হৃদয়ের দখিন দুয়ার পর্ব-০৩

0
712

#হৃদয়ের_দখিন_দুয়ার
#পর্ব-৩
ইশরাক ঝিলিক কে নিয়ে বউভাতের তিন দিন পর ই ঢাকায় ফিরলো। ঢাকায় ঝিলিক মেয়েদের সঙ্গে ফ্ল্যাট শেয়ার করে থাকতো। নিজেই রান্না করে খেত। ইশরাকের ফ্ল্যাট টাও ছোট। দুই বেডরুম, ডাইনিং, ড্রইংসহ। বাবা, মা মাঝেমধ্যে এসে থাকেন বলে এই ফ্ল্যাট নেয়া। ঝিলিক আগেও এই বাসায় এসেছে। তবে আজকের আসার মধ্যে পার্থক্য আছে। আজ এই বাসাটা শুধু ইশরাকের একার না। ঝিলিক ঘরে ঢুকেই বেডরুমের দিকে গেল। ইশরাক ভীষণ গোছানো স্বভাবের। অন্যদিকে ও ততোটাই অগোছালো। জামাকাপড় পাল্টে এখানে সেখানে ফেলে রাখে। লিপস্টিক, ফাউন্ডেশন, ক্লিনজার প্রয়োজনের সময় কখনো খুঁজে পায় না।

ঝিলিক ঘুরেফিরে সবকিছু দেখছিল ততক্ষণে ইশরাক ফ্রেশ হয়ে এসেছে। এসে বলল,

“যা ফ্রেশ হয়ে আয়। ফুডপান্ডায় খাবার অর্ডার করেছি, চলে আসবে কিছুক্ষনের মধ্যেই। ”

ঝিলিক পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালো ইশরাকের দিকে। খালি গায়ে গলায় তোয়ালে জড়িয়ে রাখা। ধবধবে সাদা শরীর। মাথাভর্তি এক ঝাকরা চুল। গভীর সুন্দর চোখ। জিম করে সুন্দর বডিও বানিয়েছে। ঝিলিক কে খাওয়াদাওয়ার ব্যাপারে এবার সচেতন হতে হবে। ফাস্টফুড পেলেই কান্ডজ্ঞান ভুলে গিয়ে গপাগপ গিলে ফেলে। না ঝিলিক, আজ থেকে পিজ্জা, বার্গার, পাস্তা সব বন্ধ। ওরা সব তোর সতীন।

ঝিলিক কে ওভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে ইশরাক টিশার্ট খুঁজতে গেল। বিড়বিড় করে বলল,

“আস্ত একটা বেয়াদব ঘাড়ে ঝুলিয়ে নিয়ে এসেছি। ভুল তো আমার ই। ”

ঝিলিক অস্পষ্ট কথাগুলো শুনতে পেল না। বলল,

“আমাকে কিছু বললে?”

ইশরাক ততক্ষণে টিশার্ট টা পরে ফেলল। বলল,

“মহারানী দয়া করে ফ্রেশ হয়ে আসুন। খাবার চলে আসলে আমি কিন্তু আপনার জন্য অপেক্ষা করব না। আমার ভীষণ খিদে পেয়েছে। ”

ঝিলিক বুকে হাত রেখে বলল,

“উফ! এটা কী বললে! মহারানী! তার মানে তুমি মহারাজা! আজকের দিন টা এতো ভালো কেন!”

ইশরাক রাগী চোখে তাকাতেই ঝিলিক শব্দ করে হেসে ফেলল। দৌড়ে গেল ওয়াশরুমের দিকে।

***
খেতে বসে ইশরাক বলল,

“কাল খালা আসবেন। রান্নাবান্না, ঘরের অন্যান্য কাজ সে করবেন। তোর কোনো কাজের দরকার নেই। তুই শুধু পড়াশোনা করবি। ”

“তুমি খালাদের রান্না খেতে পারো? ইশ কী বাজে হয়! হোস্টেলে থাকতে আমি প্রতিদিন খাবার নষ্ট করতাম। ”

“এই খালা তেমন না, ভালো রাঁধেন। তোর সমস্যা হবে না। ”

“আচ্ছা। তবে আমিও তোমাকে মাঝেমধ্যে রেঁধে খাওয়াব। খিচুড়ি টা আমি ভালো পারি। সঙ্গে পিয়াজের ভর্তা আর আমের আচার। খেয়ে তুমি আমার আঙুল চাটবে। ”

শেষ বাক্যটা যে বলা উচিত হয় নি সেটা ঝিলিক পড়ে বুঝতে পারলো। ইশরাক খাওয়া বন্ধ করে শীতল চোখে তাকালো। বলল,

“আমার বউ হবার চেষ্টা করিস না ঝিলিক। আর কথাবার্তা একটু সামলে বলিস। সবসময় তুই যা বলবি তা সামনের মানুষ টার ভালো নাও লাগতে পারে। ”

ঝিলিকের খুব খারাপ লাগলো। ঠোঁট চেপে কান্না আটকানো চেষ্টা করলো। ওর সঙ্গে সবাই ই এমন করে কথা বলে। সবাই বলে বলুক, তাই বলে ইশরাকও বলবে! চাপা গলায় বলল,

“আমি তোমার বউ ই। চেষ্টা করার কিছু নেই। আর কথাবার্তা যেরকম বলি সেরকম ই বলব। ”

ইশরাক এবার আর তর্কে গেল না। এই মেয়েটার সাথে তর্ক করে লাভ নেই। যুক্তি তর্কের ধার যারা ধারে না, তাদের সাথে তর্কে যাওয়া উচিতও নয়।

ইশরাক চুপচাপ খেয়ে উঠলো। ঝিলিক ভেবেছিল তর্ক বিতর্ক খানিকক্ষণ চলবে। ইশরাক আগেই রণে ভঙ্গ দিয়ে পালালো! ঝিলিক নিজেই আগ বাড়িয়ে গেল কথা বলতে।

“কাবার্ডের চাবিটা দাও তো। জামা কাপড় গুলো গুছিয়ে রাখি। ”

ইশরাক চাবি দিতে গিয়েও থেমে গেল। বলল,

“কাল রাখিস।”

“কেন আজ কী সমস্যা? ”

ইশরাক ঝিলিকের চোখের দিকে তাকিয়ে সরাসরি বলল,

“কাবার্ডের একটা অংশে সুপ্রীতির জিনিসপত্র আছে। আমি চাই ওগুলোয় তুই হাত না দিস। ”

বুকের ভেতর ছুড়ি দিয়ে আঘাত করলে যেমন যন্ত্রণা হয় ঝিলিকের যন্ত্রণা এই মুহুর্তে তার চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। তবুও কন্ঠস্বর স্বাভাবিক রেখে পাল্টা প্রশ্ন করলো,

“তোমার কাবার্ডে ওর জিনিসপত্র কেন?”

ইশরাক এবারের জবাব টাও দিলো কঠিন ভাবে। বলল,

“ওর ই থাকার কথা। উড়ে এসে জুড়ে বসেছিস তুই। সমস্যা নেই কাবার্ড আমি খালি করে দেব কাল। তবে ওই কাবার্ড নিয়েই সন্তুষ্ট থাকিস কেমন! ”

ঝিলিক শক্ত গলায় বলল,

“ও প্রায় ই তোমার ফ্ল্যাটে আসতো?”

ইশরাক তাকিয়ে আছে ঝিলিকের চোখের দিকে। নাকের পাটা ফুলে ফুলে উঠছে। ঝিলিক আর পারছে না! অসহ্য! দ্রুত পায়ে চলে গেল ঘর ছেড়ে।

ইশরাক বুক ভরে নি:শ্বাস নিলো। পানি খেল অনেক টা। চুলগুলো খামচে ধরলো শক্ত করে। ঝিলিক কে আঘাত করাটা কী সত্যিই জরুরী ছিলো! হ্যাঁ ছিলো, ঝিলিক এই বিয়েতে রাজী না হলেও পারতো। ইশরাক তো রাজী ছিলো না। কাউকে ডাকে নি বিয়েতে, কাউকে না।

ইশরাক ঝিলিক কে ডাকলো না। বাতি নিভিয়ে শুয়ে রইলো যন্ত্রের মতো। সুপ্রীতির সঙ্গে একবার কথা বলার দরকার ছিলো। এখনো সুযোগ পেলে বলবে। সুপ্রীতি তুমি এতো স্বার্থপর কবে হয়ে গেলে! স্বার্থপর যখন হবেই তাহলে স্বপ্ন দেখাতে কেন গেলে!

ঝিলিক এলো অনেকক্ষন পর। এসেই ইশরাক কে ঝাপটে ধরলো শক্ত করে। ভেজা গলায় বলল,

“তুমি একটা মিথ্যুক। আমি জানি তুমি অমন না। সুপ্রীতি যেমন ই হোক, তুমি সংস্কার, নীতি এগুলো মানো। আমাদের বংশে এরকম কেউ হতেই পারে না।”

ইশরাক নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে দূরে সরে গেল। স্পষ্ট অবজ্ঞা ও অপমানের পরও ঝিলিক দ্বিধান্বিত। এই সবকিছু ভবিতব্য জেনেও তো ও এই বিয়েতে রাজী হয়েছিল।

****
“নাতাশা তোকে কল করেছিল?”

সুপ্রীতি স্বাভাবিক গলায় ই জবাব দিলো,

“না। আমি কারো কল রিসিভ করি না। ”

“ঠিক করছিস। নাতাশাকে প্রশ্রয় দিবি না। বেইমান একটা। ”

“তুমি কী এগুলো বলার জন্য কল করেছ?”

স্বপ্নার গলার স্বর নরম হয়। বলেন,

“না। তোরা আসবি কবে?”

“অর্ণব যেদিন বলবে। ”

স্বপ্না খানিকটা আশাহত হলেন। অর্ণবের সব কথা মেনে চলে সুপ্রীতি! বললেন,

“ওমা এ আবার কেমন কথা! তুই বল যে আমার মায়ের বাসায় যেতে ইচ্ছে করছে। তাহলেই তো ও যেতে চাইবে।”

“না আমার যেতে ইচ্ছে করছে না। আমি এখানেই ভালো আছি। আর অর্ণব সম্ভবত হানিমুনে যাবার প্ল্যান করছে।”

“তাই? কই বললি না তো?”

“সব তোমাকে কেন বলতে হবে? ”

স্বপ্না কথা খুঁজে পান না। ফোন রাখেন। সুপ্রীতির সঙ্গে অনেক দিন তার ভালো সম্পর্ক ছিলো না। সেটার নেপথ্যে ছিলো ইশরাক। নাতাশার দেবরের সাথে সুপ্রীতির প্রেম শুনে স্বপ্না পাগল হয়ে যান। তিনি কখনো ভাবতে পারেন না যে তার মেয়ের ইশরাকের সাথে বিয়ে হবে। এই নিয়ে মায়ে মেয়েতে অনেক ঝামেলা গেছে। চিরকাল বাধ্য মেয়ের অভিনয় করা সুপ্রীতি মা’কে মানতে চায় না। মেরে রক্তাক্ত করেছিলেন একবার, তবুও মেয়ের দৃঢ় স্বভাবে চমকে উঠেছেন। শেষমেস পেরেছিল ইশরাকের শেকল থেকে মুক্ত করতে। বিয়েও দিয়েছেন পছন্দের পাত্রের সঙ্গে। অর্ণব অস্ট্রেলিয়া থেকে পোস্ট গ্রাজুয়েট করে ফিরেছে। বিদেশী কোম্পানিতে হাই স্যালারি নিয়ে কাজ করছে। পারিবারিক ব্যবসার একটা অংশ পাবে। ঢাকা শহরে দুটো বাড়ির একটা ওর। এরচেয়ে ভালো পাত্র আর কিছুতে হতে পারে না। তবে সুপ্রীতির আচরণ বদলায় নি একটুও। ইদানীং স্বপ্নার ভয় লাগছে মেয়েকে। কেন, কী কারণে ভয় লাগে সেসবের ব্যখ্যা তার কাছে নেই। কেমন এক অদ্ভুত অনুভূতি ।

***
ইশরাকের ঘুম ভাঙলো বারোটার দিকে। ঘুম ভাঙার অনেকক্ষন পর মনে হলো আরে ঘরে তো ঝিলিক নেই। দু’বার ডাকলো,

“ঝিলিক, ঝিলিক!”

কোনো সাড়াশব্দ নেই। একটু খুঁজতেই ঝিলিক কে পাওয়া গেল। বারান্দার দেয়ালে ঠেস দিয়ে ঘুমাচ্ছে। আরও দু’বার নাম ধরে ডাকার পর অস্ফুট শব্দ করলো। ইশরাক গায়ে হাত দিয়ে দেখলো জ্বর আছে। সারারাত জেদি মেয়েটা বারান্দায় ছিলো। শেষ রাতে এক পশলা বৃষ্টির সঙ্গে ঠান্ডা বাতাস বইছিল!

ইশরাক ঝিলিক কে এনে বিছানায় শুইয়ে দিলো। খানিকক্ষণ তাকিয়ে রইলো এক দৃষ্টিতে। মনে মনে বলল,

“কেন এলিরে তুই ঝিলিক! কেন কষ্ট পেতে এলি! তোকে কষ্ট দিতে আমারও কী ভালো লেগেছে! ”

ইশরাক কপালে হাত রাখলো ঝিলিকের। চোখ বন্ধ করে ভাবলো, না ঝিলিক কে আর কষ্ট দিবে না। সুপ্রীতির জায়গা যেমন ঝিলিকের নয় তেমনি সুপ্রীতির রাগের বহিঃপ্রকাশও ঝিলিকের সঙ্গে করবে না। ঝিলিক ওর জীবনে আলাদা একজন হয়েই থাকবে। ওর সঙ্গে কখনো সুপ্রীতিকে মিলাবে না

চলবে…..

সাবিকুন নাহার নিপা