আমি আছি পর্ব-২৩+২৪+২৫

0
1079

উপন্যাসের নাম::#আমি_আছি
লেখনিতে:#সাদিয়া_আফরোজ
পর্ব: ২৩
,
,
,
,
,
,
,
,
জানালার কাঁচ ভেদ করে এক ফালি রোদ্দুর ছুঁয়ে দিচ্ছে তৃধাকে। চোখ মুখ কুঁচকে নিলেও পাশ ফিরলো না । জানালার কাঁচে ঠক ঠক শব্দে মুচকি হেসে চোখ জোড়া খুললো। এই শব্দ নতুন নয়। এই ঠক ঠক শব্দ তৃধার চেনা। চোখ মেলে তাকালো সেই দিকে।আজো সেই চড়ুই দুটো এসে বসেছে জানালার কাঁচ ঘেঁষে। দু’জনের মধ্যে বাকবিতন্ডা চলছে। মাঝে মাঝে জানালার কাঁচ ঠুকে আবার কিচিরমিচির শব্দ করে যাচ্ছে। তৃধার মতে তারা বর বউ। কোনটা বর কোনটা বউ তৃধা জানে না। ধারনা করলো যে চড়ুই পাখিটা বারবার কাচ ঠুকছে সে নিঃসন্দেহে বউ। বর বেচারার আওয়াজ কম। কাঁচে ঠোঁট ঠুকার মত কাজে সে নেই। বউয়ের কথার ফাঁকে ফাঁকে নিজে দু চারটে কথা বলছে। তাও সে পেরে উঠছে না। তৃধার মায়া হলো বরের প্রতি। এই বর চড়ুইটা একদম তার বাবার মত। মায়ের সামনে বাবা ভীতু, অপারগ পুরুষ। বাবা চুপচাপ দোষ গুণ সব মেনে নেয়। তৃধা খেয়াল করলো এতো ঝগড়ার পরেও বর চড়ুই বউ চড়ুইয়ের কাছ ঘেঁষে বসলো। হাসলো তৃধা, শাল জড়িয়ে পা টিপে টিপে জানালার কাছ ঘেঁষে বসে হাত রাখলো জানালায়। পাখি দুটো সতর্ক হলো,তৃধা পুনরায় হাত রেখে তাদের অবয়ব ছুঁতে চাইলো। তার আগেই পাখি দুটো উড়াল দিলো। শব্দ করে হাসলো তৃধা। পাখি দুটোর আচরণ ঠিক তার মা বাবার মতই।

সকাল সকাল কিচেন থেকে ঝন ঝন শব্দ বয়ে আসছে। তমাল ব্যাস্ত পায়ে বাজারের থলে এনে রাখলো কিচেনে। তার পেছনে ঢুকলো নুসাইব। তার হাতে হরেকরকম ফাল ভর্তি ব্যাগ। নাবীব শেখ মিষ্টি হাতে ফ্রিজের সামনে দাঁড়িয়ে। সায়রা বানু মিষ্টির প্যাকেট গুলো ফ্রিজে তুলে রাখছে। তৃধা হাত খোঁপা করে কিচেনে ঢুকলো। তমাল নুসাইবকে রেখে সেখান থেকে কেটে পড়লো। হাত খোঁপা করে ব্যাস্ত ভঙ্গিতে কিচেনে প্রবেশ করা তৃধার মধ্যে বউ বউ ভাব আছে। নুসাইব চোখ ফেরালো। ফল ভর্তি ব্যাগ রেখে বেরিয়ে পড়লো। আর কিছুক্ষন থাকলে নির্লজ্জের মতো আরো কত কি ভেবে বসবে তার ইয়াত্তা নেই।
এতো এতো তোড়জোড় দেখে সন্দিহান তৃধা। কে আসবে কে আসবে চিন্তা করতে করতে ফরিদা হককে জিজ্ঞেস করল,,,আন্টি এতো আয়োজন? তিন্নি আপু আসবে?

ফরিদা হক হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে কপাল মুছতে মুছতে বললো,, সকাল সকাল নবনী জানালো তারা আজকে আসতে চাইছে। ছেলের মা বাবা নবীকে দেখবে। কি করে না করি বলতো মা? কাল হলেও আসবে আজ হলেও আসবে। তাই বললাম আসুক। আমরাও ছেলে দেখি। ভালো করিনি বল?

তৃধা হেসে বললো,, অবশ্যই ভালো করেছো। এর মধ্যে আমাকে ডাকলে না কেন?

ফরিদা হক মাংস নাড়তে নাড়তে বললো,, গিয়েছিলাম ডাকতে। পরে আর মন সায় দেয়নি। এতো আদুরে হয়ে ঘুমাতে দেখলে কেউ উঠানোর সাহস করবে?

তৃধা হেসে উঠলো।
,”ঠিক আছে তখন উঠাওনি, এখন বলো কি কি রান্না হবে।

ফরিদা হক ভেবে বললো,, এইগুলো আমি সামলে নিবো। তুই বরং নাস্তার আইটেম গুলো দেখ মা। তিন্নি থাকলে চিন্তা ছিলো না।

, “ঠিক আছে আমি সামলে নিবো।”

ফরিদা হক বাধসেধে বলল,” আগে নাস্তা সেরে নে বাকি সব পরে দেখা যাবে।”

এগারোটা নাগাদ সব কাজ গুছিয়ে নিলো তিনজন মিলে। বাড়ির পুরুষেরা কেউ আজ কাজে গেলো না। তমাল তৃধার হাতে হাতে বাকি কাজ এগিয়ে দিচ্ছে। নুসাইব ল্যাপটপ নিয়ে বসলো , জরুরী কাজ গুলো মেহমান আসার আগে আগে সেরে ফেলতে হবে। নাবীব শেখ আশপাশ দেখে শরৎচন্দ্রের “দেবদাস” নিয়ে বসলেন। ফরিদা হককে খুন্তি নিয়ে বেরিয়ে আসতে দেখে বইটা গুছিয়ে টি-টেবিলের উপর রাখলেন।

আড়চোখে বাবার কান্ড দেখে হাসলো নুসাইব। পুরুষ নারীর চেয়ে শক্তিশালী হলেও ভালোবাসার মানুষের কাছে পুরুষের চেয়ে দূর্বল আর কেউ নেই। ব্যাক্তিগত রমনীকে সব পুরুষই ভয় পায়। সেই ভয় ভালোবাসা কমে যাওয়ার ভয়,দুরে চলে যাওয়ার ভয়,কথা না বলার ভয়। নুসাইব ভাবছে বিয়ে হলে সেও কি তৃধাকে ভয় পাবে?
গাড় ঘুরিয়ে তাকালো তৃধার দিকে। কিচেনের বাইরে ইলেকট্রনিক চুলায় কি সব তৈরি করছে। পাশে দাঁড়িয়ে তমাল তৃধার এসিস্ট্যান্ট এর দায়িত্ব পালন করছে। তৃধা ভীষণ ব্যস্ত,এতো এতো ব্যাস্তার মাঝে চুল পর্যন্ত সামলাতে পারছে না। খোঁপা থেকে অবাধ্য কয়েকটা চুল বেরিয়ে ছুঁয়ে দিচ্ছে কপোল। কিঞ্চিৎ বিরক্ত হয়ে কপাল কুঁচকে নিলেও হাত উঠিয়ে সেই চুল গুলো গুজলো না। নুসাইব মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইল। তৃধার বিরক্ত বিরক্ত চেহার আদল ছুঁয়ে দেওয়ার তীব্র বাসনা মনে মনে পুষতে থাকলো। তৃধা হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চুল সরালো এবার। বিরক্ত হলো নুসাইব ,এই এলোমেলো চুল যেন তার গুছিয়ে দেওয়ার কথা।
নাবীব শেখ মুচকি হেসে ধীর পায়ে বেরিয়ে পড়লো।গল্পটা এইভাই শুরু হোক , ঠিক যেভাবে ফরিদা আর তার শুরু হয়েছিলো।

এইদিকে তমাল দাঁত দিয়ে ঠোট চেপে ধরে ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। এতো সময় গাড় ঘুরিয়ে না রেখে সামনাসামনি দেখলেই হয়। দুর থেকে দেখে চোখ নষ্ট হচ্ছে,গাড় ধরে আসছে কতো সমস্যা শুরু হবে হিসেব আছে? এতো সমস্যা নিজ ঘরে হলে কেউ আর আমার স্বরনাপন্ন হবে না। লোকে ছিঃ ছিঃ করে বলবে নিজ ঘরে রোগী রেখে অন্যের রোগ ভালো করতে এসেছে। নিজ ঘর মানেই বিনা পয়সায় চিকিৎসা। লজ্জায় টাকাও চাইতে পারবে না। ভবিষ্যৎ ডাক্তার নিজের ভবিষ্যৎ অন্ধকার দেখছে।
তমাল গলা ঝেড়ে ডাকলো,, ভাইয়া একটু হেল্প করবে?আমি ওয়াশ রুমে যাবো।

তৃধা নাখোচ করে বলল,, সমস্যা নেই আমি পারবো। তমাল বাধ সেধে বলল,, তৃধা আপু তুমি ছোট মানুষ।একা একা এতো কাজ পারবে না। ভাইয়া আসুক ভাইয়া হেল্প করবে।

তমাল চলে গেল। নুসাইব ল্যাপটপ রেখে উঠে আসলো। তৃধা নুসাইব দু,জনই কনফিউশনে পড়ে গেছে। নুসাইব আগ বাড়িয়ে বলল,, ডোন্ট ওয়ারি আমাকে বলো কি হেল্প লাগবে।

নুসাইবকে দেওয়ার মত কোনো কাজ পেলোনা তৃধা। তাও বেশ ভেবে চিন্তে ফালুদার জন্য ফল কাটার মত সহজ কাজটাই দিলো।

সায়রা বানু দুজনকে একসাথে দেখে মুখটিপে হাসলেন। ফরিদা হক রান্না রেখে দুইবার উঁকি দিয়ে গেলেন।
তমাল উপর থেকে দাঁড়িয়ে দেখছে। তার সাথে কিছু ভিডিও আর ছবি তুলে নিলো। আপাতত সে নিজেও ব্যাস্ত হয়ে পড়বে। তার মত বড় কাজ কেউ করছে বলে মনে হয় না। তমাল হুটোপুটি করে ছুটলো নবনীর ঘরের দিকে। আজব প্রানীটাকে ঠেলে উঠাতে হবে,তা না হলে সে আজ পড়ে পড়ে ঘুমাবে। তমাল যতটা স্পিড নিয়ে রুমে ঢুকেছিল ঠিক ততটাই স্পিড নিয়ে চিৎকার করে বেরিয়ে আসলো। নবনী বিরক্ত হলো খুব।এতো রিয়েক্ট করার কি আছে বুঝলো না। তমাল বুকে থুতু দিয়ে পুনরায় রুমে ঢুকলো। নবনী ফেইস মাস্ক লাগিয়ে বসে আছে।
তমাল বুকে হাত রেখে হাঁপাতে হাঁপাতে বললো,, মেকাপেই তো ভালো ছিলি । আসল রুপে আসতে কে বলেছে? তোর লেকচারার এসে তোর আসল রূপ দেখলে হার্ট অ্যাটাক ফেট্যাক করে ম*রে যাবে। আমার মত ভবিষ্যৎ ডাক্তারো তখন কিছু করতে পারবে না। তাড়াতাড়ি মেকাপ করে নে নবনী।
রাগে নবনীর গা থরথর করে কাঁপছে। তমাল অবস্থা বুঝে ধীর পায়ে বেরিয়ে এলো। আর কিছুক্ষণ থাকলে জংলিটা নির্ঘাত চুল ধরে ঝুলে থাকবে।
__________

দুদিন ধরে সুমনা রেগে আছে।রেগে কথা বলছে না। রাগের কারনে চুলাও জ্বলেনি। রজব ঘরের বাইরে বসে আছে। দুইদিনে সুমনার রাগ ভাঙ্গানোর চেষ্টা করেছে অনেক। অথচ রাগ বেড়েই চলেছে। আগে তৃধা যখন রেগে থাকতো তখন রজবের এতো ঝামেলা পোহাতে হতো না। বসে দুদণ্ড ভালোবাসার কথা বলে জড়িয়ে ধরলেই রাগ পড়ে যেতো। কিন্তু এখন? এখন রাগ ভাঙাতে হলে মিষ্টি কথায় কাজ হয় না। বরং রাগ ভাঙাতে খরচ করতে হয়। হাতে টাকা কড়ি নেই তাই রাগ কমেও কমছে না। পুরোনো কথা ভেবে আক্ষেপে ভরা নিঃশ্বাস ফেলল। রজব বুঝতে পারছে তার ভুলটা কোথায়। হুট করে তৃধার জন্য বুকটা হু হু করে উঠলো। উতলা হলো রজব। কোথায় আছে তার তৃধুরানী? হড়বড়িয়ে উঠে দাঁড়ালো। সুমনার চোখ দুটো জ্বলজ্বল করে উঠলো। ভেবেছে রজব তাকে নিয়ে শহরে যাবে। যদিও সেটা আর হলো না, রজব তার আশায় জল ঢেলে শার্ট গায়ে জড়িয়ে বেরিয়ে পড়লো।
সুমনা রাগে দুঃখে বিছানায় হাত থাবড়ে চেঁচিয়ে উঠলো। রজব শুনেও না শোনার মত করে বেরোয়। তার ভীষণ তাড়া।
________

সাড়ে বারোটায় সমুদ্র তার পরিবার সমেত নবনীদের বাড়িতে এসেছে।যদিও সমুদ্রদের আসার কথা ছিলো বিকেলে, কিন্তু ফরিদা হকের কথায় তারা এবেলায় আসতে বাধ্য হলো।
তৃধা নাস্তা দিয়ে সম্পূর্ণ ডাইনিং টেবিল সাজিয়ে ফেললো। ফরিদা হক নাবীব শেখকে ইশারায় দেখালো। তার গুনী বউমা হবে। নাবীব শেখ প্রত্যুত্তরে মুচকি হাসলো।

শেফালী বেগম সাজানো টেবিল দেখে বললো,, আপা এতো কিছুর কি প্রয়োজন ছিলো? খামোখা কষ্ট করলেন।
সমুদ্র একপাশে বসে আছে। নুসাইব তার দিকে বিচক্ষণতার চোখে তাকিয়ে। যা সমুদ্রকে তোপের মুখে ফেলছে। সমগ্ৰ ভাই জাতি বোনেদের জন্য মাত্রাতিরিক্ত যত্নবান হয়। নুসাইব যে কতটা যত্নবান সেটা প্রথম দেখাতেই বুঝেছিলো।
এতক্ষণে কিবরিয়া সাহেবের সাথে নাবীব সাহেবের বন্ধুত্ব হয়ে গেছে। তাঁদের আলাপ আলোচনা নতুন সম্পর্ক ছাড়িয়ে গেছে। দুজন এমনভাবে কথা বলছে যেন যুগ যুগ ধরে পরিচিত।
তৃধা নবনীকে তৈরি করছে। নবনীর পরনে তৃধার দেওয়া শাড়ি। শাড়ি তৃধা পরালেও বাকি সাজ নবনী নিজেই সেজেছে। প্রিয় মানুষটা আজ প্রথম তাকে শাড়ি পরা দেখবে। ভাবতেই নবনীর হৃৎপিণ্ড কেঁপে উঠলো।

নবনীকে নিয়ে নিচে নামলো তৃধা। সমুদ্র নুসাইব আর তমালের দৃষ্টি অনুসরণ করে তাকালো। সমুদ্র একনজর দেখবে বলে তাকালেও তার আর নজর ফেরানো হলো না । মুগ্ধ চোখ জোড়া আটকে রইলো নবনীতে। নুসাইব বোনকে দেখা মাত্র সমুদ্রের দিকে তাকালো,তমালো তাই। দুই ভাই সমুদ্রকে দেখতে ব্যাস্ত।
শেফালী বেগম নবনীকে দেখে মুচকি হাসলো। তার মনে ধরেছে নবনীকে। মেয়েটা ছবি থেকে বাস্তবে সুন্দর। কিবরিয়া সাহেব নিজের স্ত্রীর ভাবমূর্তি দেখে খুশি। তাছাড়া পরিবারটা ভালো।

সমুদ্রের চোখে চোখ পড়তেই লজ্জা পেলো নবনী। কান দিয়ে গরম ধোঁয়া বের হচ্ছে। হৃৎপিণ্ড অস্বাভাবিক আচরন করছে। নবনীর হাত পা কাঁপছে। তৃধা নবনীর হাত চেপে ধরে বলল,, খবরদার নবনী। সেন্সলেছ হয়ে যেও না। তমাল আজিবন খোঁটা দিবে।

নাবনী বসে আছে ভদ্র,সভ্য বাচ্চার মত। দেখে বুঝার উপায় নেই সে চঞ্চল। তমাল ক্ষনে ক্ষনে অবাক হচ্ছে। তমাল নিরবে বোনের পাশ ঘেঁষে বসলো। মুরুব্বিরা তাদের গল্পে মশগুল। নাস্তার ফাঁকে ফাঁকে সমুদ্রের সাথে টুকটাক কথা বলছে নুসাইব। তৃধা সায়রা বানু সাথে দুপুরের খাবারের ব্যাবস্থা করছে। নবনী নাস্তার সমাহার দেখে বললো,, এতো কিছু কখন হলো ভাইয়া?
তমাল গম্ভীর গলায় বললো,, সকাল থেকেই কাজ চলেছে। তৃধা আপু একা হাতে সব করেছে।

,” পাগল হয়ে গেছে? শুধু শুধু এতো কিছু কেন করলো।”

তমাল ফিসফিস করে বলল,, আরে অচল জিনিস চালাতে হলে এমন একটু আকটু মেহেনত করতে হয়। তা না হলে ভুত ঘাড় থেকে নামবে না।”

নবনী রে*গে আ*গুন। পারলে এক্ষুনি তমালের চুল ধরে ঝুলে থাকে। কিন্তু সময় খারাপ, এখন এইসব করা যাবে না। তাই ভেতরে ভেতরে ফুঁসছে।

একপর্যায়ে শেফালী বেগম তৃধাকে দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলো ,, বড় ছেলের বউ?
ফরিদা হক গলার আওয়াজ নিচু করে বললো,, উঁহু ! আমার বান্ধবীর মেয়ে। ছেলের বউ এখনো হয়নি। তবে অতিশীঘ্রই হবে। চেষ্টা চলছে আপা। দোয়া করবেন।

চলবে,,,

উপন্যাসের নাম::#আমি_আছি
লেখনিতে:#সাদিয়া_আফরোজ
পর্ব: ২৪
,
,
,
,
,
,

দুপুর গড়িয়ে বিকেল, খাওয়া দাওয়ার পর্ব শেষ হতেই আলোচনা বসলো মুরুব্বিরা। তৃধা, নবনীকে নিয়ে রুমে চলে গেলো। তাদের পিছু পিছু ছুটলো তমাল। নবনীকে রাগানোর মত গুরুদায়িত্ব পালন করছে সে। সায়রা বানু সব কিছু গুছিয়ে নিতে ব্যাস্ত হলেও ফরিদা হক ব্যাস্ত পারিবারিক গল্পে।তার সাথে যোগ দিয়েছেন নাবীব শেখ আর কিবরিয়া সাহেব। অন্যদিকে নুসাইব সমুদ্র সহ বাগানে হাঁটছে। কথার এক পর্যায়ে নুসাইব জিজ্ঞেস করলো,, আমার মনে হয় আমি তোমাকে কোথাও দেখেছি। আসলেই কি দেখেছিলাম? পরিচিত চেহারা মনে হচ্ছে।
সমুদ্র সময় নিলো। মৌনতা কাটিয়ে বললো,, হ্যাঁ দেখা হয়েছিলো, কথাও হয়েছিলো। নবনীর এডমিশনের দিন। ওইদিন প্রথম নবনীর সাথে আমার দেখা হয়। আপনার সাথেও প্রথম দেখা তখন হয়েছিলো।

নুসাইব মনে করার চেষ্টা করলো। উঁহু! তার মনে পড়ছে না। মনে নেই কিভাবে দেখা হয়েছিল। মনে থাকার কথাও নয়। সেইদিন নবনীর এডমিশন থাকলেও নবনী প্রচন্ড রকমের অসুস্থ ছিলো। নুসাইব নবনীকে নিয়ে ব্যাস্ত ছিলো ভীষণ। তার মনে নেই । চোখের সামনে সব চেহারা ঝাপসা মনে হচ্ছে।

সমুদ্র নুসাইবের দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভরা চেহারা দেখে বললো,, বোধহয় মনে নেই। ওইদিন ভার্সিটির গেইটে দেখা হয়েছিলো। নবনী অসুস্থ ছিলো মনে হয়। আপনার গায়ে বুমি করে দিয়েছিল। নিজের গায়ে বমি নিয়েও নবনীর খেয়াল রাখতে পিছপা হননি। আমার স্পষ্ট মনে আছে সব। নবনীর মাথায় স্নেহ মাখা হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলেন বারবার। নবনীকে ছেড়ে উঠার মত অবস্থা ছিলো না। ওইসময় কেউ একজন আপনাকে পানির বোতল এগিয়ে দিয়েছিল। আপনি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে ভার্সিটি সংক্রান্ত খবর জানতে চেয়েছিলেন তার থেকে।

নুসাইব মুচকি হেসে বলল,, পানির বোতল এগিয়ে দেওয়া সেই কেউ তুমি ছিলে?

সমুদ্র মুচকি হেসে বলল,, হ্যাঁ

বাগানে পেতে রাখা বেতের সোফায় সমুদ্রকেও বসতে বলে নিজেও বসলো।

নুসাইব লম্বা শ্বাস টেনে বললো,, নবনী সম্পর্কে কতটুকু জানো সে বিষয়ে আমার আইডিয়া নেই। থাকার কথাও না। নবনীও হয়তো তোমার সম্পর্কে ততটুকু জানে না যতটুকু তোমার পরিবার জানে। এখন বলো, আমার বোন সম্পর্কে তোমার কিছু জানার আছে?

সমুদ্র হাঁসি মুখে জবাব দিলো,, স্পেসেফিক কোনো বিষয় সম্পর্কে জানার আগ্ৰহ নেই। আপনি যদি মনে করেন নবনী সম্পর্কে কোনো বিষয় আমার জানা উচিৎ তাহলে বলতে পারেন। না বলার থাকলেও সমস্যা নেই। আমার মনে হয় আমার চেনা পরিচিত নবনীকে নিয়ে গোটা একটা জিবন পার করে দিতে পারবো।

সমুদ্রের কথা শুনে নুসাইব বলে উঠলো,, জিবনে আগে কেউ ছিলো?আই মি পছন্দ কিংবা ভালোবাসা?

সমুদ্র অম্লান হেসে বলল,, প্রশ্ন এমন যে উত্তর দেওয়া মুশকিল। সত্যি বলতেও ভয় মিথ্যা বলাও অপরাধ। আপনি বলুন কেমন উত্তর দিবো।

,”যা সত্যি তাই বলবে। একটা মিথ্যা হাজারটা মিথ্যার সৃষ্টি করে।”

,” ছিল কেউ আগে। তখন আমার বয়স কেবল একুশ। সম্পর্কের এক বছরের মাথায় তার বিয়ে হয়ে গেছে। এর পর জিবনে আর কেউ ছিলনা।”

নুসাইব সব শুনে নড়েচড়ে বসল। সমুদ্রের মুখের আদল স্বাভাবিক হলেও মনে মনে ঠিকই ভয় কাজ করছে। সমুদ্র প্রথম দিনেই বুঝে ছিল নুসাইব তার বোনকে কতটা ভালোবাসে,স্নেহ করে। নিজের বাচ্চার মত আগলে রেখেছে বোনকে।

সমুদ্রের চোখে ক্ষীণ ভয় দেখে নুসাইব বলল,, আমার তিন ভাই বোনের মধ্যে সবচেয়ে আদরের যদি কেউ থাকে তবে সেটা তমাল আর নবনী। তমাল আর নবনীর মধ্যে নবনী। তমাল নবনী প্রায় পিঠোপিঠি। তমালের বয়স যখন তিন বছর তখন নবনীর জন্ম হয়। ওইসময় তমাল প্রচন্ড অসুস্থ হয়ে পড়ে। তখন নবনীর বয়স কেবল একমাস। আমার মা বাবা তমালকে বাঁচাতে হাসপাতালে হাসপাতালে ছুটোছুটি করছে। সমুদ্র , ভেবে দেখো পরিবারের অবস্থা কেমন ছিলো। নবনী ছোট তাকে সামলানো কোনো ছেলের কাজ নয়। তাও তিন্নি আর আমি রাতদিন এক করে ছোট্ট পুঁচকে বাচ্চাটাকে সামলেছি। তিন্নিরই বা বয়স কত! রাত জেগে থাকতে কষ্ট হতো। পুরো রাত ওই ছোট্ট নবনীকে পাহারা দিয়ে রেখেছি। বোনটা কত আদরের কল্পনাও করতে পারবে না।

সমুদ্র মাথা নিচু করে বললো,, হ্যাঁ।

,”তোমার অতীতে কি হয়েছে তা নিয়ে আমার মাথা ব্যাথা নেই। এমন অতীত সবার থাকে। খেয়াল রাখবে অতীতের ছায়া বর্তমানে যেন না পড়ে।

,” আমি অবশ্যই খেয়াল রাখবো ভাইয়া।”

,”আমি জানি না নবনীকে নিয়ে কি ভাবো, কিংবা কতটুকু জানো। তবে আমার বোনটা শুধু মাত্র হাতে পায়ে আর বয়সেই বড় হয়েছে। বুঝে কম, হুটহাট রেগে যায়, বুঝে শুনে কথা বলে না ইভেন কোথায় কি বলতে হবে সেটাও জানে না। ওকে সব কথা নিভৃতে যত্ন করে বুঝাতে হয়। পরিবারের ছোট হওয়াতে মাত্রাতিরিক্ত চঞ্চল। বিরক্ত করবে ভীষণ।

সমুদ্র প্রসস্থ হেসে বলল,, আমি জানি নবনী চঞ্চল। হুটহাট রেগে যায়, অদ্ভুত অদ্ভুত যুক্তি দিয়ে কথা বলে তাছাড়া সে স্পষ্টভাষী। এই নিয়ে আমার কোনো অভিযোগ নেই। আমার প্রফেশনাল লাইফে আমাকে প্রচন্ড সিরিয়াস থাকতে হয়। আমি চাইনা ওইরকম পরিস্থিতি পরিবেশ বাড়ি ফিরেও দেখি। নবনী চঞ্চল ,ওর চাঞ্চল্যতাই পছন্দ আমার। এই নিয়ে চিন্তা করবেন না। ভরসা রাখুন, নিরাশ করবো না।

সমুদ্রের কথায় বুকের ভারী ভাবটা কেটে গেল। নুসাইব স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বললো,, তবুও কখনো যদি মনে হয় বিরক্ত হচ্ছো তাহলে আমাকে জানিও। আমার বাড়ির দরজা খোলা আছে। আমি যতদিন বেঁচে থাকব ততদিন আমার বোনের জন্য আমার বাড়ির দরজা খোলা থাকবে।

সমুদ্র নুসাইবের কথা শুনে বললো,, ওইরকম সময় যেন না আসুক দোয়া করবেন। আমি আপনাকে অভিযোগ করার সুযোগ দিবো না।

______

সমুদ্রের সাথে নবনীর আলাদা কথা বলা হয়ে উঠলো না। তার আগেই নবনীর হাতে রিং পরিয়ে বিদায় নিলো। সম্পূর্ণ ভাবে নবনী তার না হলেও প্রনয়ের সম্পর্ক থেকে এক ধাপ এগিয়ে গেলো। নবনীকে এখন ব্যাক্তিগত রমনী মনে করতেও দ্বিধা বোধ করবে না। অধিকার বোধ তৈরি হয়েছে দু’জনার মধ্যে। এখন আর লুকিয়ে চুরিয়ে কথা বলতে হবে না। বরং প্রকাশ্যে বলতে পারবে এই রমনীই তার প্রেয়সী।

এইদিকে তমাল গুরু গম্ভীর মুখে সোফায় বসে আছে। “গুপ্তচর” নামক Whatsapp একাউন্টে সমুদ্রের দুটো ছবি সেন্ড করলো। ছবি পাঠিয়ে গোটা গোটা অক্ষরে লিখলো,” নবনীকে পাহারা দেওয়ার দরকার নেই। এইবার থেকে ছবির ছোকরাটাকে পাহারা দিবি। কোনো মেয়ের সাথে ব্যাক্তিগত ভাবে কথা বলতে দেখলেই ছবি সমেত প্রমাণ পাঠাবি।”
তমাল কাজ শেষ করে উঠে দাড়ালো। এইবার ফিরতে হবে। ভবিষ্যৎ ডাক্তারদের বাড়িতে পড়ে থাকতে নেই। তাদের ফিরতে হয় মেডিকেল কলেজ নামক ট*র্চার সে*লে।

নবনী হাতের দিকে যতবার তাকাচ্ছে ততবারই লজ্জায় লাল হয়ে যাচ্ছে, সব কিছু স্বপ্ন মনে হচ্ছে। তৃধা নবনীর কান্ড দেখে বললো,,, এতো লজ্জা? আজ তোমার সমুদ্রের সাথে কথা বলবে কিভাবে? যে ভাবে লজ্জায় লাল নীল হয়ে যাচ্ছো কল রিসিভ করতে পারবে কিনা সন্দেহ।

তৃধার কথায় মুখ লাকালো। কেন জানি আজ ভীষণ লজ্জা লাগছে তার। বুকের ভেতর অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে,পেটের ভেতর অস্থিরতা কাজ করছে। বুঝতে পারছে না ঠিক কি হচ্ছে। লজ্জারা আজ বাগে পেয়েছে তাকে। কথা বলাও দুস্কর।

শব্দ করে হাসলো তৃধা। আজ নবনীকে একা ছাড়া উচিৎ। একা একা অনূভুতি গুলো সামলে উঠুক। স্বপ্ন স্বপ্ন ভাব কাটিয়ে বাস্তবতা বুঝুক। বুঝুক যা হচ্ছে তা স্বপ্ন নয়। বরং বাস্তব সত্য।

ফরিদা হক খুশিতে গদগদ। মোবাইল ফোন নিয়ে পড়ে আছেন তিনি। বাপরে বাড়ি শ্বশুর বাড়ি কোথাও বাদ রাখেনি সব জায়গায় কল দিয়ে খুশির খবর বলে ফেলেছে। নাবীব শেখ মনে মনে বেজায় খুশি হলেও ফরিদা হকের মতো মোবাইল ফোন নামক যন্ত্র নিয়ে পড়ে নেই। তিনি খুশি মনে দেবদাস উপন্যাসটা পড়তে বসলেন।

নুসাইব তিন্নির সাথে কথা বলছে। বিস্তারিত বলার পর তিন্নি ভীষণ খুশি হলো। যদিও শর্ত বেঁধে দিলো। যে করেই হোক বিয়েটা তার দেশে ফেরার পর পরই হবে। এর আগে হলে সবার খবর আছে বলে শাসালো। বোনের কথায় নুসাইব নিজেও সহমত পোষণ করলো।
________

সকাল হতে না হতেই ব্যাগ পত্র উঠিয়ে বেরিয়ে পড়লো তমাল। তৃধা থেকে লম্বা বিদায় নিয়ে ভাইয়ের সম্মুখে দাঁড়িয়ে বললো,,, কাল আম্মু কি বলেছে মনে আছে? মনে থাকলে তো ভালোই। আমি বাড়ি ফিরতে ফিরতে মাস দুই লাগবে। এর মধ্যে আর ফিরবো না। পরীক্ষা আছে। নবনী গেলে তারও ফিরতে দেরী হবে। তুমি মাঝে মাঝে তৃধা আপুকে নিয়ে বাইরে থেকে ঘুরে এসো। বেচারি ঘরে বসে বসে বোর ফিল করে। কথা শেষ হতেই নুসাইবকে চোখ টিপলো। নুসাইব ভাইয়ের ইশারা বুঝলেও কিছুই বললো না। তার পুরো পরিবার তৃধাকে নিয়ে খুশি ব্যাপারটা মনে হতেই বুকটা প্রশান্তিতে ভরে উঠে।

তমাল মা জড়িয়ে ধরলো। ফরিদা হক ছেলেকে হাজারটা উপদেশ দিলেও নাবীব শেখ ভরাট গলায় বলল,, পাশ করলে ভালো ,না করলে মতির দোকান তো আছেই। চয়েস ইজ ইউরস্।

নবনী মুখ চেপে হাসতেই তমালের চোখে পড়লো। তমাল ভ্রু কুঁচকে বললো,, তোর মনে হয় বেশি হাঁসি পাচ্ছে। অবশ্য আমিও বা কাকে কি বলছি। জংলি কোথাকার! তৃধা আপু থেকে কাজ শিখে নে। তা না হলে তোর মত অকর্মার ঢেঁকিকে বাড়ি নিয়ে ওই বঙ্গোপসাগর পস্তাতাবে।

নবনী রাগলো। রেগে এগোতেই নুসাইব নবনীর হাত ধরে নিজের পাশে দাঁড় করিয়ে ঝগড়া করতে মানা করলো। রাগে মুখ ফুলায় নবনী। কাল থেকেই তমাল তাকে জ্বালাচ্ছে কেউ কিছু বলছে না। আজো তাই করছে। রাগ লাগছে তার।

তমাল নবনীর রাগি চেহারা দেখে মুচকি হেসে জড়িয়ে ধরল। মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে বললো,, রাগলে ‘নান’ ছবির ভুতুড়ে ‘নানের’ মত লাগে। এই ভাবে যদি লেকচারার দেখে ফেলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। খবরদার নবনী রাগবি না।

নুসাইব তমালের মাথায় টোকা দিয়ে বললো,, কি হচ্ছে কি?
রাগলো না নবনী। বরং তমালকে জড়িয়ে ধরে বললো,, সাবধানে যাবি। রাতে বেশি বের হবি না ঠিক আছে।
তমাল কিছু বললো না। বরং ঠোঁট চেপে হাসলো। বুকের ভেতরটা হঠাৎ করে হুহু করে উঠলো। নবনীর বিয়ে হয়ে যাবে, নবনী চলে যাবে, দরজা খুললে নবনীর চেহারাটা আর চোখে পড়বে না, বাড়ি ফিরে নবনীর সাথে ঝগড়া করতে পারবে না। ভাবতেই বুকটা ঈষৎ কেঁপে উঠলো। তমাল দাঁড়ালো না। ব্যাগপত্র সমেত গাড়িতে উঠে বসলো।

নবনী যেন ভাইয়ের মনের কথা বুঝলো। মনটা ভীষণ ভার হলো তার। ধীর পায়ে রুমে ফিরে গেলো।
________

নাবীব শেখের গ্ৰামের বাড়ি থেকে ফোন এসেছে। মা রেগে আগুন। বলা নেই কওয়া নেই নাতনির বিয়ে ঠিক করে ফেলেছে। পাত্রকে দুদন্ড দেখার সৌভাগ্যও হলো না। এ কেমন বিয়ে?

নাবীব শেখ মায়ের অভিমান বুঝলেও উত্তর করলো না। শুধু একবার সেধে বলেছে,” শহরে এসে বেড়িয়ে যাও। আসলে দেখা হবে মা। ছেলে ভালো, তোমার নাতনীর ভার্সিটিতে পড়ায়। চিন্তা করো না।”
এর পর আর মায়ের সাথে কথা হলো না। কল কেটে বাড়ির বাইরে বেরিয়ে গেলেন। মায়ের সাথে কথা বললেই তিনি উদাস হন। চাঁপা অভিমানে অভিযোগ মন ভারী হয়। ফরিদা হক বাঁধা দিলেন না। বরং বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় একটা চাদর গায়ে জড়িয়ে দিলেন।
_________
সময় বয়ে চলছে আপন গতিতে। তার সাথে বদলাচ্ছে ঋতু। শীত শেষে বসন্ত এসে ধরা দিয়েছে প্রকৃতিতে। গাছে গাছে নতুন পাতার দেখা মিলছে। বাগানের একপাশে লাগানো দেবকাঞ্চন গাছ। গাছ ভর্তি ফুল দেখলেই বুঝা যায় ঋতু রাজ বসন্ত প্রকৃতিকে তার ছোঁয়ায় ফুটিয়ে তুলেছে। নিচু ঢাল থেকে দুটো ফুল ছিঁড়ে কানের পেছনে গুঁজলো তৃধা। হঠাৎ করে মনটা ভালো হয়ে গেলো।
বাগানে পেতে রাখা বেতের সোফায় বসে শরৎচন্দ্রের ‘পরিণীতা’ পড়া শুরু করলো। কাল নাবীব আংকেল দিয়েছিলো তাকে। পরনীতার নাম শুনলেও পড়া হয়নি কখনো। দুই এক পাতা পড়ে আশেপাশে তাকিয়ে দেখছে সে। গাছের সংখ্যা বেশি হওয়াতে পাখপাখালির আগমন বেশি। তৃধা মাঝে মাঝে তাদের আনাগোনা লক্ষ্য করছে।

সপ্তাহের শুক্রবার আজ নুসাইব বাড়িতে থাকলেও। দুপুরের পর বেরিয়েছিল কোথাও। ঘন্টা না পেরুতেই উপস্থিত হলো আবার।
তৃধার সাথে সম্পর্কটা স্বাভাবিক হলো। দু’জনের মাঝে আগের মত সেই জড়তা নেই। তমাল নবনী যাওয়ার পর টুকটাক কথা হতো দু’জনার মধ্যে। সেই টুকটাক কথার সময় ঘন্টাখানেকের আড্ডায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে। ব্যাপারটা চোখে পড়েছে সবার । দেখেও না দেখার ভান করে চোখ ফেরালো সবাই।

নুসাইব তৃধার ঠিক বিপরীত পাশে বসে বললো,, বাবার ভুতে ধরেছে?

নুসাইবের আগমনে আগের মত চমকালো না। বেশ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বসে রইল। নুসাইবের কথা বুঝতে সময় লাগলো না তৃধার। ভাবুক হয়ে বললো,, উঁহু! মোটেও না।আমি আগ থেকেই ভুতে ধরা ছিলাম।

নুসাইব আলতো হাসলো। কানের পেছনে গুঁজে রাখা দেব কাঞ্চন ফুল দেখে গভীর চোখে তাকালো। বেনী করা চুল তার উপর কানের পেছনে গুঁজে রাখা দেব কাঞ্চন ফুল যেন তৃধার মায়া বোহুগুন বাড়িয়ে দিলো। সাধারণ রূপে অসাধারণ লাগছে তৃধাকে। দুটো ফুল থেকে একটা পড়তে নেয়। নুসাইব সতর্ক চোখে তাকিয়ে ফুলটার পড়ে যাওয়া দেখলো। মন খারাপ হলো তার। তৃধা নুসাইবের দৃষ্টি লক্ষ করে নিচে তাকালো। কানের পেছনে গুঁজে রাখা ফুল পড়ে গেছে। মনে পড়লো হঠাৎ।তার কানে ফুল গুঁজে রাখা। হাত বাড়িয়ে অপর ফুলটা ধরতে গেলেই বাধ সাধল নুসাইব। নিচ থেকে ফুলটা তুলে বইয়ের উপর রেখে বললো,, ফেলো না। আবার গুঁজে দাও। সুন্দর লাগছে তোমায়।

চলবে,,,,,

উপন্যাসের নাম::#আমি_আছি
লেখনিতে:#সাদিয়া_আফরোজ
পর্ব: ২৫
,
,
,
,
,
,
ভার্সিটি থেকে আগ পিছ করে বের হলো সমুদ্র, নবনী। অনির্দিষ্ট কারনে নবনী রেগে একাকার। সমুদ্র জানে না এই রাগের কারণ কী। চিন্তায় পড়ার মত বিষয়। কপাল কুঁচকে চশমা ঠিক করে গাড়ির দরজা খুলে দাঁড়ালো। নবনী পাশ কাটিয়ে চলে যেতে হাত ধরে আটকে দিলো। নবনী হাত ঝাড়া দিলেও সমুদ্র ছাড়লো না। মুচকি হেসে আঙ্গুলের ভাঁজে আঙ্গুল ডুবিয়ে দিলো। নবনী হাত ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেও পারলো না। সমুদ্র জোর করে গাড়িতে বসিয়ে নিজে ড্রাইভিং সিটে বসে পড়লো। মুখ ঘুরিয়ে জানালার বাইরে তাকিয়ে রইল অভিমানী। সমুদ্র হাসে, গা কাঁপিয়ে হাসে। নবনী চোখ গরম করে তাকালো।এই শ্যাম সুন্দর ব্যাক্তিগত পুরুষের হাসি তার বড্ডো বেশি পছন্দ।এমন হাসির পর রেগে থাকা যায় না। তাও নবনী রেগে রইলো। সমুদ্র গাড়ির স্টেয়ারিং থেকে হাত সরিয়ে নবনীর দু’গালে রেখে বললো,, রাগলে বেশি আদুরে লাগে। রাগছো কেন?

নবনী দুহাতের আজলে মুখ রেখে রেগে বলল,, আদুরে লাগার জন্য।

পুনরায় হাসলো সমুদ্র। রাগী নবনীর কপালে কপাল ঠেকিয়ে বললো,, বেশি রাগলে একদম বাড়ি নিয়ে যাবো। অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে এক্ষুনি বাড়ি নিয়ে যাবো। পারলে আরো বেশি রাগো।
___________________
সূর্যাস্তের পর পর ছাঁদ থেকে নেমে পড়লো তৃধা । মাগরিবের নামাজ শেষ করে বিছানায় পিঠ ঠেকিয়ে বসলো। তখন ফরিদা হক চায়ের কাপ নিয়ে হাজির। সায়রা বানু পেঁয়াজু হাতে ফরিদা হককের পেছন পেছন এলো। তৃধা সোজা হয়ে বসলো। ফরিদা হককের চেহারা বলছে তৃধার সাথে তার জরুরি কথা আছে। যদিও মুখে কিছু বলছে না। ফরিদা হকের মুখাভঙ্গি দেখে জিজ্ঞেস করল,,কিছু বলার আছে আন্টি? থাকলে বলো।

ফরিদা হক নাখোচ করে বললো,, না না কিছু না। তিনজন মিলে একসাথে চা খাবো এইজন্য এসেছি। আয় সায়রা, বস। গল্প করি।
তৃধা বই রেখে চায়ের কাপ হাতে তুলে নিলো। ফরিদা হক গভীর নিঃশ্বাস ফেলে চায়ের কাপে চুমুক দিলেন।

নাবীব শেখ মতি মিয়ার দোকানে বসে আয়েশ করে চা খাচ্ছেন।
,” মতি রেগে আছিস?”

মতি মিয়া মাথা নাড়িয়ে বললো,, খামখা রাগুম ক্যান?

,” উঁহু! তুই রেগে আছিস। রেগে না থাকলে চায়ে এতো চিনি দিলি কেন? তুই রেগে আছিস মতি।”

,” আমারে কি দেইখা রাগনের মানুষ মনে অয়?”

,”দুনিয়ার সব মানুষই রাগে মতি। কেউ দেখায়, কেউ দেখায় না। তোরও রাগ আছে। তুই দেখাস না।” রাগিস না মতি দোকান নিবো না। মতি মিয়ার ভান্ডার তোরই থাকবে।”

মতির চোখ জোড়া চকচক করে উঠলো। চায়ের সাথে দুটোর জায়গায় তিনটা বিস্কুট দিয়ে বললো,,
ছোট মিয়া দোকান নিবো না?

নাবীব শেখ চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বললো,, আরে না । আমার তমালের অনেক মেধা। ডিপার্টমেন্টে সেকেন্ড হয়। সেকেন্ড মানে দুই নাম্বার মতি। এক নাম্বার হতে পারতো যদি সিরিয়াস হতো। আমার মত বাউন্ডুলে স্বভাবের এইজন্য পারে না। স্বভাব আমার মত হলেও প্রচুর মেধা তমালের।দেখবি একদিন বড় ডাক্তার হবে মতি। আমার ছেলেটার জন্য দোয়া করিস।

মতির খুশির শেষ নেই। উপর ওয়ালার কাছে হাত পেতে বললো,, আমিন ।

মতির উচ্ছ্বাস দেখে নাবীব শেখ গদগদ হয়ে বললো,,মতি তোর চিকিৎসা ফ্রী । তুই আমার ছেলের জন্য দোয়া করেছিস।
মতি মিয়া হাতে চাঁদ পাওয়ার মত অবস্থা। কস্মিনকালেও তার দোয়ার গুরুত্ব কেউ দেয়নি। আজ নাবীব শেখের কথায় খুশিতে আত্মহারা।

কাজের সুত্রে অফিস থেকে বিকেলে বেরিয়েছিলো নুসাইব। গাড়ির প্রয়োজন ছিলোনা দেখে বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছে। এখন ফিরলো উবারে। বাড়ি পর্যন্ত গেলো না,মেইর রোডে ভাড়া মিটিয়ে হেঁটে চললো বাড়ির দিকে। মতিমিয়ার ভান্ডার থেকে বাবার গলার আওয়াজ আসছে। কোনো বিষয়ে আলোচনা হচ্ছে মনে হয়। নুসাইব খেয়াল করে শুনলো বিষয়টা তমালকে নিয়ে। তমাল সম্পর্কে বাবার মনোভাব শুনার জন্য পাশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে কান পাতলো। ব্যাপারটা লজ্জা জনক হলেও তোয়াক্কা করলো না। অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে তমাল প্রাসঙ্গিক শ্রুতিমধুর বাক্য গুলো শুনে হাসলো নুসাইব। সামনে যত রাগারাগী যত লেগপুলিং হোক না কেন। দিন শেষে বাবার ভালোবাসাটাই সত্য। লোক দেখানো রাগ, অভিমান তো কেবল অভিনয় মাত্র। নুসাইব মুচকি হেসে হাঁটা ধরলো।

রাতে খাবার টেবিলে আলাপ আলোচনা হলো অনেক। নবনীর বিয়ের প্রসঙ্গ থেকে শুরু করে তিন্নির দেশা ফেরার ব্যাপার নিয়ে। এর মধ্যে নাবীব শেখের ফোনে কল এলো। নাবীব শেখের মা সেতারা বেগম কল করেছেন। তিনি আর সোয়েব শেখ পরশু শহরে আসবে বেড়াতে। নাবীব শেখ অমত করলো না। বরং কিঞ্চিৎ খুশিই হলেন।
নুসাইব বাবার চেহারা দেখে জিজ্ঞেস করল,, কে কল দিয়েছে?

,” তোর দাদী। পরশু তোর দাদা দাদী বেড়াতে আসবে।”

নুসাইব বিরক্ত ভঙ্গিতে বলল,, হঠাৎ?
নুসাইবের এহেন কথায় তৃধা আর সায়রা বানু অবাক হলে ফরিদা হক আর নাবীব শেখের কোনো হেলদোল নেই। তারা জানতো এমন কথাই নুসাইব বলবে।

ফরিদা হক বললেন,”আসুক, বেড়িয়ে যাক কয়েকদিন। সমস্যা নেই।”

নুসাইব প্রত্যুত্তর করলো না। খাওয়া শেষ হতেই রুমে চলে গেল। নাবীব শেখ খাওয়া পাতে বসে আছে। ফরিদা হক তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে বললো,, তুমি তো জানোই তোমার ছেলে কেমন? ওর কথা ধরে বসে থাকলে তো হবে না। ওনারা তোমার মা-বাবা। তুমি বরং তাদের কথা ভাবো।

নাবীব শেখ বিনা বাক্যে খাওয়া শেষ করে উঠে পড়লেন।

পরদিন সকালে নাবীব শেখ বের হয়। তার জরুরি কাজ পড়ে গেছে। কাজটা ঠিক কি সেটা বলে গেলেন না। বরং বাড়ি থেকে হড়বড়িয়ে বেরহলেন।
দুপুর গড়িয়ে বিকেল ফরিদা হকের মেজাজ তুঙ্গে। কাল সকাল হতেই ঘরের মুরুব্বিরা ঘরে ফিরবে অথচ এদের বাপ বেটার হেলদোল নেই। ফরিদা হক নাবীব শেখকে কল করেও পেলেন না। তৃধা বসে বসে বাজারের লিস্ট করছে। ফরিদা হককের মেজাজ দেখে সায়রা বানু বললেন,, আপা নুসাইব বাবাকে কল দিলেই হয়। না হয় তৃধা সহ গিয়ে দেখে শুনে বাজার করে নিয়ে আসবে।

নিজের কথা শুনতেই ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো তৃধা।
ফরিদা হক তৃধার দিকে তাকিয়ে বলল,,ঠিক বলেছিস সায়রা। এক্ষুনি কল করছি। তৃধা মা, যা তাড়াতাড়ি চেন্জ করে আয়।

ফরিদা হককের কথা ফেলা যায় না। অগত্যা তৈরি হয়ে এলো তৃধা।
মায়ের এক কথায় অফিস থেকে বেরিয়ে পড়লো নুসাইব। বাড়ির গেটের সামনে গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। হর্ন বাজিয়েছে দুবার। বাজার লিষ্ট হ্যান্ড ব্যাগে ভরে বেরিয়ে এলো তৃধা। নুসাইব তৃধাকে দেখে মুখ টিপে হাসলো। মা ইচ্ছে করেই তৃধাকে পাঠিছে সেটা বুঝতে বাকি নেই। গাড়ি থেকে বেরিয়ে তৃধার সাইডের দরজা খুলে দিল। কয়েক সেকেন্ড ফ্রন্ট সিটের দিকে তাকিয়ে বসলো । এই সিট নিয়ে কতশত স্মৃতি হিসেব নেই। কোথাও ঘুরতে যাওয়ার সময় এক প্রকার মা*রামা*রি হয়ে যেতো। লম্বা নিঃশ্বাস নিয়ে সিট বেল্ট লাগিয়ে নিলো। তৃধার এমন ভাবু চেহারা নুসাইবের দৃষ্টি গোচর হলো। গাড়ি স্টার্ট দিতে দিতে বলে উঠলো,, ‘যে স্মৃতি তিক্ত নয় তাকে মনে করে কষ্ট পেতে নেই বরং খুশি হতে হয় তৃধা।’
তৃধা মলিন হেসে বললো,, বুঝলেন কিভাবে স্মৃতি তিক্ত নয়?

নুসাইব বললো,, দু সেকেন্ডের পজ নিয়ে গাড়িতে উঠে বসেছিলে। তাছাড়াও বেশিরভাগ সময় তোমার চেহারায় ভেসে ওঠে।

মাথা কাত করে নুসাইবের দিকে তাকিয়ে বলল,’ আচ্ছা ফেইস রিডার সাহেব, বুঝলাম।

তৃধার কথা বলার ধরন আর কথা শুনে নুসাইব শব্দ করে হেসে উঠলো। তৃধা নিজেও হাসছে। হঠাৎ করে নুসাইবের মনে হলো জিবনে আর কোনো চাওয়া নেই । তার সব চাওয়া পূর্ন হয়ে গেছে। যার অভাব ছিলো সেটাও তৃধার আগমনে পূর্নতা পেয়েছে।

নুসাইবকে সুপার শপের সামনে গাড়ি দাঁড় করাতে দেখে তৃধা চেঁচিয়ে বলে উঠলো,, আরে এইখানে কেন? আন্টি বলেছে এইসব সাহেবদের দোকানে গেলে আপনার কান টেনে ধরে কাঁচা বাজারে নিয়ে যেতে। এইখানে দাম বেশি-ও নেয় আবার সব পরিমানে কমও থাকে।

তৃধার কথায় কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে বলল,, তোমার কান টানা খেতে এসেছি। নাও কান টানো।

নুসাইবের কথা শুনে তৃধা গোল গোল চোখে তাকিয়ে রইল। নিজের কথায় নিজেই ফেঁসে যাবে মোটেও টের পায়নি। কোনোরকম আমতা আমতা করে বলল,, আমি বলিনি এই কথা। আন্টি বলেছে।

,”জানি তোমার আন্টিই বলেছে।”

,”তাহলে?”

,”তাহলে আর কি? এখান থেকে বাজার হবে।”

,”কিন্তু,,”

,”কোনো কিন্তু নয়। তোমার আন্টি জানে এখন কয়টা বাজে? এইসময় আমি একটা মেয়েকে নিয়ে ওই ভীড়ের মধ্যে বাজার করতে যাবো? ইম্পসিবল!
বাজারে সব মানুষ সুবিধার না। দাম বেশি হোক সমস্যা নেই।সেইফটি ফাষ্ট। চলো!”

নুসাইবের দূরদর্শী চিন্তাধারা দেখে মুচকি হাসলো। নুসাইব নামক লোকটার প্রতি অদ্ভুত এক ভালো লাগা ছেয়ে গেলো। যাবেই বা না কেন? মানুষ ভালো হলে তার প্রতি ভালোলাগা নিতান্তই স্বভাবিক ব্যাপার।

নুসাইব শক্-সবজি , ফলমূল আর প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনে নিলেও মাছ মাংস কিছুই নিলো না। তৃধা হড়বড়িয়ে বললো,, মাছ ? মাংস? এইগুলো কই? আন্টি আপনাকে বাড়ি ছাড়া করবে।

নুসাইব চকলেটের দুটো প্যাকেট আর দুই ফ্লেভারের দুটো আইসক্রিম তৃধার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল,, শোনো, আন্টির পার্সোনাল ম্যাসেঞ্জার!ওইসব চিন্তা না করলেও চলবে । ওইগুলো যাওয়ার সময় নিবো।

তৃধা শপের স্টাফ দের দেখে ফিসফিস করে বলে উঠলো,, যাওয়ার সময় মানে? আমরা এখন যাবো না?

নুসাইব ভাবুক হয়ে বললো,, নো। এতো দিন পর বাইরে এলে ,এতো তাড়াতাড়ি ফিরতে চাইছো? একটু ঘুরা ঘুরি করে তবেই ফিরবো। তাছাড়া আমিও কাজের কারনে কোথাও যেতে পারি না।

তৃধা অমত করলো না। নুসাইবের পিছু পিছু হেটে কাউন্টারে চলে গেল।
*
*

গাড়িতে বাজার রেখে হাঁটতে শুরু করল। তৃধা প্রশ্ন করলো,, আমরা কোথায় যাচ্ছি?

নুসাইব পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়ল,” কোথায় যেতে চাও?”

তৃধা নুসাইবের পায়ে পা মিলিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বললো,” এই শহরে নতুন কোনো জায়গায় থাকলে নিয়ে চলুন। পুরাতন সব কিছুই তো চেনা।”

,”সব চেনা?”

নুসাইবের প্রশ্ন শুনে তৃধা আলতো হেসে বলল,” মিষ্টার নুসাইব শেখ এই শহরটা শুধু আপনার নয়। কোনো এক সময় এইটা আমারো শহর ছিলো।”

নুসাইব ঘড়িতে সময় দেখে আলগোছে তৃধার হাত ধরে টেনে নিয়ে যেতে যতে বললো,, এই শহর এখনো তোমার তৃধা। চলো তাড়াতাড়ি ।

হঠাৎ তাড়াহুড়োর করনটা তৃধা বুঝলো না। তাও নুসাইবের সাথে পায়ে পা মিলিয়ে দৌড়াতে লাগল। নুসাইব প্রগাঢ় হেসে দৌড়াচ্ছে তার সাথে তৃধাও। আশ পাশের মানুষ অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে আছে। ভীড় ঠেলে ছুটে চলার কারণ কারো বোধগম্য নয়। যদিও সেই সব মানুষের তোয়াক্কা করলো না তৃধা নুসাইব।তারা ছুটছে তাদের মত করে।

বেশ কিছুটা দূরত্বে গিয়ে থামলো দুজন। দুজন হাঁপাতে শুরু করলো। তৃধা এক পর্যায়ে হাসতে হাসতে বলল,, মনে হচ্ছে আবারো স্কুলের দিন গুলোতে ফিরে গেছি। নুসাইব হাঁপাতে হাঁপাতে বললো,, তুমি হাসছো তৃধা!আমার তো নিঃশ্বাস নিতেই কষ্ট হয়ে যাচ্ছে।

তৃধা ফুটপাত বসে আলগোছে কানের পেছনে চুল গুঁজে নিয়ে বললো,, স্বীকার করুন, আপনি বুড়ো হয়ে গেছেন।

নুসাইব তৃধার দিকে তাকিয়ে বলল,, আমি বুড়ো হলে তুমিও বুড়ি।

,” মোটেও না। তাহলে আবার দৌড় প্রতিযোগিতা হোক । যে লাষ্ট হবে সে বুড়ো।”

তৃধার এমন বাচ্চামোতে হাসলো নুসাইব। দুহাত নাড়িয়ে বললো,, আমি পারবো না। যাও হার মানলাম।

জয়ী তৃধা খিল খিল করে হেসে উঠলো। নুসাইব তৃধার হাঁসি দেখে মাথা চুলকাতে চুলকাতে বললো,, এইভাবে না হাসলে হয় না?

তৃধা হাসি থামিয়ে বলে,, এতো তাড়াতাড়ি হার মানতে কেউ দেখেছে আপনাকে?

নুসাইব তৃধা চোখে চোখ রেখে বলল,, তুমিই প্রথম।‌

নুসাইবের এহেন দৃষ্টিতে তৃধার হৃৎপিণ্ডে কাপন ধরলো। চোখ ফেরালো তৃধা। রাস্তায় ছুটে চলা গাড়ি গুলোর দিকে তাকিয়ে বলল,, বসে থাকবেন? চলুন আরেকটু হাঁটি।

নুসাইবের ধ্যান ভাঙল। চুলে বার বার হাত চালিয়ে বললো,, এখন আর হাঁটব না। চলো পছন্দের কিছু খাই।

পা চালিয়ে হেঁটে একটা ঝুপড়ির সামনে দাঁড়ালো নুসাইব। ভেতরে বসা বৃদ্ধ লোকটাকে দেখে বলল,, একদম ঠিক সময়ে এসে পৌঁছালাম।

তৃধা আশপাশে তাকিয়ে ঝুপড়ির লোকটার দিকে তাকিয়ে বলল,, দাদার দোকানে এমন কি আছে স্পেশাল?

,” স্পেশাল বলতে চা। আমার মনে হয় এই পুরো শহরের মধ্যে ওনার চাইতে বেষ্ট মালাই চা কেউ বানায় না।”

তৃধা অবাক হয়ে বললো,” রেগুলার কাস্টমার নাকি?

,” হ্যাঁ”

নুসাইবের পোশাকের দিকে তাকিয়ে বলল,, “আপনার সাথে যাচ্ছে না।”

,” স্যুটবুট পরে চার চাকায় চড়ি বলে রোড় সাইডে দাঁড়িয়ে চা খেতে পারবো না?”

,”সেটা বলিনি। বললাম এই ড্রেসে মানাচ্ছে না। একটা পাঞ্জাবি হলে ঠিক লাগতো”

তৃধাকে নিয়ে কাঠের বেঞ্চিতে বসতে বসতে বলল,” নেক্সট টাইম আসবো।”

বৃদ্ধা নুসাইবকে দেখে হেসে উঠে বলল,” নাত বউ নাকি?”
তৃধা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। নুসাইব মুচকি হেসে চোখ টিপলেও মুখে বললো,”না”

নুসাইবের ইশারা বুঝলো বৃদ্ধা। তিনি হেসে চা বানাতে লাগলো।
ততক্ষণে তৃধা কিছুটা স্বাভাবিক। নুসাইব ফিসফিস করে বলল,, টেইক ইট ইজি তৃধা। বয়স্ক মানুষ,না বুঝেই বলেছে।

তৃধা মাথা নাড়ালো।

চায়ের দোকান থেকে বেরিয়ে ফুচকা স্টলের দিকে হাঁটা ধরলো। তৃধা অবাক হলেও কিছু বললো না। নুসাইব জিজ্ঞেস করলো,’ ফুচকা পছন্দ? অবশ্য পছন্দ হওয়ারই কথা। মেয়েদের যদি ফুচকা পছন্দ না হয় তাহলে সেটা মেয়ে নয়। কোনো ভুত পেত্নী হবে।’

নুসাইবের এমন রহস্য করে বলা কথা শুনে তৃধা হাঁসি দমিয়ে রেখে বললো,, এখন যদি বলি আমি ফুচকা পছন্দ করি না, তাহলে?

নুসাইব আড়চোখে তাকিয়ে বলে উঠলো,” তাহলে আরকি! একটু আগের কথাটাও আমি বলিনি।”

তৃধা গা কাঁপিয়ে হাসতে হাসতে বলল,, সিরিয়াসলি? আজকেই আপনার পিচ্চি ভাই-বোন দুটোকে জানাতে হবে।

ভীড় ঠেলে তৃধাকে নিয়ে ফুচকা স্টলের সামনে দাঁড়িয়ে বললো,, ওরা বিশ্বাস করবে না। ওরা জানে ওদের ভাই অতিসয় গম্ভীর, মিথ্যা বলা তার স্বভাবের বাইরে।

দুই।প্লেট ফুচকা নিয়ে দুজন মিলে খেতে শুরু করলো। নুসাইবের প্লেটে ঝালের পরিমাণ বেশি। একটা মুখে দিতেই বেচার চোখ মুখ লাল হয়ে উঠলো। তৃধা তৎক্ষণাৎ প্লেট চেন্জ করে নিজের প্লেট নুসাইবের হাতে দিয়ে বলল,, আমার প্লেটে ঝাল কম পড়েছে। এইটা খান, আমার ঝাল পছন্দ।

নুসাইব মুচকি হেসে খাওয়া শুরু করলো। এর মধ্যে পাশ থেকে পুরুষালি গলায় কেউ বলে উঠলো,, কেমন আছো তৃধা?

এতক্ষণ সময় ভালো কাটলে সেই কন্ঠস্বর শোনা মাত্র থমকালো তৃধা। মুখের সামনে ধরা ফুচকাটা নিচে পড়ে গেছে ততক্ষনে। পাশ না ফিরেই ব্যাক্তিটাকে চিনো ফেললো। নুসাইবের হাসি উবে গেলেও ভ্রু জোড়া কুঁচকে তাকালো লোকটার দিকে। লোকটাকে নুসাইব চেনে। তৃধা নুসাইবের কাছ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে তাকালো সেই লোকটার দিকে। লোকটাকে তৃধা চেনে। এতো বেশি চেনে যে ভুলেও ভুলা যাচ্ছে না। চেষ্টা করেও স্মৃতির পাতা থেকে মুছে ফেলা যাচ্ছে না।

রজবের তৃষ্ণার্ত চোখ তৃধাকে দেখে চলেছে। সেই দৃষ্টি তৃধার গায়ে সুচের মত ফুটছে। নুসাইব তৃধার অস্বস্তিতে ভরা চেহারা দেখে তৃধার হাতখানা নিজের হাতের মুঠোয় নিলো। তৃধা চোখ তুলে তাকালো নুসাইবের দিকে। নুসাইব চোখ দিয়ে ইশারা করে বললো,, আমি আছি।

চলবে,,,