হৃদয়ের দখিন দুয়ার পর্ব-১৫+১৬

0
446

#হৃদয়ের_দখিন_দুয়ার
#পর্ব-১৫
সুপ্রীতি এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে অর্ণবের দিকে। ঘুমের সময় সবাইকে দেখতে প্রায় শিশুর মতো লাগে। অর্ণব কে দেখে মনে হচ্ছে রেগে ঘুমাচ্ছে। কপালের ভাজ টা স্পষ্ট। অর্ণবের বেশ কিছু ছুতমার্গ আছে, ওর ঘুমের সময় কোনোভাবেই ডিস্টার্ব করা যাবে না। একই ভাবে সুপ্রীতির ঘুমের সময়ও অর্ণব একদম ডিস্টার্ব করে না। বিয়ের বেশ কিছুদিন পরের ঘটনা। সুপ্রীতি দুপুরের ভাতঘুম দিয়েছে। কতক্ষণ ঘুমিয়েছে খেয়াল নেই, ঘুম ভাঙতেই দেখলো অর্ণব বসে আছে। সুপ্রীতি ভয় পেয়ে উঠে বসতেই অর্ণব বলল,

“রিলাক্স! আমার একটা পেনড্রাইভ ভুলে রেখে গেছি। ড্রয়ার খুলতে গেলে ঘ্যাঁচ করে একটা শব্দ হবে, ঘুম ভেঙে যাবে তোমার তাই বসে আছি। ”

খুব সামান্য ঘটনাটা পরবর্তীতে পর্যবেক্ষণ করে সুপ্রীতির মনে হলো এটা খুব ভালো একটা গুন। যা কিছু আমার সহ্য হয় না, সেটা অন্যের ক্ষেত্রেও করা ঠিক না।

সুপ্রীতির ইচ্ছে করলো অর্ণবের চুলে আঙুল ডুবিয়ে দিতে। অর্ণবের ঘুম বেশী গাঢ় না, ভেঙে যাবে। তারপর রাগ দেখাতে না পেরে ঘন্টাখানেক চুপচাপ বসে থাকবে।

সুপ্রীতি শুয়ে রইলো আরও কিছুক্ষন। কয়েকদিন বেশ ঘোরাঘুরি হলো, আজ রেস্ট নেবার দিন। আজকের প্ল্যানে শুধু শপিং করা আছে। সুপ্রীতির বেশী মানুষজন নেই, যাদের জন্য কিনতে হবে। প্রকৃতির জন্য কিনবে, নাতাশা আর পালকের জন্য কিনবে। বাবার জন্য কিছু কিনবে না, বাবাকে একটু বোঝাতে হবে যে ও এবার রেগে আছে। সাদাতের জন্যও কিছু কেনার নেই, ওর সঙ্গে সুপ্রীতির তেমন সদ্ভাব নেই। অনেক আগের ঘটনা, সাদাত বাড়িতে কিছু বন্ধু এনেছে। সবাই ভদ্রঘরের ছেলে। গেম খেলছিল, এক পর্যায়ে একজন কে গালি দিলো বাজেভাবে। সুপ্রীতির সেটা সহ্য হয় নি। রাগের মাথায় সাদাত কে এক থাপ্পড় মারলো। সেই প্রথম ভাইয়ের গায়ে হাত তোলা, ততদিন পর্যন্ত সুপ্রীতি জানতো যে যাকে আদর করা যায় তাকে শাসনও করা যায়। সাদাত চিৎকার করে বলল, তুমি আমার গালে থাপ্পড় মারার কে! এটা কী তোমার বাড়ি? এতো সাহস তোমার! সুপ্রীতি দ্বিতীয় বার আরেকটা থাপ্পড় মারলো, ও’কে অনেকটা বিস্মিত করে সাদাত ফুলদানি ছুড়ে মারলো। স্বপ্না এই খবর শুনে সুপ্রীতিকে শাসন করেছে। কেন সুপ্রীতি সাদাত কে ওর বন্ধুদের সামনে মারলো। ও’কে কেন সাদাতের গার্জেন হতে হবে! সে তো এখনো মরে যায় নি। আর কথা তো সত্যিই ওই বাড়িটা তো সুপ্রীতির না।

সেই এক ঘটনা ভাইয়ের সঙ্গে দূরত্ব সৃষ্টি করেছে। একটু বুঝতে শেখার পর সুপ্রীতি বুঝেছে জীবনে ভালো থাকতে হলে বেশীকিছু করতে হয় না। শুধু সাহস করতে হয়। যারা আমাদের জীবনে ক্ষতির কারণ, মন খারাপ, অসম্মানের কারণ হয় তাদের সঙ্গে দূরত্ব বাড়িয়ে দিতে হয়।

প্রকৃতির কাছে ঝিলিকের কথা শুনেছে। ওর তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া হয় নি। ঝিলিক যে ইশরাক কে পছন্দ করে সেটা জেনেছে ইশরাকের সঙ্গে সম্পর্ক হবার বেশ কয়েকমাস পরে। সেবারের শীতে ওরা দুই বোন বেড়াতে গেল নাতাশার ওখানে। ইশরাকের অন্যান্য কাজিন রাও এলো। সন্ধ্যে হলেই ছাদে মাদুর পেতে আড্ডা বসে। সঙ্গে চা, মুড়ি, গরম গরম পিঠা। এক সন্ধ্যায় ঝিলিক একটা শাড়ি পরে এলো। উলের সোয়েটারের উপর শাড়ি। প্রথম কিছুক্ষন সবাই বিস্মিত চোখে তাকিয়ে হো হো করে হেসে ফেলল। ঝিলিকের তাতে কিছু যায় আসে না। ও ইশরাক কে জিজ্ঞেস করলো, আমাকে কেমন লাগছে বলো তো! ইশরাক বলল তোর দিকে তাকালেই কেমন ইরিটেশন হয়। বোধ থাকলে বুঝে নে এটা কেমন ধরনের কমপ্লিমেন্ট! ঝিলিক এবার রিয়েক্ট করলো। কান্নাকাটি করলো, শীতের রাতে বালতি ভরে গায়ে পানি ঢালল। ভাত খেল না। শেষমেস ইশরাক গিয়ে রাগ ভাঙিয়ে ভাত খাওয়ালো। ঝিলিকের মা তখন বলল ওরে একমাত্র ইশরাক ই সামলাতে পারবে। সুপ্রীতি তখনও পর্যন্ত জানতো ও ভালো মনের মানুষ। হিংসা, বিদ্বেষ, ঈর্ষা ওর মধ্যে নেই। কিন্তু ঝিলিকের কর্মকান্ড, ইশরাকের রাগ ভাঙানো ওর ভালো লাগে নি। ভীষণ খারাপ লাগলো, ঝিলিক কেও ভীষণ অসহ্য লাগলো। ইশরাক এই ব্যাপার টাকে কখনো গুরুত্ব দিতো না, কিন্তু সুপ্রীতি যতবার ঝিলিক কে দেখতো ততোবারই মনে পড়ে যেত। মাঝেমধ্যে মনে হতো কিছু কর্মকান্ড ঝিলিক ইচ্ছে করেই ও’কে দেখানোর জন্য করতো।

সুপ্রীতি হঠাৎ চোখ খুলে দেখলো অর্ণব এক দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। সুপ্রীতি একটু থতমত খেল, সঙ্গে অপ্রস্তুতও হলো। অর্ণব আড়মোড়া ভেঙে বলল,

“তোমার চোখের পাতা কাঁপছিলো। কার কথা ভাবছিলে?”

সুপ্রীতি স্মিত হেসে জবাব দিলো,

“অনেকের কথা। ”

“সেই অনেকের মধ্যে স্পেশাল কেউ কী ছিলো? ”

সুপ্রীতি উত্তর দিতে সময় নেয় না। সঙ্গে সঙ্গে বলে, না তো।

অর্ণব হেসে ফেলল। বলল,

“আমার ঘুম তো আরও আগেই ভেঙেছিল। ভেবেছি তুমি হয়তো মাথায় হাত বুলিয়ে দিবে। কপালে চুমু টুমু খাবে। সকাল টা শুরু হবে রোমান্স দিয়ে। ”

সুপ্রীতি হাসলো। গাল দুটো লাল হলো অকারণেই। অর্ণব অন্যদিকে ঘুরে শুয়ে আছে। সুপ্রীতি একটু এগিয়ে অর্ণবের চুলে হাত রাখলো। অর্ণব হাত বাড়িয়ে সুপ্রীতির আরেক হাত নিয়ে চুমু খেল। গভীর গলায় ডাকলো,

“সুপ্রীতি! ”

“হু?”

“আই লাভ ইউ। ”

সুপ্রীতি শুকনো ঢোক গিলল। অস্থির গলায় বলল,

“ওকে। ”

অর্ণব মৃদু হাসলো।

***
ইকরাকে ভীষণ আপসেট দেখাচ্ছে কয়েক দিন ধরে। মেজাজটাও রুক্ষ। ফাহাদ বোঝার চেষ্টা করছে সমস্যা টা কী! ইকরা কী ও’কে এড়িয়ে চলতে চাইছে। তাহলে কী ও শুধু ইকরার টাইমপাস ছিলো। ফাহাদ নিজেও ইকরাকে নিয়ে সিরিয়াস ছিলো না, ফ্যামিলি ম্যান, মেয়ে আছে কিন্তু ইকরা যেমন আকর্ষনীয় সেরকম আকর্ষনীয় কেউ এখনো ওর চোখে পড়ে নি। প্রায় ই মনে হতো নাতাশা ওর জীবনে একটা বড়সড় ভুলের নাম। চারটা বছর পর বিয়ে করলে ওর পাশে ইকরাই থাকতো।

অফিস সহকারী ছেলেটার সঙ্গে ইকরা খুব খারাপ ব্যবহার করলো আজ। কফি নিয়ে, ইকরা এমনিতে চিনি ছাড়া কফি খায়। আজ দুই চামচ চিনি চেয়েছিল। ছেলেটার খেয়াল ছিলো না। ফাহাদ এক ফাঁকে গিয়ে ইকরার ডেস্কের পাশে বসলো। ইকরা ফিরেও তাকাচ্ছে না। ফাহাদ মৃদু গলায় জিজ্ঞেস করলো,

“কোনো সমস্যা? ”

“ডোন্ট টক টু মি ফাহাদ। ব্যস্ত আছি। ”

“ওকে। অফিস শেষ করে কথা বলি। তোমার পছন্দের ক্যাফেতে। ”

“না। আমি বিজি আজ। বিজনেস এর কিছু পেন্ডিং কাজ আছে। ”

ফাহাদ গলার স্বর একটু খাদে নামিয়ে বলল,

“কিবরিয়া ভাই ডেকেছিল। বেশকিছু কথা বলেছে…. সেগুলো নিয়েই আলাপ করতাম। ”

ইকরা হঠাৎ জমে গেল। কিবরিয়া ভাই এই অফিসের ম্যানেজিং ডিরেক্টরের একজন। তার কথাবার্তা খুবই তিক্ত ধরনের। উইদাউট এনি নোটিশে চাকরি থেকে বের করে দেয়া তার কাছে কোনো ব্যাপার ই না৷ ইকরা খুব অস্থির হলো। কী হচ্ছে এসব! রুবাবের অপমান টা এখনো হজম করতে পারছে না। তার মধ্যে এখন অফিসের ঝামেলা। সবকিছু একসাথে বেরিয়ে যাবে হাত থেকে।

***
ফাহাদ এক রকম চিৎকার করে বলল,

“আমাকে ইগ্নোর করছ? ভেরি গুড ইকরা! এরকম কিছুর জন্য আমি অপেক্ষা করে ছিলাম কিন্তু…

অন্যমনস্ক ইকরা ফাহাদের এই শয়তান রুপ টা খেয়াল করলো না। ক্লান্ত গলায় বলল,

“রুবাব তার আসল রুপ টা দেখিয়ে দিয়েছে ফাহাদ। তুমি জানোই না যে আমার উপর দিয়ে ঠিক কী কী যাচ্ছে! ”

ফাহাদের গলার স্বর নরম হলো। বলল,

“কী হয়েছে বলো তো?”

ইকরা সব কিছু খুলে বলল। ফাহাদ অবাক কিংবা কষ্ট পাবার বদলে খুশি হলো। এখন ওর আর ইকরার এক হওয়ার মধ্যে তেমন বাঁধা থাকবে না। ফাহাদ স্বস্তির নি:শ্বাস টা দীর্ঘশ্বাসের মতো ফেলে বলল,

“আমাদের কপাল খারাপ আসলে…. আমাদের পার্টনার রা আমাদের জন্য মিসম্যাচ। এতো ভেবো না, হারামজাদাকে ডিভোর্স পেপার পাঠিয়ে দাও। একটা মেয়ে ডিভোর্স পেপার পাঠাচ্ছে এটা নিশ্চয়ই ইগোতে লাগবে। এইটা সহজে হজম করতে পারবে না।”

ইকরা কিছু বলল না। ওর প্ল্যান ছিলো অন্য। সবকিছু সেভাবেই হচ্ছিলো একটু একটু করে। শুরুটা হয়েছিল বেডরুমের দূরত্ব থেকে। একে অপরকে পোক করা তো ছিলোই। এভাবে করে রুবাব নিজেই বিরক্ত হয়ে ও’কে ছাড়ার কথা ভাবতো। লাভ হতো ইকরার, কাবিনের দশ লাখ টাকা পাওয়া যেত। আর এখন! ডিভোর্স পেপার পেয়ে অপমানিত হবার বদলে হাসবে! এসব ভেবে ভেবেই অসুস্থ হয়ে যাচ্ছে ও। ফাহাদ হাত বাড়িয়ে ইকরার হাত টা ধরলো। ইকরার এই কষ্ট, টেনশন সবকিছুই ভালো লাগছে। ভীষণ ভালো লাগছে।

****
ঝিলিক থাপ্পড় খেয়ে কান্নাকাটি করলো না। একটা নির্ঘুম রাত কাটিয়েও হতভম্ব ভাব কাটলো না। ইশরাক কোনো কথা বলল না। সকালে খালাকে বলল,

“খালা আজ থেকে আপনি আমার একার জন্য রান্না করবেন। ঝিলিকের জন্য করবেন না। আপনার রান্না ঝিলিকের পছন্দ হয় না, ওরটা ওর মতো করে নিবে। ”

এই কথার পর খালাও ঝিলিকের সাথে কথাবার্তা সেদিন থেকে কমিয়ে দিলো।

এতো অপমানের পরও ঝিলিকের বাড়ি চলে যেতে ইচ্ছে করে না। ইশরাক পাশের রুমে গিয়ে ঘুমাচ্ছে। ওর ইচ্ছে করে দরজা ভেঙে ইশরাক কে ডেকে নিয়ে আসতে। ভারী নি:শ্বাসের শব্দ ছাড়া ঘুম আসতে চায় না এখন আর। হাত বাড়িয়ে ইশরাকের মুখ, কপাল, চুল ছুঁয়ে অনুভব করা যায় যে মানুষ টা সত্যি সত্যিই ওর। সবাই কতো করে বলেছিল ইশরাক জীবনেও ওর হবে না। পাগলা কুকুরের কামড় খেয়েও নাকি ও’কে বিয়ে করবে না। অথচ কতো নির্বিঘ্নে বিয়ে হলো, ঝিলিক ওর সঙ্গে এক খাটে ঘুমায়। শরীর, মনের দখলদারি নিতে পারে নি এখনো, তবে শিগগিরই নিয়ে ফেলবে।

***
ঝিলিক আজ আবার শাড়ি পড়েছে। সাধারণ তাঁতের শাড়ি। ইশরাক এসে এক পলক দেখে নিজের কাজে মন দিলো। ইদানীং আসছেও দেরি করে। ঝিলিক সামনে গিয়ে ভনিতা ছাড়াই বলল,

“আজ থেকে ঘরে ঘুমাতে আসবে। ওটা আমার পড়ার রুম। ”

ইশরাক নির্লিপ্ত গলায় বলল,

“তাহলে তুই ওই ঘরে চলে যা। রাতেও ওখানে থাকবি। ”

“কেন? ”

“কারণ তোর সঙ্গে ঘুমাতে আমার রুচিতে বাঁধে। ”

ঝিলিক খানিকক্ষণ চুপ থেকে বলল,

“রেগে গিয়ে মুখে যা আসছে তাই বলে দিচ্ছো? কেন রুচিতে বাঁধে? আমার শরীর থেকে ইঁদুর মরা গন্ধ আসে? অবশ্য তুমি তো জানোই না আমার শরীরের গন্ধ কেমন! ”

ইশরাক ল্যাপটপ টা সাইডে রেখে ঝিলিকের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলল,

“এতদিন পর্যন্ত তোর কথাবার্তা, চাল চলন সব মেনে নিয়েছি কারণ ভেবেছি বাচ্চা মানুষ। কিন্তু এখন আর সেটা পারছি না। যা আমার পার্সোনালিটিতে যায় না সেগুলো তোর সঙ্গে করতে হচ্ছে। ”

ঝিলিক স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো অনেকক্ষন। তারপর জামাকাপড় জিনিসপত্র সব গুছিয়ে পাশের ঘরে গেল। ইশরাক ডাইনিংএ বসে ছিলো। ইশরাক কে বলল,

“যাও নিজের ঘরে যাও। আমি সত্যিই ডিস্টার্ব করব না। ”

ইশরাক উঠে যাওয়ার সময় বলল,

“ওকে। থ্যাংক ইউ। ”

“আর শোনো?”

ইশরাক ফিরে তাকায়। ঝিলিক স্মিত হেসে বলে,

“আজ অন্য কারো নাম জপছো না! একদিন ঝিলিক ঝিলিক করে মরে যেতে চাইবে। সেদিন আমি এতো নিষ্ঠুর হবো যে তুমি কল্পনাও করতে পারবে না। আমার এই অভিশাপ লাগবে। ”

চলবে…..

#হৃদয়ের_দখিন_দুয়ার
#পর্ব-১৬
নাতাশা একাই বাসা খুঁজতে বেরিয়েছে। সমস্যা হলো একা মেয়েকে নিয়ে থাকবে শুনে কেউই বাসা ভাড়া দিতে আগ্রহী নয়। স্বামীর সঙ্গে কেন ছাড়াছাড়ি হলো, বাসা ভাড়া দিতে পারবে কিনা এসব কথা জিজ্ঞেস করার পর পর ই গম্ভীর গলায় বলে সম্ভব না। তারা ছোট ফ্যামিলি ভাড়া দিতে চায়। নাতাশা ভেবেছিল বাসা ভাড়া সহজে পাওয়া যাবে, কিন্তু এতোটা কঠিন হচ্ছে যে একেকসময় হতাশায় চোখে পানি এসে যাচ্ছে। নাতাশার ব্যাংকে কিছু টাকা আছে। ওর বিয়ের সময় বাবার বাড়ি থেকে চাচা, ফুপুরা মিলে এক লাখ টাকা দিয়েছিল। ফাহাদ সেই টাকাটা ওর নামেই ব্যাংকে রেখে দিয়েছিল। পালকের জন্মের পর যে যা টাকা দিতো সব জমিয়ে রাখতো মেয়ের জন্য। সেই টাকাটা এখন কাজে লাগবে। কিন্তু সমস্যা অন্য জায়গায়, বাসা ভাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। এদিকে স্বপ্নার কাছে থাকাও কঠিন হয়ে যাচ্ছে। খালু অবশ্য বলছেন তাদের ওখানে থাকতে আরও কয়েক মাস। কিন্তু নাতাশা পারছে না। স্বপ্নার কথার খোঁচা খুব ভয়ংকর। সেদিন পালক কে পেয়ারা খেতে দেখে বলল, সোনাপাখি ভালো করে খাও। এরপর তো আস্তেধীরে মানুষের রক্তচুষে খেতে শিখবে। যেমন টা তোমার মা এখন করছে। কী ভয়ংকর কথাবার্তা! ছোট মেয়েটাকে এভাবেও বলা যায়! তার উপর অন্যান্য আত্মীয়স্বজন দের কথার টর্চার তো আছেই। ছোট মামী এসে বললেন, কিরে তোর কী অবস্থা! এতো বড় একটা ধাক্কা গেল দেখে তো বোঝা যায় না। মোটাও তো হইছিস। এই বাসায় শুয়ে বসে ইচ্ছেমতো খাস শুধু!

অথচ এখানে শুয়ে বসে খাওয়া তো দূরের কথা। দুইবেলা রান্না ও’কে করতে হয়। এছাড়াও স্বপ্নার বিভিন্ন ফরমায়েশ তো আছেই। দুদিন একদিন পর পর ই বাসায় বড় রান্না থাকে। স্বপ্নার বিভিন্ন খাতিরের লোক আসে। তাদের জন্য রান্না করতে হয়। সাদাতের জন্য স্ন্যাকস বানাতে হয়। ভালো করে রেস্ট নেবার সুযোগ পায় না। এরমধ্যে প্রকৃতি এসে যদি কখনো সাহায্য করে তখন স্বপ্না তেলে বেগুনে জ্বলে ওঠে। সেটা নিয়ে আরেকটা ঝামেলা তৈরী হয়।

সপ্তাহ খানেক আগে আরেকটা ঘটনা ঘটলো। ফাহাদের বাবা এলেন পালক কে দেখতে। বয়স্ক মানুষ জার্নি করে এসেছে। সম্পর্ক যেমন ই হোক, মানুষ টার জন্য নাতাশার খারাপ লাগলো। এসে যখন পৌছালো তখন বারোটা বেজে গেছে। নাতাশা নিজে থেকেই বলল দুপুরে খেয়ে যেতে। স্বপ্না পছন্দ করলেন না, নাতাশা ভেবেছিল ঝিলিকের সাথে ওইদিন আন্তরিকতা দেখালো আজও হয়তো সেরকম হবে। স্বপ্না গম্ভীর গলায় বললেন,

“এসব কী নাটক শুরু করছিস? এটা কী হোটেল যে প্রতিদিন লোক এসে খেয়ে যাবে!”

নাতাশা এতো লজ্জা পেল। আমতা আমতা করে বলল,

“দুপুর হয়েছে… তাছাড়া বয়স্ক মানুষ! ”

“হুহ! তোরে না এরা লাত্থি দিয়া বের করছিল। কতো তামাশা যে করো। ”

নাতাশা বেশী কিছু করার সাহস পেল না। স্বপ্না পালং শাক, ডাল আর ছোট মাছ টমেটো দিয়ে রাঁধতে বললেন। রাতে ভারী রান্না হবে তাই দুপুরে হালকা খাবার যেন হয়।

পালকের দাদার সামনে খাবারগুলো নিয়ে যেতেও ওর হাত কাঁপলো। তিনি খেয়ে গেলেন দুপুরে ওই সাদামাটা তরকারি দিয়েই। খাওয়ার ব্যাপার টা তার কাছে মুখ্য ছিলো না। তিনি তার নাতনিকে দেখতে এসেছেন, তাতেই ভীষণ খুশি ছিলেন। কিন্তু নাতাশা খুব কষ্ট পেল। রাতে চালের আটার রুটি আর গরুর মাংস হলো, নাতাশা খেতে পারলো না। অভিমানে পালককেও খাওয়ালো না। দুপুরের ডাল দিয়েই মেখে খাইয়ে দিলো। এইসব দিন তো জীবন থেকে চলেই যাবে কিন্তু আপনজন দের আচরণ তো মনে থেকে যাবে চিরকাল। হৃদয়ের গভীর থেকে আর শ্রদ্ধা আসবে না কখনো।

মিরপুর এগারোর দিকে একটা বাসা দেখতে গেল। অনলাইন গ্রুপে দেখে দেখতে গেছে। এই বাসার মালিক মহিলা। তিনি অন্যদের চেয়ে আরও বেশি গম্ভীর। প্রশ্নও করলেন অনেক। তার বাসায় থাকতে গেলে অনেক রুলস মানতে হবে। তেরো হাজার টাকা ফ্ল্যাট ভাড়া। নাতাশাকে ভাড়া দিতে আপত্তি নেই, তিন মাসের এডভান্স করতে হবে। অন্যদের থেকে দুইমাসের এডভান্স নেয়, নাতাশার কাছ থেকে একমাসের বেশী নিবে। কারণ ওর ঝামেলা আছে। আর নয় তারিখ রাত দশটার মধ্যে বাসা ভাড়া না দিতে পারলে বাসা ছাড়ার নোটিশ দেয়া হবে। নাতাশা সব মেনে নিলো। দুই রুমের ছোট্ট ফ্ল্যাট টা ওর পছন্দ হলো খুব। বাড়িওয়ালি যখন রাজি হলেন তখন মনে হলো ও যেন বাসা নয়, খড়কুটো পেয়েছে। যেটা আকড়ে ধরে ও বাঁচতে পারবে।

***
সুপ্রীতি সবার জন্য অনেক জিনিসপত্র কিনে আনলো। শাশুড়ীর জন্য আনা গিফটগুলো সে খুব পছন্দ করলেন। এই ভদ্রমহিলাকে ওর খুব ভালো লাগে, কেন যেন সেটা প্রকাশ করতে পারে না। শাশুড়ীকে মা ডাকতেও ওর সময় লেগেছে দুই মাস। তিনি কিছু বলেন নি। তিনি অবশ্য কাউকেই কিছু বলেন না। সারাদিন টিভি দেখতে পছন্দ করেন। মাঝেমধ্যে দুই বউয়ের কাছে যান। ছেলেরা বাসায় ফেরার সময় দুজনেই দেখা করে আসে। এতেই সে সন্তুষ্ট। ছেলের বউদের থেকে বেশী কিছু আশাও করেন না। সুপ্রীতি সবসময় ই জেনে এসেছে সংসারে শাশুড়ী আর ননদ হলো জটিল জিনিস। ওর দুজন ননদ আছে। একজন কানাডায় থাকেন, আরেকজন আমেরিকায়। হোয়াটসঅ্যাপে, মেসেঞ্জারে কথাবার্তা বলেন, আন্তরিক দুজনেই। বিয়ের সময় এসেছিল, দুজনেই লাগেজ ভর্তি করে সুপ্রীতির জন্য গিফট এনেছে। সুপ্রীতির জা আবার একটু অন্যরকম। তিনি প্রচুর কথা বলেন, আর অন্যদের বদনাম করেন। সুপ্রীতিকেও সম্ভবত পছন্দ করে না তেমন একটা। তবে একটা কিছু বানালে সেটা সুপ্রীতির জন্য পাঠায়।

অর্ণবের প্রতি বাড়তি স্নেহ থেকে বোধহয় শাশুড়ী সুপ্রীতিকে একটু বেশী পছন্দ করেন। একদিন মাংস রান্না করে বাটিতে করে তার জন্য পাঠানো হলো, খানিকক্ষণ বাদে তার হেল্পিং হ্যান্ড মুনিরা এসে বলল, ভাবী খালাম্মা মাংসে দুইটা আটার গোল্লা দিতে বলছে এতে নাকি লবন কম হবে। সুপ্রীতির এই ব্যাপার টা ভালো লেগেছে। আরেকদিন সুপ্রীতিকে ডেকে নিয়ে গেছে চুলে তেল দেবার জন্য। ওর আবার অভ্যাস নেই, আনাড়ি হাতে তেল ম্যাসাজ করে দিলো। ও’কে কিছু বলল না, কিন্তু অর্ণব কে জানালো যে সুপ্রীতির ম্যাসাজ তার ভালো লেগেছে।

আজ গিফটগুলো দিয়ে আসার সময় শাশুড়ী জিজ্ঞেস করলো,

“তোমার মায়ের জন্য কী আনছ?”

সুপ্রীতি ভারী অপ্রস্তুত হলো। বলল,

“কিছু আনিনি আম্মা।”

ভদ্রমহিলা অবিশ্বাস্য চোখে সুপ্রীতিকে দেখলেন। তিনি একটুও বিশ্বাস করছেন না সুপ্রীতির কথা। সুপ্রীতিও বুঝলো, দীর্ঘশ্বাস লুকিয়ে বলল,

“আমার কেনা জিনিস মায়ের পছন্দ হয় না বেশীরভাগ সময় ই। তাই লাগেজ ভরে লস করিনি। ”

“তাইলে এখান থেকে পছন্দমতো কিনে দিও। তোমার মায়ের নাক উঁচা এটা ঠিক। ”

সুপ্রীতি হাসলো। পৃথিবীতে সবচেয়ে সহজ সম্পর্ক হয় মায়ের সঙ্গে, কিন্তু ওর সবচেয়ে জটিল সম্পর্ক মায়ের সঙ্গে।

***
ইকরা আর রুবাব বসে আছে মুখোমুখি। টেবিলের দুই প্রান্তে দুজন। প্রথম কথা বলা আজ ইকরাই শুরু করেছে। অনেক দিন পর ইকরা আজ নরম স্বরে কথা বলছে।

“আমি তোমার পথের কাঁটা হবো না রুবাব। আমি চলে যাব। ”

“ডার্লিং শোনো, আমি কোনো বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্কে নেই। কাউকে বিয়েও করতে যাচ্ছি না যে তুমি আমার পথের কাঁটা হবে। বাই দ্য ওয়ে, আমি নিজেকেও তোমার পথের কাঁটা ভাবছি না। আই এম দ্য গোল্ড। একদম পিওর গোল্ড। তোমার গোল্ড ভালো লাগে না তাই স্বস্তা জিনিস চুজ করেছ। ইটস ওকে। আই হ্যাভ নো প্রবলেম। কিন্তু সিনেমার ডায়লগ দিও না। ”

রুবাব শান্ত অথচ কঠিন গলায় কথাগুলো বলল। ইকরা আজকে সব লজিক, সব ট্রিকস গুলিয়ে ফেলেছে। রুবাব জিজ্ঞেস করলো,

“ডিভোর্স পেপার এনেছ?”

ইকরার হাত কাঁপছে এবার। কখনো, কোনোদিন রুবাব কে ওর ভয় লাগে নি। আজ লাগছে।

“দাও। সাইন করে দিচ্ছি। তোমার তো আবার নতুন করে বাসর সাজাতে হবে। ”

ইকরা এবার ক্রুদ্ধ চোখে তাকালো। রুবাব ভাবলেশহীন। ইকরা উঠে গিয়ে এনভেলপ টা এনে রুবাবের দিকে ছুড়ে মারলো। রুবাব সময় নিয়ে পড়ে সাইন করার আগে ছবি তুলে রাখলো। তারপর সাইন করে দিলো। শান্ত গলায় বলল,

“যেহেতু বাসা ভাড়ার এডভান্স আমি দিয়েছি সেহেতু এই বাসায় আমি থাকব। তুমি কাল ই চলে যেও। আমার যা কিছু আছে সেটার লিস্ট করে রেখেছি। সেগুলো বাদে বাকী সব নিয়ে যেও। ”

ইকরা চোখ তুলে তাকালো। চোখে চোখ রেখে বলল,

“আসো একটা ডিল করি। আমরা কেউ কারো বদনাম করব না। তুমিও আমার বদনাম করবে না, আমিও তোমার বদনাম করব না। আমার একসঙ্গে থাকতে পারিনি সেটা দুজনের ই প্রবলেম। কিন্তু প্রবলেম নিয়ে ডিসকাস করব না কারোর সাথে। ”

“তুমি দুদিন পর যখন সস্তার আংটি আঙুলে পরবে তখন কিন্তু ধরা পড়ে যাবে। ”

অন্যান্য সময় হলে ইকরা হয়তো জুতা ছুড়ে মারতো রুবাবের মুখে। আজ চোরের মতো সব হজম করছে।

“সেটা যাই হোক, তোমার কোনো সমস্যা তো হবে না। ”

“ওকে। ”

ইকরা পরদিন ওই বাসা থেকে বেরিয়ে এলো। তার পরদিন রুবাব তার এক লাখ ফলোয়ার ওয়ালা ফেসবুক প্রোফাইলে ফাহাদ আর ইকরার রেস্টুরেন্টে হাত ধরা হাস্যজ্বল ছবি পোস্ট করে লিখলো,

“শুভকামনা শত্রুগন। আগামীর পথচলা অশুভ ও কাঁটাময় হোক। আমি খুব খুশি। যে আমাকে সবসময় লুজার বলতো সে আমার চেয়েও বড় লুজারের হাতে পড়তে যাচ্ছে। ”

এই ছবি ও পোস্ট প্রচুর শেয়ার হলো, কটাক্ষ ও ট্রল করা হলো ফাহাদ ও ইকরাকে।

চলবে….

সাবিকুন নাহার নিপা