#হৃদয়ের_দখিন_দুয়ার
#পর্ব-১৯
অর্ণব সুপ্রীতিকে একটা বাড়তি প্রশ্নও করে নি। শুধু একটা কথাই বলেছে ছবিটা কে পাঠাতে পারে সুপ্রীতি! আর কেনই বা পাঠিয়েছে! সুপ্রীতি সেই রাতে অর্ণব কে খেয়াল করেছে বারবার। না ও রেগে নেই, অন্যান্য সব স্বাভাবিক রাতের মতোই। কিন্তু ওই রাত টা ছিলো সুপ্রীতির জীবনে সবচেয়ে কঠিন রাত। কঠিন এক দোলাচলে ছিলো ও। অর্ণবের আলিঙ্গনেও অস্বস্তি হয়েছে ভীষণ। ওই ছবিটা এমনি তো কেউ পাঠায় নি, উদ্দেশ্য তো নিশ্চয়ই কিছু আছে। কিন্তু কার উদ্দেশ্য! ইশরাক! এছাড়া আর কে হতে পারে! কিন্তু ও যে ইশরাক কে চিনে সেই ইশরাক কী সত্যিই এরকম প্রতিশোধপরায়ণ হতে পারে! বোধহয় পারে!
গভীর রাত। সুপ্রীতি সতর্কতার সহিত বিছানা ছাড়ে। ফ্রিজ খুলে বোতলের অনেকখানি পানি খেয়ে ফেলে এক নি:শ্বাসে। ড্রইংরুমে এসে সোফায় বসে। শহরে শীত আসার সময় হয়ে এসেছে। প্রকৃতিতেও এই সময় দারুন পরিবর্তন। সুপ্রীতি ফোনের লক খুলে নাতাশার নাম্বারে ডায়াল করে। নাতাশার ঘুম পাতলা। যদি ফোন সাইলেন্ট ম্যুডে না থাকে তাহলে একবারেই তুলবে। হলোও তাই। নাতাশা ঘুমঘুম গলায় বলল,
“হ্যাঁ সুপ্রীতি বল। এতো রাতে?”
“আপু একটা কথা বলার জন্য ফোন করেছি। ”
নাতাশার তন্দ্রাভাব কাটেনি তখনও। ও খেয়াল করলো না সুপ্রীতি কতো টা ব্যকুল গলায় কথা বলছিল।
“এতো রাতে কী হইছে তোর?”
সুপ্রীতি নি:শ্বাস নিয়ে বলল,
“আপু আমার বিয়ের পর তোমার সাথে ইশরাকের যখন কথা হয়েছে তখন কী ইশরাক একবারও বলেছে বদলা নিবে, কিংবা রিভেঞ্জ ম্যুডে অন্য কিছু বলেছে।”
ঠিক এই মুহুর্তে নাতাশার ঘুম টা চটে গেল। উত্তেজিত গলায় জিজ্ঞেস করলো,
“কিছু কী হয়েছে সুপ্রীতি? ”
সুপ্রীতির এবারে মনে হলো ভুল হয়ে গেছে এতো রাতে নাতাশাকে কল করা। যে টপিকে ওরা কথা বলছে, সেটা আসলে ফোনে বলার মতো টপিক না। অর্ণব ও’কে পাশে না পেয়ে যেকোনো সময় আসতে পারে। তখন ব্যাপার টা আরও কমপ্লিকেটেড হবে। সুপ্রীতি শান্ত গলায় বলল,
“আপু সকালে আসব। এখন রাখি, দেখা হলে কথা হবে। ”
সুপ্রীতি ফোন রেখেও বেশ কিছুসময় বসে রইলো। সবকিছু ও কেমন জটিল করে ফেলছে। যে ওই ছবিটা অর্ণব কে পাঠিয়েছে সে আরও বেশকিছু ছবি পাঠাতে পারে। হতেই পারে আরও অনেক ছবি তার কাছে আছে। আর যদি সেটা ইশরাক হয়ে থাকে তাহলে আরও বেশী জটিল পরিস্থিতি তৈরী হবে। ইশরাক খুব ভালোবাসে স্মৃতি জমিয়ে রাখতে। যদিও প্রকৃতিকে দিয়ে সমস্ত স্মৃতি ইশরাক মুছে ফেলতে চেয়েছে, কতটা সৎ সুপ্রীতি সেখানে ছিলো সেটা তো ওর জানা নেই।
সুপ্রীতি শুয়ে পড়লো অর্ণবের পাশের ফাঁকা জায়গায়। চোখ বন্ধ করে আছে। মাথার এক পাশে তীক্ষ্ণ যন্ত্রণা শুরু হয়েছে। হঠাৎ অর্ণবের স্পর্শ পেল। আঙুল দিয়ে ম্যাসাজ করে দিচ্ছে। সুপ্রীতি অপ্রস্তুত হলো আরও একবার! অর্ণব জেগে আছে!
***
ঝিলিক এখনো আসে নি। তিন দিনের কথা বলে দুই সপ্তাহ থাকছে। ইশরাক কল করে জিজ্ঞেস করেছিল,
“কবে আসবি ঝিলিক? ”
“থাকব আরও কিছুদিন। এখানে তো আরামে আছি। ”
“আর ইউনিভার্সিটি? ”
“যাক চুলোয় সব। আমার আর পড়াশোনা দিয়ে কী হবে!”
“সত্যি কিছু হবে না! কিসব থার্ড ক্লাশ কথাবার্তা তোর। ”
“আমি মানুষটাই তো থার্ড ক্লাশ। কথাবার্তা নিশ্চয়ই ফার্স্ট ক্লাশ হবে না। ”
ইশরাক এরপর আর কথা বাড়ায় না এই প্রসঙ্গে কথা বলে। আশ্চর্য ব্যাপার হচ্ছে ঝিলিকের সঙ্গে ওর তেমন কথা এগোয় না। অথচ বক্তা হিসেবে ওর যথেষ্ট সুনাম আছে। ঝিলিকের সঙ্গেই কেবল দুই একটা বাক্য বিনিময়ের পর সেটা ঝগড়ায় রুপ নেয়।
আজ ছুটির দিন। হাতে অফুরন্ত সময়। একটা মুভি দেখে নেয়া যায়, বহুদিন জমিয়ে সেভাবে কিছু দেখা হয় নি। আগে ছুটির দিন কী করবে না করবে সেগুলো আগের রাতে প্ল্যান হতো। সুপ্রীতির সঙ্গে আলাপ হতো। ইশরাকের হঠাৎ সুপ্রীতিকে মনে পড়ে ভীষণ। আলস্য দুপুরে ফোন হাতে নিলে মনে পড়ে যায় এখন আর কল কিংবা টেক্সট করে কী করছ জানার মানুষ টা নেই। আজ ছুটির দিনে হঠাৎ মনে হলো, সুপ্রীতির ছুটির দিন কেমন কাটে। রান্নাবান্নার ঝামেলা নিশ্চয়ই নেই, বড়লোক বাড়ি বিয়ে হয়েছে। বেলা অবধি ঘুমায় সম্ভবত। বই পড়তে ভালোবাসতো খুব, প্রতিদিন অন্তত দশপাতা হলেও বই পড়া ওর রুটিনে ছিলো। এখন কী করে!
ইশরাকের হঠাৎ মনে হয় সময় অনেক কিছু পাল্টে দিয়েছে। প্রথম প্রথম বুকের ভেতরে যে জ্বালাপোড়া হতো আজ আর হয় না। সুপ্রীতির ক্লোজ ফ্রেন্ড ছিলো ফয়সাল। ওর কাছে গিয়েছিল একদিন। ইশরাক তখন খুব বিষন্ন, সুপ্রীতিকে নিয়ে। ফয়সাল বলল, এসব কিছু না ভাই তুই দুই মাসে ঠিক হয়ে যাবি। ইশরাক তখন অবিশ্বাস্য ক্রোধের আক্রোশে ফুটছিল। আজ সেকথা ভাবলে খারাপ লাগে।
দুপুরে ঝিলিক এসে হাজির হলো। বড় বড় কতোগুলো ব্যাগপত্র নিয়ে। ইশরাক বলল,
“তুই আসবি সেটা আগে থেকে জানাবি না? আমি গিয়ে নিয়ে আসতাম। ”
“গাড়ি করে আসছি। বাসার সামনে নামিয়ে দিলো। দারোয়ান আঙ্কেল হেল্প করলো তাই তোমাকে আর দরকার হয় নি। ”
ঝিলিক বাড়ি থেকে অনেকরকম খাবার নিয়ে এসেছে। মাছ ভাজা, মুরগী ভুনা, চিংড়ির দোপেয়াজা। ইশরাক আরাম করে খেল। ঝিলিক খাওয়ার সময় বলল,
“বড় আম্মা আসবে এই মাসের শেষে বলল। ”
“কই মা তো আমাকে কিছু জানায় নি। কোনো দরকারে আসবে? ”
“কী জানি! ”
“তোকে কিছু বলে নি কেন আসবে? মা’র তো আটকা জায়গা পছন্দ না। ”
ঝিলিক নির্লিপ্ত গলায় বলল, আমি মা’কে বলেছি যে আলাদা ঘরে ঘুমাই। আর তুমি আমাকে থাপ্পড়ও মারছ সামান্য ঘটনায়। মা মনে হয় সেটা জানিয়ে দিয়েছে।
ইশরাক স্থির চোখে ঝিলিকের দিকে তাকালো। ঝিলিক আরেকটা কাঁচা মরিচ ভেঙে ভাতের সাথে মিশিয়ে নিলো। ইশরাক কে উপেক্ষা করছে রীতিমতো।
***
“তোর সন্দেহ ছবিগুলো ইশরাক পাঠাচ্ছে? ইশরাক অর্ণব কে কিভাবে চিনবে? নাম্বার কিভাবে পাবে?”
“এগুলো এমন কোনো জটিল ব্যাপার না আপু। চাইলেই পারা যায়। ”
“ইশরাকের এমন করার কথা না সুপ্রীতি। করলে আরও আগে করতো। না না আমি ভুল করছি, ইশরাক এটা কখনোই করবে না। ”
“আমারও একবার তাই মনে হয়। আরেকবার মনে হয় ও ছাড়া আর কে….. আমার তো সেরকম কোনো শত্রু নেই। ”
“এটাই আমরা ভুল করি সুপ্রীতি। বেশীরভাগ সময় আমরা যাদের বন্ধু ভাবি, কাছের ভাবি দেখা যায় তাদের কাছে আমাদের কোনো গুরুত্ব নেই। আমরা তাদের জীবনে ভিলেন ছাড়া কিছু না। ”
“তা হয়তো ঠিক আপু। কিন্তু ভেবে আমি কাউকে খুঁজে পাচ্ছি না। যে এরকম টা করতে পারে। ”
নাতাশা একটু ভেবে বলল,
“আমি ইশরাক কে জিজ্ঞেস করব?”
“আমি তোমাকে একটা প্রশ্ন করব?”
“বল সুপ্রীতি। ”
“ইশরাকের ঝিলিকের সঙ্গে সম্পর্ক ঠিক আছে। ”
“না ঠিক নেই। ইশরাক কে জোর করা হয়েছে বিয়ের জন্য। চাপে পড়ে রাজি হয়েছে। ”
সুপ্রীতি তীর্যক হেসে বলল,
“এই কথাটা মেয়েদের ক্ষেত্রে খাটে আপু। ছেলেদের না। ”
নাতাশা কিছু বলল না। মেয়েলী কৌতুহল থেকে আজও ওর জানতে ইচ্ছে পুরো ঘটনা। আবছা যতটুকু শুনেছে সেটুকু বিশ্বাসযোগ্য মনে হলেও ভেতরে ফাঁক ফোঁকর আছে বলে মনে হয়।
নাতাশা বলল,
“আমার একটা উপদেশ শুনবি সুপ্রীতি?”
সুপ্রীতি জিজ্ঞাসু চোখে তাকালো।
নাতাশা বলল,
“তুই ইশরাকের কথা অর্ণব কে বলে দে। ক্ষত জায়গায় মলম শুরুতেই লাগাতে হয়। নাহলে পড়ে ইনফেকশন হয়ে যায়। ভয়ের কিছু নেই। তুই আগে কেন বলিস নি সেটাই তো বুঝতে পারছি না। ”
সুপ্রীতি বিড়বিড় করে বলল,
“মা বারণ করেছে। মাথায় হাত দিয়ে প্রতিজ্ঞা করিয়েছিল আপু। আমিও ঝোঁকের মাথায় প্রতিজ্ঞা করেছি। ”
নাতাশা সুপ্রীতিকে ভরসা দেবার জন্য বলল,
“এসব প্রতিজ্ঞা, মাথা ছোঁয়াছুয়ি তে বিশ্বাস করিস তুই! কী যে হয়েছিস! বোকা মেয়ে। ”
সুপ্রীতি হাসলো। বলল,
“ইশরাক কে আমার হয়ে একটা কথা বলবে আপু, ও’কে আমি সম্মান করব সবসময়। ও যেন প্লিজ সেই সম্মান টা না খোয়ায়। ”
“বলব। কিন্তু আমাকে তুই ভুল বুঝিস না। আমি হয়তো তোর চেয়ে বেশি ইশরাক কে চিনি না, হয়তো মানুষ টাও আমি বোকা কিন্তু ইশরাক এমন কাজ করে নি। এই কাজ করার জন্য বুকের পাটা, সাহস ইশরাকের থাকলে তুই ইশরাকের বউই হতিস। ”
***
সুপ্রীতি মনে মনে প্রস্তুত হয়ে নিলো। অর্ণব আজ বাসায় ফিরলো অন্যান্য দিনের চেয়ে দেরি করে। এরমধ্যে অসংখ্য বার ফোন করেছে সুপ্রীতি। কখন আসবে, আর কতো দেরি হবে। অর্ণব এতোবার ফোন পেয়ে নিজেও একটু ভয় পেল যেন। ঘরে ঢুকেই উদ্বীগ্ন গলায় জিজ্ঞেস করলো,
“তোমার কী হয়েছে সুপ্রীতি? শরীর খারাপ? ”
সুপ্রীতি তাকিয়ে রইলো। পরনে এখনো বাইরের পোশাক। চুলগুলো এলোমেলো এখনো। ক্লান্ত গলায় বলল,
“কিছু না। কাল রাতে ভালো ঘুম হয় নি। ”
অর্ণব সুপ্রীতির পাশে বসলো। হাত ধরে জিজ্ঞেস করলো,
“কেন ঘুম হয় নি? কী সমস্যা? ”
“আজ ছুটির দিনেও অফিসে গেলে যে?”
“অফিসে একটা মিটিং ছিলো গুরুত্বপূর্ণ। সবাইকেই যেতে হলো। ”
সুপ্রীতি অর্ণবের কাঁধে মাথা রাখলো। চোখে চোখ রেখে বলার সাহস বোধহয় ওর নেই। বলল,
“ছবিতে যে ছেলেটা আমার সঙ্গে ক্লোজ হয়ে বসেছিল ওর নাম ইশরাক। আমরা তখন রিলেশনে ছিলাম। ”
অর্ণব অস্ফুটস্বরে বলল,
“হু?”
“আই অ্যাম সরি অর্ণব। রিয়েলি সরি। ”
চলবে…..
#হৃদয়ের_দখিন_দুয়ার
#পর্ব-২০
অর্ণব কে শান্ত ও স্থির দেখা গেল। সুপ্রীতির হাত ধরা অবস্থায় আছে এখনো। সুপ্রীতি কিছু বলছে না। অর্ণব শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করলো,
“পানি খাবে?”
সুপ্রীতি মাথা নেড়ে না বলল। অর্ণব বলল,
“তুমি যে একটা রিলেশনে ছিলে সেটা তো আগে আমাকে জানিয়েছ। ডিটেইল বলো নি, আমিও জিজ্ঞেস করি নি। এখন ওই ছবিটা দেখে আপসেট হচ্ছো কেন?”
সুপ্রীতির খেয়াল হলো। তাই তো, ও বলেছিল অর্ণব কে। কিন্তু ইশরাকের নাম অথবা ইশরাকের সম্পর্কে কিছু বলে নি।
অর্ণব আবারও বলল,
“তোমার আগের লাইফ আগের সম্পর্ক নিয়ে আমার ইন্টেরেস্ট নেই বিন্দুমাত্র। কিন্তু তুমি যদি এখনো তোমার প্রেমিক কে মনে রাখো, কিংবা কোনো ছুতোনাতায় তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে চাও, সেই বিষয়ে আমার অনেক আপত্তি আছে। ”
সুপ্রীতি চোখ তুলে তাকালো। অর্ণব বলল,
“শোনো সুপ্রীতি, প্রতিটা সম্পর্কে ভাঙন আসেই তিক্ততা থেকে। আমি তোমাকে যতটুকু অবজার্ভ করেছি তাতে এটুকু বুঝেছি যে তোমার পাস্ট রিলেশন টক্সিক ছিলো। সেই ট্রমা থেকে বের হবার আগেই তোমার বিয়ে হয়েছে। তুমি আমার সঙ্গে স্বাভাবিক আছ, অস্বাভাবিক কিছু চোখে পড়ে নি এখনো পর্যন্ত। ইটস এনাফ ফর মি। এর বাইরে আর কিছু জানার আগ্রহ নেই। তবে প্রাক্তন নিয়ে অনেকের অনেক থিউরি আছে, কেউ কেউ মনে করে প্রাক্তন বন্ধু হিসেবে থাকতে পারে। এই থিউরি টা আমার জন্য যথেষ্ট আপত্তিকর। আমি মনে করি একটা সম্পর্ক ভেঙে গেলে দুজন দুই প্রান্তের হয়ে যায়। সেখানে বন্ধুত্ব ব্যাপার টা থাকে না। ”
সুপ্রীতি অর্ণবের কাঁধে মাথা রাখলো। অর্ণব বলল, সুপ্রীতি জীবনের কিছু পার্ট থাকে যেগুলো ট্র্যাশবক্সে ফেলতে হয়। তোমার জীবনের ওই অংশ টুকু চিরতরে ডিলিট করে দাও। ব্যস আর কিছুই চাওয়ার নেই।
***
রুবাব বেশ কিছুদিন আউট অফ নেটওয়ার্কে ছিলো। এই ব্যাপার টা একদিক থেকে ভালো। দৈনন্দিন জীবনে জটিলতা কম থাকে। শহরে ফেরার পর আবার মন টা ভারাক্রান্ত হতে শুরু করলো। ইকরা বিয়ে করে নিয়েছে। তাও ওই ফাহাদ কে। ইকরা যে ফেক পার্সোনালিটি ক্যারি করে সেটা বুঝতে ওর সময় লেগেছে। তবুও মেনে নিয়েছে। পার্টনারের সব গুন যে পছন্দ হবে ব্যাপার টা তেমন না, দুজন দুজনের অপছন্দ মেনে নিয়েও থাকা যায়। ওর মায়ের ভীষণ পরিস্কারের বাতিক ছিলো। বাবা ছিলেন অন্যরকম। তিনি বাইরে থেকে এসে বাসী কাপড় টাও পাল্টাতেন না। এই নিয়ে অভিযোগের শেষ ছিলো না, একসময় মা অভিযোগ করা বন্ধ করে দিলেন। বাবা তখন হঠাৎই সচেতন হওয়া শুরু করলেন।
রুবাব চেয়েছে ইকরার অপছন্দগুলো কে মায়ের মতো মেনে নিতে। কিন্তু উচ্চভিলাসী ইকরার সমস্যা ছিলো রুবাবের ক্যারিয়ার নিয়ে। ওর প্যাশন, পছন্দ এসবের কোনো দাম নেই। হাই সোসাইটিতে এসব প্যাশনের দাম নেই। এরচেয়ে রুবাব অন্য কিছু করুক। ব্যাংকের চাকরি করুক কিংবা ব্যবসা করুক। এই একটা জায়গায় রুবাব হেরে যায়। নিজের প্যাশন কে ছাড়তে পারে না।
রুবাব এই কষ্ট কাটিয়ে উঠবে। এটা নতুন কোনো ঘটনা নয়, এটা যে ফেস করতে হবে সেটা আগে থেকেই জানতো।
রুবাব ফেসবুকে লগ ইন করলো। অসংখ্য নোটিফিকেশন, টেক্সটে ভরে গেছে। খুব আগ্রহ নিয়ে সেগুলো চেক করছিল। সেখানে হঠাৎ খেয়াল করলো ওর পোস্টে অনেক মানুষ একজন কে মেনশন করছে। তার নাম নাতাশা তাসনিম। রুবাব নাতাশার একাউন্ট টা ঘুরে এলো একবার। প্রোফাইল ঘুরে বাচ্চা মেয়েটার ছবি দেখলো শুধু। ভীষণ রাগ হলো ফাহাদের উপর। একই সঙ্গে ইকরার উপরও। একটা সম্পর্ক ভাঙা এতো সহজ ভাবে এরা! রক্তের সম্পর্কের কথাও ভাববে না একবার!
***
ঝিলিক নিজের জিনিসপত্র নিয়ে ইশরাকের ঘরে এলো। ইশরাকের মা বাবা দুজনেই এসেছে। ইশরাক কে তেমন কিছু বলে নি কিন্তু ঝিলিক কে বলেছে কিছু কথা। ঝিলিক কে ঘরে আসতে দেখে ইশরাক বলল,
“এতো ঝামেলা কী করার দরকার ছিলো তোর?”
“কী ঝামেলা করলাম? ”
“এই যে ঘরে আসার জন্য এতো নাটক করলি। বাবা, মা’কে পর্যন্ত আনলি।”
“নাটক করিনি। আমি আমার মা’কে বলেছি যে আমি আলাদা ঘরে ঘুমাই।”
ইশরাক কিছুসময় চুপ থেকে বলল,
“ঝিলিক এদিকে আয়। আমার কাছে এসে বস।”
ঝিলিক আসলো। বেশ স্নিগ্ধ লাগছে। পরনে সাদা টিশার্ট। চুলগুলো এলোমেলো করে বাঁধা। ইশরাক বলল,
“শোন তোর আর আমার এতো ঝগড়া কেন হয় জানিস? আমি কারো সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করি না, কিন্তু তোর সঙ্গে করি। এটার কিন্তু কারণ আছে। ”
“জানি। ”
“কী জানিস। ”
“আমি তো শুধু তোমার ই। এখন তুমি যা খুশি করতে পারো আমার সাথে, চাইলে থাপ্পড় মারতে পারো, জুতা দিয়ে মারতে পারো, আবার আদরও করতে পারো। ”
ইশরাক হেসে ফেলল। বলল,
“তোর মাথায় সত্যিই কিছু নেই?”
“তা তো জানিনা। মাথা খুলে দেখি নি। ”
ইশরাক মাথায় হাত দিয়ে বসে রইলো। হাসতে হাসতে বলল,
“তোর আর আমার একটা কারণেই কনফ্লিক্ট হয়। সেটা হলো মেন্টালিটি। আমি মানুষের সৌন্দর্য দেখে এট্রাক্ট হই না। আমাকে এট্রাক্ট করে পার্সোনালিটি। ”
ঝিলিক গম্ভীর গলায় বলল, আচ্ছা!
ইশরাক বিড়বিড় করে বলল,
“কাকে কী বলছি। তুই এসব বুঝবিও না। ”
“বুঝেছি খুব। ”
“কী বুঝেছিস বুঝা তো। ”
“আমরা মিসম্যাচ। ”
“এক্সাক্টলি। এটাই বুঝাতে চাইছি। ”
ঝিলিক শুয়ে পড়লো ইশরাকের গা ঘেঁষে। ইশরাক আজ সরে গেল না। ঝিলিক বলল,
“ডোন্ট ওরি। আমি তোমার জীবনে কাঁটা হয়ে থাকব না। ”
ইশরাক কৌতুক স্বরে বলল,
“যাবি কোথায়?’
“ইউনিভার্সিটি শেষ হলে জব করব। তারপর একটা বাসা নিয়ে চলে যাব। প্রতি শুক্রবার আসব সেজেগুজে তোমাকে দেখাতে। একা আসব না, একটা বয়ফ্রেন্ডও সাথে থাকবে। হিলে আওয়াজ তুলে ক্লিপ ক্লপ শব্দ তুলে যখন তোমার সামনে আসব তখন তোমার একটা হার্ট অ্যাটাক হবে। তারপর যখন আমার পারফিউমের গন্ধ পাবে তখন দ্বিতীয় টা হবে। আর যখন আরেকজনের হাত ধরব তখন তৃতীয় বার হার্ট অ্যাটাক হবে। ”
ইশরাক হাসতে হাসতে বলল,
“এতো হার্ট অ্যাটাক হবে! মরে যাব না। ”
“না। আমার বাচ্চাকাচ্চা হবে, দেশ বিদেশ ঘুরব। সেগুলো না দেখে মরবে না। ”
“আচ্ছা আচ্ছা! আর?”
ইশরাকের ভালো লাগছে ঝিলিকের কথাগুলো শুনতে। ঝিলিক বলল,
“এখন আমি ঘুমাব। গুড নাইট। তোমার স্বপ্নে যেন ঝিলিক আসে। ”
ইশরাক হাসলো আবারও। ঝিলিকের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। ঝিলিক বলল,
“আমিই পৃথিবীর একমাত্র মানুষ তোমার জীবনে। যে সিরিয়াস ম্যুডেও তোমাকে হাসাতে পারে। তোমার থাপ্পড় খেয়ে মুখের জিওগ্রাফি পাল্টাতে পারে। একদিন আসলে তুমি খুব মিস করবে আমাকে। খুব মিস করবে। ”
চলবে…..
সাবিকুন নাহার নিপা