মৃদুমন্দ পর্ব-০২

0
376

মৃদুমন্দ

২.
মিলহান লোকটাকে যতটা ভালো ভেবেছিলাম, আসলে লোকটা তেমন নন। মায়ের ভদ্র, নম্র উপমা তো নয়ই। বরং এলাকার শ্রেষ্ঠ হতচ্ছাড়াটা যদি কেউ থেকে থাকেন, নি:সন্দেহে সেই পুরষ্কারটা মিলহানই পাবেন। সেদিন দেখলাম, মিলহান আর আবছা অন্ধকারে বসে গান গাইছেন না। বারান্দায় ছোট্ট মরিচবাতি লাগিয়েছেন। আধো সোনালী রঙের, লম্বালম্বি ভাবে। তার মুখ স্পষ্ট দেখা যায় ওতে। রাত তিনটায় আমি চাতক পাখির মতো বসে আছি তার গান শোনার জন্যে। ইদানিং আমারও যে কি হয়েছে! তার গান না শোনা অব্দি ঘুম আসে না। অস্থির লাগে। গাঢ় অস্থিরতা! মিলহান একটু রয়েসয়েই গান ধরলেন। আমি যেহেতু অপেক্ষায় ছিলাম, দেড়ি করলাম না। জানালার পর্দা সরালাম অল্পসল্প। উঁকিঝুঁকি দিয়ে তাকানো মাত্রই চমকে উঠলাম খুব! আশ্চর্য! হতচ্ছাড়া লোকটা বারান্দার রেলিং ঘেষে দাঁড়িয়ে আছে। একদম আমার জানালা বরাবর। চোখের দৃষ্টিও এদিকটায় ঘুরছে। মরিচ বাতির আলোয় স্পষ্ট বুঝলাম, বেয়াদব লোকের ঠোঁটের কোণে বিরাট শয়তানি হাসি। বাঁকা হাসি বলে হয়তো এটাকে। আমাকে দেখা মাত্রই হাসিটা আরেকটু গাঢ় হলো। সুর পালটে বিশ্রী কণ্ঠে গাইলেন, “অল্পনা বয়সের ছকিনা ছেড়ি, আমার মনটা ক্যান করলি চুরি?”

ছকিনা? ছকিনা কে? মিলহান কি আমাকে বললেন? আর মন চুরি? ভ্রু কুঁচকে তার দিকে তাকাতেই চোখ মারলেন। আমার নজর ছুটলো। ভীষণ বিরক্ত হয়ে আওয়াজ তুলে জানালা আটকালাম। টেনে দেওয়া পর্দা আবার টানলাম। কি সমস্যা এই লোকের? আমাকে এভাবে জ্বালাচ্ছে কেন?

মিলহান লোকটা থামলেন না। বোঝাতে চাইলেন, সে থামবার পাত্র নন। তাকে রাতে যেটুকু সময় আমি জানালা দিয়ে উঁকি মেরে দেখতাম, তা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেল। চোরের মতো জানালা খুললেই দেখা যেত আরেক চোর আমার জানালার দিকে তাকিয়ে আছে। চোখ মারছে! অতিষ্ঠ হয়ে জানালা খোলাই বন্ধ করে দিলাম। পর্দা টানা থাকতো সর্বদা। মা এ নিয়ে চেঁচাতেন। গরম বাড়ছে। বাতাসের আনাগোনা বন্ধ বিধায় আমার ঘরে ঢুকে যে কেউ বলবে, “ওরে বাবা! এ তো মরুভূমিতে ঢুকে পরেছি!”

আর রইলো তার গানের কথা! একেকটা গান যেন তিনি আমাকে উদ্দেশ্য করেই গাইছেন, গান, গাইবেন। গানের কলিতে আমাকে হেনেস্তা করবার হাজারটা পায়তারা। এইতো সেদিন, এলাকার রাস্তায় দেখা হলো আমাদের। বাসা থেকে একটু দূরেই। কিছু ছেলেপেলেকে গান শোনাচ্ছেন। ভার্সিটিতে যাচ্ছিলাম তখন। ভোর সকাল। তার গান গাওয়া দেখে কপালে ভাঁজ পরলো। এ লোকের কি গান গাওয়া ছাড়া আর কোনো কাজ নেই? বিদেশে কি গানের পড়াশোনা করতে গিয়েছিলেন? নাকি বোঝাতে চাইছেন, “আমার মতো গানের গলা এই ইহদুনিয়ায় কারো নেই। এই এলাকায় তো নয়-ই। তাই আমি পণ করেছি, গান গেয়ে গেয়ে সবার কান নষ্ট করে দেব।”
মানুষ যায়ও গান শুনতে। একই গান বারবার। ভাবখানা এমন, আমি যেচে যেচেই কান নষ্ট করবো। ওতে আমার সমস্যা নেই।

বড়সড় শ্বাস ফেললাম। এলাকার প্রায় মানুষই মিলহানের গানের পাগল। লোকটাও এর বরাই করেন খুব। সময় নেই, জায়গা নেই, শুরু হয়ে যান। রাতে গান গাওয়ার জন্য দু’বার নালিশও হয়েছিল। কিন্তু তার কান নষ্ট ভক্তরা আছে বিধায় ঘটনা বেশিদূর এগোয় নি।
হেঁটে যেতে যেতে আমার হঠাৎ খেয়াল হলো, এ লোক গান শোনার জন্য আমার কাছে টাকা চেয়েছিল। এখন যে এলাকা শুদ্ধ সেধে সেধে বিনা পয়সায় গান শোনায়? তার বেলা?

সরব, বিরাট ডাক পরলো, “প্রিয়তা? এদিকে আয়। মিলহান ভাই গান শোনাচ্ছেন। নতুন গান। শুনে যা। নইলে মিস করবি।”

আজব! দেখছে না আমি ভার্সিটি যাচ্ছি? কানের সাথে সাথে চোখও গেছে নাকি? কিছু বলবো, তার পূর্বেই মিলহান উত্তর দিলেন, “ওকে শোনাবো না, শফি। আমি যাকে তাকে টাকা ছাড়া গান শোনাই না।”

মূর্খ, অসভ্য! তোর গান শুনতে চায় কে? রাগে কটমট করে তাকালাম। আমার বড় বড় চোখগুলো ছোট ভাইটা দেখলে নিশ্চিত ভয় পেত? অথচ এই লোক ভয় তো দূর, হেসে উড়িয়ে দিলেন। মুখের কুৎসিত হাসিটা এঁটেই বললেন, “ভার্সিটি যাচ্ছো, প্রিয়? দ্রুত যাও। তোমার জন্য আমি গান গাইতে পারছি না।”

আমি নজর সরালাম। পায়ের গতি ম্যারাথন জিততে পারবে। ওই লোককে আমার একদম সহ্য হচ্ছে না! একদম না! আমিও প্রিয়তা। কারো প্রিয় নই। কিছু একটা না করে তো হাল ছাড়বো না!

_

শফি, রফি দুজনেরই প্রেমিকা আছে। শফি এ নিয়ে অতশত ভয় না পেলেও রফি ভীষণ পায়। একটু দূর্বল হৃদয়ের তো! আমি কখনোই ভালো ছিলাম না, না আছি। এই সুযোগটা কাজে লাগালাম। ইনিয়ে-বিনিয়ে ভয় দেখিয়ে মিলহানের নম্বর জোগার করলাম। নতুন সিম কিনলাম। নম্বর সেভ করলাম ‘না হওয়া আতিফ আসলাম’ দিয়ে। যখন তখন খুব মেসেজ দিতাম। এই যেমন, “আমি তোমাকে দেখেছি আজকে। নীল রঙের শার্ট পরেছো। সুন্দর লাগছিল। বিদেশিদের মতো একটু লিপস্টিকও লাগাতে পারো মিলহান! তোমাকে কিন্তু খুব সুন্দর লাগবে। একদম বিদেশি আন্টির মতো।”

প্রথম প্রথম ওয়াটস্ অ্যাপে এসএমএস দিতাম। রিপ্লাই দিতেন না। কল দিয়ে দু’সেকেন্ড অপেক্ষা করে আবার কেটে দিতাম। লাগাতার অনেকবার। তবুও মেসেজ দেখতেন না। আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছিলাম। টোপ কি কাজে লাগেনি? ফাজলামোটা ছেড়েই দিতাম, হঠাৎ দেখলাম মেসেজ যাচ্ছে না। ব্লক করে দিয়েছেন। আমাকে আর পায় কে? এবার সরাসরি কল দেওয়া শুরু করলাম। কল দিয়ে কথা বলতাম না। চুপ থাকতাম। সে মাঝে মাঝে কল ধরতেন। আবার কখনো ফিরেও চাইতেন না। কল ধরলে তার কথপোকথন ছিল খানিকটা এমন, “কে বলছেন? সমস্যা কি?”
এরপর আর কিছু না। কল কেটে যেত। আমি খুব মজা পাচ্ছিলাম। তাকে জ্বালাতে আমার মনে এত এত আত্মীক শান্তি লাগতো! ঘুম ভালো হতো, খাওয়া ভালো হতো, দিন ভালো যেত!

সময় এভাবেই কাটছিল। মিলহানকে জ্বালিয়ে। অথচ আমি টের পাইনি। আমি না, বরং মিলহান আমাকে জ্বালাচ্ছিলেন। লোকটা অত্যন্ত ধুরন্দর, চালাক! একবার তাকে মেসেজে বলেছিলাম, “তোমার দ্বারা কিচ্ছু হবে না। ওই গানই পারবে। বেকার লোক কোথাকার!”

এর কয়েকদিন পর শুনলাম, নতুন চাকরিতে জয়েন করেছেন মিলহান। উচ্চ পদ। সেলারি ভালো। এদিকে আবার কল করলেও অদ্ভুত অদ্ভুত কান্ড ঘটছে। উনাকে আগে কল দিলে তেমন ধরতেন না। ওই হঠাৎ-বিঠাৎ! অথচ এখন কল দিলেই ধরেন। কথা বলেন না। কল কাটেনও না। ওপাশ থেকে মিলহানের নিশ্বাসের সূক্ষ্ণ শব্দ শোনা যায়। গানের ছন্দে তাল মেলাচ্ছে যেন।

ভয় হলো, উনি কিছু টের পেয়ে যাননি তো? আমি তাই কয়েকদিন কল দিলাম না। অনেকদিনের ওয়াদা ভঙ্গ করে পর্দা সরিয়ে একটু একটু উঁকি দিতাম। তাকে দেখার আশায়! কিন্তু হায়! সে এখন ব্যস্ত মানুষ। তার দেখা পাওয়া মানে সকাল বেলা চাঁদ ওঠার মতো। আজকাল রাতে গানও গাইছেন না। আমার হাঁসফাঁস লাগতে লাগলো। অস্থিরতায় পাগল হয়ে যাচ্ছিলাম। মিলহানের কি হয়েছে? বারান্দাতেও তো তেমন আসেন না! মা আমার শুকনো মুখ দেখে বললেন, “কি হয়েছে তোর, প্রিয়তা? শরীর খারাপ লাগছে, মা? জ্বর এসেছে?”

উত্তর না দিয়ে আমি বরাবরের মতোই রুমে চলে এলাম। ঘরে ভ্যাপসা গরম। দমবন্ধ হয়ে আসছে। বহুদিন বাদ পর্দা পুরোপুরি সরালাম। জানালা খুললাম। ওমনি, সুরসুরিয়ে বাতাস এসে ছুঁয়ে দিলো আমায়। চোখ বুজে এলো। এত স্নিগ্ধ! এত আরাম! ফোনের টিংটং শব্দ শুনতে পাচ্ছি। এসময় কে মেসেজ দিলো? মোবাইল হাতে নিয়ে স্ক্রীনে তাকাতেই দেখলাম, না হওয়া আতিফ আসলাম থেকে মেসেজ এসেছে, “কি সমস্যা, প্রিয়? এখন আর কল দাও না যে? আমার কণ্ঠ কি শুনতে ইচ্ছে হয় না?”

আমার অভিমান হলো। এমনভাবে বলছেন, যেন আমি কল দিলেই তিনি কথা বলেন!

________________

চলবে~
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা