হৃদয়ের দখিন দুয়ার পর্ব-৩৪+৩৫

0
325

#হৃদয়ের_দখিন_দুয়ার
#পর্ব-৩৪
সুপ্রীতি এই মুহুর্তে বসে আছে অর্ণবের মুখোমুখি। অর্ণব নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে কফিতে চুমুক দিচ্ছে। যাবতীয় ঘটনায় তার বিন্দুমাত্র অনুতাপ নেই। স্বপ্নার মুখে ফোস্কা পড়ে গেছে। জিহবা পুড়ে ভয়ংকর অবস্থা হয়েছে। ঠান্ডা, গরম কিছুই খেতে পারছে না। যন্ত্রণায় ভীষণ কান্নাকাটি করেন। স্বপ্নার বাড়ির লোক এর একটা হেস্তনেস্ত করে ছাড়বেন। তারা এতো সহজে অর্ণব কে ছাড়বেন না। সুপ্রীতির ছোট মামা ও’কে কল করে বলেছে,

“তুই কী একা আসবি নাকি আমি পুলিশ নিয়ে আসব। ”

সুপ্রীতি ঠান্ডা গলায় জবাব দিয়েছে,

“না আসব না। ”

“কেন আসবি না। দেখ প্রীতি তুই এলে আমরা কী করি। ওরে শিক্ষা দেয়া কোনো ব্যাপার ই না। তুই চাইলেই হবে। ”

“তোমরা মায়ের ভালো করে ট্রিটমেন্ট করাও। ওকে শিক্ষা দেয়ার দরকার নেই। ও অন্যায় করেছে, কিন্তু ও’কে উস্কে দেয়ার দায়িত্ব মা নিয়েছিল। তাকে অসংখ্য বার বলা হয়েছিল যেন সে আমার সংসারে নাক না গলায়। ”

“নাক গলায় মানে কী? ছোটলোকি কথাবার্তা শিখেছিস কোথায় তুই? মায়ের চেয়ে বড় আর কেউ হয়। ”

সুপ্রীতি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,

“বিয়ের দিন মা বলেছিল এখন থেকে অর্ণব ই তোমার সবকিছু। অর্ণব যেমন বলবে তেমন হয়ে চলবে। কোনো অভিযোগ যেন না আসে। আমি সেগুলো অক্ষরে অক্ষরে মানছি মামা। ঠিক যেমন মামী তোমাকে মানে। মায়ের কথাই রাখছি। ”

মামা হতাশ গলায় বলেন,

“তুই আসবি না তাই তো?”

“মা’কে দেখতে আসব। ”

“না সেটা আসার দরকার নেই। তুই তোর স্বামী নিয়ে থাক। নাতাশার মতো তোর অবস্থাও যখন ওরকম হবে তখন কোথাও জায়গা পাবি না। ”

সুপ্রীতি তারপরও মা’কে দেখতে গিয়েছিল। স্বপ্না কথা বলতে পারলেন না ভালো করে। কথা বলার মতো অবস্থায় থাকলে হয়তো কিছু বলতেন। সুপ্রীতি ঠান্ডা মাথায় স্বাভাবিক গলায় বাবাকে জিজ্ঞেস করলো,

“বাবা কে আসল অপরাধী বলো তো? মা নাকি অর্ণব। অর্ণব যদি শাস্তি পায় তবে মায়ের কী শাস্তি হওয়া উচিত নয়? ”

বাবা তাকিয়ে রইলেন মেয়ের দিকে। এই মেয়েকে তিনি কী বলবেন! স্বপ্নাকে এতকাল তার জেদি মনে হয়েছিল। ছেলেমেয়েদের জন্য তার ভাবনা টা অস্বাভাবিক হলেও সেটাতে স্বার্থ খুঁজে পান নি। আত্মসর্বস্ব একজন মা চান তার মেয়ে তার হিসেব মতো ভালো থাক। কিন্তু এখন এই পরিস্থিতিকে তিনি কীভাবে বিচার করবেন। শুধুমাত্র একজন অসুস্থ মস্তিষ্কের মানুষ ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারছেন না। সুপ্রীতি মা’কে কিছু বলল না। বাবাকে বলে গেল ফর্মাল সম্পর্কটুকু বজায় রাখা ছাড়া আর কোনোকিছু আমার কাছে তোমরা আর এক্সপেক্ট করবে না বাবা। আমিও ঠিক ওই একই মায়ের মেয়ে। আমিও শুধু নিজের ভালো ভাবব। আমার যেটা ঠিক মনে হবে, শত লোক সেটা ভুল বললেও আমার ঠিক নিয়েই অনড় থাকব।

***
অর্ণব কফি শেষ করে বলল,

“তুমি কী চুপ করে থাকবে? আমাকে কিছু বলবে না?”

“অর্ণব তুমি যেটা করেছ সেটা যে অন্যায় এটা তো মানবে? ”

“অবশ্যই। আমি অন্যায় করেছি। তবে সুপ্রীতি আমি কিন্তু একটা ব্যাপার সবসময়ই ক্লিয়ার করেছি তোমার কাছে। যে আমাকে যতটুকু সম্মান করবে আমি তাকে ঠিক ততটুকু সম্মান ই দেব। যে আমার সঙ্গে যতটুকু নিষ্ঠুর হবে আমি তার সঙ্গে ততটুকু নিষ্ঠুর হব। ”

“তোমার যুক্তি আমি অস্বীকার করছি না অর্ণব। কিন্তু উনি আমার মা। পা*পী হোক খু*নী হোক উনি কিন্তু আমার মা। ”

“আই এম সরি সুপ্রীতি। তোমার মা’কে আমি আমার মায়ের জায়গাটা দিতে পারিনি। কোনোদিন পারবও না। উনি সবচেয়ে জঘন্য কাজ টা আমার বাচ্চার মায়ের সঙ্গে করছেন। এটার ক্ষমা হয় না। ধরে নাও দুনিয়ার গুটিকয়েক খারাপ লোকের আমি একজন। ”

সুপ্রীতি অর্ণবের হাত ধরে বলল,

“তুমি প্লিজ আমার মায়ের কাছে একবার ক্ষমা চাইবে। ”

অর্ণব শান্ত গলায় বলল, আচ্ছা। তুমি বলেছ এজন্য আমি ওনাকে সরি বলব। তবে আমি মন থেকে সরি ফিল করছি না। কেন করছি না সেটার লজিকও আছে আমার কাছে। তুমি শুনতে চাইলে বলব।

“আমি তোমার মনের অবস্থাটা বুঝতে পারছি অর্ণব। তবুও মা তো খারাপ লাগে। মনে হয় আমি মায়ের সঙ্গে এমন করছি, আমার সন্তান পৃথিবীতে আসলে সে যদি আমার সঙ্গে এমন করে!”

অর্ণব স্মিত হেসে বলল, আরে তুমি তো কিছু করো ই নি। যা করার আমি করেছি। ফলও আমি ভোগ করব। দেখো সবকিছু নিজের মতো করে তো হয় না। আমার মা আমাকে যতটুকু ভালোবেসেছেন ততটুকু ভালোবাসা তাকে আমি দিতে পারছি না। আমার মনে হয় তার তুলনায় আমি কম ই বাসছি। কিন্তু সে তো আমার মতো করে ভাবেন না। কিংবা আমি তাকে একদিন সমপরিমাণ ভালোবাসা ফিরিয়ে দেব সেটা ভেবেও সে আমাকে ভালোবাসে নি। ধরো আমি এখন তাকে ভালোবাসা বন্ধ করে দিলে সেও কী বন্ধ করে দিবে! কখনো না। ওটা ন্যাচারাল ব্যাপার। আমার সন্তানের ক্ষেত্রেও ব্যাপার টা ঠিক তেমন ই। আমি আমার সন্তান কেও আমার মতো করেই ভালোবাসব। বিনিময়ে তার কাছ থেকে সেই পরিমাণ ভালোবাসা কখনো আশা করব না। ভালোবাসা ব্যাপার একান্তই নিজের।

সুপ্রীতি মৃদু হেসে বলল, তুমি এতো গুছিয়ে যুক্তি দাও যে আমি নিজের যুক্তি ভুলে যাই।

“সুপ্রীতি শোনো, এই কথাটা এখন উঠছে বলে আমাকে ব্যাপার গুলো বলতে হচ্ছে। তোমার মনে হচ্ছে আজকের এই ঘটনায় সবচেয়ে দোষী আমি। কিন্তু আমি কিংবা তোমার মা যতটা দোষী তারচেয়ে বেশী দোষী তুমি। ”

সুপ্রীতি জিজ্ঞাসু চোখে তাকালো। অর্ণব আবারও বলল,

“তোমার আমার প্রথম দেখার কথা মনে আছে! তোমাকে দেখেই আমার মনে হয়েছিল তুমি সেই মুহুর্তে ভেঙে পড়া একজন। কিছুদিন আগেও যে বিয়ে করতে রাজি ছিলো না সে এখন বিয়েতে রাজি এতেই ব্যাপার টা বোঝা যায়। আমি ব্যাপার টা নিয়ে শিওর ছিলাম না। তুমি ক্লিয়ার করে বলো নি আমাকে। হতেই পারে তোমার উপর না বলার জন্য চাপ ছিলো। তুমি হ্যাপিলি বিয়েটাকে একসেপ্ট করলে। এরেঞ্জ ম্যারেজে সহজ হতে সময় লাগে এই সময়টুকু তুমি নিলে এবং খুবই স্মার্টলি ব্যাপার টা হ্যান্ডেল করলে। ব্যাপার টা আসলেই এপ্রিশিয়েট করার মতো। কিন্তু এখানে যদি তুমি সবকিছু জানিয়ে, বুঝিয়ে করতে তাহলে কিন্তু এতো ঝামেলা হতো না। প্রেম, ভালোবাসা ব্যাপার গুলো ভীষণ স্বাভাবিক ব্যাপার। আমাকে ইশরাকের ব্যাপারে সবকিছু বললে, তোমার মায়ের ব্যাপারে বললে আজকের এই পরিস্থিতি এমন হতো না। না আমি তোমাকে দোষ দিচ্ছি না। তুমি এভাবেই বড় হয়েছো, তোমার পরিবেশ থেকে এরকম ই শিক্ষা পেয়েছ। ঠিক একইভাবে আমিও আমার পরিবেশ, পরিস্থিতি থেকে অন্যরকম শিক্ষা নিয়েছি। আমার যে বন্ধু তোমার সঙ্গে অশ্লীল রসিকতা করেছে সে যদি পোলাইটলি বলতো সুপ্রীতিকে খুব সুন্দর লাগছে আমি কিন্তু তাতে রিয়েক্ট করতাম না। আমি রিয়েক্ট করেছি যখন সে তার লিমিট ক্রস করেছে। এটা সবার চোখে দেখতে খুব খারাপ। কিন্তু এরপর যখন আবার বন্ধুমহলে তোমাকে নিয়ে যাব তখন সবাই একটা ব্যাপার মাথায় রাখবে যে অর্ণবের বউকে কিছু বলা যাবে না।

মনে আছে বিয়ের দুদিন পর ছোট ফুপু তোমার চা খেয়ে বলেছিল স্বাদ ভালো হয় নি। আমি তখন রিয়েক্ট করেছিলাম। ছোট ফুপুর সঙ্গে এরপর তোমার যতবার দেখা হয়েছে সে কিন্তু কোনো ছুঁত খুঁজে পায় নি। অথচ ভাবীর দোষ ধরতে সে ব্যস্ত সবসময় ই। তোমার মায়ের কন্ট্রোলফ্রিক আচরণ আমার পছন্দ হয় নি, আমি সেটা জানিয়েছি। আমি এমনই, মেনে নেয়া মানিয়ে নেয়া ব্যাপার গুলো পারি নি। একটা মাত্র জীবন আমার, সেখানে কেন নিজে কষ্ট পাব! নিজের চেয়েও বেশী কষ্ট হয় আমার আপনজনের কষ্ট দেখলে। এই মুহুর্তে তোমাদের চেয়ে আপনজন আর কে বা আছে।

অর্ণব শেষ কথাটা বলল সুপ্রীতির পেট স্পর্শ করে। সুপ্রীতির চোখে পানি। হাসছেও, অর্ণবের হাত টা আলতো স্পর্শে ছুঁয়ে রাখলো। ফিসফিস করে বলল,

“আমার এমন তোমাকেই ভালো লাগে। খুব ভালো লাগে। আজ আর আমার ভয় নেই… কোনো ভয় নেই। ”

অর্ণব হেসে বলল,

“তোমার মা’কে কল করে সরি বললে হবে? ”

“না বলতে হবে না। মন থেকে না চাইলে করবে না। তুমি কখনো আমার মন কে বাধ্য করো নি কিছু করতে। আমিও করব না। ”

“আরেকটা রিকোয়েস্ট…! ”

সুপ্রীতি হেসে বলল,

“ইশরাকের সঙ্গে আর কখনোই দেখা করব না। কথাও বলব না। ”

অর্ণব হেসে ফেলল। এই ব্যাপার টা ভেবে একটু লজ্জাও পেল। এই একটা ব্যাপারেই ওর লজিক দূর্বল। খুব দূর্বল।

চলবে…..

#হৃদয়ের_দখিন_দুয়ার
#পর্ব-৩৫
বেশ কিছুদিন ধরে ইকরা আর ফাহাদের ঝগড়াঝাটি হচ্ছে না। এটা হবার কারণ হলো ফাহাদ ইকরার সবকিছু মেনে নিয়েছে। ওর বন্ধু মিরাজ বলল সবকিছু মেনে না নেয়া অবধি শান্তি আসবে না। কথা সত্যি, বিয়ের পর থেকে ওদের ছোট ছোট ব্যাপার নিয়ে এতো ঝামেলা হচ্ছে! আর এই অশান্তি গিয়ে ওদের অন্তরঙ্গ মুহুর্ত তৈরীতেও ব্যাঘাত ঘটে। কোনোকিছু নিয়ে ইকরার ম্যুড অফ থাকলে সেদিন কঠিন গলায় বলে, ফাহাদ আমার থেকে দূরে থাকো। ফাহাদ সরি টরি বলেও লাভ হয় না। একদিন আদুরে গলায় সরি বলে জড়িয়ে ধরতে গেলে ইকরা একটা ধাক্কা মারলো। ফাহাদ উঠে চলে গেল ওয়াশরুমে। ওর রাগ দেখানোর একমাত্র মাধ্যম হচ্ছে দেয়াল। হঠাৎ হঠাৎ অবচেতন মন প্রশ্ন করে, ফাহাদ ঠিক একই আচরণ যদি নাতাশা তোমার সাথে করতো তবে তুমি কী করতে!

ফাহাদের তখন আরও বেশী রাগ লাগে। না এই রাগ ইকরার জন্য, না নাতাশার জন্য। অকারণে রাগে ফেটে পড়ে। শাওয়ারের নিচে দাঁড়িয়ে নিজেকে শান্ত করে, মাঝেমধ্যে না পেরে দেয়ালেও আঘাত করে।

ইদানীং ফাহাদ ইকরাকে খাওয়া দাওয়া নিয়ে বিরক্ত করছে না। ফ্রোজেন খাবার দাবারে সমস্যা ছিলো সেটাও মিটিয়ে নিয়েছে। সকালে ব্রেকফাস্টে পাউরুটি, ডিম, কলায় অভ্যস্ত হয়ে গেছে। ভুলেও ভাত, মাছের কথা মুখে আনে না। এখানে অবশ্য অন্য গল্প আছে। সকালের পাউরুটি, ডিম, কলা হজম হয়ে যায় অফিসে যেতে যেতেই। অফিসে ঢোকার আগে তাই গোটা পাঁচেক পরোটা, নেহারি, বুটের ডাল পেটে চালান করে যায়। দুপুরেও ভাত, বিরিয়ানি, তেহারি ইচ্ছেমতো খায়। অফিস শেষে এক ঘন্টা জিম সেড়ে তারপর বাসায় ফিরে। তবে সমস্যাটা রাতের খাবার নিয়ে। রাতে ইকরার সঙ্গে ওইসব হাবিজাবি খাবার খেতে হচ্ছে। তবে কিছু আইটেম ইকরা খুব ভালো রান্না করে। চিকেন স্টু, চিকেন ফ্রাই, মাটন ভুনা এসব ভালোই করে। কিন্তু করলা সেদ্ধ, অল্প তেলে নিরামিষ শাক পাতা মুখে তোলা যায় না।

ইকরা অবশ্য ফাহাদের এতো লুকোচুরি ধরতে পারছে না। ফাহাদ ও’র সব কথা শুনছে ওর মতো চলছে এতেই খুশি। তার উপর ওর বিজনেসের জন্য পাঁচ লাখ টাকা দিয়েছে, এতে আরও বেশী সন্তুষ্ট।

অথচ সত্যিকার অর্থে এটাকে ঠিক ভালো থাকা বলে না। এইভাবে মনে একরকম আর মুখে আরেকরকম কতদিন ই বা চলবে!

***
নাতাশা ইশরাকের কাছে খবর পেয়েছে যে ঝিলিক এখনো স্বাভাবিক হয় নি। ইশরাকের সঙ্গে ভালো করে কথা বলছে না। সকালে বেরিয়ে যায়, রাতে ফিরে। পড়াশোনা অন্যান্য কাজে নিজেকে ব্যস্ত রেখে ইশরাক কে এড়িয়ে চলছে। দুজনের কথাবার্তাও সীমিত শব্দে শেষ হয়। ইশরাক কিছু বলতে গেলেও ঝিলিক হ্যাঁ, না তে জবাব দিয়ে এড়িয়ে যায়।

নাতাশা আজ এসেছে ঝিলিকের সঙ্গে দেখা করতে। ভাগ্য ভালো বলে ঝিলিক কে বাসায় পেল। এর আগে দুদিন এসে পায় নি। ঝিলিক স্বাভাবিক ভাবেই পালক কে কোলে নিলো, আদর করলো। নাতাশাকে যথাসম্ভব এড়িয়ে চলার চেষ্টা করলো। নাতাশার কষ্ট হলো, ঝিলিক কে কষ্ট দেয়া ওর উদ্দেশ্য ছিলো না। ঝিলিক ব্যাপার টা ভালোভাবে বুঝবে না বলে ও জানাতে চায় নি। বরং এই ব্যাপার টা নিয়ে ওদের মধ্যে ঝামেলা না হোক সেটা এড়াতেই শুধু ইশরাক কে বলেছিল।

নাতাশা ঝিলিক কে বলল,

“ঝিলিক আমার কাছে একটু বসো। কথা আছে তোমার সঙ্গে। ”

ঝিলিক পালকের সঙ্গে আহ্লাদ করতে ব্যস্ত ছিল। বলল,

“রান্না করে কিছু খাওয়াতে পারব না। সামনে একটা বিরিয়ানির দোকান আছে। ভালো বিফ বিরিয়ানি পাওয়া যায়। পালকের জন্য আনাব। তুমি কী খাবে? ”

নাতাশা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,

“আমি রান্না করে নিয়ে আসছি। তোমার সঙ্গে একসঙ্গে খাব বলে। ”

“ইশরাক কে ফোন করে আসতে বলো। ও তোমাকে সঙ্গ দিবে। তোমার জন্য ওর অনেক সময়। ”

নাতাশা চুপচাপ হজম করলো। ঝিলিকের এই রাগ ওর মেনে নিতেই হবে। অস্বীকার করার তো উপায় নেই যে ওর দোষ ছিলো না। নাতাশা অনুনয় করে বলল,

“একটু আমার কথা শোনো। ”

“যা বলার ইশরাক কে বলো। তোমার কাছের মানুষ। ”

“তুমি আমার কাছের কেউ না?”

“না। তুমিও আমার কাছে এখন স্রেফ পালকের মা। আপনজন, কাছের মানুষ এগুলো শুধু মাত্র বলার জন্যই। ”

“তোমার অভিমান বড্ড ভয়ংকর ঝিলিক। ”

ঝিলিক হাসলো। নাতাশা খেয়াল করলো ঝিলিকের এই হাসিটাও মলিন। ওর প্রাণখোলা হাসিটা কতোই সুন্দর। ”

ঝিলিক বিরিয়ানি আনিয়ে নিজেও খেল, পালক কেও খাইয়ে দিলো। নাতাশার জন্য রাখা বিরিয়ানি টা টেবিলে পড়ে রইলো। নাতাশা আবারও বলল,

“তুমি আমার সঙ্গে সত্যিই কথা বলতে আগ্রহী নয় ঝিলিক? ”

“না। প্লিজ তুমি ইশরাক আর সুপ্রীতির সঙ্গে কথা বলো। আমাকে কিছু বলতে এসো না। ”

“তুমি আমাকে এবার কষ্ট দিচ্ছো ঝিলিক। আমারও তো কিছু বলার আছে, নিজের স্বপক্ষে যুক্তি আছে। ”

“কিন্তু আমি সেগুলো শুনতে আগ্রহী নেই। আর কষ্টের কথা বলছ! তুমি তো নিজেকে মহান বুদ্ধিমতি ভাবো, তবে এটুকু কেন বুঝতে পারছ না যে আমিও মানসিক ভাবে কতটা বিপর্যস্ত এখন। তুমিও তো একসময় আমার সঙ্গে খুব খারাপ আচরণ করেছিলে! কখনো তো বলিনি যে আমি কষ্ট পাচ্ছি, আমার কী দোষ! আমাকে কেন কষ্ট দিচ্ছো! কারণ আমি জানতাম তুমি খারাপ না, তোমার সময় টা খারাপ যাচ্ছে। অথচ আমার ক্ষেত্রে তুমি ধরেই বসে আছ বিশ্বের সবচেয়ে খারাপ মেয়ে আমি। ”

নাতাশা বুঝতে পারছিল আজ ঝিলিক কে কোনো কিছু বোঝানো ওর পক্ষে সম্ভব নয়। অসম্ভব রাগ পুষে বেড়াচ্ছে মনের ভেতর। কারোর কথা শুনবে না। ঝিলিক হাত ধুয়ে অত্যন্ত স্বাভাবিক গলায় বলল,

“আরও বেশী সময় যদি থাকো তবে ইশরাক কে কল করো। আমি এখন বেরোবো। ”

নাতাশাও জেদি গলায় বলল, হ্যাঁ তাই ই থাকব। তুমি যাও।

ঝিলিক তৈরী হয়ে বেরিয়ে গেল। যাবার সময় চাবি রেখে গেল ওর জন্য।

নাতাশা কিছুক্ষন বসে থেকে পালক কে নিয়ে বেরিয়ে এলো। ইশরাকের জন্য আর অপেক্ষা করলো না।

***
ঝিলিক আজ রাতেও দেরি করে আসছে। ইশরাক বেশ কিছুদিন ধরে এই অনিয়ম দেখছে। কিছু বলছে না, সকালে সেমিস্টার ফি রেখেছিল টেবিলের উপর। সেই টাকাটা তেমন ই রাখা। আজ এসেছে ও সাড়ে এগারোটায়। বারোটায় মেইন গেট বন্ধ হয়ে যায়। তবুও একদিন ঝিলিক সাড়ে বারোটায় এসেছিল। ইশরাক আজ অপেক্ষা করলো ঝিলিকের সঙ্গে কথা বলার জন্য। ঝিলিক এসে গোসল করে নিলো। বাইরে ভ্যাপসা গরমে গা কুটকুট করছিল। ইশরাক দরজা খুলে ঢুকে পড়তেই ঝিলিক বলল,

“দরজা নক করে ঢোকা উচিত ছিলো কিন্তু। ”

ইশরাক এই কথার জবাবে কিছু বলল না। এইসব ছোট খাট তুচ্ছ বিষয় নিয়ে ঝগড়া করতে ওর মন চাইছে না। ও ভনিতা না করে জিজ্ঞেস করলো,

“সেমিস্টার ফিসের টাকাটা জমা করে দিলি না যে?”

“কাল জমা করে দেব। বাবা পাঠাবে কাল। ”

ইশরাকের ভ্রু কুঞ্চিত হলো। ওদের এই ঝগড়ার টপিক বাড়ির লোকের কান পর্যন্ত পৌছে গেছে!

“তুই বাড়িতে কী বলেছিস?”

“কী বলব? টাকার কথা বলেছি।”

“হঠাৎ টাকার কথা বললি? কেউ জিজ্ঞেস করে নি কিছু? ”

“ওটা না শুনলেও হবে। তোমার কথা কিছু বলিনি। আমি ছোটলোক না।”

ইশরাক শান্ত গলায় বলল,

“ঝিলিক তুই কিন্তু এবার পাগলামী করছিস। ”

“আমি খুবই টায়ার্ড। ঘুম দরকার একটু, রাতে পড়তেও হবে। তোমার কাজ না থাকলেও আমার অনেক কাজ আছে। ”

“আমার সঙ্গে কথা বলতে চাইছিস না তাই তো?”

“হ্যাঁ। ”

ইশরাক বেরিয়ে গেল। ঘরে গিয়ে দুই দন্ড বসতেও পারলো না। বেরিয়ে এসে দেখলো ঝিলিক গোগ্রাসে ভাত গিলছে। গরম ভাত সঙ্গে ডিমভাজা। ইশরাক একটা চেয়ার টেনে বসলো। এতো সুন্দর আর চমৎকার দৃশ্য মনে হলো ঝিলিকের ভাত খাবার এই দৃশ্যটি। ঝিলিক ফিরে তাকালো না একবারও। ইশরাক প্রশ্ন করলো,

“চুল কেটেছিস?”

“হ্যাঁ। ”

“কেন?”

“পার্লারে ডিসকাউন্ট ছিলো। আমার বড় চুল ভালো লাগছিল না।”

ইশরাক একটু ভাবলো। ঝিলিক মনে হয় নিজেকে বদলাতে চাইছে। সিরিয়াল দেখে বোধহয় এগুলো ফলো করছে। করুক যা ইচ্ছে, ওর তাতে সমস্যা নেই। শুধু ওর সঙ্গে নরমাল আচরণ করলেই হবে। কিন্তু সেটাই তো হচ্ছে না।

ইশরাক ঝিলিকের পেছনে পেছনে ও এখন যে ঘরে থাকে সেই ঘরে গেল। ঝিলিক বলল,

“বিরক্ত কোরো না তো। আমি এমনিই খুব টায়ার্ড।”

ইশরাক বিছানায় শুয়ে পড়লো। ঝিলিক কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল। ও চলে গেল বেডরুমে। বিছানায় শুয়ে পড়ার খানিকক্ষনের মধ্যে টের পেল ইশরাক এসে ও’কে আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরেছে। ঝিলিক চাপা গলায় বলল,

“ভালো লাগছে না। ”

ইশরাক শুনলো না কিছু। এলোপাথারি চুমু খেল গালে, চিবুকে। দম বন্ধ লাগে ওর ঝিলিকের এখনকার রুপ দেখে। কাল পরশু দুই রাত ঘুম হয় নি। তিন বার পাশের ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল।

ইশরাক নিজেও বোধহয় বুঝতে পারলো না যে ও ঝিলিক কে ঝিলিকের মতো করেই ভালোবেসে ফেলেছে।

চলবে….