প্রণয়ডোর পর্ব-৪+৫+৬

0
1678

#প্রণয়ডোর
#লেখিকা_রামিশা_তাসলিম
#পর্ব-চার

তখনই কেবিনের দরজা খোলার আওয়াজ হল। ডাক্তার ইয়ানাত তাসবি এসেছে। বেডে শুয়ে থাকা শুভ্রার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করে,

— এখন কেমন লাগছে ? ”

শুভ্রা প্রথমে ইতস্তত বোধ করলেও পরক্ষণেই নিজেকে স্বাভাবিক রেখে উত্তর দেয়,

— জি, ভালো আছি। ”

শুভ্রার এতোটুকু কথা পরেই তাসবি আর কিছু বলেনা। গায়ে এপ্রোন পড়া দেখেই বুঝতে পারছে যে ওনি একজন ডক্টর। তারপর তাসবি এগিয়ে এসে মা কে জিজ্ঞাসা করে,

— মা বাসায় যাবে না ? ”

— হ্যাঁ ! যাবো। ”

ভদ্র মহিলা এটুকু বলেই দেওয়াল ঘড়ির দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। ঘড়িতে পোনে ৩ টা বাজে। এবার উঠে দাঁড়ায় তিনি। ভদ্র মহিলার সাথে ডাক্তারের কুশলাদি বিনিময়ে বুঝা যাচ্ছে যে এটাই বোধহয় তার ছেলে। এবার ভদ্রমহিলা শুভ্রার মাথায় পরম স্নেহের হাত বুলিয়ে তাকে বলে,

— আমি তাহলে আসছি মা। তোমার সাথে পরিচয় হয়ে ভালো লাগলো। আজকে তোমার জন্য আমার ছেলে এখানে রয়ে গেছে। তা তো বললামই। আমাকে ছাড়াও সে রাতের খাবার খায় না। তাই ঠিক খাবার নিয়ে এসেছি। মায়ের মন তো ! বাদ দাও, জানিনা কিভাবে এতটা মিশে গিয়েছি তোমার সাথে। তবে এই নাও আমার কার্ড, যদি কোন দরকার হয় তাহলে আমার বাড়িতে চলে এসো। আর এখন তোমার সম্পূর্ণ বেড রেস্টে থাকা দরকার। কি পরিমান ধকল গিয়েছে তোমার উপর দিয়ে। যা করবে সাবধানে কর। আর সমস্যা হলে , আমার ছেলেকে বলতে ভুলবে না কিন্তু। হি ইজ এ বেস্ট ডক্টর। ”

ভদ্র মহিলার কথা শুনে শুভ্রা মুচকি হাসে । উত্তরে জি আন্টি বলে। শুভ্রার সম্মতি পেয়ে ভদ্র মহিলা মুচকি হেসে সন্তানের সাথে বেরিয়ে যান কেবিন থেকে। শুভ্রাও যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। তখনই কেবিনে প্রবেশ করে নার্সটি। একের পর এক মানুষের আনাগোনা যেন বড্ড বিরক্তিতে ফেলছে শুভ্রা কে । নার্স এসে তার ভালো-মন্দ জিজ্ঞাসা করে। কোথাও অসুবিধা হচ্ছে কিনা তা জানতে চায়। শুভ্রা সবটাই বলে। এরপর নার্স শুভ্রাকে শুইয়ে দেয় বেডে। তখনো তার হাতে স্যালাইন চলছে। শরীর অতিরিক্ত দুর্বল হওয়ায় একের পর এক স্যালাইন তাকে দেওয়াই হচ্ছে। এইতো একটু আগেই নার্সটি স্যালাইনের ব্যাগখানা বদলে দিয়ে গেলো। শুভ্রা ত্বাচ্ছিল্যের হাঁসি হাসে । সে নার্সদের জীবনটা ভাবে। অগণিত রাওগীদের একের পর এক রোগের সমস্যা তাদের সমাধান করতেই হয়। অথচ তাদের জীবনে হয়তো বা অনেক জটিল সমস্যা রয়েছে। যা তারা সমাধান করতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে। হঠাৎ কেন শুভ্রার মনে এরকম ভাবনা এল সে নিজেও বুঝতে পারল না। তবে সব বাদ দিয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করব। অপেক্ষায় একটি সুন্দর সকালের। আর ধন্যবাদ জানাবে সেই ব্যক্তিটিকে, যে কিনা তাকে এখানে এনেছে। এই ভেবেই সে ঘুমের দোয়া পড়ে চোখযুগল বুঁজে ফেললো।

~~

সকাল দশটা বেজে একুশ। শুভ্রার পাশে বসে আছি লোকটি। যখন থেকেই ডাক্তার ইয়ানাত তাসবির থেকে জানতে পেরেছে যে, মেয়েটার নামও শুভ্রা, তখন থেকেই লোকটা প্রচন্ড রকম কৌতুহলী হয়ে বসে আছে। শুভ্রার ঘুম এখনো ভাঙেনি। বোধহয় ঘুমের ইনজেকশনের প্রভাব এখন পড়ছে। এদিকে সকালের নাস্তা সেরে ডক্টর ইয়ানাত তাসবি এসেছে রোগী চেকআপ করতে । তারপর আস্তে আস্তে সিরিয়াল আসলে ১১৩ নম্বর পেশেন্টের। শুভ্রা কে দেখেই চিনে ফেললো ডাক্তার ইয়ানত তাসবি। এত বেলা অব্দি শুয়ে থাকতে দেখে খানিকটা অবাক হয় ডাক্তার। এগিয়ে এসে ভদ্রলোকটিকে জিজ্ঞাসা করে,

— পেশেন্ট এখন পর্যন্ত ঘুমাচ্ছে কেন ? ”

ডাক্তার কে দেখে উঠে দাঁড়ায় ভদ্র লোকটি। বিনীত স্বরে ডাক্তারকে উদ্দেশ্য করে বলে,

— জানিনা বাবা । সে তখন থেকে মেয়েটার জন্য বসে আছি। ঘুম থেকে ওঠার নাম’ই নেই। ”

ভদ্র লোকটির কথা শুনে খানিকটা চিন্তিত হয় ডাক্তার । এগিয়ে এসে শুভ্রার হাত ধরে পালস চেক করার জন্য। অমনি সাথে সাথে ছিটকে দূরে সরে আসে। ক্ষিপ্ত কন্ঠে ভদ্র লোকটিকে বলে,

— আপনি কি এতক্ষণ ধরে এখানে বসে ছিলেন ? ”

— হ্যাঁ অপেক্ষা করছিলাম ! ”

— ওর গায়ে হাত দিয়ে দেখবেন না ? ”

ডাক্তারের কথা বুঝতে পারল না ভদ্রলোক। খানিকক্ষণ চুপ থেকে বলে,

— মানে ? ”

— মানে টা হচ্ছে মেয়েটার শরীর জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে। আই থিংক তীব্র জ্বরে বোধ হয় সে জ্ঞান হারিয়েছে ঘুমের মধ্যেই। আপনি এতক্ষণ ধরে বসে আছেন, ভালো কথা । মেয়েটার গাঁয়ে হাত দিয়ে তো দেখবেন যে সে আদৌ ঠিক আছে কিনা। আসুন তো এগিয়ে এসে দেখুন। মেয়েটার শরীরের কি পরিমাণ তাপমাত্রা। মানলাম আপনি ওর কেউ হন না কিন্তু অন্তত দায়িত্ববোধ থেকে তো ওর খবর টা রাখবেন। একজন নার্সকে ডাকতেও তো পারতেন ? ”

ডাক্তারের কথা শুনে এবার ভদ্রলোকটি মাথা নুইঁয়ে ফেলে । মেয়েটার নাম ও যে শুভ্রা, এই উত্তেজনায় তিনি ভুলেই বসে ছিলেন মেয়েটা যে অসুস্থ। এবার তিনি মনে মনে নিজেকে অনেক ঘৃণা করতে লাগলেন। তার অনুতপ্ত বোধ হলো । এদিকে ডাক্তার নার্সকে ডেকে কিছু কড়া কথা শুনিয়ে থার্মোমিটার দিয়ে জ্বর মাপতে বলে । গায়ে জ্বরে পরিমাণ তীব্র। ১০৫ ডিগ্রির উপরে । তাপমাত্রা তো হবেই। এই ভেবেই ডাক্তার একটা ইনজেকশন পুশ করে দেয় শুভ্রা শরীরে। আর পাশে থাকা ভদ্রলোকটিকে বলে,

— এখানে একজন মহিলা মানুষ থাকলে খুব ভালো হতো। আপনি থাকলেও সমস্যা নাই তবে মেয়েটার দিকে একটু খেয়াল রাখবেন। আই হোপ তার জ্বরটা নেমে গেলে জ্ঞান ফিরবে। হতে পারে এক ঘন্টা বা ঘন্টা তিনেকের মধ্যে জ্ঞান ফিরবে। ”

এই বলেই প্রস্থান ঘটায় ডাক্তার। ভদ্রলোক ও চিন্তিত হয়ে বসে রইলেন। খানিকক্ষণ চুপ থেকে বাড়িতে ফোন দেয়। কাজের লোক লতুকে কল দিয়ে বলে পুরোটা বলে। লতু-ও বোধহয় খানিকটা চিন্তিত হয়।

~~

— মেয়েটাকে হাতছাড়া করলি কেনো হতচ্ছড়া ? ”

এই বলেই দেখতে অসম্ভব ভয়ংকর একটি লোক থাপ্পড় বসায় রফিকের গায়ে। রফিক নাম করা গুন্ডা। এ পর্যন্ত মিশন ফেইল হয়েছে খুব কম’ই। আর এই মিশন এটারই অন্যতম। সুপারি ছিলো মেয়েটাকে নষ্ট করে পতিতাপল্লির কর্মি করা আর রাজি না হলে মেরে ফেলা। দুটোর একটাও হয়নি। আর তখনই থাপ্পড় খাওয়া রফিক থাপ্পড় খাওয়া গালে এক হাত রেখে খানিকটা বেকে উত্তরে বলে,

— আরে ভাই ! কম চেষ্টা করেছি ? ”

রফিকের এই উত্তরে অজ্ঞাত ব্যক্তিটি কিছু বলতে যাবে তার আগেই পাশের জন বলে ওঠে,

— হ মামা ! মাইয়্যাডার তেজ অনেক। ওই বাংলা ভাষায় একখান কথা কয় না যে, ছোট মরিচের ঝাল বেশি । কইতারেন হেমন ডাই। একটানা সাতদিন খাওয়ন দিয়া না দিয়া রাখছি আর বাপের ব্যাপারে চাপ দিছি। কোনো কাম হয়নায়। কিন্তু পরে যহন রাসেল যায় ধস্তাধস্তি করতে তহনি মাইয়া সুযোগ বুইজ্ঝা মশার স্প্রে দিয়া পালাইছে। ”

পাশের জনের কথা শুনে অজ্ঞাত ব্যক্তিটি বলে,

— এই রাসেল কেরে এদিকে আয় ! ”

রাসেল নামে ব্যক্তিটি নিজের নাম শোনা মাত্রই থরথর করে কাঁপতে থাকে । যেখানে সে নিজে একটা ডন। সেখানে অন্য একজন নিজের নাম নেওয়াতে সে ভয় পাচ্ছে। কথায় আছে না, বাঘ যখন বাঘকে ভয় দেখায় তখন ব্যাপারটা ব্যাপারহীন হয়ে যায়। সেটাই হয়েছে রাসেলের ক্ষেত্রে। এলাকায় নারীদের উত্ত্যক্ত করার পিছনে তার একখানা হাত-ও রয়েছে। থানায় গিয়ে হিস্ট্রি খুললে হিস্ট্রি আর শেষ হবে না। শুধু একের পর এক রেকর্ড বের হবে। আর এরকম গুন্ডা কে শেষ করে ফেলা আর অজ্ঞাত ব্যক্তির কাছে হাতের লেগে থাকা ময়লাটা সরিয়ে ফেলা একই কথা। এক পা দু পা ফেলে এগিয়ে যায় সামনে। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ব্যক্তিকে দেখে এসে ভয় পাচ্ছে। মোটা সোটা একজন লোক, পড়নে হাফ লুঙ্গি শরীরে সেন্টু গেঞ্জি আর মাথায় একটা ক্যাপ। সাধারণ মানুষ দেখে বুঝবে যে লোকটা বোধ হয় বদ্ধ পাগল। কিন্তু না বর্তমানের লোকটা ভয়ংকর রকম পাপের সাথে জড়িত। তার এই সাধারণত্বের জন্য’ই বোধহয় সে সহজে লোকসমাজে ধরা পড়ে না। আর তার এমন সব কু-কাজ রয়েছে, যা সাধারণ মানুষের কল্পনার বহির্ভূত। রাসেল নামক ছেলেটা সামনে আসতেই ছেলেটার চুলগুলো লোকটির বড়সড়ো হাত দিয়ে মুঠ করে নেয়। আর এতেই যেন রাসেল নামক লোকটি ব্যথায় কঁকিয়ে ওঠে। চুল সারানোর চেষ্টা করতেও সে ব্যর্থ হয়। ওমন ধামার মতো একখান লোকের সাথে পারা যায় নাকি ? চুপ রয় রাসেল। এবার অজ্ঞাত লোকটি টেবিল থেকে ধাঁরালো অস্ত্র নিয়ে এক টানে শিঃরচ্ছেদ করে। মুহূর্তেই রক্তাক্ত হলো ফ্লোর। সাদা গেঞ্জিটা রাসেলের ফোঁটা ফোঁটা রক্তে মেখে রয়। বিরবিরিয়ে বলে,

— তোকে মারলাম এবার আমিও যমরাজের থেকে মুক্তি পেলাম। প্লেন করে যমরাজের থেকে এইবারের মতো মুক্তি পেলেই হলো। এই তোরা পরের মিশনে যা। ”

কথাটুকু সকলেই শুনে। তারই মধ্য থেকে একজন মুচকি হেঁসে মনে মনে আওড়ায়,

— এক যম আরেক যম কে ভয় পেলে যা হয় আরকি। ”

— চলবে?

#প্রণয়ডোর
#লেখিকা_রামিশা_তাসলিম
#পর্ব-পাঁচ

আল্লাহ তাআলার অশেষ রহমতে কেটে যায় আরোও এক সপ্তাহ। শুভ্রা এখন পুরোপুরি সুস্থ না হলেও তুলনামূলক সুস্থ। সেদিনের আরো দুইদিন হসপিটালে এডমিট রেখে তারপর আবার ডাক্তার রিলিজ দিয়ে দেয়। ভদ্রলোকের সাথে যখন শুভ্রার দেখা হয়, তখন তিনি শুভ্রাকে শুরু থেকে সব বলেছেন। শুভ্রা সেগুলো শুনে কৃতার্থ হয়। তারপর হাসপাতালের বিল ভদ্রলোক দেওয়াতে, নিজেকে খানিকটা ঋণী মনে করে শুভ্রা। ঋণ শোধ করার উপায় অন্তর খুঁজে পাচ্ছিলো না সে। তাই ভদ্রলোক তার হারিয়ে যাওয়া মেয়ে আর স্ত্রীর অবস্থার কথা বর্ণনা করেছেন। এতে যেন শুভ্রার নরম মন গলে গিয়েছিল। তারপর যখন ভদ্রলোকটি তাকে তার বাসায় যাওয়ার জন্য অনুরোধ করলো , তখন তার মন তাকে বলতে শুরু করেছিলো,

❝ এই লোকটা তোকে বাঁচিয়েছে শুভ্রা। লোকটার প্রতি অন্তত কৃতজ্ঞতা দেখাতেই লোকটার সাথে যা। ❞

শুভ্রা সর্বদাই তার মনের কথা শুনে। এবারও তার ব্যতিক্রম নয়। তাই সে সেদিন বান্ধবীকে সবটা খুলে বলে। বান্ধবীর সবটা জানতে পেরে ভদ্রলোকটার সাথে চলে যাওয়ার অনুমতি দেয়। সে এখানকার বাইরে অবস্থান করছিল তখন। তাই বলল, সপ্তাহখানেক পর তার সাথে দেখা করবে। সে কোথায় আছে এটা যেন তাকে জানিয়ে দেয়। বর্তমানে তার চার কুলে আপন বলতে এই মেয়েটাই আছে। যাকে সে নিজের বান্ধবী নয় বরং নিজের বোন হিসেবে মানে। আর বোন যখন পারমিশন দিয়ে দিয়েছে সেখানে না করার কোন প্রশ্নই আসে না। তাই সে সেদিন ভদ্রলোকের সাথে তার বাসায় চলে আসে। ভদ্রলোকের ভদ্রমহিলা তো শুভ্রাকে পেয়ে ভীষণ খুশি। মুখে প্রকাশ করতে না পারলেও তার অভিব্যক্তি বারবার বলে দিচ্ছে যে শুভ্রার তাদের বাড়িতে আসাটা , ওনার অত্যন্ত পছন্দনীয় হয়েছে।

~~

সব রাতে মধ্যে পুরো ঘর গোছ-গাছ করে নিয়েছে। আজকে তার বান্ধবী আসবে। তাকে দেখতে। শুভ্রা খানিকটা অগোছালো হলেও, তার বান্ধবী তার উল্টো। ভীষণ খুতখুঁতে স্বভাব তার। সবকিছু সে পরিষ্কার আর পরিষ্কার। তাইতো সকাল থেকে উঠে পড়ে লেগেছে কাজে। সকাল ১১:০০ টার দিকে রান্না করে গিয়েছিল সব গোছাতে। তা দেখে সে বাসাযর মেয়ে লতু তো তাকে বলেই ফেলেছিলো ,

❝ আরে আপা আপনার অত কাম করা লাগতো না। আমি তো আছিই। খালা আর খালু যদি এটা জানতারে তাইলে আমারে কট্টি তিতা কথা হুনাইবো। যদিও তা হুনতে আমার বিরক্ত লাগে না। বরঞ্চ মেলা ভালাই লাগে । তাই মোট কথা হইতাছে আমি আপনারে কোন কাম করতে দিতাম না। ❞

লুতু মেয়েটার কথা শুনে সে তখন উত্তর দিয়েছিল,

— আরে লতু আপু। আমাকে নিয়ে পেতে ব্যস্ত হয়ো না। মনে কর আমি তোমার আর একটা বোন। আমি সব সময় তোমাকে সব কাছে সাহায্য করবো । ধরতে পারো তোমার একটা হেলপার হয়ে গেল। ”

— তা ঠিক কইছেন। তবে আম্নের কাছে আমার একটা আবদার। ”

— কোন প্রকার দ্বিধা ছাড়াই বলে ফেলো তাহলে। ”

— আসলে কথা হইতাছে , আফনের নাম আর আমরার খালা বইন শুভ্রা আফা মনির নাম তো একডাই। খালা তো সত্যি জানে না। আমি আর খালু’ইতো সব জানি। আমনে আমার খালারে ভালা কইরা দেন। ”

লুতু মেয়েটার এমন আবদার শুনে মুচকি হাসির শুভ্রা। মুখে মিষ্টি হাসির রেখা টেনেই তাকে উত্তর দেয়,

— এটা কোন কথা হলো লতু আপা ? ঠিক করার মালিক হচ্ছে আল্লাহ। আল্লাহ পাক চাইলে অবশ্যই উনি ঠিক হয়ে যাবেন। মাধ্যমটা শুধু আমি । তাই আমি বলব আপনি আমার কাছে না বলে আল্লাহ পাকের নিকট প্রার্থনা করুন। ”

— হ আপা । ঠিকি কইছেন। এতদিন ফরে তাইলে আমি আমার একখান ভালা সঙ্গী ফাইলাম। ”

লতুর কথায় এবারও মুচকি হাসে শুভ্রা। হাসতে হাসতে তাকে শোনায়,

— হয়েছে লতু আপা। আর কথা বইলেন না। দ্রুত কাজ সারি। আমার বান্ধবীর কথা তো আমি তোমাকে বললামই। তাহলে ছটফট কাজ করি আমরা। তারপর বিকালে ঘুরতে বের হব। ”

শুভ্রার কথা শুনে লতু মেয়েটাও সায় জানায়। অতঃপর তারা আবারো হাত চালায় আর মনযোগী হয় কাজে।

~~

দুপুরের অত্যন্ত কড়া রোদে দাঁড়িয়ে আছে ফারিয়া। একটাও খালি রিক্সা ও তার চোখে পড়ছে না। বিরক্তিকতে কপাল কুঁচকে আনছে বারংবার । ঘড়িতে তখন ২:২০। শুভ্রার দেয়া লোকেশনে যাওয়ার কথা ছিল ১:৩০। যা পেরিয়ে এসেছে দুইটা বিশ এ। অন্যদিন আবহাওয়া থাকে খুবই গুমোট । যেন এই একটু পরে বৃষ্টি পড়বে। আজ যেন বাঘের মতো রোদ উঠেছে। রোদের প্রশংসা করতে গিয়ে ফারিয়া মনে মনে বলে ওঠে,

❝ ও রোদ তুমি দ্বিধা হও , নয়তো আমাকে করে দাও। তোমার এই ঝলসানো রূপের বাহারে কখন জানি আমি নিজেই ঝলসে যাই। এত উত্তাপ দিও না শরীরে। পরে না আবার আমার ডায়রিয়া হয়ে যায়। ❞

ফারিয়া কথাটা বিরবির করে না বলে বেশ জোড়েই বলেছে। পাশে দাঁড়িয়ে ছিল বস্তি দুটো ছেলে। ১০-১১ বছর হবে হয়তো। দুজন ছেলে ছিল। একজন আরেকজনের দিকে তাকিয়ে হাসতে হাসতে বলে নাক ধরে বলে,

— দেখ দেখ কেমন জানি গন্ধ আসছে। কেমন যেন ডায়রিয়ার গন্ধ। বলি রোদে মনে হয় কারো পটি যায়। ”

এই কথা একজন বলতেই আরেকজন হোঁ হোঁ করে হাসি দেয়। ফারিয়া কপাল চাপড়ায়। শেষ পর্যন্ত কিনা রাস্তার ছেলেগুলো তাকে ইভটিজিং করল। ব্যাপারটা যেন সে মেনে নিতে পারল না। লজ্জা আর অপমানে মুখ থমথম করে, এগিয়ে যায় সামনে। আজ একটা রিক্সা নিয়েই তবেই থামবে।

বেশ খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পরে রিকশা খুঁজে পায় ফারিয়া। ভাড়া ফুরিয়ে উঠে বসে বলে রিক্সায়। গৌন্তব্য শুভ্রার বাসা।

~~

কাঁপা কাঁপা হাত দিয়ে মেইন দরজায় কলিংবেল চেপেছে ফারিয়া। কলিংবেলের পাশে বড় কার্ডে বড় বড় করে লেখা লেখা , “হিমপদ্ম” । নামটা দেখে বেশ আনন্দিত হয় ফারিয়া। এখনকার সময় এইরকম নামের বাড়ি খুব কম পাওয়া যায়। ফারিয়া নিশ্চিত ভাবে, শুভ্রাবাদ এই নামটা আগে কখনোই দেখিনি। দেখলে অবশ্যই বলতো। আজ পর্যন্ত এমন কিছুই হয়নি যা শুভ্রা ফারিয়াকে বলেনি। শুভ্রার কাছে বরাবরই এরকম বাড়ি পছন্দনীয় ছিলো। এসব ভাবতে ভাবতে একজন মেয়ে সে দরজা খুলে দিল। মুচকি হেসে তাকে জিজ্ঞাসা করল,

— আফনে কি ফারিয়া আফা ? ”

— জি আমিই ফারিয়া। ”

ফারিয়ার কথা শুনে মেয়েটির হাস্যজ্জল মুখ যেন আরো প্রশস্ত হল। সাথে সাথে উত্তর দিল,

— আহেন, আহেন। শুভ্রা আফা এনেই আসে । ”

লতুর কথা শুনে ফারিয়াও এগিয়ে যায়। যেতে যেতে শুভ্রা কে পেয়ে যায় । শুভ্রা তো তাকে পেয়ে আনন্দে আত্মহারা। ফারিয়া আশে পাশে চোখ বুলায়। হুইল চেয়ারে বাসায় অবস্থায় দেখতে পায় একজন মহিলা কে। এনিই বোধ হয় মিসেস আশা। ভদ্রলোকটির স্ত্রী। তখনই টুং করে নোটিশ আসে ফারিয়ার ফোনে। ফারিয়া সাথে সাথে ফোন চেক করতেই লেখাগুল্ক জ্বলজ্বল করে ,

— কতদিন আর আগলে রাখবি ওকে ? একদিন না একদিন মরতেই হবে ওকে আমাদের হাতে। পরবর্তীতে বাধা দিলে তোকেও মেরে ফেলবো। বি কেয়ারফুল। বাবা কে মেয়ে হারা করতে চাইছি না। গুড বাই। ”

–চলবে ?

#প্রণয়ডোর
#লেখিকা_রামিশা_তাসলিম
#পর্ব-ছয়

উম ! উম ! করে শব্দ করছে অন্ধকার ঘরে বসে থাকা লোকটি। মুহূর্তে দরজা খুলে যায়। প্রবেশ করে দুজন অজ্ঞতা ব্যক্তি। আবারো দরজা বন্ধ হয়ে যায়। রুমে ঘুটঘুটে অন্ধকার বিদ্যমান থাকে। আস্তে আস্তে করে এগোয় তারা। তাদের হাঁটার শব্দ শুনে মুখে কাপড় দিয়ে বাধা লোকটি খানিক ঘাবড়ে যায়। ভাবতে থাকে মৃত্যু বোধ হয় তার এবার নিশ্চিত। কেননা তাদের হাঁটার শব্দ বলে দিচ্ছে , তারা কতটা ভয়ানক রেগে আছে। সেই খুট ঘটে অন্ধকারে কোথা থেকে একটা চেয়ার টেনে বসলে একজন। আরেকজন দিব্যি দাঁড়িয়ে আছে। বসে থাকা লোকটি হাতে তুড়ি বাজাতেই রুমের লাইট অন হয়ে যায়। দৃশ্যমান হয় দুই অজ্ঞতা ব্যক্তি। উভয়েরই পরনে হুডি, ট্রাউজার আর ক্যাপ, সেই সাথে মুখে মাস্ক।

তাদের মধ্যেই একজন এগিয়ে এসে চেয়ারে বসে থাকা লোকটির হাতের বাঁধন খুলে দেয়। অপর অজ্ঞাত ব্যক্তিটি আরেকটা চেয়ার টেনে বসে আরাম করে। শান্ত দৃষ্টিতে অবলোকন করে হঠাৎই মারধর করা লোকটির চুল মুষ্টিবদ্ধ করে। চুল টেনে একদম দাঁড়িয়ে যায়। ভয়ংকর গলায় চিল্লিয়ে বলে ,

— বল তুই কার কথায় শুভ্রাকে কিডন্যাপ করেছিলি ? ”

লোকটি চালানো শুনে পাশের জন্য কেঁপে উঠেছিল। চেয়ারে মুখে কাপড় বেঁধে বসে থাকা লোকটাও খানিক ভয় পায়। তবে এখনই তার ভয় প্রকাশ করতে চায় না । তাই সে বাজে দেখতে চাইলো। সেও কর্কশ কন্ঠে উত্তর দিল ,

— আরে ! কে বে তুই ? আমাকে আটকে রেখেছিস কেন? জানিস আমি কে ? ”

লোকটির কথা শুনে অপরজন হেসে দেয়। লোকটির কাছে মনে হলো যেন তার সামনে বসে থাকা লোকটি এরকম কৌতুক থাকে শুনিয়েছে। তাই সে পাশের জন টাকে আঙ্গুল ইশারা দিয়ে বলে,

— আরে ভাই ছেলেটা তো ফ্রি তে জোকস শুনিয়েছে আমাকে। কিছু টিপস তো দে ! ”

লোকটির এবারের কণ্ঠটা ছিল খুবই নরম। যেন স্বাভাবিক কণ্ঠস্বর। তবে এই স্বাভাবিক কণ্ঠস্বরের স্থায়িত্বকাল বেশিক্ষণ ঠিকলো না। ঝাঁঝালো কন্ঠে সামনের লোকটি কে বলে উঠে আবার,

— এই থাম। আমাকে একদম গরম মেজাজ দেখাবি না। তোর যে কতটুকু মুরাদ আছে তা তো বুঝেই গিয়েছি। যদি অতই মুরাদ থাকতো তাহলে এতক্ষণে আমার ডেরা থেকে বেরিয়ে যেতি। কিন্তু দেখ আমার সাধারণ গুন্ডাদের কাছে মার খেয়েই তোর বেশামাল অবস্থা। আমি মারলে কি হবে বলতো ? তবে আমি তো তোকে মারবো না। একদম জবাই করব। ”

কথাগুলোতে ছিলাম প্রচন্ডরকম রাগ। এবার লোকটি ভয় পায়। ভয়ে প্রায় কেঁদেই দেয়। আর সে কান্না মাখা কন্ঠেই বলে ,

— ভাই ছেড়ে দেন আমাকে ছেড়ে দেন ! আপনি যা যা বলবেন আমি তাই করবো তাও আমারে মাফ করেন। আমার ঘরে বউ বাচ্চা আছে বৃদ্ধা মা আছে। আমার পরিবারের রোজগারের মাধ্যম একমাত্র আমিই আছি। ”

এই বলে লোকটি পায়ে পড়ে যায়। আর কাঁদতে থাকে । এদিকে অজ্ঞাত একজন লোকটির দিক তীক্ষ্ণ নজর দিয়ে পপর্যবেক্ষণ লোকটিকে। কিছু একটা ভেবে লোকের উদ্দেশ্য বলে ,

— ঠিক আছে। তোর কাজ তোকে একটু পর বুঝিয়ে দেওয়া হবে। পরে তুই যদি আমার বিরুদ্ধে যাস , তবে তোর পরিবারের কেউ বেঁচে থাকবে না। মাইন্ড ইট। ”

— না, না স্যার কখনোই না। আপনি যা যা বলবেন আমি তাই করবো। তাও স্যার আমাকে ছুড়ে ফেলে দিয়েন না। ”

লক্ষ্মীনের শব্দের চেয়ার থেকে আবার উঠে দাঁড়ায়। আর অজ্ঞাত লোকটি তার দাঁড়ানো দেখে শুকনো গলায় তার দিকে তাকিয়ে বলে ,

— স্যার আমার পরিবারের কিছু করবেন আপনি কথা দিন। ”

লোকটির কথা শুনে অজ্ঞাত লোকটির হাঁসি পায় । কণ্ঠস্বর স্বাভাবিক রেখে ফের বলে,

— যে আমার সাথে নিমো খারামি করে আমিও তার সাথে নিমো খারামিই করি। অন্যথায় নয়। ”

এই বলে প্রস্থান ঘটায় সে । পকেট থেকে ফোনটা বের করে ফোনের লক স্ক্রীন অন করে দেয়। শুভ্রার আশ্চর্য হয়ে থাকা মুখের ছবি সেখানে জ্বলজ্বল করছে। ছবির কর্ণারে লেখা , ‘মাই পার্কি’ । ছবিটা দেখার সাথে সাথে তাসবির মুখ হাস্যজ্জল হয়। মুখ থেকে মাস্ক আর মাথা থেকে হুডির টুপি আর ক্যাপ সরিয়ে নেয়। দ্রুত পায়ে হাঁটতে হাঁটতে গাড়ির নিকট পৌঁছায় । গাড়িতে বসে স্টিয়ারিংয়ে হাত রেখে কাউকে মেসেজ করে ,

— ফারু ! ওয়েট ফর মি। আই হোপ আই কেন রিচড মাই ডেস্টিনেশন। ”

সাথে সাথে রিপ্লাই আসলো ,

— ওকে দাভাই। আমি আর শুভ্রা এখন বাহিরে বের হয়েছি। মার্কেটেই আছি। আর একটু পর পার্কে যাব। আই হোপ সেখানে আমি তোমাকে পাবো। ”

তাসবি’র মুখে মিষ্টি হাসি। মুচকি হেঁসে উত্তর দেয়,

— অবশ্যই মাই লিটল সিস ! স্টে বি কেয়ারফুল । ”

— চলবে?