আমি আছি পর্ব-৪১+৪২

0
866

উপন্যাসের নাম::#আমি_আছি
লেখনিতে:#সাদিয়া_আফরোজ
পর্ব: ৪১
,
,
,
,
,
,
,
,
তৃধা মোবাইল হাতে নিয়ে বসে আছে।মোবাইল ফোন দিলেও পাসওয়ার্ড দেয়নি লোকটা। হয়তো ভুলে গেছে। নুসাইব রেষ্টরুম থেকে বেরিয়ে তিহানের পছন্দের খাবার অর্ডার করে তৃধার মুখোমুখি বসে বললো,’ মোবাইল দেখার অভ্যাস নেই? এইভাবে ফেলে রাখলে যে? বউরা বরের মোবাইল এইভাবে ফেলে রাখে? তোমার জায়গায় অন্য কেউ হলে মোবাইল ঘেঁটে গার্লফ্রেন্ড বের করতো।

তৃধা মোবাইল হাতে নিয়ে বলল,’ গার্লফ্রেন্ড আছে কিনা দেখার জন্য পাসওয়ার্ড জানা লাগে। আপনার ফোন লকড্। ‘

নুসাইব জিভে কামড় দিয়ে বললো,’ সরি সরি তৃধা একটুও মনে ছিলোনা।তুমিও তো বলনি।

,’সমস্যা নেই। মোবাইলের প্রতি আগ্ৰহটা এখন আর নেই।’

,’ আগ্ৰহ থাকা উচিৎ। আমার খোঁজ খবর নেওয়ার জন্য, আমার উপর নজর রাখার জন্য হলেও আগ্ৰহ থাকা উচিৎ।’

নুসাইবের কথায় তৃধা মুচকি হেসে বলল,’ দরকার নেই। আপনি বিয়ের আগে যখন কাউকে পটাতে পারেননি বিয়ের পর পারবেন বলে মনে হয় না।’

নুসাইব বাঁ চোখের ভ্রু উঁচিয়ে বললো,’ এতো কনফিডেন্স?’

তৃধা টেবিলের উপর হাত রেখে মুখটা সামনে এগিয়ে নিলো। অতঃপর গলা নামিয়ে ফিস ফিস করে বলল,’ একটা সিক্রেট বলি শোনেন। আপনার মা মানে শ্বাশুড়ি আম্মু বলেছে,” জানিস তৃধা! আমার বড় বাচ্চাটা বেরসিক টাইপের। মেয়ে পটানো তো দূরের কথা। সে ভালোবাসার নজরেই তাকাতে পারে না। একরাশ বিরক্ত নিয়ে তাকালে কি আর হয়? এই ছেলে জিবনে আমাকে একটা বউ এনে দিতে পারবে না। এর মধ্যে সব গুন থাকলেও আল্লাহ প্রেম ভালোবাসার গুনটা দিতে ভুলে গেছে।” চিন্তা করে দেখুন কনফিডেন্সটা আসে কোথা থেকে।’

তৃধার কথায় নুসাইব স্তব্ধ । তার পিঠ পিছে মা তাকে পুরো এক্সপোজ করে দিয়েছে,তাও আবার তৃধার কাছে। নুসাইব অবাকতার সুরেই বললো,’ বাড়িতে বসে বসে দুজন এইসব করতে? মানে আমার কোনো সিক্রেট আদৌ আছে নাকি সব বলে দিয়েছে?’

সিক্রেটের কথা শুনতেই তৃধা মুখ টিপে হাসি আটকে রাখার চেষ্টা করতে করতে বললো,,’আরেকটা আছে। বলবো?’

নুসাইব সন্দিহান চোখে তাকিয়ে বললো,’ আবার কি?’

তৃধা বলতে নিয়ে হাসতে শুরু করলো। পেটে খিল ধরার মত হাসি। নুসাইব ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে। তৃধা অনেক কষ্টে বলে উঠলো,’ স্কুলের প্রথম দিন প্যান্টে,, আর বলতে পারলো না।তার আগে তৃধা হাসতে হাসতে লুটোপুটি খাচ্ছে। নুসাইবের বুঝতে বাকি নেই তার মা তাকে নিয়ে যত গল্প আছে সব তৃধাকে শুনিয়েছে। তৃধা হাসতে হাসতে বললো,’ আপনি ছিঃ!’

নুসাইব কিছুটা লজ্জা পেলেও তৃধা থেকে চোখ সরালো না। এই নিয়ে দ্বিতীয়বারের মত তৃধাকে এইভাবে হাসতে দেখছে সে।
অতিরিক্ত হাসার কারনে তৃধার চোখের কোন বেঁয়ে নোনা জল গড়িয়ে পড়ছে। তৃধা হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে মুছতে মুছতে বললো,,’ আপনার ছোটবেলা আমার মুখাস্ত নুসাইব।মনে পড়লে হাঁসি কন্ট্রোল করা যায় না।’

নুসাইব গালে হাত ঠেকিয়ে বসে আছে।তার চোখ জোড়া তৃধার চেহারার আদল ঘুরে বেড়াচ্ছে।তৃধার কথায় মুচকি হেসে বলল,,” কন্ট্রোল করার দরকার নেই। তুমি হাসো আমি দেখি। তোমার হাসি বড্ড সুন্দর তৃধা।”

নুসাইবের কথায় নড়েচড়ে বসলো তৃধা । শাড়ির আঁচল গুটিয়ে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে।

লাজুক তৃধা নজর লুকাতে ব্যস্ত। গালের দুপাশ ঈষৎ লাল,নাকের ডগায় বিন্দু ঘাম জমছে। নুসাইব তা দেখে মৃধু হাসলো।

তিহান বাইক পার্ক করে হেলমেট আর গিফ্ট বক্সটা হাতে নিয়ে ঢুকল। চার পাশে তাকিয়ে নুসাইবকে খুঁজতেই তার দেখা মিললো। কারো সাথে হেঁসে কথা বলছে নুসাইব।সে কেউ টা যে নুসাইবের ওয়াইফ সেটা স্পষ্ট তিহানের কাছে। যদিও তিহান তার মুখটা দেখেনি এখনো। নুসাইবের প্রাণবন্ত হাসি দেখে তিহান নিজেও হাসলো। খুব কম সময় নুসাইবকে এইভাবে হাসতে দেখা যায়। যদি সে কারো সাথে এইভাবে হাসে তাহলে বুঝতে হবে মানুষটা তার বিশেষ কেউ যাকে সে বিশ্বাস করে,ভালোবাসে এবং আপন মনে করে। তিহান বুক ফুলিয়ে শ্বাস নিলো। অতঃপর নুসাইবের কাছে না গিয়ে পুনরায় বেরিয়ে পড়লো।

নুসাইব ঘড়িতে সময় দেখতে দেখতে বললো,,’ বেয়াদবটা এখনো আসেনি। দশ মিনিট পেরিয়ে বিশ মিনিট হয়ে গেছে।’

নুসাইবকে কপাল কুঁচকে এমন বিরক্ত হয়ে কথা বলতে দেখে তৃধা জিজ্ঞেস করল,,’ কাকে এমন বকা দিচ্ছেন? স্পেশাল কেউ নাকি?’

নুসাইব লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে বললো,, ‘হুম অনেক স্পেশাল। একদম তুমি তুমি টাইপের স্পেশাল।চিন্তা করো না , সে বন্ধু হিসেবে স্পেশাল আর তুমি বউ হিসাবে স্পেশাল।’

তৃধা মুচকি হেসে বলল,’ আমি জানি।’

নুসাইব ভারী চিন্তিত। পুনরায় কপাল কুঁচকে বললো,’ এতো দিন জেনেও চুপ ছিলে তৃধা? হাউ রুড। দিন দিন নটি হয়ে যাচ্ছো।

তৃধা ভ্রু কুটি করে তাকিয়ে বললো,’ বদলে যাচ্ছেন মনে হয়? এক মানুষের দুই রূপ। আসলে বলুন তো কোনটা সত্যি?

তিহান অনেক ভেবে চিন্তে সুপার শপে ঢুকলো। বেছে বেছে অনেক রকম চকলেট কিনে কাউন্টারে রেখে বলল,,” চকলেট গুলো দিয়ে সুন্দর করে কিছু একটা বানিয়ে দেওয়া যাবে? লাইক ফ্লাওয়ার বুকেই টাইপ। অনলাইনে যেমন দেখা যায়। আমি ঠিক বুঝিয়ে বলতে পারছি না।”

কাউন্টারে বসা মেয়েটা মুচকি হেসে বলল,, “সমস্যা নেই স্যার আমি বুঝতে পারছি। আসলে ইন্সট্যান্ট বানিয়ে দেওয়া যাবে না কিন্তু আপনি চাইলে যে গুলো রেডি করা আছে সেগুলো থেকে একটা নিতে পারেন। চকলেট এইখান থেকে হয়তো দু’একটা কম পড়বে।”

তিহান বলল,,”ঠিক আছে তাহলে সেটাই দেন।”
এর মধ্যে নুসাইব দুবার কল দিয়ে ফেলেছে। আরেকবার কল দিতেই নুসাইব কল কেটে পেমেন্ট করে দৌড়ে বের হয়।

অল্প কতক্ষনের মধ্যে পৌঁছালো তিহান। নুসাইব ম্যানু কার্ড তৃধার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো,,আমি অর্ডার দিয়েছি তারপরও তোমার কিছু ভালো লাগলে অর্ডার করে নাও।

তৃধা ম্যানু কার্ড হাতে নিয়ে উল্টে পাল্টে দেখছে। এমন সময় তিহান হাঁপাতে হাঁপাতে বললো,,’স্যরি রে দেরি হয়ে গেছে।’

কন্ঠ স্বর শুনে তৃধার বুকটা ধক করে উঠল। এই কন্ঠ স্বর তৃধার বহুকালের চেনা। চিনবেই বা না কেন! কন্ঠস্বরের মালিকের কোল জুড়ে হেঁসে খেলে বড় হয়েছে সে। ম্যানুকার্ড খামচে ধরে মাথা তুলে তাকালো তৃধা। তিহান নুসাইবের থেকে চোখ সরিয়ে তৃধার দিকে তাকাতেই থমকে গেলো। তৃধা চোখ জোড়া স্থির করে তাকিয়ে আছে। তিহান নিজের চোখকে বিশ্বাস করাতে পারছে না। অবিশ্বাস্য নজরে বোনকে দেখে বাক শক্তি হারালো। নুসাইব দুজনের অদ্ভুত রিয়েকশন দেখে নিজেও তাকিয়ে আছে। তৃধার চোখ জোড়া জ্বালা করছে ভীষণ। গলা ধরে আসছে তার। কথা সব গলায় আটকে গেছে।
তিহানেরো একই অবস্থা। বোনকে খুঁজে পেয়ে খুশি হবে, নাকি দুঃখ প্রকাশ করবে সেটা বুঝতে পারছে না।

দুজনকে চুপ করে থাকতে দেখে নুসাইব গলা ঝেড়ে বললো,’ তোদের দেখে মনে হচ্ছে মেলায় হারিয়ে যাওয়া ভাই-বোন। আজ হুট করে দেখে মুখের ভাষা হারিয়ে ফেলেছিস।
নুসাইবের কথায় দুজন চমকে উঠে চোখ সরিয়ে নিলো। তৃধা নিচের দিকে তাকিয়ে আলগোছে চোখ মুছে নিলেও তিহানের যেন দমবন্ধ হয়ে আসছে। তিহান আসফাস করতে শুরু করলো।

নুসাইব তিহানের কাঁধে হাত রেখে বলল,’ তৃধা ভালো করে চিনে রাখো এইটা আমার সব চেয়ে কাছের বন্ধু তিহান মাহাবুব।

তৃধা লম্বা শ্বাস টেনে তিহানের দিকে তাকালো। তিহান বোনের দিকে মায়া ভরা চোখে তাকিয়ে আছে। হাজার কথা থাকলেও সময়টা যেন বড্ড বেমানান। নুসাইব জানে তিহানের বোন ছিলো ,বোন কারো সাথে পালিয়ে গেছে। সেই সময়টা নুসাইব তাকে সময় না দিলে পুরো দমে ভেঙে পড়তো সে। তিহান জানে না নুসাইব তৃধা সম্পর্কে কতটুকু জানে। সে চায়না পরিচয় দিয়ে সংসারে ফাটল ধরাতে। তাই তো বোনকে বুকে জড়িয়ে হাজার অভিযোগ , অনুযোগ,মায়া,স্নেহ লুটানোর তীব্র ইচ্ছাকে মাটি চাপা দিয়ে চুপ করে রইলো।

নুসাইব তৃধাকে দেখিয়ে বললো,,’ আমার স্ত্রী তৃধা বিনতে মাহাবুব।’

তৃধা সরু চোখে ভাইয়ের চেহারার আদলটা পরখ করছে। মনে হচ্ছে ভাইকে দেখেছে যে হাজার বছর হয়েছে। সময়টা অন্যরকম হলে এতক্ষনে ভাইকে ধরে হাজার আবদার জুড়ে দিতো। কিন্তু আজ সময় স্রোতের বিপরীতে বইছে। তৃধা চাইলেও ভাই বলে ডাকতে পারছে না। অপরাধবোধে ঘিরে আছে তাকে। তাছাড়া নুসাইব যদি জানতে পারে তিহান তার ভাই তাহলে বন্ধু সম্পর্কে ধারনা নিশ্চয়ই ভালো হবে না। এতোটা স্বার্থপর তৃধা নয়। অন্তত এই দু’টো মানুষের মধুর সম্পর্কে মধ্যে ফাটল ধরানোর মত মেয়ে সে নয়। তৃধা তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে তিহানকে সালাম দিলো।

তিহান কাপা হাতে চকলেট আর ছোট গিফ্টের প্যাকেটটা তৃধার দিকে বাড়িয়ে দিল। তৃধা চোখ জোড়া আবারো ভিজে উঠলো। চকলেটের জন্য ঘুর ঘুর করতো ভাইয়ের পিছু পিছু। তিহান চকলেট আনলেও লুকিয়ে রাখতো। তৃধা পুরো ঘর উলট পালট করে চকলেট খুঁজতো। কিন্তু আজ তিহান সেধে চকলেট দিচ্ছে। তৃধা ঠোঁট চেপে কান্না আটকে রাখার চেষ্টা করে হাত বাড়ালো।

তৃধার হাতে চকলেট আর গিফ্টের প্যাকেট ধরিয়ে দিয়ে দাড়াল না তিহান। ফোন কানে ধরে বললো,,” জ্বী স্যার আমি এক্ষুনি আসছি।”
নুসাইবকে কোনো কথা বলতে না দিয়ে বললো,,” দোস্ত আমাকে তাড়াতাড়ি যেতে হবে। হেডকোয়ার্টার থেকে কল এসেছে।”

নুসাইব কোনো কথা বলার সুযোগ পেলো না। তার আগেই তিহান দৌড়ে বেরিয়ে গেলো।
তৃধা মায়া ভরা চোখে তিহানের যাওয়া দেখছে।

চলবে,,

উপন্যাসের নাম::#আমি_আছি
লেখনিতে:#সাদিয়া_আফরোজ
পর্ব: ৪২
,
,
,
,
,
,
,
,
বাইকের পাশে মাথা নিচু করে বসে আছে তিহান । নিঃশব্দে চোখের জল ফেলছে সে। বোনের সাথে এইভাবে দেখা হবে সেটা কল্পনাতেও ছিলো না। তিহান নিজের চোখ,মন, মস্তিষ্ক কোনো কিছুকে বুঝাতে পারছে না। পরশু রাত থেকে কত শত খারাপ চিন্তা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল তার হিসেব নেই। কিন্তু আজ বোনকে জীবিত দেখে কতটুকু খুশি হয়েছে সেটা বলে বুঝানো মত নয়। কান্নার কারনে পুরো শরীর থেকে থেকে কেঁপে উঠছে।

পাশ দিয়ে দুজন লোক যাওয়ার সময় দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করল,’ ভাই আপনি ঠিক আছেন? কোনো সমস্যা হয়েছে?’
তিহান চোখ মুছে উঠে দাঁড়ালো। বললো,,’ না ভাই ঠিক আছি সমস্যা নেই।’

তিহানের কথা শুনে লোক দুটো চলে গেলো। তিহান বাইকে উঠে হেলমেট পরলো। এখনো তার পুরো শরীর কাঁপছে।
*
*
*
তৃধা এদিক ওদিক তাকিয়ে চোখের পানি আটকে রাখার চেষ্টা করতে করতে বললো,, আপনি বসুন আমি রেষ্টরুম হয়ে আসছি।’
নুসাইব মাথা নেড়ে বললো,’ যাও আমি আছি।’

তৃধা হুটোপুটি করে রেষ্টরুমের দিকে ছুটলো। এইদিকে নুসাইব কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলে তৃধার যাওয়ার পানে তাকিয়ে আছে।

ট্যাপের পানি ছেড়ে শব্দ করে কাঁদছে তৃধা। নিজেকে এতো ছোট এতো ব্যার্থ বোধহয় আর কখনো মনে হয়নি। এতো বছর পর ভাইকে দেখেও কথা না বলতে পারার মত কষ্ট মনে হয় আর একটাও নেই। কলিজা ছিঁড়ে যাওয়ার জোগাড় বুকে হাত রেখে শব্দ করে কাঁদছে তৃধা। মনে হচ্ছে এর চেয়ে মরন ভালো।

দশ মিনিট হয়ে গেছে। ওয়েটার খাবার দিয়ে গেলেও তৃধার আসার নাম নেই। নুসাইব বেশ চিন্তিত। অপেক্ষা না করে টেবিল ছেড়ে উঠে পড়লো। যদিও আর যাওয়ার দরকার হয়নি। তৃধা নিজেই বেরিয়ে এলো। নুসাইব তৃধার চেহারার দিকে তাকিয়ে আছে। পুরো মুখ লাল হয়ে আছে। বিশেষ করে চোখ আর নাকের ডগা। চোখ জোড়া ফুলে রয়েছে মনে হচ্ছে কেঁদেছে খুব। নুসাইব ব্যস্ত পায়ে এগিয়ে গেল তৃধার সমীপে। উদ্বিগ্ন গলায় জিজ্ঞেস করল,,’ কি হয়েছে ? খারাপ লাগছে? তোমাকে এমন দেখাচ্ছে কেন?
নুসাইবের প্রশ্নে তৃধা জোর পূর্বক হেসে বলল,,’ তেমন কিছু না। এমনিতেই আবহাওয়ার কারনে একটু খারাপ লাগছে। চলুন বসি।’

নুসাইব সন্দিহান চোখে তাকিয়ে আছে। তৃধা নুসাইবকে এইভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে বললো,, আরে সত্যি বলছি কিছু হয়নি।’

নুসাইব আর কথা বাড়ায়নি। দুজন মিলে খেতে বসলেও তৃধার তেমন একটা খাওয়া হলো না। সে ভীষণ অন্যমনস্ক হয়ে আছে।

*
*
*

মাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে তিহান। মায়া জাহান অস্থির হয়ে পড়ে। তার ছেলেটা কাঁদছে দেখে তার কলিজাটা মোচড় দিয়ে উঠলো। না জানি কোন খবর শুনতে হয়। মায়া ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,, কি হয়েছে আব্বু ? মাকে বল? হঠাৎ কি হলো?

তিহান মায়া জাহানকে ছেড়ে তার হাত দুটো শক্ত করে চেপে ধরে বলল,, তৃধার সাথে দেখা হয়েছে আজ। আমার পিচ্চিটার সাথে দেখা হয়েছে।’ বলতে বলতে কেঁদে উঠলো তিহান।
মায়া জাহান বিস্ময় নিয়ে ছেলের দিকে তাকিয়ে আছে।তৃধার সাথে দেখা? মানে তৃধা বেঁচে আছে? মায়া জাহান তিহানের হাত ঝাঁকিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে বললো,, কোথায় দেখা হয়েছে? কখন দেখা হয়েছে? কোথায় আছে আমার মেয়েটা? চল আমাকে নিয়ে চল। না না দরকার নেই, বরং তুই ওকে ঘাড় ধরে নিয়ে আয়। যা যা তাড়াতাড়ি যা।

তিহান লম্বা শ্বাস টেনে নিজেকে ধাতস্থ করে বললো,, নুসাইবের সাথে তৃধার বিয়ে হয়েছে। এতো মাস ধরে নুসাইব যার কথা বলতো সে তৃধা।

মায়া জাহান কি বলবে ভেবে পাচ্ছেনা।
তিহান একে একে পুরো ঘটনা মাকে বলে। তিহানের কথায় মায়া জাহান স্তম্ভিত হয়ে তাকিয়ে আছে।
তিহান ঠোঁট চেপে নিজেকে সামলে রাখার তীব্র চেষ্টা করতে করতে বললো,’আমি আমার বোনটাকে জড়িয়েও ধরতে পারিনি মা। আমি চাইনা আমার জন্য ওর সংসারটায় ফাটল ধরুক। জানো মা আমি চোরের মত পালিয়ে এসেছি।’

মায়া জাহানের ইচ্ছে তৃধাকে দেখার, জড়িয়ে ধরে দুটো আদুরে অভিযোগ করার কিন্তু তিহানের কথা শুনে সেই ইচ্ছেটা আর প্রকাশ করলেন না। একটা সময় ছেলেমেয়েকে দেখার চাইতে মা বাবা তাদের সুখ দেখাটাকে প্রাধান্য দেয় বেশি। মায়া জাহানও তা চাইলেন। তিনি দুচোখ মুছে শক্ত গলায় বলল,”নুসাইব ভালো মানুষ। আমার মেয়েটাকে কষ্ট দিবে না। তাও যা করেছিস ভালো করেছিস। মেয়েটা সুখে থাকুক ভালো থাকুক। প্রয়োজনে দূর থেকে দেখবো। তাও যেন কষ্টে না থাকে।’

খাওয়া দাওয়া শেষ করে তৃধাকে নিয়ে বের হলো নুসাইব। তৃধা পুতুলের মত নুসাইবের সাথে হাঁটছে। মনে হচ্ছে না সে কোনো মানুষ। নুসাইব তৃধার মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে জিজ্ঞেস করল,,’ মন খারাপ? খারাপ লাগছে?’

নুসাইবের হাতের স্পর্শ আর জিজ্ঞেস করার ধরনে তৃধার শুকনো চোখ জোড়া আবারো ভিজে উঠলো। তৃধা তৎক্ষণাৎ মাথা নিচু করে বললো,,” না।”

নুসাইব মুচকি হেসে বলল,’ তোমার ভীষণ মন খারাপ তৃধা। এতোটাই মন খারাপ যে, মন খারাপ ব্যাপারটা লুকাতে পারছো না। তোমার চোখ বলছে মন খারাপ,কেন লুকাচ্ছো বলো তো?’

হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখ মুছে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে তৃধা। কান্না পাচ্ছে খুব।

নুসাইব রিকশা থামিয়ে তৃধাকে নিয়ে উঠে পড়লো। আর ঘুরা ঘুরি নয়। ব্যাক্তিগত রমনীর মন খারাপের চেয়ে বড় কিছু নেই। আপাতত এই রমনীর মন ভালো করার টনিক খুঁজতে হবে।
__________

বাড়িতে পৌঁছাতে ফরিদা হক ছেলে, ছেলের বউকে দেখে বলে উঠলো,”এতো তাড়াতাড়ি? কি হলো?”

তৃধা চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। নুসাইব পেছন থেকে ইশারা করে মাকে প্রশ্ন করতে মানা করে দেয়। ছেলের ইশারা পেয়ে ফরিদা হক কথা বাড়ালেন না।
তৃধা চুপচাপ সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেল। ফরিদা হক ছেলের মুখের দিকে প্রশ্ন সূচক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। নুসাইব কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে বললো,,” আপাতত কিছুই বলা যাচ্ছে না আম্মু। কিছু সময় একা থাকুক, এরপর নাহয় জিজ্ঞেস করবো। ততক্ষণ সময় একা থাকুক।’

ফরিদা হক মাথা নেড়ে বললো,’ ঠিক আছে। তুই যা গিয়ে কথা বল। মনে হচ্ছে মেয়েটার মন ভীষণ খারাপ ।’

নুসাইব লম্বা শ্বাস নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেলো।

বিকেল করে বের হলো নুসাইব। তৃধা তখনও ঘুমিয়ে। মাগরিবের আজান শুনে উঠে বসলো। চোখ জোড়া তখনো জ্বলছে। চোখ বুলিয়ে নুসাইবকে খুঁজলো। নাহ্ নুসাইব কোথাও নেই। হাই তুলতে তুলতে উঠে বসে তৃধা।

নবনী ভাইয়ের রুমের সামনে ঘুর ঘুর করছে।তৃধাকে বিরক্ত না করার জন্য ফরিদা হক বারবার নিষেধ করার সত্বেও দরজার সামনে ওঁত পেতে আছে।

নামাজের বিছানায় অন্যমনস্ক হয়ে বসে আছে তৃধা। চোখজোড়া ক্রমশ ঝাপসা হয়ে আসছে। ভাইয়ের সাথে দু’দন্ড কথা বলতে না পারার আফসোস, আক্ষেপ ঘিরে ধরছে তাকে। দম বন্ধ লাগছে তার। ইস্ কেন যে ভাই বলে জড়িয়ে ধরলাম না,কেন যে বললাম না ভাই কেমন আছিস। কেন যে অভিমান অভিযোগ করলাম না। কেন? অনুসূচনা অস্রু হয়ে চোখের কোন বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে।

নবনীর ধৈর্য্যের বাঁধ ভাংলো। দরজায় ঠক ঠক আওয়াজ করে ডাকলো,,” ভাবী আপুউউ!! কোথায় তুমি? তোমার বোনের মত ননদ তোমাকে ছাড়া ঘরে টিকছে না। ওঠো ঘুম থেকে।

তৃধা চটজলদি চোখ মুছে জায়নামাজ গুটিয়ে নিলো।
*
*
*
নবনী তৃধার হাত ধরে সিঁড়ি বেয়ে নামতে নামতে এটা ওটা জিজ্ঞেস করছে। তৃধাও নবনীর প্রশ্নের উত্তর দিয়ে চলছে।

ফরিদা হক ঠোঁট কামড়ে আ*গুন চোখে মেয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। মেয়েটা বাঁচাল হয়েছে। কারো সুখ দুঃখ বুঝে না। সায়রা বানু পাশ থেকে বলে উঠলো,,’ আপা একা থাকলে মন আরো বেশি খারাপ হবে। নবনী আছে কথা বলতে বলতে মন খারাপ ভুলে যাবে।

ফরিদা হক সায়রা বানুর কথা শুনে বললো,’ সেটা যদি হয় তাহলে তো ভালোই। এমনিতে আমার মেয়েটার বকবকানিতে মাথা গরম হয়ে যায়।

ফরিদা হকের কথায় সায়রা বানু মুখ টিপে হেসে কিচেনে চলে গেল।

তৃধা কিচেনের দিকে আসতে নিলে ফরিদা হক বাঁধ সেধে বলে,,” কিচেনে যাওয়ার দরকার নেই। আজ সায়রা নাস্তা বানাচ্ছে। চল আমরা বসি।
নবনী তৃধার হাত ছেড়ে দিয়ে বলল,’তোমরা বসো আমি কিচেন থেকে ঘুরে আসি।’

ফরিদা হক তৃধাকে নিয়ে সোফায় বসে আছে। তার সাথে বিভিন্ন রকমের গল্প করছে। এর মাঝে তৃধা জিজ্ঞেস করল,’ বাবাকে দেখছি না! উনি কোথায়?

ফরিদা হক হতাশার নিঃশ্বাস ফেলে বললো,,’আর বলিস না মা,,’ বুড়ো বয়সে ভীমরতি হয়েছে। এই বয়সে পিকনিক করতে গেছে। সব গুলো বুড়ো বেটা মিলে আয়োজন করেছে। দেখবি কাঁচা মাছ মাংস খেয়ে বাড়িতে আসছে।’

শ্বাশুড়ির কথা শুনে হাসছে তৃধা। মোবাইলের কথা মনে পড়তেই কিচেন থেকে হড়বড়িয়ে বের হলো নবনী। দেরী না করে তড়িঘড়ি করে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেল।

ফরিদা হক তৃধার হাঁসি মুখ দেখে বললো,’ এখন হাসছিস, আমার মত বয়স হলে বুঝবি আমার ছেলেটা তোকে কেমন জ্বা*লা*য়। আমিতো পারছি না, শোন তুই একটা কাজ করবি। ঘরের মধ্যে তালা ঝুলিয়ে রাখবি। বের হতে বললেই রান্নাবান্না বন্ধ করে দিবি। পুরুষ মানুষ ছাড় দিলেই যত সমস্যা।
তৃধা মাথা নেড়ে ভাবুক হয়ে বললো,, ভালো বুদ্ধি আম্মু। এখন থেকে ট্রাই করবো?

ফরিদা হক মুখ টিপে হেসে ফিসফিস করে বলল,,’এখন দরকার হবেনা তৃধা। এখন তোর কথার বাইরে যাবে না। আমার বড় ছেলেটা ওর বাবার মত অত চালাক নয়। একটু বোকাসোকা, প্রেমে পড়ার পরতো আরো বেশি বোকা হয়ে গেছে। এখন যা বলবি তা-ই শুনবে।

শ্বাশুড়ির কথায় লজ্জায় লাল টুকটুকে হয়ে গেছে।
ফরিদা হক কিছু বলতে যাবে তার আগে কলিং বেল বেজে উঠলো। ফরিদা হক দরজার দিকে ইশারা করে বললো,,’ এসেছে দুই নবাবের মধ্যে এক নবাব।’

তৃধা মুচকি হেসে বলল,’ দাঁড়াও দেখি।’

তৃধা ভেবেছিলো হয়তো নুসাইব নয়তো তার শ্বশুর হবে। কিন্তু দরজা খোলার পর সেই ধারনা বদলে গেলো। দরজায় দাঁড়িয়ে আছে এক ঝাঁক মহিলা। যাদের মধ্যে একজন বয়স্ক মহিলা আর বাদ বাকি সব‌ মাঝ বয়সী মহিলা। তৃধা গোল গোল চোখে তাকিয়ে আছে,এতো অপরিচিত মুখ আগে কখনো দেখেনি।

দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা মহিলারা তৃধাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে।

ফরিদা হক তৃধার আওয়াজ না শুনে ঘুরে তাকায়।

পাড়ার মহিলারা নতুন বউ দেখতে এসেছে। দাওয়াত না করাতে রেগে ছিলো দুদিন। যদিও কৌতুহলের কাছে সেই রাগ ভাটা পড়েছে আজ। তাইতো পাড়ার প্রতিবেশীরা জড়ো হয়ে বউ দেখতে এসেছে।

তৃধা নরম গলায় সালাম দিলো সবাইকে। ফরিদা হক দেরি না করে তৃধার পাশে দাঁড়িয়ে বললো,,” আসো ভেতরে আসো।

সবাই একে একে ভেতরে ঢুকলেও তাদের নজর তৃধার দিকে সেটা ফরিদা হকের বুঝতে বাকি নেই। তৃধা ঘোমটা টেনে ফরিদা হকের দিকে তাকিয়ে আছে। ফরিদা হক ইশারা ইঙ্গিতে কিচেনে ঢুকতে বললো। বুঝতে পেরে দ্রুত পায়ে কিচেনের দিকে এগোয় তৃধা।

ফরিদা হক সবাইকে বসতে দিয়ে নিজেও বসলো। সবাই বেশ খোশ মেজাজে কথা বলছে। এর মধ্যে বয়স্ক মহিলাটা বলে উঠলো,,” বউমা, বড় নাতির বউটাকে ডাক দাও আমরাও একটু কথা টথা বলি। রান্না ঘরে ঢোকার তো কাজ নেই।

ফরিদা হক ইচ্ছে না থাকার সত্বেও তৃধাকে ডাকলেন।

সায়রা বানু খুব বিরক্ত। এই জাতীয় মহিলাদের তিনি খুব চেনে। এরা কাটা গায়ে নুনের ছিটা আর সংসারে আ*গুন লাগানো ছাড়া কিছুই পারে না। তাই তৃধাকে বললেন,’ অতো কথার উত্তর দেওয়ার দরকার নেই। সালাম দিয়ে চুপচাপ আপার পাশে বসে থাকবা। এইসব মহিলা মানুষের মনে কষ্ট দিতেই আসে। কারণ নিজের মনে শান্তি নেই। যাও তাড়াতাড়ি যাও।

তৃধা সুন্দর করে ওড়না জড়িয়ে কিচেন থেকে বেরিয়ে সবাইকে সালাম দিয়ে ফরিদা হকের পাশে বসলো।
সালাম নিয়ে তৃধাকে দেখছে সবাই। নাম জিজ্ঞেস সহ আরো অনেক রকম প্রশ্নই করছে তাকে। কিছু উত্তর তৃধা দিলেও বাকি গুলো ফরিদা হক আগবাড়িয়ে দিচ্ছে। এর মধ্যে একজন জিজ্ঞেস করল,’ কপালে এটা কিসের দাগ? কেটে গেছে মনে হয়।
তৃধা মাথা নেড়ে বললো,” জ্বী। পা স্লিপ করে পড়ে গেছিলাম। ইটের কোনায় লেগে কেটে গেছে।”

আরেকজন বলে উঠলো,,” শান্তার মেয়েটারও ঠিক এমন জায়গায় কাঁটা দাগ আছে। ওর বর ওকে মে*রে*ছিল। তখন পড়ে গিয়ে কে*টে গেছে। পুরো চার সেলাই লেগেছে।”

ফরিদা হক তাচ্ছিল্য করে হেসে বলল,,” শান্তার মেয়ের কাহিনী সবাই জানে। ঘটা করে বলার কিছু নেই মিনু ভাবী।”

ফরিদা হককের কথায় তাহামিনা খানম বললো,,” শুনলাম নতুন বউয়ের আগে একবার বিয়ে হয়েছিল। তা ওই ঘরের ছেলে পেলে নেই?”

কাজ সেরে নবনী আর তৃধার জন্য আইসক্রিম নিয়ে ফিরলো নুসাইব। ঘরের মেইন দরজা হাট করে খোলা দেখে নুসাইব চিন্তিত ভঙ্গিতে ঘরে ঢুকলো। ঘরে ঢুকে যে কথাটা শোনার কথা ছিলো না সে কথাটাই শুনলো আগে।

ড্রয়িং রুমে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসা ছয় কি সাত জন মহিলা। যাদের প্রায় সবাইকে নুসাইব চেনে। এবেলায় তাদের সবার একসাথে আগমন দেখে চমকালো না নুসাইব। বরং কারনটা প্রশ্নের সাথে স্পষ্ট হলো।

নুসাইব লম্বা শ্বাস টেনে বললো,, ‘এই প্রশ্নটা ওকে জিজ্ঞেস না করে আমাকে জিজ্ঞেস করতেন। উত্তরটা আমি ভালো বলতে পারতাম।’

নুসাইবের গলার আওয়াজে ফিরে তাকালো সবাই। আইসক্রিমের প্যাকেট ডাইনিং টেবিলের উপর রেখে তৃধার কাছ ঘেঁষে সোফার হাতলের উপর বসলো নুসাইব। ফরিদা হক তৃধা দু’জনই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। বাকি সবাই নুসাইবের দিকে প্রশ্নবিদ্ধ চোখে তাকিয়ে আছে। এর মধ্যে একজন বললো,’বুঝলাম না।’

নুসাইব তৃধার ঘোমটা ঠিক করে দিয়ে বললো,’ দ্বিতীয় বিয়ের ব্যাপার,ছেলে পেলের ব্যাপার। আসলে তৃধার ছেলে পেলে নেই। কিন্তু আমার আগের ঘরের দুটো ছেলে আছে।

সবাই স্তম্ভিত নজরে তাকালো। ফরিদা হক মুখ টিপে হাসছে। তৃধা বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছে।

সবার রিয়েকশন দেখে নুসাইব রহস্য করে বললো, বিশ্বাস হচ্ছে না? আরে সত্যি আমার আগে বিয়ে হয়েছে। সেই ঘরের দুটো ছেলেও আছে। পরিবারকে না জানিয়ে করেছিলাম। এখন মন উঠে গেছে ছেড়ে দিয়েছি। আবার মনে হলো বিয়ে করা উচিৎ তাইতো আরেকটা করলাম। তা না হলে আমার মত ছেলে অবিবাহিত হলে এমন একটা বিবাহিত মেয়েকে বিয়ে করতো? মোটেও করতো না। আমার দোষ আছে দেখেই আরেক দোষ ওয়ালা মেয়েকে বিয়ে করেছি। ঠিক যেমন তাহামিনা আন্টি তার ছেলেকে করিয়েছে। তাইনা তাহমিনা আন্টি?

তাহমিনা রাগে ফেটে পড়ছেন। নুসাইব যে তাকে উদ্দেশ্য করে বলছে এতে কোনো সন্দেহ নেই।

ফরিদা হক অনেক কষ্টে হাসি চেপে রাখলেও তৃধা হা করে তাকিয়ে আছে।

নুসাইব পুনরায় তাহমিনাকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো,,’আন্টি আপনার মেয়েই তো রিমা তাইনা ? শুনলাম রিমারও তো এইটা দ্বিতীয় বিয়ে ?আপনার মেয়ে নাকি জামাই থাকার সত্বেও অন্য আরেকজনের সাথে পালিয়ে গেছিলো! ইজ ইট ট্রু?

নুসাইবের কথায় তাহমিনা খানম রেগে বললো,,’ নুসাইব তুমি ইচ্ছে করেই এইগুলো বলছো তাইনা? সবার সামনে আমাকে হেনস্তা করার জন্য।’

নুসাইব দায়সারা ভাবে বলল,” হ্যাঁ! অবশ্যই । আপনি বাড়ি বয়ে এসে আমার ওয়াইফকে উল্টো পাল্টা কথা বলছেন। আমি কেন চুপ করে থাকব? তাছাড়া এইখানে থাকা সবার ঘরেই ইতিহাস আছে। অন্যের পরিবার নিয়ে এতো কৌতুহল ভালো নয় আন্টি। আমি এই মুহূর্তে কৌতুহল দেখালে অনেক কথাই উঠে আসবে। আমি কাকে বিয়ে করেছি না করেছি That’s none of your concern. এসেছেন বসুন কথা বলুন । চা অফার করলে সেটা খেয়ে চলে যাবেন। এর আগে কিছুই না।

নুসাইবের কথায় তাহমিনা খানম উঠে ধুপধাপ পা ফেলে বেরিয়ে গেছেন। নুসাইব বাকিদের দিকে তাকিয়ে বলল,’আজকের জন্য আমার বিয়ে আর বাচ্চার টপিকটাই যথেষ্ট। ওটা নিয়ে দু’চার বছর আলোচনা করুন।
নুসাইব ভ্রু কুঁচকে তৃধার দিকে বললো,,” তুমি বসে আছো কেন?তোমার এইখানে কাজ নেই। ওঠো ,রুমে যাও।

নুসাইবের কথায় একে একে সবাই বেরিয়ে পড়লো। তৃধা ফরিদা হকের দিকে তাকালে ফরিদা হক ইশারায় যেতে বলে। তৃধা আর দাঁড়ালো না, নুসাইবের কথায় সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেলো।
নুসাইব বিরক্ত ভঙ্গিতে মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল,,”এই মহিলা গুলো বাড়িতে এলে জায়গা দিবে না। দুঃখের সময়ে যখন কেউ ছিলো না তখন সুখের সময়েও কাউকে দরকার নেই। আসলেও তৃধা যেন ওদের সামনে না আসে।

ফরিদা হক মাথা নেড়ে বললো,” একদম ঠিক বলেছিস। এক একটা সাপ। হঠাৎ এসে পড়বে কে জানতো।

নুসাইব আইসক্রিমের প্যাকেট দেখিয়ে বললো,,”ওইখানে আইসক্রিম আছে। নবনীকে ডেকে দাও।”

,,” দাঁড়া, তোদের জন্য চা দিয়ে দিচ্ছি উপরে নিয়ে যা।”
*
*
*
বারান্দায় পেতে রাখা চেয়ারে বসে আছে তৃধা। আজকের পুরো দিনটা এক এক করে চোখের সামনে ভাসছে। নুসাইবের হাসি মুখ,ভাইয়ের মায়া মায়া চেহারা, ফরিদা হকের স্নেহ,নবনীর চপলা কন্ঠে বলা কথা । সুখ-দুঃখ , আক্ষেপ,পূর্নতা আজকের দিনটাতে সব কিছুই আছে। তৃধা শূন্যে তাকিয়ে উদাস হলো।

নাস্তার ট্রে বিছানার উপর রেখে বারান্দায় পা বাড়ালো নুসাইব। তৃধা মৃদু হেসে বলল,,” আচ্ছা নুসাইব,আপনার জীবনে কোনো আক্ষেপ আছে, কোনো অপূর্ণতা ? আমার মনে হয় নেই।

নুসাইব মুচকি হেসে বলল,,” হুম নেই। কেন বলোতো?”

,,”আচ্ছা ধরুন, আপনার খুব আপন একজন মানুষ। আপনার ভুলের কারণে তার সাথে আপনার অনেক বছর দেখা হয়নি। একদিন হুট করে সে মানুষটা সামনে এসে দাঁড়ালো তখন কি করবেন?”

নুসাইব মুচকি হেসে বলল,,” ভেরি সিম্পল, আমি জড়িয়ে ধরে মাফ চেয়ে মান অভিমান মিটিয়ে নিবো।এমন কোনো ভুল নেই যেটার ক্ষমা হয়না। সব ভুলের ক্ষমা আছে , তাছাড়া মানুষটা যেহেতু আপন সেখানে ক্ষমা আরো সহজ। আমি শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ক্ষমা চেয়ে নিবো।”

তৃধা ভেজা চোখে হাঁসি ঝুলিয়ে রেখে বলল,,”আমি কেন এমন সহজ করে চিন্তা করতে পারি না? আমার মধ্যে কেন এতো জটিলতা?”

নুসাইব তৃধার হাত ধরে রুমে নিয়ে যেতে যেতে বললো,,”কারন তুমি ভীতু তৃধা। কখনো এমন সিচুয়েশন এলে কারো চিন্তা করবে না। মন যা বলে তাই করবে। এখন চলো কিছু খেয়ে নিবে।”
*
*
*
*
রাত প্রায় বারোটা। খাওয়া দাওয়া সেরে সবাই সবার রুমে চলে গেলেও নুসাইব ফিরলো না।জরুরী ফোন এটেন্ড করতেই রুম ছেড়ে বেরিয়েছে। তৃধা বসে বসে নুসাইবের বলা কথাটা ভাবছে আর তার দেওয়া মোবাইলটা হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখছে ।

চলবে,,,,,