হৃদয়ের দখিন দুয়ার পর্ব-২৯

0
362

#হৃদয়ের_দখিন_দুয়ার
#পর্ব-২৯
ঘুরে আসার পর নাতাশা একদিন ইশরাক কে কল করে বলল ওর কাছে যেন একবার আসে। খুব গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে। ঝিলিক কে যেন সঙ্গে না আনে। ইশরাক বুঝতে পারে নাতাশা কোন প্রসঙ্গে কথা বলতে চায়। কিন্তু এখন এই সময়ে কেন এই প্রসঙ্গে কথা বলতে চায়! সময় অনেক টা গড়িয়ে গেছে। ইশরাক মুভ অন করেছে। সুপ্রীতির পিছুটান নেই বললেই চলে। কোনো আশাও নেই। মনে মনে নাতাশার প্রতি আক্ষেপ থাকলেও একদিন অফিস শেষ করে ইশরাক গেল নাতাশার কাছে। নাতাশা স্বাভাবিক গলায় জিজ্ঞেস করলো,

“কী খাবে ইশরাক? তোমাকে দেখে অনেক ক্লান্ত লাগছে। ”

“ক্লান্ত না ভাবী। একটু আপসেট। ”

“আপসেট কেন? ঝিলিক তো দেখলাম ফেসবুকে অনেক ছবি দিলো। খুশিই লাগছিল দুজন কে। ”

ইশরাক হেসে বলল,

“ঝিলিকের সঙ্গে সব ঠিক আছে। আপসেট তোমার জন্য। ঝিলিক কে সঙ্গে না নিয়ে আসতে বলেছ কেন সেটা আমি আন্দাজ করতে পারছি। কিন্তু ভাবী কী এমন হলো যে আমাকে এই টপিকে কথা বলার জন্য ডেকেছ? তোমার কী মনে আছে কতবার তোমাকে আমি রিকোয়েস্ট করেছিলাম? ”

“আমি আসলে অনেকটা বাধ্য হয়ে ডেকেছি ইশরাক। প্রশ্নটা করতেও অস্বস্তি হচ্ছে…. ”

ইশরাকের ভ্রু কুঞ্চিত হলো। নাতাশা একটু সময় নিয়ে বলল,

“অর্ণব কে কেউ তোমার আর সুপ্রীতির ছবি পাঠাচ্ছে। লাগাতার ছবিগুলো পাঠানো হচ্ছে। গ্রুপ ট্যুরের ছবি, তোমার জন্মদিনে তোলা ছবি। ”

ইশরাক বিস্মিত হলো। কাতর গলায় বলল,

“ভাবী বিশ্বাস করো, আমি এতোটা নিচেও নামিনি। আমি জানি তুমি আমাকে বিশ্বাস করবে না…! ”

ইশরাক উঠে পায়চারি শুরু করলো। অস্থির হয়ে চুল খামচে ধরলো। নাতাশা ইশরাক কে শান্ত করার জন্য বলল,

“আমি তোমাকে বিশ্বাস করি ইশরাক। বিশ্বাস করি বলেই এই কথাটা তোমাকে এতদিন বলিনি। না পেরে জিজ্ঞেস করছি ইশরাক। এমন তো নয় তোমার কাছ থেকে ছবিগুলো সংগ্রহ করে ঝিলিক এরকম কিছু করছে। ”

ইশরাক স্তব্ধ হয়ে বসে পড়লো। নাতাশা আবারও বলল,

“ঝিলিক কে আমি খারাপ জানিনা ইশরাক। কিন্তু ও এখনো অনেকটা বাচ্চা। এমনকি হতে পারে তোমাদের ঝগড়া, মনোমালিন্য থেকে ও এই বাচ্চামি করছে। ”

ইশরাক জবাব দিলো না। ওদের সম্পর্ক স্রেফ বন্ধু, শুভাকাঙ্ক্ষীরাই জানতো। ফেসবুকে দেখানোর মতো দু:সাহস ওদের ছিলো না। তাছাড়া দুজনে মিলে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে সম্পর্ক টা প্রাইভেট রাখবে। সব ছবি, সব মেমোরি ইশরাকের কাছে আছে। প্রকৃতি যেদিন এসেছিল সেদিন বলেছিল সব ডিলিট করে দিতে। ইশরাক খানিকটা ঝাঝালো স্বরে বলেছিল, এটা তো আমার চয়েজ যে আমি রাখব নাকি ডিলিট করব। যে সময়ে আমি সুপ্রীতির সঙ্গে ছিলাম সেই সময়ে আমিও আমার ইমোশন ইনভেস্ট করেছিলাম। এখন সেই সময়ের স্মৃতি আকঁড়ে রাখব নাকি ডিলিট করব সেটা আমার পারসোনাল চয়েজ। তবে শিওর থাকো যে ওর ম্যারিড লাইফে আমি কখনো ঝামেলা করব না। আমি টিপিক্যাল লুজার না।

অস্বীকার করতে পারবে না যে ওদের ভালো কিছু সময় ছিলো না। সব ছবি, টেক্সট এখনো আছে। কিন্তু সেগুলো আর্কাইভ করা। যেহেতু ঝিলিকের এই চাপ্টার টা অজানা নয় তাই প্রাইভেসি মেইনটেইন করার দরকার হয় নি।

ইশরাক স্বাভাবিক গলায় বলল,

“আমি ঝিলিকের সাথে কথা বলব ভাবী। ”

“ইশরাক, যা কিছু করবে কৌশলে করবে। আমি আমার সন্দেহ প্রকাশ করলাম। তুমি এটাকে সত্যি ভেবে কোনো একশন নিও না। হতে পারে তুমি আমি ভুল। তোমার আর সুপ্রীতির কোনো অচেনা শত্রুও থাকতে পারে। যে বন্ধু সেজে ছিলো। আমি এই ব্যাপার টা তোমার উপর ছাড়লাম। ”

“আচ্ছা। ”

নাতাশা ইশরাকের মনের অবস্থা বুঝতে পারলো। ও পড়েছে গ্যারাকলে। কাউকে কষ্ট দিতে চায় না। সুপ্রীতির শরীর খারাপ হয়ে গেছে এসব ভেবে। কতো ভালো একটা সময় ওর জীবনে এখন। অথচ প্রতিনিয়ত থাকছে ভয়ে ভয়ে।

“ইশরাক তোমাকে একটা কথা বলি, তুমিও জীবন টা’কে গুছিয়ে নিয়েছো। সুপ্রীতিও অনেক টা এগিয়ে গেছে জীবনে। ওর জীবনের আরেকটা সুন্দর অধ্যায় শুরু হতে যাচ্ছে। চমৎকার একজন স্বামী ও পেয়েছে ঠিকই। তবুও একটা ভয়, আতঙ্ক সারাক্ষণ ও’কে অস্থির করে বেড়ায়। তুমি আমার ব্যাপার টা বুঝতে পারছ তো ভাই? তোমাকে কষ্ট দেয়া আমার উদ্দেশ্য না। ”

ইশরাক এবার বেশী অবাক হলো। বলল,

“ভাবী বিশ্বাস করো, সুপ্রীতির প্রতি আমার অভিমান আছে। আমি একবার ওর মুখ থেকে আমার দোষ টা শুনতে চেয়েছিলাম। শুরুতে এটাও ভেবেছিলাম যে ওর মায়ের চাপে ও বিয়েটা করেছে। যোগাযোগ করে এই ব্যাপার টা কনফার্ম হতে চেয়েছিলাম। এমনকি ঝিলিক কে বিয়ে করার আগ পর্যন্ত ভেবেছি সুপ্রীতি চাইলে আমার কাছে ফিরে আসুক। একটা অপরাধবোধ আমারও ছিলো। ”

নাতাশা আর কিছু বলল না। সেদিন ইশরাক একরাশ মন খারাপ নিয়েই ফিরলো। প্রাক্তন মানে তাকে ঘৃনা করতে হবে ব্যাপার টা তেমন নয়। এক বুক অভিমান সুপ্রীতির জন্য ওর আছে। সুপ্রীতিকে মনে মনে অসংখ্যবার স্বার্থপরও বলেছে। কিন্তু ক্ষতি কখনো চায় না। বরং ও মন কে প্রবোধ দেয় যদি কখনো অচেনা ভীড়ে এককালের চেনা মানুষটার সঙ্গে দেখা হয়ে যায় সেদিন যেন ও মন থেকে শ্রদ্ধা, সম্মান জানাতে পারে।

***
সুপ্রীতি বসে আছে বারান্দায়। ইদানীং অদ্ভুত এক সমস্যা হয়েছে। রাতে ঘুম হয় না একদম। খাওয়া দাওয়ার সমস্যা তো আছেই। যে চিংড়ি মাছ ওর কোনো সময়ে ভালো লাগতো না এখন সেটা অমৃত লাগে। মাংস কষানোর গন্ধ পেলে আগে চোখের সামনে গরম এক প্লেট ভাত ভেসে উঠতো। এখন সেই গন্ধে বমি আসে। ডালের ফোড়নের সময় নাক চেপে বসে থাকে। কতো কঠিন এই মা হবার জার্নি। যে আসছে তাকে আনতে কতকিছু সহ্য করতে হচ্ছে। কতকিছু ত্যাগ করতে হচ্ছে।

সুপ্রীতির মাঝেমধ্যে ভীষণ খারাপ লাগে নিজের মায়ের জন্য। মায়ের প্রথম সন্তান ও। অথচ চিরকাল ই মনে হয়েছে ওর জন্য মায়ের মায়া সবচেয়ে কম। ছোটবেলায় মায়ের হাতে মার সবাই খায়। ওর বয়সী রুপম কেও মা মারতো, তারপর আদর করতো। এরকম ই তো হয়। মা মারবে, শাসন করবে, বকবে তারপর আবার বুকে জড়িয়ে ধরে সব অভিমান পুষিয়ে দিবে। সুপ্রীতি দেখেছে অন্যরকম এক মা’কে। যে মনে করে পৃথিবীতে সে একমাত্র ঠিক। তার মেয়েকেও হতে হবে তার মনের মতো। নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধে কিছু করলেই সে ভয়ংকর হয়ে যেত।

সবকিছুতে পারফেক্ট বানাতে গিয়ে তিনি মেয়ের শৈশব, কৈশোরের কনফিডেন্স নষ্ট করে দিলেন। ম্যাথে পঁচানব্বই পেয়েও যে মেয়ে মায়ের হাতে মার খেয়ে ঠোঁট কেটে ফেলে সে পরেরবার ম্যাথ পরীক্ষায় পারা অংকটাও ভুল করে আসে। চমৎকার গানের গলা যে মেয়েটার সেই মেয়ে ফাইনাল পরীক্ষার দুই মাস আগে কাজিনদের আড্ডায় গান গাওয়ার জন্য অকথ্য গালাগাল শুনে সব সুর ভুলে যায়।

পরিবারের মানুষের হ্যাঁ তে হ্যাঁ বলা মেয়েটাও একসময় বেপরোয়া হতে চায়৷ সুপ্রীতিও চেয়েছিল তাই। ভার্সিটির ভর্তি পরীক্ষাগুলো স্কিপ করে বেপরোয়া হবার প্রথম পদক্ষেপ শুরু হয় ওর। মেয়ের প্রচন্ডরকম মাথাব্যথার অসুখের সামনে এবার মা হেরে যান। ডাক্তার, পেইন কিলার কিছুতে কাজ হয় না। হবে কী করে! মা তো জানেন না যে মেয়ে এক অঘোষিত লড়াইয়ে নেমেছে। এই লড়াইয়ে জেতার জন্য সে মরিয়া হয়ে আছে।

সুপ্রীতি সবচেয়ে বেশী বেপরোয়া হলো প্রেমে পড়ে। এমনিতেই কথায় আছে প্রেমে পড়লে মানুষ হিতাহিত জ্ঞান ভুলে যায়। ও চেয়েছিল ওর জীবনের সবকিছু জুড়ে ইশরাক থাকুক। যে জীবন, যে পৃথিবীতে ও বাস করে সেই জীবনের বাইরে একটা চমৎকার জীবন ইশরাকের সঙ্গে হোক। শুধু ইশরাকের সঙ্গে। ইশরাক ওর সেই স্বপ্নকে অস্বীকার তো কোনোদিন করে নি। তবে ওর ধারণা ভুল প্রমাণিত করেছিল।

সুপ্রীতি ভেবেছিল ইশরাক ওর মতন। ও যেমন ইশরাকের জন্য সব ছাড়তে পারবে তেমনি ইশরাকও ওর জন্য সব করতে পারবে। স্বপ্না যখন পুরোপুরি সম্পর্কের ব্যাপারে জানতে পারলেন তখন সে তার স্বভাবসুলভ আচরণ করলেন। এই সম্পর্ক কিছুতেই মানবে না। প্রয়োজনে সুপ্রীতিকে জোর করে বিয়ে দিবেন। বাবা এই সময় সুপ্রীতির পাশে দাঁড়ালেন। দুই পরিবারের ঝামেলা, তর্ক বিতর্কে ইশরাক বেশী মুষড়ে পড়লো। সুপ্রীতি তখন টের পেল ইশরাক পরিবারের কথা বেশী ভাবছে। ইশরাক ভালো ছেলে, পরিবারের কথা ভাববে স্বাভাবিক। এটাতে দোষের কিছু নেই। দুইজনের তর্ক যুদ্ধে সম্পর্কে অবনতি হয়।

সময় গড়ায়। সুপ্রীতিদের ড্রইং রুমে পাত্রপক্ষ এসে বসে থাকে। সুপ্রীতি তার সিদ্ধান্তে অবিচল। একজনের সামনেই সেজেগুজে যাবে। প্রথম এবং শেষবার। আর সেই একজন ই ওর জীবনসঙ্গী হবে।

হেমন্তের এক বিকেলে সুপ্রীতি বাসা থেকে বেরিয়ে যায়। সেজেগুজে লাল শাড়ি পরে যায়। ওর সবসময় ই ইচ্ছে বিয়ে হবে লাল শাড়িতে। কাজী অফিসের সামনে বসে থাকে ঘন্টার পর ঘন্টা। দুই পক্ষের চারজন সাক্ষীও এসে বসে থাকে। অপরিচিত কেউ না, ওদের ই বন্ধুইশরাক আসে না, কলও রিসিভ করে না। রাত নয়টার দিকে ইশরাক কল করে জানায়, ও আসতে পারবে না। পরিবারের একজন অসুস্থ, তাকে নিয়ে হসপিটালে ছিলো। দুদিন পর কাজি অফিসের ব্যাপার টা সেড়ে ফেলবে। সুপ্রীতি যেন একটু ম্যানেজ করে।

অনেকের কাছেই ব্যাপার টা খুব ই সামান্য। অথচ সুপ্রীতি এই ব্যাপার টাকে অনেক বড় করে দেখেছিল।

চলবে….

(ভাই বানান ভুল সংশোধন করে পড়ে নিয়েন প্লিজ।)