সরি আম্মাজান পর্ব-০৪

0
156

#সরি_আম্মাজান।
#পর্ব- চার৷

এসআই শাহরিয়ার গভীর কৌতূহল নিয়ে মোহসীনের দিকে তাকিয়ে আছেন। তার ঠোঁটের কোণে এখনো হাসির রেখা লেগে আছে। তবে তিনি মোহসীনকে কোনো প্রশ্ন না করে আচমকা সাজুকে একপাশে ডেকে নিয়ে গিয়ে বললেন,

” এসব কি বলছো তুমি? ওনার মা কিছুক্ষণ আগেই মারা গেছেন। এমন অবস্থায় তাকে সন্দেহ করে মানসিক কষ্ট দেওয়া কি ঠিক হবে?”

সাজু কোনো কথা না বলে নীরবে একবার মোহসীনের দিকে তাকায়, আবার কল্পনার দিকে। কল্পনার সঙ্গে চোখাচোখি হতেই মেয়েটি দ্রুত মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে পড়ে।

শাহরিয়ার আবার বললেন,
” ধরো খুনটা করেছে অন্য কেউ। তদন্ত শেষে যদি সত্যি তাই প্রমাণিত হয়, তখন আমাদের অনুশোচনা হবে। কারণ এমন মর্মান্তিক মুহূর্তে আমরা তাকে তার মায়ের খুনের সন্দেহ করেছি। এটা নিতান্তই অন্যায়। ”

সাজু চাইলেই এর জবাব দিতে পারত। কিন্তু শাহরিয়ার তার পরিচিত কেউ নয়। সে তার বন্ধু নোমানের ফুফাতো ভাই। শাহরিয়ারের প্রকৃত স্বভাব সম্পর্কে সাজুর কোনো ধারণা নেই। এ পরিস্থিতিতে তর্ক-বিতর্কে সময় নষ্ট করাটা বোকামি ছাড়া আর কিছু হবে না।
রাত ক্রমশ গভীর হচ্ছে। আশেপাশের মানুষজনও কমতে শুরু করেছে। চারপাশে নীরবতার চাদর যেন ধীরে ধীরে ঢেকে দিচ্ছে সবকিছু।

সাজু ধীর কণ্ঠে বলল,
” মোহসীনের সঙ্গে আপনি এবং আমি আলাদা আলাদা কথা বলেছি, তাই না? ”

” হ্যাঁ, তো? তাতে কি হয়েছে? ”

শাহরিয়ারের কণ্ঠে বিস্ময়। সাজু তখনো গভীর মনোযোগে চারপাশের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে। তার চোখে এক অদ্ভুত শান্ত অথচ দৃঢ়তার ছাপ স্পষ্ট।

সাজু বললো ,
“ মোহসীনের ছোটমামি আর ওই কল্পনা মেয়ের কাছে আমরা ঘটনা জিজ্ঞেস করি। সবার বক্তব্য এক হলে বোঝা যাবে কোনটা সত্যি কোনটা মিথ্যা। তাই না? ”

“ বোকার মতো কথা বলো কেন? মানলাম তারা প্ল্যান করে কাজটা করেছে। যদি সত্যি সত্যি এরা প্ল্যান করে তাহলে তো মোহসীনের বক্তব্যটাও প্ল্যানের মধ্যে থাকবে তাই না? ”

তর্ক করতে একদমই ইচ্ছে করছে না। কিন্তু সাজু সংক্ষেপে বললো ,
“ প্ল্যান করে এতবড় গল্প সাজানো যায় না। যদি এটাও সাজানো হয় তাহলে এরা দুজন একই গল্প বলতে গেলে তখন কিছু একটা ভুল করবে। ”

“ শোনো সাজু, আজকে আমরা আর কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করবো না। এরা কেউ পালিয়ে যাচ্ছে না। ”

সাজু থমকে গেল। মুখে কিছু না বললেও তার চোখেমুখে হতাশার ছাপ স্পষ্ট। শাহরিয়ার পা বাড়াতেই শান্ত গলায় বলল,
“আমি অন্তত কল্পনা আর তার শাশুড়ির সঙ্গে কথা বলতে চাই, তারপর এখান থেকে যাব। আমাকে এইটুকু সুযোগ দিন। নাহলে রাতে একটুও ঘুমাতে পারব না।”

শাহরিয়ার কয়েক সেকেন্ড ভেবে নিলেন। আজ এই বাড়িতে একটি খুন হয়েছে। চারপাশে তাই এক অদ্ভুত থমথমে পরিবেশ। শেষে মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়ে মালেক মুন্সির দিকে এগিয়ে গেলেন।

সাজু সুযোগ পেয়েই কল্পনা ও তার শাশুড়ির দিকে এগিয়ে গেল। তাদের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে একই প্রশ্ন করল,
“সকালে ঢাকা স্টেশনে আপনাদের প্রথম দেখা হয়েছিল, তাই না?”

কল্পনার শাশুড়ি কিছু বলার আগেই কল্পনা জবাব দিল,
“হ্যাঁ, স্টেশনে। ছবি তোলার সময়।”

কল্পনার কণ্ঠের দৃঢ়তা দেখে সাজু একটু থামল। এরপর বলে উঠল,
“পরবর্তী প্রশ্নের উত্তর আপনিই দেবেন।”
সে কল্পনার শাশুড়ির দিকে ইঙ্গিত করল।

কল্পনা কিছুটা বিরক্ত হয়ে বলল,
“মা মানসিকভাবে খুব ভেঙে পড়েছেন। ওনাকে হয়রানি করবেন না, প্লিজ। আমরা দুজন তো সবসময় একসঙ্গে ছিলাম। আপনি যা জানতে চান, আমাকে জিজ্ঞেস করুন। আমি সব উত্তর দেব।”

সাজু শান্ত অথচ দৃঢ় স্বরে বলল,
“এত কথা বলার দরকার নেই। ওভারস্মার্ট হওয়ার চেষ্টা করবেন না, কল্পনা বেগম। পরিস্থিতি বুঝে সাবধানে কথা বলাই উচিত।”

কল্পনা একটু অপ্রস্তুত হয়ে নীরব হয়ে গেল। তার শাশুড়ি মাথা নিচু করে বললেন,
“কিছু মনে করবেন না। আপনি যা জানতে চান, বলুন।”

সাজু তার স্বাভাবিক কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,
“মোহসিন আর তার মা আপনাদের সেই পুরনো আত্মীয়—এটা আপনারা কখন বুঝতে পেরেছিলেন? ঢাকা স্টেশনে, নাকি ট্রেনে ওঠার পর?”

কল্পনার শাশুড়ি ভয়ার্ত চোখে কল্পনার দিকে তাকালেন। কল্পনা কিছু বলার চেষ্টা করছিল। সাজু তার মুখের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল, যেন সব উত্তর কল্পনার ঠোঁট থেকে বেরিয়ে আসার অপেক্ষায়। সাজু জানে এরকম গুরুত্বপূর্ণ উত্তরটাও কল্পনা দিবে। কারণ যদি তার শাশুড়ী দেয় তাহলে গোলমাল হয়ে যাবে।

সত্যি হলোও তাই। কল্পনা বললো ,
“ আমরা কুষ্টিয়া স্টেশনে নেমে তারপর জানতে পারি ওনারা আমাদের আত্মীয়। তার আগে তো আমরা একসাথে ছিলাম ঠিকই কিন্তু কেউ কারো পরিচয় জানতাম না। ”

সাজুর বিরক্তির সীমা রইল না। সব ঝামেলা এই মোহসীন আর কল্পনার মধ্যে সেটা এখন জলের মতো পরিষ্কার। কিন্তু জলটা নিজের আয়ত্তে নিতে হবে। এদিকে শাহরিয়ার আর অপেক্ষা করতে চাচ্ছেন না।

সাজু কল্পনার দিকে তাকিয়ে বললো ,
“ রাত গভীর হচ্ছে। যতটা ভয়ংকর মনে হচ্ছে ততটা ভয়ংকর কিন্তু নয়। ভাবতে পারেন আজ এই রাতটাই বুঝি শেষ। ”

কল্পনা বললো , আপনি শুধু শুধু আমাদের কেন সন্দেহ করছেন সেটাই বুঝতে পারছি না।

সাজু বললো , রাত পেরিয়ে সকাল হবে। রাতের আঁধারে যা কিছু দেখা যায় না, সেটা দিনের বেলা জ্বলজ্বল করবে৷ সত্য গোপন করা সহজ নয়। অন্তত প্রফেশনাল পর্যায়ের হলে কিছুদিন ঘুরাতে পারবেন কিন্তু লুকাতে পারবেন না।

কল্পনা কোনো জবাব দিল না। কল্পনার শাশুড়ী ঠোঁট নেড়ে কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেলেন৷ সাজু বললো ,
“ আপনার মোবাইলটা একটু দেখতে পারি? ” কল্পনার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে সাজু।

“ কেন? ” ভ্রু কুঁচকে জবাব দেয় কল্পনা।

“ আপনার হাতেই রাখুন। আপনার ফোন নাম্বারটা দিন শুধু। ”

কল্পনা তার নাম্বার দিল। সাজু নিজের মোবাইলে নাম্বারটা তুলে নিয়ে মোহসীন ও শাহরিয়ার যেখানে সবার সঙ্গে দাঁড়ানো সেখানে এগিয়ে গেল। সাজু গিয়ে শুনছে শাহরিয়ার বলছেন ,

“ চিন্তা করবেন না মোহসীন ভাই। আপনার দুই ভাইকে আসতে বলেন। আমরা আগামীকাল এসে আবার কথা বলবো। আপনারা থানায় গিয়ে মামলা করবেন। বাকিটা আমরা দেখবো। ”

মালেক মুন্সি কাছেই দাঁড়িয়েছিলেন৷ তিনি সাজুর দিকে তাকিয়ে বললেন ,
“ আপনার সঙ্গে একটু কথা ছিল। ”

“ জ্বি অবশ্যই। ”

সামান্য দুরত্বে গিয়ে মালেক মুন্সি বললো ,
“ পুলিশের চেয়ে আপনাকেই বেশি কৌতূহলী মনে হচ্ছে। তাই আপনার কাছেই দাবিটা করছি। আপনারা আমার বোনের খুনিদের যেভাবেই হোক খুঁজে বের করুন। ”

“ আপনার বোন যখন বাড়িতে আসে তখন আপনি ও আপনার স্ত্রী তাদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেছিলেন? ”

সাজুর প্রশ্ন শুনে মালেক মুন্সি খানিকটা লজ্জা পেলেন৷ তারপর মাথা নিচু করেই বললেন ,
“ মনের মধ্যে রাগ ছিল। বাবা তার মৃত্যুর কদিন আগে বারবার ওকে দেখতে চাইতেন। কিন্তু ওর কোনো খবর জানতাম না। ”

একটু থেমে আবার বললেন , “ বাবার জন্যই ওর প্রতি রাগ ছিল। তাই বলেছিলাম এত বছর পরে কেন এসেছে। সম্পত্তির লোভে নাকি? ”

তারা কথা বলছিল আর সেখানেই এসে দাঁড়ায় মালেক মুন্সির বাড়ির কাজের ছেলে আকবর। আকবর এসে বলে ,
“ কাকা ওনাদের নাস্তার ব্যবস্থা করছি। ”

“ আপনাদের জন্য সামান্য চা করতে বলছি। চলুন একটু চা পান করবেন। ” সাজুদের আহ্বান জানান মালেক মুন্সি। এতগুলো পুলিশ ও সাজুর বন্ধুদের জন্য সামান্য ব্যবস্থা।

থমথমে পরিবেশ তবুও কিছু থেমে থাকে না।
সাজুর পাশেই বসেছে মোহসীন। কিছু খাওয়ানো যাবে না এটাই স্বাভাবিক। সাজু অনুরোধ করে কফি চাইল৷ বাসায় কফি ছিল। সাজুর জন্য আলাদা করে কফি দেয়া হয়েছে। কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে মোহসীনকে সাজু বললো ,

“ আপনার মোবাইলটা একটু বের করেন। যদি আপনার আপত্তি না থাকে। ”

মোহসীন মোবাইল বের করে। সাজু মোবাইলে একটা নাম্বার তুলতে বলে৷ একটু আগে কল্পনা যে নাম্বার দিয়েছে সেই নাম্বারটাই তুলতে বলে। নাম্বার তুলে ডায়েল করে কিন্তু নাম্বার সেভ করা নেই। সাজু প্রথমে ভেবেছিল হয়তো নাম্বারটা সেভ করা থাকতে পারে। কিন্তু পরে আবার ভাবে যে পরিকল্পনা করে যেটা করা হয় সেখানে সতর্কতা থাকতেই পারে।

এরপর সাজু নিজের হাতেই মোবাইলটা নিল। তারপর মোহসীনের মোবাইলের মেসেঞ্জারে গিয়ে সেখান থেকে সার্চ করতে গিয়েই প্রথমে নজরে আসে নামটা। রিসেন্টলি সার্চ করা নামগুলো যেখানে দেখা যায় সেখানে সবার উপরে নামটাই পাওয়া গেল “ Othoy Kolpona ”।
মোহসীন বেশ অস্বস্তি নিয়ে তাকিয়ে রইল।
সাজু আইডির ভিতরে গিয়ে দেখল সেখানে সব মেসেজ রিমুভ করা হয়েছে।
‘সম্ভবত পুলিশের উপস্থিতি আর সন্দেহের কারণে দ্রুত সব রিমুভ করেছে।’ মনে মনে ভাবলো সাজু৷
তারপর আইডির ভেতর প্রবেশ করে সেখানে কল্পনার ছবি দেখে পুরোপুরি নিশ্চিত হলো এটা কল্পনারই আইডি।

সাজু বিড়বিড় করে বললো,
“ ফেসবুকেও এড আছে দেখছি। তারমানে আপনারা আগে থেকেই পরিচিত তাতে কোনো সন্দেহ নেই। ”

মোহসীন কিছু না বলে চুপচাপ বসে রইল। সাজু আর কোনো প্রশ্ন না করে কফির কাপে সম্পুর্ন মনোযোগ দিয়ে কি যেন ভাবতে থাকে।
সবকিছু শেষ করে রাতের মতো বিদায় নেয়ার সময় সাজু মোহসীনের কানের কাছে মুখটা নিয়ে বলে ,
“ সকালে দশটার দিকে আমি দেখা করতে আসবো৷ আমার বিশ্বাস আপনি সব সত্যিটা আমার কাছে বলবেন। ”

সাজুরা সবাই চলে গেল ঠিকই কিন্তু পরদিন সকাল বেলা সাজুর সঙ্গে মোহসীনের আর দেখা হলো না। কারণ সকালে এসআই শাহরিয়ারের কাছে খবর আসে রাতের আঁধারে মোহসীন তার মামা বাড়ির সামনে একটা কাঁঠাল গাছের সঙ্গে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেছে।



চলবে…

মো: সাইফুল ইসলাম (সজীব)