#হৃদয়ের_দখিন_দুয়ার
#পর্ব-১৩
নাতাশা ডিভোর্স পেপার টা পেল স্বপ্নার থেকে। সেদিনের সেই ঘটনার পর স্বপ্নার সঙ্গে নাতাশার কথাবার্তা কম হয়। স্বপ্না কয়েকদিন খুব শান্ত রইলো। রান্নাবান্না, ঘরের কাজ সব বন্ধ রেখে দরজা বন্ধ করে থাকলো, শুধু খাওয়ার সময় বেরিয়ে চুপচাপ খেয়ে নিয়েছে। বেশীক্ষন না খেয়ে থাকলে এসিডিটির সমস্যায় ভুগে।
আজ সকালে প্রকৃতি এসে বলল,
“আপু মা ডাকছে। ”
নাতাশার এখন মনের অবস্থা এমন যে কোনো কিছুতে বিচলিত কিংবা ভয় পাওয়ার ক্ষমতাও লোপ পেয়েছে। প্রকৃতি আশ্বস্ত করে বলল,
“কিছু হবে না। বলতে চাইছিলাম না, তবুও তোমার মুখের এক্সপ্রেশন দেখে বলতে হচ্ছে। সম্ভবত ভাইয়া ডিভোর্স পেপার পাঠিয়েছে। ”
নাতাশা অস্ফুটস্বরে শুধু বলল,
“আচ্ছা!”
এতো বড় একটা খবরে নাতাশা বিন্দুমাত্র বিচলিত হলো না। এটাই তো ভবিতব্য ছিলো, সবকিছু ভেবেই তো ছেড়ে এসেছে শ্বশুর বাড়ি।
শ্বশুর, শাশুড়ী কল করেছে, ঝিলিক কল করেছে নাতাশা কারোর কল রিসিভ করে নি। ফাহাদ একবার যখন জেদ করেছে সে অবশ্যই জেদে অনড় থাকবে। কোথাও যাবার জায়গা না থাকলেও নাতাশা হাতে পায়ে ধরতে পারবে না।
স্বপ্না চা’য়ে পরোটা ভিজিয়ে খাচ্ছে। নাতাশাকে এক পলক দেখে বলল,
“সারাদিন ঘরে শুয়ে বসে থাকিস, মেয়েটাকে নিয়ে বাইরে গেলেও তো একটু পারিস। ”
নাতাশা স্মিত হাসলো। চেয়ার টেনে স্বপ্নার মুখোমুখি বসলো, মাথা নিচু করে। স্বপ্না কাগজ টা বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
“এই যে তোর আমলনামা এসে গেছে। সাইন করে দিলে, টাকা পাঠিয়ে দিবে। একবারেই দিবে জানালো। ”
নাতাশা এখনো চুপ। স্বপ্না আবারও বলল,
“ওই বাসায় ড্রেসিং টেবিল ছিলো না?”
নাতাশা বুঝতে না পেরে জিজ্ঞাসু চোখে তাকালো। স্বপ্না বলল,
“আয়নায় নিজেকে দেখিস না, দিন দিন মোটা হচ্ছিস! চেহারার যে হাল তাতে স্বামীর নজর বাইরে তো যাবেই। ও বেচারার কী দোষ! ”
স্বপ্না তার উদ্দেশ্য হাসিল করতে সক্ষম হলো। নাতাশা এই কথায় কষ্ট পেয়েছে। চোখে স্পষ্ট অপমানিত হবার ছাপ ফুটে উঠেছে। তবুও হাসার চেষ্টা করলো। স্বপ্না আবারও বলল,
“এখন বল আমার কী কী করা লাগবে তোর জন্য? মাসে কত টাকা দাবি করতে চাচ্ছিস? ভেবেচিন্তে ঠিক তো করেছিস?”
“আমার কিছু লাগবে না খালামনি। সুপ্রীতি রাগের মাথায় বলেছে। কিছুদিন পর আমি চলে যাব নিজের ব্যবস্থা করে। একটু সময় দিও।”
“কিছু করা লাগবে না মানে কী? এক বছরের যাবতীয় খরচ তো আমার ই দেবার কথা নাকি! আর বড় কথা বলছিস তোর কী এমন যোগ্যতা আছে যে নিজের ব্যবস্থা করবি। চেয়েচিন্তে খাওয়া ছাড়া আর কী উপায় আছে! ”
নাতাশার চোখ ভরে জল এলো। মনে মনে বলল, আল্লাহ চাইলে যোগ্যতা নিশ্চয়ই একদিন হবে। সবার জীবনে খারাপ, ভালো সময় আসে। আমি কী এতোই অভাগা যে সবসময় আমার জীবন উল্টো স্রোতে বইবে। কিন্তু জবাব দিলো না। কথায় কথা বাড়বে, অশান্তি বাড়বে। জীবনে এই মুহুর্তে এমনিতেই অশান্তির শেষ নেই, তাই চুপচাপ সয়ে নেয়াই ভালো।
নাতাশা চলে এলো কাগজ টা নিয়ে। অনিশ্চিত জীবনের শুরু টা এবার পাকাপাকি ভাবে হয়েই গেল। সব বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে যাবে। কারোর বউ, বউমা, ভাবী থেকে শুধুমাত্র পালকের মা হওয়ার একটা লম্বা ও কঠিন জার্নি শুরু হবে নাতাশার। এই জার্নিতে যেন কখনো ক্লান্ত নাহয়, কারোর সাহায্য যেন না চাইতে হয় এটাই ওর চাওয়া। সৃষ্টিকর্তা সর্বশক্তিমান, তিনি ও’কে ধৈর্য্য দিক।
***
ইকরার সঙ্গে ফাহাদের কথাবার্তার টপিক এখন বদলেছে। ঘুরেফিরে একটাই কথা সেটা হলো ফাহাদের সঙ্গে এক হওয়া নিয়ে। ইকরা প্রসঙ্গটা এড়িয়ে যেতে চায়, আরও সময় নিতে চায়। দিন দিন রুবাব রীতিমতো বিরক্তিতে পরিনত হচ্ছে। এক ফোঁটা মুগ্ধতাও এখন আর খুঁজে পায় না রুবাবের মধ্যে। দুজনের সম্পর্ক এখন ফ্ল্যাটমেটের মতো। রুবাব মাঝেমধ্যে ভাব জমাতে এলেও দুই একটা কথার পর ই শুরু হয় একজন আরেকজন কে খোঁচানো।
ফাহাদ আজকেও জানিয়েছে ও সবকিছু থেকে মুক্ত। ইকরার সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় আছে। ইকরা এতো তাড়াতাড়ি কিছু ভাবতে চায় না, সবকিছু ভেবেই এগুবে। রুবাব কে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত টা ছিলো পাগলামী। রুবাবের বোকা বোকা প্রেমের কথায় কেন যে ভুলে গিয়েছিল সেটা ভেবে নিজের চুল ছিড়তে ইচ্ছে করে ইকরার।
রুবাব এসে কখন যে ওর পাশে বসলো টেরও পায় নি।
“কোনো কিছু নিয়ে টেনশন করছ কী?”
“অনেককিছু নিয়ে। তোমার শুনতে ভালো লাগলেও আমার বলতে ভালো লাগবে না। ”
রুবাব ঠোঁট উল্টে বলল,
“আচ্ছা। ”
ইকরা হঠাৎ সিরিয়াস গলায় বলল,
“রুবাব তুমি কী ভাবছ বলো তো? এভাবেই কিছু না করে জীবন কাটিয়ে দিবে?”
“কিছু করছি না! স্ট্রেঞ্জ!”
“সত্যি কিছু করছ? আমার চোখে পড়ছে না কেন বলোতো? চোখে কী কিছু হলো নাকি?”
রুবাব হেসে ফেলল। বলল,
“দাঁড়াও কফি নিয়ে আসি। ”
ইকরা মেঘস্বরে বলল,
“রুবাব?”
রুবাবের ভাবান্তর হলো না। কৌতুক চোখে তাকিয়ে আছে। মুখের হাসিটাও স্পষ্ট।
“আমাদের সম্পর্ক দিন দিন খারাপের দিকে যাচ্ছে। এম আই রাইট?”
“না তো। ইটস নরমাল। তুমি জব করো, স্ট্রেস বেশী থাকে, রিয়েক্ট করে ফেলো। আর আমি তোমাকে পোক করি। ”
“আমি যে ভীষণ টায়ার্ড সেটা কী বুঝতে পারছ?”
“পারছি। কিন্তু তুমি তো কাজ ভালোবাসো। আমার থেকেও বেশী। ”
“শুধু তোমাকে ভালোবেসে ঘরে বসে থাকলে যে পেট ভরবে না এটুকু বোঝার মতো সেন্সেও তুমি নেই। ”
রুবাব এগিয়ে এসে ইকরার হাত ধরে বলল,
“চলো কোথাও ঘুরে আসি। আমি স্পন্সর করব। অনেকদিন ঘোরা হয় না। ”
ইকরা শীতল গলায় বলল,
“কোথায় যাবে? কক্সবাজার নাকি শ্রীমঙ্গল? ”
“তুমি যেখানে চাও। ”
ইকরা শব্দ করে হেসে বলল,
“আমি এমন একটা মানুষের সঙ্গে আছি যার মিনিমাম সেল্ফ রেসপেক্ট টুকু নেই।”
রুবাব শান্ত হয়ে গেল। ইকরা ঠিক জানে রুবাব কে শান্ত করার ওষুধ কোনটা। রুবাব হাই তুলে বলল,
“সেল্ফ রেসপেক্টের ডায়লগ তোমার মুখে মানায় না সুইটহার্ট। সেল্ফ রেসপেক্ট যাদের থাকে তারা এক্সট্রা ম্যারিটাল এফেয়ারে জড়ায় না।”
ইকরা বিস্মিত হলো। নিজেকে সামলাতেও কষ্ট হলো খুব। কোনোভাবে প্রশ্নটা করলো,
“হোয়াট ডু ইউ মিন?”
রুবাব ভ্রু নাচিয়ে বলল,
“আমি ভুলও হতে পারি। হতে পারে অফিসে গুডবুকে থাকার জন্য তোমাকে এসব করতে হচ্ছে। ”
রুবাব শান্ত গলায় কথা বললেও ইকরা ভেতরে ভেতরে উত্তেজিত হচ্ছে। চেহারা দেখে বোঝাও যাচ্ছে সেটা। রুবাব ওর পিছনে গোয়েন্দা লাগিয়েছে! ছি:! কিভাবে জানলো এসব! ফোন চেক করে হোয়াটসঅ্যাপের টেক্সট দেখেছে! ইকরা যথেষ্ট সচেতন ছিলো তো, প্রতিদিনের টেক্সট গুলো ঘুমানোর আগে ডিলিট করে। রুবাব কে ওর ভয় নেই। ওর সব টেনশন ইমেজ নিয়ে। তবুও ব্যাপার টা রুবাবের সামনে আসায় হতবিহ্বল হয়ে যায়। রুবাব একই রকম কৌতুক চোখে তাকিয়ে আছে। ঠোঁটে তীর্যক হাসি!
চলবে……
#হৃদয়ের_দখিন_দুয়ার
#পর্ব-১৪
ঝিলিক এক রকম বাধ্য হয়ে সুপ্রীতিদের বাসায় এলো। সঙ্গে রিয়াদ আছে। বাবা আসতে চাইলেও ঝিলিক বারণ করলো। স্বপ্নার স্বভাব চরিত্র সম্পর্কে ওর ধারণা আছে। স্বপ্না ঝিলিক কে দেখে খুশি হবার ভান করলে । কেমন আছে, সংসার কেমন চলছে এসব কথাবার্তা জিজ্ঞেস করে পরিস্থিতি কিছুটা সহজ করলেন। নাতাশা ঝিলিক কে দেখে খুশি হলো না। ঝিলিক পালক কে আদর করে রিয়াদের সঙ্গে বাইরে পাঠালো। নাতাশার কাছে এসে বলল,
“ভাবী আমার ওখানে চলো। ”
নাতাশা শুকনো কাপড় গুলো ভাজ করতে করতে প্রশ্ন করলো,
“তারপর? ”
“তারপর আর কী? তুমি আমার সঙ্গে থাকবে? ”
“কতদিন? ”
“তোমার যতদিন ইচ্ছে। ”
নাতাশা হাসে। বলে,
“তারপর তোমার ভাইয়ের রাগ কমে গেলে আমি তোমাদের বাড়ি ফিরে গিয়ে ভাত, ডাল, চার রকমের তরকারি রান্না করব তাই তো?”
ঝিলিক মন খারাপ করলো না। ভাবীর সঙ্গে যা হয়েছে তাতে সে অনেকগুলো খারাপ কথা সে বলতে পারে। ঝিলিক বলল,
“ভাবী সবাই ভাইয়ার বিপক্ষে। কেউ তার পক্ষে নেই, আমরা সবাই তোমার পক্ষে। ”
নাতাশা ডিভোর্স পেপারটা ঝিলিক কে দেখিয়ে বলল,
“আমার সিগনেচার টা দেখো ঝিলিক। এই সিগনেচার যখন করেছি তখন থেকে তোমরা আমার আর কেউ না। তোমার মা’কে আর মা ডাকব না, বাবাকেও বাবা না। এমনকি তুমিও আর আমাকে ভাবী ডাকবে না। তোমরা এখন থেকে শুধু আমার মেয়ের আত্মীয়। ”
ঝিলিক আহত গলায় বলল, ভাবী!
নাতাশা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“এই শব্দটা শুনতে খারাপ লাগে ঝিলিক। অন্য একজন কে ভাবী ডাকার প্রিপারেশন নাও। ”
ঝিলিক কাঁদছে। এতো খারাপ ওর কখনো লাগে নি। উঠে এসে নাতাশাকে জড়িয়ে ধরে বলল,
“তুমি একটা বার ভাইয়ার সঙ্গে কেন কথা বললে না ভাবী? একটু দুজনে সামনাসামনি বসে কথা বললে অনেক কিছু ঘটতো না। আমার তোমার জন্য কষ্ট হয়, পালক কে ছাড়া মা, বাবা কিভাবে থাকবে? ”
“আমরা সবাই ই সব কিছুতে অভ্যস্ত হয়ে যাব। তোমাদের বাড়িতে আমার জায়গায় একজন এসে যাবে। শুধু একটা ব্যাপারে সন্দেহ জাগে, সে কী আমার মতো সবার ফরমায়েশ মানবে তো? না মানলে অবশ্য একটা ব্যাপার ভালো, সবাই একটু হলেও পালকের মা’কে মনে করবে। ”
নাতাশা যত শক্ত বাইরে থেকে দেখাচ্ছে ভেতরে ক্ষত টা তারচেয়েও গভীর হচ্ছে! কী জীবন পেল ও! ভালো বউ, ভালো বউমা, ভালো ভাবী সবকিছু হবার চেষ্টা করেও একটা ভাঙনের তকমা কপালে জুটলো। এই যে ঝিলিক এলো মরিয়া হয়ে ওর জন্য, এতেও ভীষণ রাগ লাগছে। ওই বাড়ির সব মানুষ এক ঝটকায় যেন পর হয়ে গেল। সিদ্ধান্ত ফাহাদের একার হলেও নাতাশার বারবার মনে হচ্ছে এরা সবাই দায়ী ওর আজকের পরিস্থিতির জন্য। নাতাশা হঠাৎই ঝিলিকের দিকে তাকালো। এতো শক্ত চোখে তাকানো নাতাশাকে দেখে ঝিলিকের কেমন ভয় লাগলো। নাতাশা বলল,
“তোমরা কেন আশা করে ছিলে যে আমি তোমার ভাইয়ের হাতে পায়ে ধরব! ঘরে বউ, বাচ্চা থাকতেও যে অন্য মেয়ের দিকে নজর দেয় সেরকম চরিত্রের মানুষের কাছে হাতে পায়ে ধরতে হবে কেন? তিন বেলা ভাতের জন্য নাকি একটা মেয়ে আছে সেজন্য? নাকি আমার যাওয়ার জায়গার অভাব। ”
ঝিলিক মাথা নেড়ে বলল,
“আমরা চাইছিলাম সম্পর্ক টা ভালো থাকুক ভাবী। ভাইয়ার রাগ….
“রাগ তো আমার হবার কথা তাই না? আর ভাইয়ার রাগ, ভাইয়ার জেদ বলে তাকে জাস্টিফাই কোরো না ঝিলিক। তোমার ভাই চরিত্রহীন। আমি ঠিক করেছি তার সঙ্গে আপোষে না গিয়ে। আমি তো আর তুমি নই যে জোর করে সম্পর্ক বানাব!”
ঝিলিক বাকরুদ্ধ হলো। নাতাশার খারাপ লাগলো না। এই এক জ্বালা হয়েছে, ফাহাদের কোনো আত্মীয় স্বজনের জন্য আর ভালো কথা আসে না, শ্রদ্ধাও আসে না। নাতাশা আবারও বলল,
“পালক কে দেখতে ইচ্ছে হলে এসো। আমার জন্য আসতে হবে না। তোমরা আমার কেউ না। মেয়ের জন্য যতটুকু সহ্য করতে হয় করব। ”
ঝিলিক আর কিছু বলল না। স্বপ্না ঝিলিক কে খেয়ে যেতে বললেন, ও রাজী হলো না। একটা শাড়ি উপহার দিলেন। বললেন, বিয়েতে যাওয়া হলো না। উপহার টা রাখো। মন দিয়ে সংসার কোরো।
ঝিলিক চলে এলো মন খারাপ করেই।
****
“তুমি আমার পিছনে গোয়েন্দা লাগিয়েছ রুবাব?”
রুবাব সবজি কাটছে। ভাবলেশহীন গলায় বলল,
“আজ আবার এই প্রশ্ন?”
“প্রশ্নের পিঠে প্রশ্ন নয় জবাব দিতে হয়। ”
“হ্যাঁ একটু করতে হচ্ছে। ”
“সিরিয়াসলি?”
রুবাব ছুড়িটা রেখে চেয়ার ঘুরিয়ে ইকরার দিকে তাকিয়ে বলল,
“আমরা লাস্ট কবে ইন্টিমেট হয়েছি মনে আছে? চার মাস আগে তাই না? তাছাড়া আমাকে তো জানতে হবে কেন আমাকে বিনা কারণে তোমার এতো বিরক্ত লাগে? ”
“বিনা কারনে? একটা কারণ বলো যেটায় তোমাকে ভালো লাগা উচিত?”
“ইকরা… আমরা ভালোবেসে বিয়ে করেছিলাম। ”
ইকরা একরকম চিৎকার করে বলল,
“আনফরচুনেটলি… আমি একটা পাগল ছিলাম। নাহলে ইউজলেস, কেয়ারলেস ছোটলোক কাউকে আমার মতো কারোর বিয়ে করার কথা না। ”
“বিহাভ ইওরসেল্ফ সুইটহার্ট। আমি যেমন সুইট করে কথা বলছি তেমনি তোমারও উচিত সুইট করে কথা বলা। চোরের মায়ের বড় গলা মানায় না।”
ইকরা ছুটে এসে রুবাবের কাঁধ খামচে ধরলো। রুবাব একই সঙ্গে শান্ত ও উত্তপ্ত। ইকরা হিসহিস করে বলল,
“নিজের একটা দাঁড় করানো ক্যারিয়ার নেই, সোশ্যাল স্ট্যাটাস পর্যন্ত নেই। ঘরের সব জিনিসপত্র আমার, যে বিছানায় পড়ে পড়ে ঘুমাও সেটা অবধি আমার। সব আমার। ”
রুবাব খানিকটা তাকিয়ে রইলো শান্ত ও নির্লিপ্ত চোখে। তারপর উঠে চলে গেল। ফিরে আসলো কতগুলো কাগজ নিয়ে। ইকরার হাতে কাগজগুলো ধরিয়ে দিয়ে বলল,
“দেখো।”
ইকরা কাগজগুলো হাতে নিয়ে বিস্মিত চোখে তাকিয়ে আছে। বিয়ের পর থেকে ওর টাকায় যেসব জিনিস কেনা হয়েছে ইকরার জন্য এবং ঘরের জন্য, সব লেখা আছে। ইকরাকে গিফট করা এক লাখ ত্রিশ হাজার এর ল্যাপটপ থেকে শুরু করে লাস্ট মাসের কফি পাউডার টার দাম পর্যন্ত লেখা।
ইকরা অস্ফুটস্বরে বলল,
“ছোটলোকের বাচ্চা!”
রুবাব শান্ত গলায় বলল,
“এখন তোমার গুলো লিস্ট করো। মিলিয়ে দেখি একজন আরেকজনের কাছে কতো টাকা পাব। লাস্ট দুই বছর আমার খারাপ সময় গেছে এটা ঠিক, কিন্তু আগের তিন বছরের ম্যাক্সিমাম কন্ট্রিবিউশান আমার। ”
ইকরা মেঝেতে বসে পড়লো। হেরে যাবার অভ্যাস যাদের নেই তারা হার টা সহজে হজম করতে পারে না। যেকোনো ইস্যু ক্রিয়েট করে রুবাব কে ছেড়ে দিলে লোকে বলতো ওরা তো মিসম্যাচ ছিলো, ইকরা আর কতো এডজাস্ট করবে! কম তো চেষ্টা করে নি। এই ব্যাপার গুলো হলে ইকরা শান্তি পেত। বুকের ভেতরের আগুন কিছুটা হলেও নিভতো। কিন্তু এখন! রুবাব জিতে যাবে। ফাহাদের ব্যাপারে কতটুকু জানে রুবাব সেটা ইকরার বোধগম্য হয় না। কিন্তু হিসাব নিকাশের কাগজগুলো বুঝিয়ে দিচ্ছে যে রুবাব প্ল্যান করে স্টেপ বাই স্টেপ এগিয়ে আছে।
ইকরা তাকালো রুবাবের দিকে। রুবাব বলল,
“ডিভোর্সের ঝামেলা টা তোমাকেই সামলাতে হবে সুইটহার্ট। আমি কিন্তু টাকা, পয়সা দিতে পারব না। উল্টো তুমি আমাকে কিছু দিয়ে গেলে ভালো হয়। অবশ্য তোমার ই দেয়া উচিত, কারণ ইউ আর এ চিটার। ”
***
“কোথায় গিয়েছিলি তুই?”
ইশরাক ঝিলিক কে ফিরতে দেখে প্রশ্ন করলো। ঝিলিক শাড়ির প্যাকেট টা বিছানার উপর রেখে বলল,
“তোমার আরেকটা প্রিয় জায়গায়। ”
ইশরাক বুঝে নেয়। নাতাশা সুপ্রীতিদের বাসায় আছে। ঝিলিক সেখানে যেতেই পারে। জিজ্ঞেস করলো,
“ভাবীর কী খবর? ”
“ডিভোর্স পেপার হাতে পেয়ে সাইন করে দিয়েছে। আজ পাঠিয়ে দিলো। ”
ঝিলিকের চোখ লাল দেখে ইশরাক বুঝলো এক দফা কান্নাকাটি করেছে। নাতাশাকে ঝিলিক খুব ভালোবাসে। অবশ্য বাসার কথাই, ওদের সঙ্গে ভাবীসুলভ আচরণ তো কখনো করে নি। সবসময় স্নেহের চোখেই দেখেছে।
ঝিলিক কে চুপচাপ বসে থাকতে দেখে ইশরাক জিজ্ঞেস করলো,
“খাবি না?”
ঝিলিক দীর্ঘশ্বাস ফেলল বড়দের মতো করে। ও কখনো এমন দীর্ঘশ্বাস ফেলে না, বলল,
“হ্যাঁ খাব। না খেয়ে থেকে কী হবে! ”
খেতে বসে ঝিলিক দেখলো খালা পটল, বরবটি আলু দিয়ে মাছ রান্না করেছে। দেখেই মেজাজ খারাপ হলো। ও বলেছিল পেয়াজ, রসুন বাটা দিয়ে মাছের পাতলা ঝোল করতে। কিন্তু সে ফ্রিজ পরিস্কার করার জন্য পটল, বরবটি সব দিয়ে রান্না করেছে।
ঝিলিক ডাল দিয়ে ভাত মাখিয়ে মুখে দিয়ে দেখলো ডাল টা টক লাগছে। টক ডাল ও খেতে পারেনা। বাড়িতে যখনই কাঁচা আম, জলপাই দিয়ে ডাল হতো, ছোট একটা পাতিলে আলাদা করে ওর জন্য ডাল হতো। মা করে আসছে, নাতাশাও করতো।
ভাতের মধ্যে এক গ্লাস পানি ঢেলে ঝিলিক উঠে গেল। ইশরাক বলল,
“এটা কী হলো? কিছু খেলি না যে?”
ঝিলিক রাগী গলায় বলল,
“শোনো ঘরের মানুষ যখন গুরুত্ব দেয়না তখন বাইরের মানুষও গুরুত্ব দেয়া বন্ধ করে। তোমার আদরের খালা জানেন যে আমি টক ডাল খাই না, তবুও রাঁধছেন। আমি যেমন করে মাছ রান্না করতে বলছি তেমন করে রান্না না করে নিজের মতো করে রাঁধছেন। মানে আমার গুরুত্ব কারোর কাছে নেই।”
ইশরাক শান্ত গলায় বলল,
“তুই বস একটু। ডিম ভেজে আনছি আমি। খুব সামান্য একটা ব্যাপার, এতো রিয়েক্ট করার কিছু নেই। স্বল্পজ্ঞানী একজন মানুষের কর্মকাণ্ড তোর আমার মতো হবে না। আমি খালাকে বলে দেব। ”
ঝিলিক ঝোকের মাথায় হোক আর ইচ্ছে করেই হোক বলে ফেলল, খুব সামান্য একটা ব্যাপারের কারণে সুপ্রীতি তোমাকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত বাদ দিয়ে অন্য একজন কে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। খুব ভালো কাজ করেছে, সেজন্যই আজ থাইল্যান্ডে হানিমুন করতে গেছে। তোমার সঙ্গে বিয়ে হলে নিশ্চয়ই সেটা হতো না।
ইশরাক স্থির চোখে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। তারপর ই অপ্রিয় কাজ টা করলো, কিছু বোঝার আগেই ঝিলিক নিজের গালে থাপ্পড় খেল।
চলবে…
(দোয়া ও প্রার্থনায় রাখবেন।)