ো কিছু হয়েছে নিজের সাথে যা তিনি ভেবেই অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন।
এরপর জি জার্মানি চলে গিয়েছিল। আর অনেক বছর কোনো যোগাযোগ ছিলো না ইলা বেগম এর সাথে। তবে হুট করে একদিন জি ইলা বেগম এর কাছে সব কিছুর জন্য ক্ষমা চান। আর নিজের ভুলের জন্য অনুতপ্ত হোন। যার জন্য ইলা বেগম ক্ষমা করে দেন উনাকে। আর তার কিছু দিন পরেই উনার স্ত্রী মারা গিয়েছিলেন। তৃণার তখন এসএসসি পাস করেছিলো। তবে মায়ের মৃত্যুতে মেয়ে টা একদম ভেঙে পড়ে। তখন তৃণা কে সাথে করে নিয়ে আসে ইলা বেগম। এবং এরপর অবস্থা আরো বেগতিক হয়। এবং ওই সময় টা আবরাজ তৃণা কে অনেক বেশি সাপোর্ট করেছিলো। যদিও খান পরিবারের সবাই এটা করতো। তবে আবরাজ এর প্রতি দুর্বল হয়ে পড়ে তৃণা। এবং আবরাজ সেটা বুঝতে পেরে নিজস্ব দূরত্ব বজায় চলতো। তৃণা কেও জি নিজের কাছে নিয়ে যায়।
সবাই এখানেই এটার সমাধান ভাবলেও আসলেই তেমন টা হয় নি। তৃণা মানসিক ভাবে এতো টাই অসুস্থ হয়ে পড়ে যে ওকে পরবর্তীতে হসপিটাইলজড করতে হয়। এবং উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা করলেও কোনো পরিবর্তন আসে নি। বাধ্য হয়ে মিস্টার জি ইলা বেগম এর নিকট আবরাজ কে চায়। বিয়ের প্রস্তাব দিলে এতে রাজি হয় না আবরাজ। কিন্তু তৃণা কে মেন্টালি সাপোর্ট করবে এমন টা আশ্বাস দেন। ততদিনে আবরাজ স্কলারশিপ পেয়ে জার্মানির একটা ভার্সিটিতে পড়তে চলে গিয়েছিল বিধায় আরো সহজ হয়ে গেলো। মিস্টার জি আবরাজ কে নিজের বাড়িতে থাকার ব্যবস্থা করে দিলেন। আবরাজ সেখানে থাকতে শুরু করলো।
-“আর এটাই হয়তো স্যার এর জীবনের সবচেয়ে বড়ো ভুল ছিলো।”
সাব্বির এক নিঃশ্বাসে কথা গুলো বলেই থামলো। ফিজার পাশে বসে বেঘোরে ঘুমচ্ছে আবরাজ। উঁহু এমনি ঘুমচ্ছে না বেচারা। অতিরিক্ত অ্যালকোহল এর ফলে বেহুঁশ আছে আপাতত। ফিজা আবরাজ এর দিকে তাকিয়ে থেকেই বলে উঠলো,
-“কেনো বিশ্বাস করব এ-সব? আর আমার প্রশ্নের উত্তর কিন্তু আমি পাই নি। আমার প্রশ্ন ছিলো আপনার স্যার বিয়ের রাতেই কেনো এখানে চলে এসেছিলো?”
সাব্বির অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো ফিজার দিকে। ফিজা বুঝে নিলো সাব্বির বলতে চাইছে না। হয়তো আবরাজ এর কঠিন নিষেধাজ্ঞা রয়েছে।
সাব্বির ফিজা কে আবার বলে,
-“বিশ্বাস না হলে বড়ো ম্যাডাম কে জিজ্ঞেস করবেন।”
-“তাহলে সেদিন মিষ্টি কেনো আমায় কিছু বলে নি?”
-“মিষ্টির বয়স দেখেছেন? সবেমাত্র ক্লাস সিক্সে পড়ে। এসব অনেক আগের ঘটনা।”
ফিজা থমথম খেলো। আসলেই। আবরাজ আব্রাহাম এর তুলনায় মিষ্টি অনেক ছোট। আর মিলন খান এর মেয়ের প্রচুর শখ ছিলো বিধায় ইলা বেগম যখন ভুলবশত কনসিভ করেন তখন একটা মেয়ের আশায় কোনো রকম ব্যবস্থা নেন নি তারা। এমনটাই শুনেছে ফিজা। ফিজা হতাশ হলো। সার্ভেন্ট ও কেনো কিছু বলে নি? আর ইলা বেগম ই বা কেনো তাকে জি কিংবা তৃণার ব্যাপারে এতোদিন কিছু বলে নি? তবে কি আবরাজ এর আজ এই অবস্থার পেছনে কোনোভাবে মিস্টার জি এর অবদান রয়েছে!
———–
অনেকদিন হয় আব্রাহাম মেহরিন এর কথা ভুলেই গিয়েছিল। তবে আজ হঠাৎ ফিজার স্থানে অফিসে মেহরিন কে দেখে সেদিন রাতের কথা মনে পড়লো। মেয়ে টা এতো ভীতু। সেদিন ক্লান্তির জন্য এটা বুঝতে না পারলেও এখন মেহরিন এর ভীতু মুখ দেখে ব্যাপার টা উপলব্ধি করতে পারছে আব্রাহাম।
আব্রাহাম মেহরিন এর দিকে তাকিয়ে একটা চেয়ারে বসতে বসতে বলে,
-“রিলাক্স। আমাকে এতো ভয় পাওয়ার কিছু নেই।”
-“ভয় পাচ্ছি না আমি।”
কিছু টা তোতলানো স্বরে বলে মেহরিন। সাদা একটা নরমাল থ্রি-পিস পড়া মেয়ে টা। ওড়না গলায় ঝুলানো। চুল গুলো অতো বড়ো নয়। ফিজার চুল অনেক লম্বা। তবে মেহরিন এর চুল বেশ ঘন। বিনুনি টা বেশ মোটাসোটা ঠিক মেহরিন এর মতোই। আব্রাহাম আনমনে হাসে। আব্রাহাম মেহরিন এর দিকে তাকিয়ে একটা চেয়ারে বসলো। গম্ভীর স্বরে জিজ্ঞেস করলো,
-“কিসে পড়ছো তুমি?”
-“অনার্স ফাইনাল ইয়ার।”
মেহরিন এর উত্তর শুনে আব্রাহাম ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে মেয়ে টার দিকে। তার বিশ্বাস হচ্ছে না। অস্ফুটে মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসে,
-“বাচ্চা মেয়ে।”
#চলবে….
[ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন প্লিজ।]