হৃদয়ের দখিন দুয়ার পর্ব-২১+২২

0
416

#হৃদয়ের_দখিন_দুয়ার
#পর্ব-২১
নাতাশা আজ একটা নিষ্ঠুর কাজ করে ফেলল। এতো শান্ত, লক্ষী মেয়েটাকে থাপ্পড় মারলো। গালে আঙুলের দাগও পড়ে গেছে। নাতাশা নিজেও হতভম্ব হয়ে গেল। পালক এখন চিৎকার করে কাঁদছে। বেশ কিছুদিন ধরে পালক বাবা, দাদু এদের কথা বলছে। এই বাসায় অভ্যস্ত হতে পারছে না। বাচ্চাটা জন্মের পর থেকে যৌথ পরিবারে থেকে অভ্যস্ত, এখন একা ভালো লাগছে না এটাই স্বাভাবিক। তার উপর আটকা জায়গায় থাকে। খেলার সঙ্গীও কেউ নেই। সুপ্রীতি অনেক খেলনা কিনে দিয়ে গেছে, সেগুলো নেড়েচেড়ে রেখে দেয়। নাতাশার প্রচন্ড বুকে ব্যথা হয়। এতো ছোট একটা মেয়েকে ও কিভাবে বুঝাবে যে পাপা পাপা করে লাভ নেই। ওর পাপার কাছে এখন ওর গুরুত্বও নেই। তবুও বোঝানোর চেষ্টা করেছে বারবার। মেয়েটা জেদ দেখিয়ে খাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। নাতাশা আর রাগ নিয়ন্ত্রন করতে পারলো না।

পুরো দুপুর নাতাশা কাঁদলো। ফাহাদের বাড়ি ছাড়বার পর এইবার ই এতোটা কাঁদলো। এর আগের কোনো দু:খই এতোটা প্রবল লাগে নি। পালক কেঁদে কেটে ঘুমিয়ে পড়লো। নাতাশা না নিজে কিছু খেল, না মেয়েকে খাওয়ালো। ইচ্ছে করছে গলায় দড়ি দিয়ে মরে যেতে। তখন মেয়েটার আর কেউ থাকবে না, ভালোবেসে চোখের জল মুছিয়ে দেবার জন্য কেউ থাকবে না। আরেকটা নাতাশা হবে। ও তো পালক কে সেটা বানাতে চায় না।

নাতাশা অস্থির হয়ে সুপ্রীতিকে কল করলো। বলল,

“আমি আজ মেয়েটাকে মারলাম সুপ্রীতি। কিভাবে পারলাম! আমি বোধহয় জানোয়ার হয়ে যাচ্ছি। ”

ফোনের ওপাশে নাতাশার ব্যাকুল গলা শুনে সুপ্রীতি খানিকক্ষন চুপ করে রইলো। সম্পর্ক ভাঙার কষ্ট, যন্ত্রণা সবসময়ই কী একতরফা হয়! সবসময় ই মেয়েদের সহ্য করতে হয়! নাতাশাকে কিছু বলে যে সান্তনা দিবে সেটার ভাষাও খুঁজে পাচ্ছে না। দূর্বল গলায় বলল,

“সহ্য করো গো আপু। আল্লাহ যখন দিবেন তখন দুহাত ভরে দিবেন। ”

নাতাশা ফোন কানে চেপেই কাঁদলো। এতো কষ্ট, দু:খ সব কেন ওর জন্য বরাদ্ধ ছিলো। ও তো সবসময় এমন ভাবেই চলেছে যেন কোনো অভিযোগের সুযোগ না আসে। তবুও আজকের এই দিন।

অনেক অনেক দিন পর এমনই এক ভর দুপুরে একজন নাতাশার জন্য খুব কাঁদবে। আফসোস করে কাঁদবে, এতো ভালো ছিলো, অভিযোগ এর সুযোগ ছিলো না তবুও কেন তার মূল্য বুঝতে পারে নি সেই আফসোসে কাঁদবে। সেই গল্প আমরা যথাসময়ে জানব।

***
ফাহাদ এতো খুশি কখনো হয় নি জীবনে। এই জীবন ওর কাছে সুন্দর স্বপ্নের সমান। ইকরাকে নিয়ে দশদিনের হানিমুন সেড়ে এলো দার্জিলিং থেকে। এতো ভালো সময় কেটেছে ওর। ইকরা একটু ডিপ্রেসড ছিলো সব কিছু মিলিয়ে। ফাহাদ সামলে নিয়েছে স্মার্ট ভাবে। চাকরির ব্যবস্থা করে দিবে, ব্যবসায় ইনভেস্ট করবে এসব বলে আপাতত কিছুটা হলেও মন ভোলানো গেছে। সেই সাথে প্রচুর শপিং তো আছেই। ফাহাদের মন টা একটু খচখচ করছিল অনেকগুলো টাকার গচ্চা যাওয়ায় কিন্তু এটার দরকার ছিলো।

ফাহাদ বাবা, মায়ের কাছে না বাসা ভাড়া নিলো। ফাহাদের ইচ্ছে ছিলো মিরপুরে বাসা নেয়ার। কিন্তু ইকরার ইচ্ছে নেই। বাধ্য হয়ে ধানমন্ডিতেই নিতে হলো। বাসা ভাড়ার খরচ হিসেব করে ফাহাদের মুখ টা শুকিয়ে গেল আবারও। দুজনের জন্য তিন রুমের এই ফ্ল্যাটের কোনো দরকার ছিল না। কিন্তু ইকরার কঠিন সিদ্ধান্ত, দরকার আছে। একটা রুম ইউজ করা হবে ওর কাজের জন্য। ওর পার্সোনাল রুম হিসেবে। আরেকটা গেস্ট দের জন্য। ফাহাদ মেনে নিলো।

একদিন ইকরাকে নিয়ে ফাহাদ গেল বাবা, মায়ের কাছে। বাবা ভালো করে কথা তো বললেন না উল্টো বেরিয়ে গেলেন। ওরা যতক্ষণ ছিলো ততক্ষণে এলেনও না। মা প্রথমে মুখ ভার করলেও পরে সহজ হলেন। খুশি এসে মুখ ভার করেই রান্নাবান্না করলো। ইকরার ওখানে তেমন ভালো লাগে নি। ওই জায়গাটা একটু অন্যরকম। নিম্ন শ্রেণির মানুষের বাস ভেবে নিলো। নাহলে এইরকম কানাকানি তো এদিকে তেমন হয় না। ইকরা ফাহাদ কে বলল,

“আমি আর এখানে আসব না ফাহাদ। ”

ফাহাদ বোকার মতো প্রশ্ন করলো,

“কেন?”

“কারণ এখানে অনেক বেশী কথা চালাচালি হচ্ছে। আমাদের বিয়েটা ভালো ভাবে দেখছে না। সরি টু সে, আমি আর আদিখ্যেতা দেখাতে পারব না। তোমার বাবা মায়ের কথা মনে পড়লে তুমি এসো। ”

ফাহাদের হঠাৎ খেয়াল হয়। ইকরাকে পেয়ে একরকম ভুলতে বসেছিলো যে নাতাশা আর পালকের অস্তিত্বও ওর জীবনে ছিলো।

ইকরাকে ফাহাদের মা একটু তোয়াজ করলো। চলনে-বলনে তাঁর মনে হলো ইকরা পয়সাওয়ালা। এমন ছেলের বউকে একটু তো তোয়াজ করতেই হয়। কিন্তু ইকরার ভালো লাগলো না। এমনকি খুশিকে, আর ওর বাচ্চাদেরও ভালো লাগলো না। রুবাবের সাথে এই ঝামেলা টা ছিলো না। শ্বশুর বাড়ির উটকো ঝামেলা পোহাতে হয় নি। এখানে তেমন সম্ভাবনা আছে। ব্যপার টা দ্রুত হ্যান্ডেল করতে হবে ভাবলো।

***
“ভাবী তুমি ও’কে মারলা কেন?”

নাতাশা ক্লান্ত, বিধ্বস্ত থাকা সত্যেও তেজী গলায় বলল,

“আরেকবার ভাবী বলে ডাকলে তোমার গলা টিপে ধরব ঝিলিক। ”

ঝিলিকের একটুও খারাপ লাগলো না। ও পালক কে বুকে চেপে ধরে বসে আছে। আজ সকালে নাতাশা কল করে ও’কে বলেছে পারলে একবার এসো। আমার শেষ হয়ে যাওয়া দেখে যেও। খুব শান্তি পাবে।

ঝিলিক ছুটে এসেছে তখনই। ইশরাক কে জানানোও হয় নি। আসতেই পালক ঝাপিয়ে পড়লো ওর উপর। ঝিলিকের জামা খামচে ধরে মেয়েটা কেঁপে কেঁপে কাঁদছিলো।

ঝিলিক নাতাশার পাশে এসে শান্ত গলায় বলল,

“তুমি যখন আমাদের বাড়িতে এলে তখন আমার বয়স কতো ছিলো! এমনিতেই সবার আদরের ছিলাম। বাড়তি বায়না করতে গিয়ে বুঝলাম এই মানুষ টা আমাকে মাথায় তুলছে না, ভালোতে ভালো বলছে, খারাপ টাকে খারাপ বলছে। আমার মাঝেমধ্যে রাগ হতো। তবুও আব্দার করতাম, জোর করে অনেক কিছু আদায়ও করে নিতাম। তুমি কখনো কিছু বলতে না। আর এখন যখনই দেখা হয় তুমি কষ্ট দিতে চাও। তুমি কী জানো আমি এক ফোঁটা কষ্টও পাই না। কারণ তুমি এই ক’বছরে এতো ভালোবেসেছো যে এই কষ্ট কিছু মনেই হয় না। ”

নাতাশা শান্ত চোখে তাকালো। ঝিলিক ছলছল চোখে তাকিয়ে আছে। এক্ষুনি চোখ উপচে জল পড়বে। নাতাশা ঠান্ডা গলায় বলে,

“আমি বোকা ঝিলিক, কেন আমি বোকা ছিলাম সেটা ভেবেই কষ্ট হয়। কেন অপাত্রে ভালোবাসা দিয়েছি সেটা ভাবলে চুল ছিড়তে ইচ্ছে করে। আমার উচিত ছিলো তোমার মতো হওয়া। তাহলে জীবন এতো কঠিন হতো না।”

ঝিলিক জবাব দিলো না। আড়াল করে নিলো চোখের দৃষ্টি। না নিজের হয়ে কিছু বলার আছে, না নাতাশাকে কোনো সান্তনা বাক্য শোনানোর আছে।

ঝিলিক বলল,

“পালক কে নিয়ে একটু বেরোলে কী রাগ করবে?”

নাতাশা দূর্বল গলায় বলল,

“সাবধানে যেও। তাড়াতাড়ি এসো ঝিলিক। ওই একটা মাত্র অবলম্বন আছে আমার বেঁচে থাকার। ”

***
অসময়ে ফাহাদ ঝিলিকের কল পেয়ে একটু অস্থির হলো। ঝিলিক জানালো একটু সমস্যায় পড়েছে। দেখা করতে চায়। ফাহাদ জিজ্ঞেস করলো,

“কোথায় আসবি?”

“তোমার বাসায় আসি। তোমার বউ ঝামেলা করবে? ”

“নেগেটিভ কথা বলিস না। তোর সাথে তো দেখাই হয় নাই। না দেখে ইকরাকে জাজ করবি না। এমনি এমনি সে আমার মন জিতে নেয় নি। ”

“আচ্ছা। তাহলে বাসায় আসি? দেখে যাই?”

“আয়। ”

ফাহাদ অফিস থেকে বেরিয়ে ঝিলিকের পছন্দের চমচম, রসমালাই, দই ফুচকা নিলো। ইকরাকে বাড়তি ঝামেলা দিলো না, কারণ রান্নাবান্নায় ইকরার খুব অনিহা।

***
ইকরা জানে ঝিলিক আসবে। ঝিলিকের ছবি দেখেছে। মিষ্টি একটা বাচ্চা মেয়ে। ও যেমন খুশি হয় নি, তেমনি বেজারও হয় নি। ও’কে দেখতে আসবে শুনে আরেকটু পরিপাটি হয়ে নিলো। ঝিলিক এলো সন্ধ্যের আগে আগে। ফাহাদ দরজা খুলেই চমকে উঠলো। পালক ঝিলিকের কোলে। ঘুমিয়ে আছে। আসার আগে ঝিলিক ও’কে ঘুম পাড়িয়ে এনেছে। ফাহাদ এতোদিন পর মেয়েকে দেখে যতটা আবেগি হলো তারচেয়ে বেশী অপ্রস্তুত হলো ইকরার জন্য। ইকরার মুখ টা পাল্টে গেলেও সামলে নিয়ে ঝিলিক কে বলল,

“হ্যালো ঝিলিক। ফার্স্ট টাইম দেখা হলো। তোমার বিয়েতে ইনভাইটেড হবার পরও যেতে না পারার জন্য একটু সরি ফিল করছি। এবার বড় একটা গিফট দিয়ে পুষিয়ে দেব। ”

ঝিলিক ফাহাদের দিকে তাকিয়ে বলল,

“পালক কে কোলে নিলে রাতে তোমার বউ তোমার সাথে শুইবে না?”

ফাহাদ স্তব্ধ হয়ে গেল। একই সঙ্গে বাক্যহারা! এক ধমকে ঝিলিক কে শান্ত করা কোনো ব্যাপার ই না ওর জন্য। কিন্তু ও এখন স্পিচলেস। ঝিলিক একটু সাবধানে পালকের গাল টা দেখালো। বলল,

“মেয়েটা মায়ের কাছে মার খেয়েছে। কেন জানো? পাপার কাছে যাবে বলে। এদিকে তার পাপা একটা প্রস্টিটিউট কে বিয়ে করে খুশি আছে। ”

ফাহাদ এবার মেঘস্বরে ডাকলো,

“ঝিলিক…..!”

পালকের ঘুম ভেঙে গেল। ঘুম ঘুম চোখে এদিক ওদিক দেখছে। চোখের সামনে বাবাকে দেখে হাসলো বাচ্চাটা। অস্ফুটস্বরে ডাকলো, পাপা!

ইকরা নি:শ্বাস নিতে পারছে না। আড়ালে অপমান হলেও চোখের সামনে একটা বয়সে ছোট মেয়ে এভাবে অপমান করে যাচ্ছে! এরকম স্পর্ধা আর কেউ দেখায় নি কখনো। ইকরা কাঁপতে কাঁপতে মেঝেতে বসে পড়লো। ফাহাদ কে বলল,

“ফাহাদ ও এক্ষুনি বেরিয়ে না গেলে আমি পুলিশে কল করব। ”

ঝিলিক সামনে রাখা দইয়ের বক্স টা ছুড়ে মারলো ইকরার দিকে। ইকরা আর্তনাদ করে উঠলো। ফাহাদ একবার ইকরার দিকে তাকালো, আরেকবার ঝিলিকের দিকে। দ্বিধাদ্বন্দের এই সময় টুকুতে ঝিলিক আরেকটা অপ্রিয় কাজ করলো। অনেকখানি থু থু ইকরার গায়ে ছিটিয়ে দিয়ে বলল, কু*ত্তী মা****!

এরপর দ্রুত বেরিয়ে এসে লিফটে ঢুকে গেল। পুরো ব্যাপার টা পালক দেখলো। মেয়েটা এতোকিছু না বুঝলেও একটা ব্যাপার বুঝলো, ওর পাপা ও’কে কোলে নেয় নি, আদরও করে নি।

চলবে…..

#হৃদয়ের_দখিন_দুয়ার
#পর্ব-২২
ঝিলিক পালক কে নাতাশার কাছে রেখে বাসায় গেল না। রেস্টুরেন্টে বসে একা একা কফি খেল। বসুন্ধরায় গিয়ে শপিংমল গুলো ঘুরে সময় নষ্ট করলো। বাসায় গেল রাত এগারোটার দিকে। ইশরাক গেটে দাঁড়িয়ে ছিলো। ঝিলিক রিকশা থেকে নামতেই ছুটে এলো।

“কোথায় ছিলি তুই? কতোবার কল করেছি তোকে। কল ধরিস নি কেন?”

“ভাইয়া এসেছিল বাসায়?”

“হ্যাঁ এসেছিল। তোকে না মেরে যাবে না, কী করেছিস বল তো?”

ঝিলিক লিফটে ঢুকে বলল,

“সেই সকালে পাউরুটি আর ডিম খাওয়া হয়েছিল। তারপর আর কফি ছাড়া কিছু খাওয়া হয় নি। ”

ঘরে ঢুকে ঝিলিক ফ্রেশ হতে গেল। ইশরাক গেল রান্নাঘরে। খালা আজ আসে নি, আগের রান্না করা খাবার আছে বক্সে। বের করে ওভেনে দিলেই হবে। কিন্তু ইশরাক সেটা করলো না। ও ব্যস্ত হয়ে গেল ঝটপট কিছু একটা বানিয়ে দেবার জন্য।

ঝিলিক ডাল আর ডিম ভাজা দিয়ে ভাত খেল। খাওয়ার সময়ে ইশরাক শুধু ও’কেই দেখলো। ফাহাদ ভাই এসেছিল, তার রাগী চেহারা আর ভয়ংকর রুপ দেখে ও বুঝেছে যে পাগল মেয়েটা একটা কিছু ঘটিয়ে এসেছে। কিন্তু এতবড় ঘটনা যে ঘটিয়েছে সেটা ও অনুমান করতে পারে নি। ইশরাক পুরো ঘটনা ঝিলিকের মুখ থেকে শুনলো। বলল,

“ফাহাদ ভাই যদি আবার আসে?”

“আসুক। ”

“আসলে কী হবে বুঝতে পারছিস?”

“আমি দরজা খুলব না। ”

“তোর যে সত্যিই মাথায় সমস্যা জানিস?”

“কিছু করার নেই। দুনিয়াভর্তি এতো এতো ভালো মানুষের মধ্যে আমার মতো দুই একটা সমস্যাওয়ালা মানুষ থাকতে হয়। ”

ইশরাক গম্ভীর গলায় বলল,

“এটা অবশ্য একদিকে ভালো বলছিস। ”

ঝিলিক খাওয়া শেষ করলো। ইশরাক বলল,

“প্লেট রেখে দে। আমি ধুয়ে রাখব। ”

ঝিলিক প্লেট ধুয়ে রাখলো। ড্রেসিং টেবিলের কাছে এসে চুলগুলো খুলে ফেলল। গভীর গলায় বলল,

“আমি আসলেই তোমাদের মতো নই। হতে চাইও না। যা আমার ভালো লাগে তাই করি, যা খারাপ লাগে সেটা বলে দেই। কাঁদতে ইচ্ছে হলে কাঁদি, হাসতে ইচ্ছে করলে হাসি। আর যাদের ভালোবাসি সব টা দিয়ে ভালোবাসি। ”

ইশরাক কিছু বলল না। আজ ঝিলিকের উপর বিরক্ত লাগছে না। কথাগুলো শুনতেও ভালো লাগছে। সবাই ফোন করে ঝিলিকের পাগলামী সম্পর্কে বলেছে। আজ ই প্রথম ওর ঝিলিকের পাগলামী ভালো লাগলো।

***
ফাহাদ বসে আছে ইকরার মায়ের বাসায়। মায়ের বাসা না বলে ভাইয়ের বাসা বললে ভালো হয়। ইকরার ভাইয়ের ঠিকাদারির ব্যবসা। গেটাপ আর হাবভাবে মনে হচ্ছে বিশাল কোনো ইন্ড্রাস্ট্রির মালিক। ফাহাদের সঙ্গে ভালো করে কথা পর্যন্ত বলে নি। বসার রুমে ঘন্টাখানেক বসার পর এক কাপ চায়ের সঙ্গে কিছু কুকিজ এলো। এই মুহুর্তে ফাহাদের এমন অবস্থা যে অপমান গায়ে মাখার মতো অবস্থা নেই। ইকরা সেদিন সন্ধ্যায় বেরিয়ে এসেছে। এরপর আর ফোন ধরছে না। ফাহাদ আজ দিশেহারা হয়ে আসছে। কিন্তু ইকরা দেখা করবে না বলে জানিয়েছে।

ইকরার মা এলো। বয়স ষাটের কাছাকাছি। মহিলাকে দেখে বোঝা যাচ্ছে বিরক্ত। ফাহাদ তার পায়ে হাত দিয়ে সালাম করলো। উনি সম্ভবত তাতেও বিরক্ত হয়েছেন। উনি বললেন,

“বিয়ে করলা নিজেরা, এরমধ্যে সমস্যা পাকাইলা! তোমার বাড়ির লোকের সমস্যা তাইলে তারা আসে ক্যান? ”

ফাহাদ ইতস্তত গলায় বলল,

“জি আসবে না আর। আমি এরপর কেয়ারফুল থাকব। ইকরাকে বলুন প্লিজ একবার যেন আসে। ”

“এতো ব্যস্ত হবার কিছু নাই। ইকরা তো যাবেই। এখানে ওরে রাখবেও না। তিন ভাইয়ের এক বোন। জীবনে এক কাপ চা বানাতেও দেই নি। হাতে হাতে রেখে পালছি। অথচ সুযোগ পেয়ে বংশের নাম ডুবাইছে। ”

ফাহাদ আরও অপ্রস্তুত হলো। ইকরার ভাই এবার মায়ের উদ্দেশ্যে বলল,

“বা*লের প্যাচাল বাদ দাও মা। রুবাব কেরানীগঞ্জ জমি কিনছে। টাকা না থাকলে জমি কোত্থেকে কিনছে। আর রুবাব কে ছেড়ে কোন কোটিপতিরে ধরছে। ”

ফাহাদ কিছু বলল না। এখান থেকে বেরিয়ে যাবার উপায়ও নেই। ইকরাকে যে করে হোক নিয়ে যেতে হবে। তারপর সব সম্পর্ক বাদ। বাপ, মা, ভাই, বোন সব। হাত ধুয়ে পিছনে লেগে পড়েছে সবাই। নাতাশাকে তিন লাখ টাকা দেয়া হইছে। বাকীটা দুই মাস পর দেয়ার কথা ছিলো সেটাও আর দিবে না। ঝিলিক কে নাতাশা পাঠিয়েছে না! ও’কে এর পরিনাম তো ভুগতে হবে। আর একটা টাকাও দিবে না, কিছু দিবে না।

***
“আমার আসলে বিশ্বাস হচ্ছে না যে সত্যিই আমাদের বিয়ের এতগুলো মাস হয়ে গেছে। মনে হয়, এই তো সেদিন গোলাপি টুকটুকে বউ নিয়ে বাড়ি ফিরলাম। ”

সুপ্রীতি হেসে ফেলল। বলল,

“লাল আমার অপছন্দের রঙ অর্ণব। ”

“আমার পছন্দের রঙ। এটুকু জোর কিন্তু করব। সব কিছুতে লাল দেখতে চাই একদিন। ”

সুপ্রীতি হাসলো। অর্ণবের মুগ্ধ দৃষ্টি। সুপ্রীতির এই হাসিটা সুন্দর। শব্দ হয় না, নি:শব্দ প্রানখোলা হাসি। কলেজে পড়ার সময় একটা মেয়েকে অর্ণবের ভালো লেগেছিল। মেয়েটার নাম ছিলো শান্তা। বিকট শব্দে হাসতো। আড্ডা হলে এমন জোরে হাসতো যে সবাই আঁতকে উঠতো। তবুও সেই হাসি অর্ণবের ভালো লাগতো। শুধু হাসির কারণে সেই মেয়েটার প্রতি একটা প্রেম প্রেম ভাব হয়েছিল। একদিন অর্ণব বলেও ছিলো। মেয়েটা বলল তোর স্টাবলিশড হতে হতে আমি বুড়ি হয়ে যাব। ততদিন অপেক্ষা করলে সব শেষ হয়ে যাবে। ব্যস সেই ঘটনার পর আর ভালোই লাগলো না অর্ণবের। তবুও সেই হাসিটা কখনো খারাপ লাগে নি।

“তুমি কী ভাবছ অর্ণব?”

অর্ণব হেসে বলল, একটা কিছু ভাবছিলাম। বললে ভাববে হয়তো কোনো সস্তা সিনেমার ডায়লগ দিচ্ছি।

“তাহলে তো অবশ্যই বলবে। এতো সিরিয়াস একজন মানুষ সে এরকম কিছু ভাবছে আমি শুনতে চাই। ”

অর্ণব গভীর গলায় বলল, তোমার মতো কেউ নেই। যত মানুষ দেখেছি তাদের কারোর সাথে তোমার মিল নেই। সম্ভবত এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড খুঁজলেও তোমার মতো কাউকে আর পাওয়া যাবে না।

সুপ্রীতি হাসলো। মনে মনে ভাবলো, কই ডায়লগ টা তো সস্তা না। মনে হলো কিছু বাক্য দিয়ে কেউ ও’কে স্পেশাল ফিল করিয়েছে।

অর্ণব সুপ্রীতির চুলগুলো নিয়ে খেলছিল। এটা ওর অন্যতম প্রিয় কাজ।

“সুপ্রীতি, চলো আমরা এনিভার্সারি দেশের বাইরে কোথাও করি। সময় আছে তো যথেষ্ট। প্ল্যান করে ফেলি। ”

সুপ্রীতি স্মিত হাসলো। বলল,

“এবারে যাওয়া ঠিক হবে না। পরেরবার যাব, আমরা তিনজন। ”

****
রুবাব চোখের ইশারায় পালকের সাথে কথা বলছে। মুখ হাসিহাসি, ভ্রু নাচাচ্ছে বারবার। পালক প্রথমে গম্ভীর মুখে থাকলেও পরে মিষ্টি করে হাসলো। রুবাব ওর দিকে তাকিয়ে হাত নাড়লো। পালক লজ্জা পেয়ে অন্যদিকে তাকালো। যাবার সময় ওর হাতে একটা চকলেট ধরিয়ে দিয়ে গেল।

নাতাশা পালক কে নিয়ে এখন প্রতিদিন ই বের হয়। পার্কে যায়, ওখানে গেলে পালক খুব স্বতস্ফুর্ত থাকে। আজ পার্ক থেকে ফেরার সময় স্বপ্নতে গেল কিছু গ্রোসারি আইটেম কেনার জন্য। পালকের হাতে চকলেট দেখে প্রতিক্রিয়া দেখালো না। ভেবেছে শপ থেকে নিয়েছে। বিল পে করতে গিয়ে জানতে পারলো পেমেন্ট করা। নাতাশা মেয়েকে জিজ্ঞেস করলো,

“চকলেট কে দিলো সোনা?”

পালক হেসে বলল, আনতেল।

নাতাশা এদিক ওদিক তাকালো। ওর পরিচিত কেউ হলে তো ওর সঙ্গে কথা বলে যেত। অপরিচিত কেউ ই বা কেন দিয়ে গেল।

***
রুবাব দূর থেকে নাতাশাকে দেখলো। হঠাৎই দেখা, পার্কে এসেছিল একজনের সঙ্গে। সেখানে চোখে পড়লো। বাচ্চাটা এতো মিষ্টি যে একটু দুষ্টুমি করতে ইচ্ছে করলো। নাতাশাকে পূর্ণ দৃষ্টিতে দেখলো এবার। চুলগুলো বিনুনি করে রাখা, শীত বলে গায়ে একটা চাদরও চাপানো। টিপিক্যাল সাধারণ মেয়েরা যেমন হয়। যাদের দেখলেই মনে একটা প্রশান্তি আসে। এদের আলাদা করে জানতে হয় না, চোখে মুখেই যেন লেখা থাকে এরা পিওর সোল, অনেস্টিতে ভরপুর। এদের সঙ্গে প্রতারণা করা যায় না। তবুও এরা প্রতারিত হয়।

চলবে…..

সাবিকুন নাহার নিপা