প্রণয়ডোর পর্ব-৪১

0
93

#প্রণয়ডোর
|৪১|
-রামিশা আঞ্জুম বুশরা

এখন সকলের মনে একটাই প্রশ্ন যে..! দ্বিতীয় শুভ্রা আসলে কে? তাহলে বলছি শুনুন! শুভ্রা নিজের সেইফটির জন্য দুটো মাস্ক অলয়েজ ইউজ করতো। একটা মাস্ক কেবল নেওয়াজের বেলায় মেয়ের চরিত্র প্লে করতো আরেকটা মাস্ক যেটা সে সবার সামনে পড়ে। প্রকৃত অর্থে এই মেয়েটার সত্যিকারের রুপ কোনটা সেটা কেউ দেখেনি।

তারপর আসি পরের কথায়! প্রশ্ন এবার একটাই নেওয়াজ মির্জা, ম্যানেজার আর তৃতীয় বোন তারা আসলে কোথায়..? আর নেওয়াজ মির্জা যদি পরিস্থিতির শিকার হয় তবে সত্যিকার ক্রিমিনাল টা কে..? তাইতো ?

তাহলে বলছি এই সত্যটাও! আসলে ক্রিমিনাল হচ্ছে….”

তাসবির কথা শেষ হওয়ার আগেই গুলির বিকট আওয়াজ আসলো। সকলেই ভয় পেয়ে গেলো। শুভ্রা উঠে কোথাও চলে গেলো। বাকীরা গুলির অস্তিত্ব খুঁজতে এদিক ওদিক তাকিয়ে কেবল খুজতে লাগলো । তবে তাসবির চোখ আটকে গেলো একটা ব্যক্তির উপর । লোকটার হাতে থাকা গুলি থেকে ধোঁয়া উঠছে। রহস্যের হাসি হাসলো সে। বিগ সাপোর্টার আগায়া…!

শুভ্রা ছুট্টে ব্যক্তিটির নিকট চলে যায়। সময় নষ্ট না করেই ব্যক্তিটি কে ঝাপটে জড়িয়ে ধরে। চারিপাশের লাইট অন হয়ে যায়। সকলের মুখ দৃশ্যমান হয়। ব্যক্তিটি একজন মহিলা। মুখে মাস্ক থাকার কারনে বোঝা যাচ্ছে না যে মহিলা টি কে।

শুভ্রা কে একহাতে জড়িয়েই মহিলা টি নিজের মতোন করে এগিয়ে আসে তাসবির কাছে। মাথায় হাত বুলিয়ে শোধায়,

– ব্র্যাভো মাই সান!

মাইক টা হাতে নিয়ে নেয়। মুচকি হেসে রাশভারী কন্ঠ বলে,

– আসতে একটু লেইট হলো! আমি কে সেই পরিচয় টা শেষেই বলি। তো আমি সকল পুলিশ অফিসারদের এলার্ট থাকার কথা বলছি! আপনারা প্লিজ এলার্ট হয়ে যান।

অতঃপর বলতে শুরু করে,

– সামাইরা আহমেদ শিলু। বিচ্ছেদ আর মেয়েকে হারিয়ে পাগলপ্রায় হয়ে রাস্তায় বেরিয়ে যায়। একদিন এক ভদ্র লোকের দয়া আর সহযোগিতায় তিনি নতুন পরিচয়ে বাঁচতে শুরু করেন। রেস্টুরেন্টে একটা শেফের কাজ পেয়েছিলেন তিনি । সেখানেই একদিন তার মতো দেখতে একটা মেয়ে আর অফিসের ম্যানেজার কে চোখে পড়ে। অবাক হন তিনি। সেটা কি তার বোন বিনু ছিলো..? মনের কৌতূহল আর প্রশ্নের চাহিদা মেটাতে সেখানে তিনি বাহানায় যান। এগিয়ে গিয়ে বোনের নাকের ডগায় কোনো তিল দেখতে পেলেন না। সেইসাথে হাতের বুড়োর আঙুলের অতিরিক্ত আঙুল টাও নজরে আসেনি। সেজন্যই তিনি নিশ্চিত হন এটা তার বোন বিনু নয়। অন্য কেউ! কিন্তু কে এই মহিলা টি..?

ওদেরকে ফলো করতে দেখে রেস্টুরেন্টের মালিক মহিলাটির থেকে সত্য জানিতে যায়। আর কৃতজ্ঞতা স্বরুপ মহিলাটি সব সত্য বলে দেয়। অতঃপর মেয়ের পাশাপাশি মায়ের ও সংগ্রাম শুরু হয়। ধীরে ধীরে তিনিও সত্যিটা জানতে সক্ষম হলেন । জানতে পারলেন নিজের মেয়ের সংগ্রামের কথা। ধরা দিলেন মেয়ের কাছে। এদিকে নেওয়াজের নিম্ন চালটা মা ধরে ফেলে। শুভ্রার সত্যি মিথ্যে দুটোই তিনি জানতেন। এদিকে নেওয়াজ এর কাছে বিশ্বস্ত হতে শুরু করলেন মহিলাটি। বলা বাহুল্য কায়দা করে তিনি নেওয়াজের টিমে যোগ দেন। ব্যবহার করেছেন মেকআপ। তৈরি করেছেন অন্য এক চেহারা অন্য এক চরিত্র। এদিকে দ্বিতীয় শুভ্রা কে ধরার জন্য নেওয়াজ মির্জা মাকে দিয়ে কাঁবু করার জন্য প্ল্যান করেন। মিথ্যে প্রমাণ সাজিয়ে শুভ্রার নিকট পৌঁছে দেন যেনো তাকে ধরতে কষ্ট না করতে না হয়।

কিন্তু প্ল্যান ফ্লপ হলো। তারপর লাস্টের প্ল্যানে শুভ্রা কে ধরে ফেললেও কায়দা করে তিনিই তাকে বের করে দেন। আর এইসব কিছুর পেছনে মাস্টারমাইন্ড হচ্ছে ম্যানেজার গৌতম আর তার ছোট বোন সুরেলি।

মহিলাটি থেমে গেলেন। ইশারায় কাউকে কিছু বললেন। সাথে সাথে নিয়ে আসা হলো সুরেলি আর ম্যানেজার কে। শুভ্রা এগিয়ে যায় তাদের কাছে। চিল্লিয়ে বলে উঠে,

– আমার বাবা ফাইয়াজ মির্জা কে সামনে রেখে এনিই নেওয়াজ মির্জার রোল প্লে করেছিলেন। ইনিই সে ব্যক্তি যে আমার শৈশব নষ্ট করে দিয়েছে!

– আ,আর আপনি? লজ্জা করলো না আপনার দু’বোনের সুখ নষ্ট করে দিলেন?

শুভ্রা এই কথাগুলো একদমে বললো। তারপরেই কন্ঠ খানিকটা খাদে নামিয়ে তাসবি কে উদ্দেশ্য করে জিজ্ঞাসা করলো,

– আপনি জানেন আপনার বাবাকে মেরে ফেলা হয়েছিল?

চকিতে তাকায় তিনজন ব্যক্তি। বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে যায় তারা। ফারিহা, বিনু আর তাসবি। তাদের চোখে মুখে বিস্ময়। তখনই বিস্ময়তার রেশ কাটাতে শুভ্রা বলতে লাগলো সুরেলি কে উদ্দেশ্য করে,

– লজ্জা হলো না আপনার? বড় বোনের স্বামী কে এক্সিডেন্ট করিয়ে মেরে ফেলে আর ছোট বোনের স্বামীকে ফাসিয়ে তাদের পরিবার টাকে ধ্বংস করে দিতে আপনার বুক কাপলো না ? অথচ আপনাকেই বা কি বলি! যে পরিবারের মানে জানে না অর্থ বুঝেনা সে আবার বুঝবে কি করে হ্যাঁ!? আমিও নাহ! যা তা প্রশ্ন করে বসি। আচ্ছা এইটা বলুন আপনি যে তাদের তিন সন্তান কে আলাদা করে দিয়েছেন এতে আপনার কি লাভ?

বিদঘুটে হাঁসি হাসলো সুরেলি মেয়েটা। মা-খালা দুজনেই ই একই মুখের আদল তবুও সুরেলি মহিলাটার হাসিটা বিদঘুটে লাগলো। হয়তোবা প্রচণ্ড ঘৃণায়। মহিলাটি উত্তর দেয়,

– শোন মেয়ে। বাকবিতন্ডা করবি না আমার সাথে। আমি সুরেলি। সব জ্বালিয়ে দিই।

আবারো শব্দ করে অট্টহাসি তে ফেটে পড়েন তিনি। হাসতে হাসতেই ফের শোধায়,

– কেন দেখিস নি? আরাফ কে কেমন করে এইসব চক্রে আনলাম? আসলাম মির্জা কে মেরে তো পরিবার ধ্বংস করে দিয়েছি তাই আর অতিরিক্ত আঘাত করতে পারিনি তাকে। কিন্তু তোর পরিবার? এতো ভালোবাসা একে অপরের প্রতি! তাইতো তোর বাবাকে দ্বিতীয় বিয়ে করালাম। মোর্শেদা মির্জা আছে না ? ওইটা। মাল/টা সহজ-সরল বলে বুঝেনি কিছু।

হেসে উঠে ফারিহা। অট্টহাসিতে হেসে ওঠে সে। এগিয়ে এসে শুভ্রার কাঁধে হাত রাখে আর শোধায়,

– ওহ তোমাকে তো বলাই হয়নি…তোমার এই পাকা কাজটাও আমার খালামণি ঘেঁটে দিয়েছে। বিয়েটা আপনার স্বামী করেছিলো সোনা! মিসেস মোর্শেদা মির্জা আপনার সতিন আমার খাকামনির না।

অবাক হলেন সবাই। মিসেস মোর্শেদা মির্জা দাঁড়িয়ে গেলেন। বিস্ময়তা তার চোখে-মুখে আছড়ে পড়ছে। নিজ অবস্থানে থেকেই বললেন,

– শু,শুভ্রা!….

– ফারিহা বলছে আন্টি!

– আন্টি! ফাইয়াজ আংকেলের ও একজন টুইন ভাই আছে। ছোটবেলায় তিনি দাদা বাড়িতে থাকতেন বলেই দু’ভাইয়ে তেমন মিল ছিলো না। তার নাম ছিলো অর্ক মির্জা। ফাইয়াজ মির্জা ভাবতেন বাড়িতে থেকে থেকে তার ভাই তার ভাগের আদর টুকুও নিয়ে নিচ্ছেন। হিংসা করতে শুরু করে লোকটা কে। যা থেকেই দূরত্ব বাড়তে থাকে পরিবার আর ভাইয়ের থেকে।

তারপর হঠাৎ ই নিজের টুইন তার সামনে এসেছিলো। যখন মিসেস মোর্শেদা মির্জার সাথে বিয়ের কথা উঠেছিলো তখন অর্ক মির্জা এসে জানায় যে সে মিসেস মোর্শেদা কে ভালোবাসেন। তিনি তাকে বিয়ে করবেন। অর্ক মির্জার ক্যারেক্টার টাই দুমুখো ছিলেন। সুরেলি কেও ভালোবাসতেন আর মোর্শেদা কেও। কিন্তু বিয়ে করলেন কেবল মোর্শেদা মির্জা কে। দু’জায়গায় দুই রোল প্লে করে কোনোমতে ভাইকে বাঁচাতে চেয়েছিলো অর্ক মির্জা । কিন্তু ভাইকে ডুবিয়ে দিতেই সুরেলি মেয়েটা ফাইয়াজ কে সামনে রেখে ম্যানেজার কে নেওয়াজ সাজিয়ে আন্ডারওয়ার্ল্ডে কালো বাজারীর ব্যবসা শুরু করে। নারী পাচার এর মধ্যে অন্যতম!

তাই সবমিলিয়ে বলা যায় মিসেস মোর্শেদা মির্জা আপনার অবিবাহিত সতিন। আর আরাফের কথা বলছেন না? ছেলেটাও দিব্যি ঠিক আছে। একটুও মনুষ্যত্ব বোধ হারায়নি। সে বৈধ সন্তান। অর্ক মির্জা আর মোর্শেদা মির্জার সন্তান আরাফ।

তাহলে একটা প্রশ্নই রইলো যে , সবকিছুই যখন অর্ক মির্জার তাহলে ফাইয়াজ মির্জা কি করছিলেন? তাহলে বলছি শুনুন! দিনের বেলায় ফাইয়াজ মির্জা আর রাতে অর্ক মির্জা থাকতেন। রাতের বেলায় ফাইয়াজ মির্জা নিজের স্ত্রী কে খোঁজার অভিযান চালাতেন আর দিনে তো এমনিতেও তিনি বাসায় থাকতেন না। তাই সুবিধা ই হতো। অপরদিকে অর্ক মির্জা ভাইকে সাহায্য করতে ম্যানেজারের সাথে জড়িত মেয়েলি মানুষ টিকে ধরবার চেষ্টা করতেন।

বলা যায় আড়ালে থেকে যেমন মা-মেয়ে চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছিলেন সফলতার জন্য ঠিক তেমন এককালীন শত্রুর মতো হয়ে যাওয়া ভাই ও ভাইয়ের করুণ পরিস্থিতিতে ঢাল হয়ে দাঁড়ায়!

#চলবে?