হৃদয়ের দখিন দুয়ার পর্ব-২৫

0
350

#হৃদয়ের_দখিন_দুয়ার
#পর্ব-২৫
বেশ কয়েকটা অফিসে সিভি ড্রপ করেছে ইকরা। কিছু জায়গা থেকে পজিটিভ রেনপন্ড করেছে, কিন্তু স্যালারি যেটা বলছে সেটা মানানসই না। তারচেয়ে বড় কথা হলো ইন্টারভিউ টেবিলে প্রত্যেকবার ই একই প্রশ্ন আগের অফিস কেন ছাড়তে হয়েছে। এই প্রশ্নের উত্তর নিজের মতো করে যা দেয় সেটা ওদের কাছে বিশ্বাসযোগ্য মনে হয় না। বিজনেসে লসের পরিমাণ টাও চোখে লাগার মতো। পেজে যা কিছু পোস্ট করে সেখানে হা হা রিয়েকশনের বন্যা বয়ে যায়। সেই সঙ্গে অকথ্য ভাষায় গালাগালি। একদিন লাইভে প্রোডাক্ট নিয়ে কথা বলতে গিয়েছিল কিন্তু দশ মিনিটের মধ্যে লাইভ বন্ধ করে দিতে হলো। এতো আজেবাজে ভাষা ব্যবহার করেছে ওর জন্য!

ইকরা চাইলেও এই ব্যাপার গুলো এড়াতে পারছে না। মাথার মধ্যে একটা ব্যাপার ই ঘোরে। কতো ভালো একটা ক্যারিয়ার ছিলো ওর! রুবাব ওর লাইফ টা হেল করে দিয়েছে। ইকরার ক্লোজ ফ্রেন্ড আছে সিলভি। সিলভি বলেছে এখন কিছুদিন সব বাদ দে। মানুষ যখন সব ভুলে যাবে তখন আবার সব শুরু করিস। ইকরার এই কথাটা মন:পুত হলো না। ও এসব ভেবে ভেবে আরও বেশী ডিপ্রেসড হচ্ছে। যার প্রভাব অনেকটা পড়ছে ফাহাদের উপর। এতো দিন যে সুইট, কিউট ইকরাকে ফাহাদ দেখেছে এখন তার মেজাজ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে। একদিন রাতে এসে বলল,

“ইকরা আজ কয়েকটা ভর্তা কোরো তো। আলু, ডাল আর তুমি যেটা ভালো পারো। বেশ কিছু দিন ধরে পাস্তা টাস্তা খেয়ে মুখ পঁচে যাচ্ছে। ”

ইকরা রান্নাবান্না তেমন পারে না। ফ্রায়েড রাইস, পাস্তা, নুডলস, চিকেন, বিফ ভুনা এগুলো পারে। রুবাবের সঙ্গে থাকাকালীন সময়ে ও’কে রান্না খাওয়া নিয়ে কখনো ভাবতে হয় নি। এই একটা ব্যাপারে ওর মনে হয় রুবাব ভালো ছিলো। সব নিজে করে খেত। হোক সেটা বিরিয়ানি আর আলুভাজি। কখনো ইকরাকে অর্ডার করতো না। ইকরা ভর্তা বানাতে পারে না এই দূর্বলতা ফাহাদের কাছে প্রকাশ করলো না। রাগী গলায় বলল,

“সরি, আমি এসব খাই না। যে জিনিস আমি খাই না সেসব জিনিস তোমাকে বানিয়ে খাওয়াতে পারব না। প্লিজ মিডল ক্লাস সেন্টিমেন্ট থেকে বেরিয়ে আসো। ”

ফাহাদের ভ্রু কুঞ্চিত হয়। চকোরিয়ার একটা হোটেলে ইকরা কাঁচ কলার ভর্তা, টাকি মাছের ভর্তা খেয়ে ইয়ামি বলেছে এখনো ওর মনে আছে।

ফাহাদ আর তর্কে গেল না। ভাতের সাথে আলু সেদ্ধ করে নিলো। ডাল ফুটিয়ে নিলো। কাঁচা পেয়াজ আর কাঁচা মরিচ দিয়ে আলু মেখে নিলো। ঘরে সরিষার তেল কিংবা আচারের তেল ছিলো না বলে ভর্তাটা বাড়ির স্বাধের মতো হলো না। ডালেও হলুদ, লবনের পরিমাণ বেশী হয়েছে। অর্ধেক টা ভাত খেয়ে যখন বেডরুমে গেল তখন দেখলো ইকরা পায়ের উপর পা তুলে ফোন দেখছে। একটু আগে চিকেন ফ্রাই খেয়েছে। ফাহাদ কিছুতেই মেজাজ নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। রুক্ষ গলায় বলল,

“ইকরা একটু রান্না তো করতেই পারো। যখন অফিস থাকবে তখনকার ব্যাপার আলাদা। ”

“আমি আগেও রান্না করতাম না। আমার ভালো লাগে না। ”

“এভাবে কতদিন? বুয়ার রান্না আমি খেতে পারি না। ওদের উপর ভরসা হয় না। টেস্ট নিয়েও কিছু বলার নেই। ”

ইকরা ফোনে চোখ রেখে বলল,

“সরি ফাহাদ। নাতাশা টাইপ কিছু তুমি আমার থেকে এক্সপেক্ট করবে না প্লিজ। ”

***
ইশরাক আজ ঝিলিক কে নিয়ে নাতাশার কাছে এলো। আরও আগে আসবে আসবে করেও সময় বের করতে পারছিল না। নাতাশা খুশিই হলো। একা থাকছে, কাছের কেউ এলেও ভালো লাগে। যতই ফাহাদের সঙ্গে সম্পর্ক চুকেবুকে যাক, পালকের জন্য হলেও এদের মধ্যে কেউ কেউ চিরকাল হয়তো ওর কাছের ই থেকে যাবে। ঝিলিক পালক কে নিয়ে বেরোলো। নাতাশা রান্নার আয়োজন করছে। ইশরাক দুই ব্যাগ ভর্তি করে বাজার এনেছে। ইশরাক চা খেতে খেতে টিভি দেখছিল। নাতাশাকে ডেকে বলল,

“ভাবী, এরপর ঝিলিক কখনো পালক কে নিয়ে বেরোতে চাইলে ভালো করে জিজ্ঞেস করবে যে কোথায় যাচ্ছে। ”

“কেন বলো তো?”

ইশরাক সেদিনের কথা বলল। ফাহাদ কী করেছে, ঝিলিকের বাড়ি যাওয়া বন্ধ হয়ে গেছে সবকিছু শুনে নাতাশা বিস্মিত হয়ে গেল। ঝিলিক অনেক কিছু করতে পারে ঠিকই কিন্তু এরকম কিছু আশা করে নি। ইশরাক হেসে বলল,

“কী মারাত্মক মেয়ে তাই না? যাদের ভালোবাসে তাদের জন্য মনে হয় জীবনও দিয়ে দিতে পারবে। ”

নাতাশা খেয়াল করেছে সেদিনের পর পালক পাপার কথা আর জিজ্ঞেস করে নি। ছোট্ট মেয়েটা কী দেখেছে আর কী বুঝেছে আল্লাহ জানে। নাতাশার বুক ভারী হয়ে এলো। আল্লাহ এই অবুঝ মেয়েটাকে অনেক ধৈর্য্য দিক।

নাতাশা খেয়াল করলো ঝিলিক আগের চেয়ে হাসিখুশি। ইশরাকও স্বতঃস্ফূর্ত। ইশরাক এই প্রথম সুপ্রীতিকে নিয়ে কোনো কথা বলল না। অবশ্য ভালো হয়েছে। সুপ্রীতি ওর জীবনের সবচেয়ে সুখের সময় কাটাচ্ছে। কাল রাত তিন টায় কল করে নাতাশাকে জিজ্ঞেস করলো, আপু বাবু এখনো লাত্থি মারা শুরু করছে না কেন? কতদিন পর টের পাওয়া যাবে। অথচ মেয়েটা শরীর খারাপ এর জন্য কিছু খেতে পারে না। তবুও কী আনন্দ নিয়ে বাঁচছে। বিয়ে মানে সত্যিই জীবনের অন্যরকম এক পরিবর্তন। কারোর হয় ভালো পরিবর্তন, কারোর খারাপ। আবার কারোর হয় ভালো খারাপের মাঝামাঝি। সুপ্রীতির হয়েছে অনেক ভালো। নাতাশার ভয় হয়, আবার নজর না লাগে কারোর। আজ ইশরাক কে একা পেয়ে একবার জিজ্ঞেস করতে চেয়েছিলো যে তুমি কী সুপ্রীতির ক্ষতি চাও? তারপর সেই ভাবনা বদলালো। এক অদম্য কৌতূহল ওরও আছে। জানতে ইচ্ছা করে কে ওই ছবিগুলো পাঠিয়েছিল অর্ণব কে। অর্ণব বুদ্ধিমান বিচক্ষন বলে কী সুন্দর সামলে নিয়েছে। মেরুদন্ডহীন কেউ হলেই তো সুপ্রীতির জীবন নরক হয়ে যেত। নাতাশার সিমে একবার আননোউন নাম্বার থেকে রাতে কল আসা শুরু করেছিল। পালকের তখন জন্ম হয় নি। ফাহাদ যে কী অশান্তি করেছিল। কী মানসিক টর্চার। নাতাশা এখন বুঝতে পারে, যার মনে আবর্জনা থাকে সে তো অন্যকে তেমন ই ভাববে।

ঝিলিক কে আড়ালে ডেকে নাতাশা জিজ্ঞেস করলো,

“তোমাদের মধ্যে সব ঠিকঠাক এখন। ”

ঝিলিক লাজুক হাসলো। নাতাশার ভালো লাগলো। আজ এই মুহুর্ত থেকে ও ঝিলিকের জন্য ভালো চাইবে। হতাশা, ঘৃনা থেকে ফাহাদের পরিবারের সবার প্রতি যে বিতৃষ্ণা ওর মনে ছিলো তার জন্য ও বিন্দুমাত্র লজ্জিত ছিলো না। ও ওই পরিবারের জন্য অনেক করেছে, অনেক সয়েছে। কখনো মুখের উপর কিছু বলে নি। কিন্তু যখন ওর দু:সময় এলো তখন সেভাবে কেউ পাশে ছিলো না। যেটুকু পাশে ছিলো, সেটা একরকম না থাকার মতো। এরচেয়ে বেশী তাদের করা উচিত ছিলো। নাতাশা ঝিলিক কে আবারও বলল,

“একটা কথা বলব যদি মন খারাপ না করো। ”

“বলো ভাবী, তোমার সঙ্গে আবার কিসের মন খারাপ? ”

“তুমি ভালো ঝিলিক, অনেক ভালো। তোমার জীবন কে নিয়ে যে ভাবনা সেটাও খারাপ না। শুধু আরেকটু ম্যাচিউর হও। ভালোবেসে নি:স্ব হয়ে যেও না। ”

ঝিলিক হাসলো। বলল,

“সুপ্রীতির মতো হতে বলছ?”

“সুপ্রীতিকে ঘৃনা কোরো না ঝিলিক। ও তোমাদের খারাপ চায় না। ইশরাকের প্রতি এখন ওর কোনো অভিযোগ, অভিমান নেই। অভিমান, অভিযোগ সেখানে থাকে যেখানে আমাদের এক্সপেক্টেশন থাকে। ওর সবচেয়ে ভালো আর স্মার্ট ব্যাপার কী জানো, আগের সবকিছু ও ভুলে গেছে। ব্যাপার টা অনেক কঠিন। কতটা কঠিন সেটা আমি বুঝি। একটা ব্যাপার শোনো, সেদিন রাত বারোটা নাগাদ পাশের ফ্ল্যাটে কলিংবেল বাজলো, আমার ঘুম ভাঙলো। পালক জড়িয়ে ধরে ছিলো। ঘুম ঘুম গলায় মেয়েকে বললাম, সোনা পাপা আসছে, পাপাকে খাবার দিয়ে আসি। আমি এরপর রান্নাঘরে এসে চাল ধুয়ে ভাত চড়িয়ে দিলাম। এতক্ষণ সময়ে আমার একবারও খেয়াল হলো না যে আমি কোথায় আছি এখন। এখন আর তোমাদের বাড়িতে নেই। এখন আমি পুরোপুরি নি:স্ব। ”

ঝিলিক নি:শব্দে কাঁদছে। পরম মমতায় নাতাশাকে জড়িয়ে ধরলো। নাতাশা স্মিত হেসে বলল,

“সুপ্রীতিকে কখনো ঘৃনা কোরো না ঝিলিক। আর এমন কিছুও কোরো না যাতে ওর ক্ষতি হয়। ”

ঝিলিক ভেজা গলায় বলল,

“ভাবী ভয় পেও না। তুমিই তো বললে আমি ভালো মেয়ে, তোমার বোনের ক্ষতি আমি করব না। আমিও চাই সে ভালো থাকুক। ”

চলবে….

সাবিকুন নাহার নিপা