সরি আম্মাজান পর্ব-০৩

0
149

#সরি_আম্মাজান
#পর্ব- তিন।

চারপাশে মানুষের গুঞ্জন। হালকা কোলাহলের মাঝে দাঁড়িয়ে কল্পনা ও তার শাশুড়ি চাপা উত্তেজনায় কথা বলছেন গোয়েন্দা সাজুর সঙ্গে। কিন্তু তাদের চেহারার ভীত সন্ত্রস্ত অভিব্যক্তি অন্য কিছুর ইঙ্গিত দিচ্ছে।
সাজুর উপস্থিতি যেন এক অদ্ভুত চাপ সৃষ্টি করেছে। কীভাবে তিনি তাদের গোপন কথা জানতে পারলেন, সেটাই এখন তাদের কাছে সবচেয়ে বড় রহস্য।

কল্পনা আর তার শাশুড়ি, দুজনের কেউই ঠিক করতে পারছেন না, কে আগে কথা বলবে। সত্য বলার সাহস কার মধ্যে আছে, তা যেন সময়ই বলে দেবে।

সাজু ধীর কিন্তু দৃঢ় কণ্ঠে বললেন,
“ যত তাড়াতাড়ি উত্তর দেবেন, ততই সবার জন্য ভালো। তবে উত্তর অবশ্যই সত্য হতে হবে। মিথ্যার আশ্রয় নিলে, সেই মিথ্যাকে ঢাকতে আরও অনেক মিথ্যার ভার আপনাদের নিতে হবে। মনে রাখবেন, সত্যটা যত সহজ, মিথ্যাটা ততই জটিল। ”

সাজুর চোখে ছিল অনড় দৃষ্টি। কল্পনা ও তার শাশুড়ি চুপচাপ তাকিয়ে রইলেন। উত্তরের অপেক্ষায় যেন সময় থেমে গেল।

সাজু আন্দাজে কোনো প্রশ্ন করেনি। অভিজ্ঞতায় জানে, একটি বাড়ির ভেতরের গোপন সত্যের সূত্রধর হতে পারে সেই বাড়ির কাজের মানুষ। তাই প্রথমেই কথা বলে হনুফার সঙ্গে, হনুফা মালেক মুন্সির ঘরের কাজের মহিলা।

সন্ধ্যাবেলা উঠোনে দাঁড়িয়ে কাপড় তুলছিল হনুফা। তখনই দোতলার বারান্দা থেকে চিৎকারের শব্দ কানে আসে। কৌতূহল চেপে রাখতে পারেনি সে। ভেতরের কোনো টানেই হয়তো কৌশলে আড়ি পাততে শুরু করে। শুনতে পায় সদ্য বাড়িতে আসা মরিয়ম আর কল্পনার শাশুড়ী শাহানার তপ্ত বাক্যালাপ।

হনুফা যা বলছে সেগুলো ছিল এমন,

“ ওনারা কী যে বলছিল! আমি ঠিকঠাক শুনেছি। মোহসীনের মা মরিয়ম বলছিলেন, ‘তোমার ছেলে আমার সঙ্গে দেখা করেছে, এটা সত্যি। কিন্তু তার মৃত্যুর জন্য আমি কেন দায়ী হবো? ’’

আর তখনই কল্পনার শাশুড়ি শাহানা বলেন , সরাসরি আপনাকে দায়ী করছি না। কিন্তু সত্যি বলতে আপনি চাইলে ওকে সেদিন মানসিক ভাবে সাপোর্ট করতে পারতেন।

হনুফা সাজুকে বলেছিল ,
“ এই কথা শুনে আমি ভয়ে পিছিয়ে যাই। কারণ তখন মুন্সি কাকা ঘর থেকে বের হচ্ছিল। ”

সাজু এগুলো শুনে নিয়েছে। নিজে নিজের সিদ্ধান্ত নিল যেহেতু মরিয়ম মারা গেছে তাই ওনার কাছ থেকে উত্তর পাওয়া তো সম্ভব না। কিন্তু কল্পনার শাশুড়ী নিশ্চয়ই সব জানেন। তাই এখন সুযোগ বুঝে সাজু প্রশ্ন করছে।

কল্পনা বললো ,
“ বাজারে অনেক বড় একটা জমি আছে আমার দাদা শশুরের৷ সেই জমিটা তিনি মরিয়ম ফুফুর নামে লিখে দিয়ে গেছেন৷ ”

বাজারের পাশের জামি৷ বিড়বিড় করে উচ্চারণ করে সাজু৷ কিন্তু এই জমির সঙ্গে মোহসীনের মা জড়িত কীভাবে? কিংবা সালেক মুন্সির ছেলে কীভাবে জড়ালো সেখানে?

শাহানা বললো ,
“ সুজনের ইচ্ছে ছিল বাজারের ওই জমিতে ভালো একটা দোকান করবে৷ বাহির থেকে মাঠের কিছু জমি বিক্রি করে বাজারের ওই জমিতে দোকান তুলে ব্যবসা করার প্ল্যান ছিল। কিন্তু জমির কাছে গেলে তখন সুজনের বড়কাকা মানে আমার ভাসুর বাঁধা দেয়। ”

সাজুর দৃষ্টি স্থির। বললো ,
“ কাকার কাছে বাঁধা পেয়ে আপনার ছেলে সুজন তার ফুফুর কাছে মানে মোহসীনের মায়ের কাছে দেখা করতে যায় তাই না? ”

কল্পনা বললো ,
“ হ্যাঁ সেটাই। কীভাবে যেন তাদের ঠিকানা খুঁজে বের করে ফেলে৷ তারপর শহরে চলে যায় তাদের সঙ্গে দেখা করতে। ”

সাজু কিছুটা বুঝতে পারলো কাহিনি। শাহানার দিকে তাকিয়ে সাজু বললো ,
“ আপনার ছেলে কীভাবে মারা যায়? ”

“ অসুস্থ হয়ে। ঢাকা থেকে প্রচুর জ্বর নিয়ে বাড়ি ফিরে আসে। সারাক্ষণ শুধু বলতো তার ফুফু এমনটা করবে সে ভাবতেই পারে নাই। কিন্তু কত জিজ্ঞেস করছি কোনো উত্তর নাই। ”

আপাতত বেশি প্রশ্ন করার নাই। সময় ফুরিয়ে যাচ্ছে না। কিন্তু রাত গভীর হচ্ছে খুব। সাজু তখন বলে ,
“ ঝগড়া মিটমাট হইছিল কখন? মরিয়ম বেগম যখন ছাদে গেলেন তখন আপনারা কোথায় ছিলেন? ”

“ ওনাদের বাকবিতন্ডা দেখে আমার খারাপ লাগছিল। তাই আমি ফুফুকে নিয়ে ছাদে গেছি। আম্মাকে বলেছিলাম যা হবার হয়ে গেছে কিন্তু এখন যেন সম্মান বজায় রাখে৷ ”

“ আপনি ছাদ থেকে কখন নামলেন? ”

“ সঙ্গে সঙ্গেই। বাড়িতে মেহমান তাই ভালোমন্দ রান্না করছিলাম। সেজন্য বেশিক্ষণ ছাদে না দাঁড়িয়ে নিচে চলে আসি৷ এটাই ফুফুর সঙ্গে আমার শেষ দেখা। ”

সাজু কিছুক্ষণ চুপচাপ মাথা দোলাতে থাকে। চারপাশের পরিবেশটাকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে নিজের মনের ভেতর যেন একটা ছবি আঁকে। প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি ছায়া, প্রতিটি অনুরণন সব কিছু মাথার ভেতর ঢুকিয়ে নিল। এরপর সেগুলোকে গুছিয়ে নিতে শুরু করল। প্রশ্ন আর উত্তরের টুকরো টুকরো অংশগুলো একত্রে জুড়ে একে একে সাজিয়ে তুলল নিজের চিন্তার ক্যানভাসে।

মনে হচ্ছিল, সমস্ত রহস্য যেন তার চোখের সামনে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। আবার সেইসঙ্গে অনুভব করল, এই রহস্যের চারপাশে এক বিশাল জালের অস্তিত্ব। এক অদৃশ্য শক্তি যেন তাকে এই জালের মধ্যে আটকে রেখেছে। সত্যিটা ঠিক হাতের নাগালে, অথচ ধরা-ছোঁয়ার বাইরেই রয়ে গেছে।

শাহরিয়ার তখনও মালেক মুন্সির সঙ্গে কথা বলছে। তার মুখে একরকম অদ্ভুত হাসি, যেন পরিস্থিতির সঙ্গে একেবারেই বেমানান। এই হাসি কেন, তা কেউ বুঝতে পারছে না। তবে সাজু তার দিকে খুব একটা মনোযোগ না দিয়ে এগিয়ে গেল মোহসীনের ছোটমামা সালেক মুন্সির কাছে।

সালেক মুন্সিকে একটু সাইডে নিয়ে গলায় চাপা স্বরে বলল,
“সন্ধ্যার আগে মোহসীনকে নিয়ে আপনিই তো বাজারে গিয়েছিলেন, তাই না?”

“হ্যাঁ,” মলিন মুখে জবাব দেন সালেক মুন্সি।

সাজু গভীরভাবে তার চোখে চোখ রেখে জিজ্ঞেস করল,
“মোহসীন কি কারো সঙ্গে গোপনে কোনো কথা বলেছিল? মানে, বাড়ি থেকে বের হওয়ার পর বাজারে গিয়ে মৃত্যুর সংবাদ শোনার আগ পর্যন্ত—এমন কোনো ফোন কল বা কথোপকথন, যেটা সন্দেহজনক মনে হতে পারে?”

সালেক মুন্সি কিছুক্ষণ চুপচাপ তাকিয়ে রইলেন। তার চোখে মিশ্রিত বিস্ময়। এই যুবক, যে পুলিশের সঙ্গে এসেছে, মোহসীনকে সন্দেহ করছে কেন? মোহসীন কার সঙ্গে কথা বলেছে, সেটা তিনি কেন খেয়াল করবেন?

অবশেষে তিনি সংক্ষিপ্ত উত্তর দেন,
“না, সেরকম কিছু দেখিনি।”

সাজু তার প্রতিক্রিয়া প্রকাশ না করে চুপ করে রইল। তার চোখে তখন একধরনের তীক্ষ্ণতা, যেন প্রতিটি কথা ও আচরণ বিশ্লেষণ করে।

“ আপনার বাবা মোহসীনের মায়ের নামে মোট কতটুকু সম্পত্তি লিখে দিয়েছেন? ”

সালেক মুন্সি আবারও অবাক হলেন। তিনি কোনো লুকোচুরি না করে বললেন।
“ অনেক। ”

“ কিন্তু কেন? যে মেয়ে চল্লিশ বছর ধরে বাড়িতে আসেনি। সেই মেয়ের নামে এতো সম্পত্তি কেন লিখে দিয়ে গেলেন? ”

চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে সালেক মুন্সি। তার মুখে কথা নেই। সাজু আবার তাড়া দিল। তখন তিনি বললেন ,
“ আমার জুয়ার নেশা ছিল। আর বড়ভাই বাবার সঙ্গে জমিজমা নিয়ে ঝামেলা করছিল। তখন বাবা রাগ করে সব সম্পত্তির বেশিরভাগই তিনি মরিয়ম আপার নামে লিখে দিয়েছেন। ”

সাজু এবার মোহসীনের দিকে তাকিয়ে রইল। মোহসীন ও এসআই শাহরিয়ার পাশাপাশি দাঁড়িয়ে কথা বলছিল৷
সেখান গিয়ে সাজু বললো ,

“ গল্প আর বাস্তবতা এক না৷ আপনাকে যখন প্রথমেই আপনার আর আপনার মায়ের এখানে আসার কথা জিজ্ঞেস করলাম তখন চমৎকার গল্প সাজিয়েছেন। ”

“ মানে? ” চমকে উঠে প্রশ্ন করে মোহসীন।

সাজু নিশ্বাস ছেড়ে বলে ,
“ চমকাবেন না। আপনিই ভাবুন খানিকক্ষণ আগেই যার মা খুন হয়েছে। সেই ছেলেটা খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে যখন ট্রেন স্টেশনে দেখা হওয়া মেয়ের সঙ্গে কাটানো রোমান্টিক মুহূর্ত। তারপর সেই মেয়েকে নিয়ে বিভিন্ন কথোপকথন আমাদের কাছে প্রকাশ করে তখনই তো কিছু একটা বোঝা যাচ্ছিল। ”

“ কী বোঝা যাচ্ছিল? ”

সাজু পকেট থেকে হাত বের করে মোহসীনের কাঁধে হাত রেখে বললো ,
“ মায়ের নামে নানাবাড়ি বিশাল সম্পত্তি। মায়ের মৃত্যু হলেই সব সম্পত্তি নিজেদের। এরকম কিছু কি ইঙ্গিত করা অপরাধ মোহসীন ভাই? ”

মোহসীন স্তম্ভিত হয়ে তাকিয়ে আছে।
সাজু বললো , “ কল্পনা আর শাহানার সঙ্গে দেখা কাকতালীয় নয় তাই না? আপনি ঠিকই জানতেন এবং তাদের চিনতেন। শুধু শুধু একটা কাহিনি সাজিয়ে আমাদের কাছে উপস্থাপন করেছেন। এতো বোকাসোকা ভাবেন কেন? ”

এসআই শাহরিয়ার নিজেও অবাক হয়ে গেছে। সাজু আবার বললো ,
“ আমি যখন কল্পনা আর শাহানার সঙ্গে কথা বলছিলাম তখন আপনি ঘুরেফিরে সেদিকেই বারবার তাকাচ্ছিলেন। বারবার হাত, চোখ, মাথা, পা,ঠোঁট সবকিছু দিয়ে ইশারা করেছিলেন। কিন্তু কেন মোহসীন ভাই? আপনাদের পরিকল্পনা সব সামনে আসার ভয়ে? ”

মোহসীন বিড়বিড় করছে। স্পষ্ট করে তার মুখ দিয়ে কোনো কথা বের হচ্ছে না। অদুরে দাঁড়িয়ে মুচকি মুচকি হাসছে কল্পনা। কারণ কী?
রাতের আঁধার তবুও সেই মুচকি হাসি সাজুর চোখ ফাঁকি দিতে পারলো না। কারণ ওনার নাম সাজু।

চলবে..