মৃদুমন্দ পর্ব-০৩ এবং শেষ পর্ব

0
473

মৃদুমন্দ

শেষ পর্ব.
আমার আর মিলহানের প্রেমটা এমনি এমনি হয়ে গেল। অথচ মিলহান আমাকে কখনো ভালোবাসি বলেননি। কিংবা তার মুখ থেকে কখনো শুনিনি, “প্রিয়তা, আমি তোমাকে খুব পছন্দ করি। তোমার জন্য আমি এভারেস্ট জয় করতে পারব।”
তার কথা কি বলছি? আমি নিজেও কখনো তার দিকে প্রেম প্রেম নজরে তাকাইনি। ভালো লাগা, ভালোবাসার কথা বলিনি। কোনো এক অজানা কারণে আমাদের দেখা হওয়া মানেই ঝগড়া। যেই সেই ঝগড়া নয়। মারাত্বক, নিষ্ঠুর ঝগড়া। আমার সুন্দর মতো মুখশ্রী দেখা মাত্রই মিলহানের চোখ মুখ কুঁচকে যায়। কপালের বলিরেখা আর তীক্ষ্ণ চোখগুলো স্পষ্ট জানান দেয়, লোকটা আমাকে দেখে বেজায় বিরক্ত। সেই বিরক্তিকে তিক্ততায় পালটে দ্বিধা ছাড়াই বলেন, “আহা! এই সাত সকালে তোমার মুখটা দেখে ফেললাম, প্রিয়। দিনটা বোধহয় আমার আর ভালো কাটবে না।”

রাগে আমার শরীর কাঁপতে থাকে। তাকে কে বলেছে সাত সকালে আমার মুখ দেখতে? রাস্তায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে?

যেহেতু চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি, ট্রেন ছাড়া যাওয়ার উপায় নেই। রেলস্টেশনটাও বাসা থেকে দূরেই বটে। রোজ ভোরে ভার্সিটির উদ্দেশ্যে বের হলেই দেখা যায়, মিলহান আমাকে রেলস্টেশন অব্দি পৌঁছে দিতে ছুঁটে এসেছেন। লোকটা ঘুম পাগল। ভোরে ওঠার অভ্যাস নেই। দেখেই বোঝা যায়।
শীত শীত ভোরে সোয়েটার গায়ে কুকঁড়ে দাঁড়িয়ে আছেন মিলহান। মূখ্য রাস্তার মোড়ে। ঠান্ডায় নাক লাল, চোখে ঘুম, পা মৃদু মৃদু দুলছে। আমাকে দেখা মাত্রই কেমন মুখ-টুক কুঁচকে বললেন, “এত দেড়ি লাগে আসতে, প্রিয়?”
—“আপনাকে আসতে বলেছে কে? আমি বলেছি?” কণ্ঠে কৃত্রিম রাগ।

মিলহান বোধহয় হাসলেন ক্ষীণ। শব্দ কানে এলো। বললেন, “তোমাকে দেখার ঠেকা পরেছে আমার প্রিয়। তুমি না বললেও আসতে হয়।”

কথার কি শ্রী! এ লোককে আমি এজীবনে ভালো ভাবে কথা বলতে দেখিনি। সব সময় ত্যাড়া ত্যাড়া উত্তর। হাঁটার গতি বাড়িয়ে বললাম, “খবরদার! আমার পিছু পিছু একদম আসবেন না! বেহায়া, আধপাগল লোক।”
মিলহান অবাধ্য হলেন। কথা শুনলেন না। আমার কথার প্রমাণ স্বরুপ ঠিক পিছু পিছু আসতে লাগলেন। দৃঢ় কণ্ঠে বললেন, “তুমি মানা করলে কেন? আমি এখন তোমার পিছু ছাড়বোই না।”

ভোর তখন কত হবে? ঘড়ি দেখা হয়নি। রাস্তায় মানুষ তেমন নেই। আমার এলাকাটা একটু আরাম প্রিয়। ৮ টার আগে মানুষের হযবরল তেমন দেখা যায় না। রিকশা পাওয়া তো আরও দুষ্কর! মিলহান গুনে গুনে ঠিক বিশ মিনিট লাগিয়ে একটা রিকশা ডাকলেন। দামাদামি করে আমাকে উঠতে বললেন। অথচ প্রতিবারের মতো নিজে উঠলেন না। এগিয়ে এসে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন কোমল স্পর্শে। ঘোমটা ঠিক করে টেনে দিলেন। নরম কণ্ঠে শুধালে, “আমার অফিসে একটু কাজ আছে। তাড়াতাড়ি যেতে হবে। তুমি একা যেতে পারবে না?”

লোকটা বোধহয় আমার দূর্বলতা চেনে। আমি যে তার একটু আদরেই কুপোকাত হয়ে যাই, তা বোঝে। এজন্যই হয়তো তার এ রূপ আমি সচরাচর দেখতে পাইনা।

আমি, প্রিয়তা রওনক, মিলহান সওদাগরের পূর্বে কারো সাথে প্রেম করিনি। পছন্দ-টছন্দও ছিল না। প্রথম প্রেম, প্রথম ভালোলাগা, ভালোবাসা— আমি বোধহয় একটু না, একটু বেশিই বেখেয়ালি ছিলাম। প্রেম করলে যে সাবধানে থাকতে হয় তা মাথায় ছিল না। অসাবধানতায় খেলামও ধরা। রাতে কথা বলছিলাম, মা দেখে ফেললেন। সে এক এলাহি কান্ড! আমাকে ঘর পরিবর্তন করে ছোট ভাইয়ের ঘরে আনা হলো। মোবাইল কেড়ে নেওয়া হলো। এক প্রকার ঘরবন্দিই ছিলাম কিছুদিন। মিলহানের সঙ্গে থেকে আমি বেহায়া, অবাধ্য হয়ে গিয়েছিলাম। যেন সদ্য কিশোরীর নয়া নয়া প্রেম ভেঙ্গেছে। সে সারাদিন কেঁদে ভাসাচ্ছে ঘরে! ব্যাপারটা লজ্জাজনক, অস্বস্তিকর। বেহায়া আমি’র কোথাও যেন লজ্জা লাগছিল বটে, তবে তা মিলহানের কঠিন প্রেমে বুদ হয়ে প্রকাশ পাচ্ছিল না। কিন্তু সত্য এটাই, মিলহান রোমান্টিক কোনো প্রেমিক নন। হতচ্ছাড়া লোক গান ছাড়া কিছুই পারেন না। ওইসব উপন্যাসের প্রেমিকের মতো দুটো রোমান্টিক উক্তি তার মুখে শোনা যায়নি কখনো। তবুও যে কিভাবে কিভাবে এ লোককে এত ভালোবেসে ফেললাম! অবাক লাগে।

বাবা আমার কান্না, আহাজারি গম্ভীর হয়ে দেখেছেন শুধু। অস্বাভাবিক শান্ত গম্ভীর। আমার জানামতে বাবা মিলহানকে মোটেই পছন্দ করেন না। আমাদের কখনো মেনে নিবেন না। দিন, তারিখ ঠিক করে কোন এক ছেলেপক্ষকেও আসতে বলেছেন আমায় দেখতে। আমার আহাজারি বাড়লেও এবার আর কাঁদলাম না। চোখ জ্বলে। আর কত কাঁদবো? অভিমানে আমার বুক ব্যথা করতো। এত কিছু হয়ে যাওয়ার পরও মিলহানের দেখা নেই। টু শব্দটি নেই। ভেবেছিলাম, আমাকে না দেখতে পেয়ে লোকটা নিশ্চিত কোনো কান্ড ঘটাবেন। অস্থির হবেন। কিন্তু নাহ্! একা অস্থির আমিই ছিলাম। সে ছিলেন নির্লিপ্ত, নিষ্প্রভ।

অভিমানটা গাঢ় হওয়ার পূর্বেই পাত্রপক্ষরা একদিন এলেন আমায় দেখতে। বিছানায় জাম রঙা জামদানি শাড়ি পরে আছে। মা রেখে গেছেন এইতো, দশ মিনিট হলো। সেই থেকে আমি দরজা আটকে বসে আছি। শত বারি, ধাক্কা কিংবা চিৎকারেও আমি দরজা খুললাম না। মিলহান আমাকে ভালো না বাসলে কি হবে? আমি তো বাসি। সেই শুরু থেকে!

বসার ঘর গলিয়ে লোকজনের সমাগমের আওয়াজ কানে আসছে। পাত্রপক্ষরা কি তবে এসে গেছেন? আমার বুক কাঁপলো ভয়ে। এ পর্যন্ত অনেক বেয়াদবি করে ফেলেছি। এখন ব্যাপারটা বাবার সম্মানের সঙ্গে জড়িত। উচ্চবাচ্য করলেই সব শেষ! আমি মনে মনে প্রস্তুতি নিলাম, মা ডাকতে এলেই দরজা খুলে দেব। নিজেকে সাজাবো অন্য একটা পুরুষের জন্য। মিলহান নামক হতচ্ছাড়ার কথা আর ভাববো না। যে আমাকে ভাবে না, মনে রাখে না, তার বিরহ করে লাভ কি?

সরব, দরজার ওপাশ থেকে ডাক এলো, “প্রিয়?”

ডাকটার আগে পিছে কিছু নেই। আমি আরেকটু অপেক্ষা করলাম। যদি ডাকটা আবার শুনতে পাই? কিন্তু নাহ্! আর কোনো সারা শোনা যাচ্ছে না। তড়িৎ গতিতে দরজা খুলতেই দেখতে পেলাম, এক অন্য মিলহান আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। পরিপাটি থাকা সত্ত্বেও তামাটে মুখে বিবর্ণতা বিঁধছে। চোখের নিচে গাঢ় কালি। ঠোঁট শুকনো। একটু শুকিয়েছেন কি? উত্তর আসে, “হ্যাঁ, শুকিয়েছেন।”

মিলহান আমাকে দেখা মাত্র স্নিগ্ধ হাসলেন। মুচকি হাসি। ক্লান্ত গলায় অনেক কিছু বুঝিয়ে বললেন, “তোমার বাবাকে মানাতে এত খাটতে হলো, প্রিয়।”

তার না বলা কথাগুলো বুঝলাম। অভিমানের শক্ত পাহাড় ফুতুর হয়ে গেল তৎক্ষণাৎ। চোখে পানি এলো, গাল বেয়ে গড়ালো। হু হু করে কাঁদলাম আমি। মিলহান ঘরের ভেতরে ঢুকে দরজাটা ভিরিয়ে দিলেন। মুহুর্তেই তার বুকে লেপ্টে নিলেন আমাকে। রয়েসয়ে, জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিঁজিয়ে বললেন, “কখনো কখনো বিচ্ছেদ এত কিছু শিখিয়ে দেয়, প্রিয়! এইযে, আমি যে তোমাকে এত ভালোবাসি, আগে বুঝতে পারিনি।”

আমার কান্না বাড়লো। মিলহানের ইস্ত্রি করা ফিটফাট শার্টটা ভিঁজিয়ে দিলাম নোনা অশ্রুজলে। আহাজারি করে বললাম, “আপনি আমাকে অনেক জ্বালিয়েছেন, মিলহান।”

মিলহান হেসে উত্তর দিলেন, “আরও জ্বালাবো।”
—“অনেক কষ্ট দিয়েছেন।”
—“আর দিবো না।”
—“আমাকে এর আগে ভালোবাসি বলেন নি কেন?”
—“এখন থেকে রোজ বলব।”
—“আর কাঁদাবেন কখনো আমাকে?”
—“দু:খ দু:খ কাঁদাবো না। খুশির কান্না কাঁদাতে পারি।”
—“আপনি নিষ্ঠুর।”
—“আর হবো না।”
—“আপনি বাজে।”
—“আর হবো না, প্রিয়।”

চোখের কান্নাগুলো আরেকদফা মিলহানের শার্টে মুছলাম আমি। আওড়ালাম, “আরেকবার বলুন ভালোবাসি। আমার নাম ধরে বলুন।”

মিলহান আচমকা আমার মুখ নিজের দু’হাতের ভাঁজে নিলেন। কপালের মধ্যিখানে আলতো অধরের ছোঁয়া এঁকে গাঢ় কণ্ঠে বললেন, “ভালোবাসি, প্রিয়। আমি তোমাকে অসহ্য রকম ভালোবাসি।”

________________

সমাপ্ত
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা