হৃদয়ের দখিন দুয়ার পর্ব-৩৮

0
161

#হৃদয়ের_দখিন_দুয়ার
#পর্ব-৩৮
“তোমার কফি কিন্তু ঠান্ডা হয়ে গেছে। ”

এখন মধ্যদুপুর। এই ক্যাফেটা এখনো ব্যস্ত। এখানে যতক্ষণ খুশি ততক্ষণ বসে থাকা যায়। নাতাশা পালক কে প্লে স্কুলে দেয়ার পর থেকে এখানে প্রায় রোজই আসে। সারাদিনের বিজনেস প্ল্যানগুলো এখানে বসে বানিয়ে নেয়। আজকের কফিডেট টা ব্যতিক্রম। আজ নাতাশার সামনে বসে আছে রুবাব। নাতাশা নিজেই রুবাব কে এখানে ডেকেছে। রুবাবও প্রথমে ভীষণ অবাক হয়েছিল। পরে কোনোকিছু না ভেবেই চলে এলো। প্রায় মিনিট বিশেক নাতাশা কোনো কথা বলল না। রুবাব দুই একটা কথা বললেও নাতাশা হ্যাঁ, না তে উত্তর দিলো। রুবাব অলরেডি নিজের কফিটা শেষ করে ফেলেছে। রুবাব নিজের জন্য আরেকবার কফি অর্ডার করে নাতাশাকে জিজ্ঞেস করলো,

“কেমন আছ নাতাশা?”

“ভালো। আপনি? ”

“ভালো। সব ঠিকঠাক চলছে। ”

“হ্যাঁ। ”

“কোনো সমস্যায় পড়ে আমাকে যে মনে করো নি সেটা বুঝতে পেরেছি। ”

“আপনার কিছু বই আমি পড়েছি। ”

“আচ্ছা! আমি তাহলে আজ ফ্যান গার্লের সঙ্গে দেখা করতে আসছি। ”

রুবাব হাসলো। নাতাশাকে একটু বিভ্রান্ত দেখালো। নাতাশা ফোনে সময় দেখে বলল,

“পালক কে আনতে যাবার সময় হয়েছে। আমি উঠি। ”

“আচ্ছা। ”

নাতাশা উঠলো। ব্যাগ টা কাঁধে ঝুলিয়েও কিছু সময় অপেক্ষা করলো। রুবাব জিজ্ঞাসু চোখে তাকাতে বলল,

“পালকের সঙ্গে আজ দেখা করবেন না?”

“আজ থাক। আমি আরেক কাপ কফি এনজয় করে উঠব। ”

নাতাশা বেরিয়ে গেল। জীবন আসলে ছক কষে চলে না। এই যে নিয়মের বাইরে একটা কাজ নাতাশা করে ফেলল। ওর হঠাৎই খুব একা লাগছিল। অথচ ওর কতো বন্ধু আছে। সুপ্রীতি, প্রকৃতি আছে। প্রকৃতি যদি শোনে ওর মন খারাপ তাহলে সব ছেড়েছুড়ে ও’কে সময় দিতে চলে আসবে। অথচ ওর তাদের কারো সঙ্গ পেতে ইচ্ছে করলো না। ইচ্ছে করলো অবন্ধু কারো সঙ্গ পেতে। রুবাব ওর শত্রু তো নয় ই। বন্ধু কিংবা শুভাকাঙ্ক্ষীও নয়। পালকের সঙ্গে দেখা করতে আসার সময় টুকুতে ও একটা বারও নাতাশার জীবন যাপন দিনকাল জিজ্ঞেস করে না। স্রেফ কয়েকটা বাক্যেই ওদের কথা শেষ হয়। আজ এতক্ষণ সময় ক্যাফেতে বসেছিল। নাতাশার ভালো লেগেছে। কিছু না বলে, দীর্ঘ বাক্যলাপ না চালিয়েও যে ভালো সময় কাটানো যায় সেটা উপলব্ধি করেছে।

রুবাব কফিটা উপভোগ করলো একা একাই। যে বয়সে ও এখন আছে সেই বয়সে প্রেম হুট করে হয় না। প্রেম হতে সময় লাগে। এই বয়সে এসে মুগ্ধতাও ফিকে হয়ে যায়। নাতাশাকে দেখে প্রেম প্রেম উপলব্ধি ওর হয় নি। হৃদয়ে এই মেয়েটার জন্য সম্মান আছে। স্রেফ সম্মান ই। এর বাইরে আর কিছু না। তবুও মাঝেমধ্যে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করে,

“নাতাশা আমরা কী বন্ধু হতে পারি। রাত জেগে কাজ করতে করতে হাপিয়ে গেলে তোমাকে কী একটা কল করা যায়! কিংবা ছুটির দিনে পোলাও রোস্ট করে একসঙ্গে শেয়ার করা যায়!”

****
ঝিলিক কে সুন্দর লাগছে খুব। এখন ও বাঁধনছাড়া পাখির মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে। ইউনিভার্সিটি, অ্যাসাইনমেন্ট, প্রেজেন্টেশন এর চাপ নেই। সংসারের কোনো চাপও নিচ্ছে না। টানা দুই সপ্তাহ ঘুরে এসেছে। একটা প্রাইভেট কোম্পানির ইন্টার্নিশিপ এর অফারও আছে ওর হাতে। এখনো কিছু কনফার্ম করে নি, তবে ওর সেখানে যাবার ইচ্ছে।

ইশরাক অফিস থেকে এসে দেখলো ঝিলিক সেজেগুজে তৈরী হয়ে আছে। দেখে ভালো লাগলো। ঝিলিক আর ওর সম্পর্ক স্বাভাবিক থেকেও যেন স্বাভাবিক নয়। সবসময় কেমন পালিয়ে পালিয়ে বেড়ায় ঝিলিক। এতো বেশী নিজেতে মগ্ন যে ইশরাক কে সময় দেয় না। খালা অনেক দিন হলো বাড়িতে গেছেন। ঝিলিক সংসারের কাজ কর্ম ভাগ করে নিয়েছে। তিনদিন ও রান্না করবে, তিন দিন ইশরাক রান্না করবে। একদিন বাইরে থেকে খাবার আনিয়ে নিবে। ইশরাক মেনে নিয়েছে। ওর ভাগ্যে যে তিন দিন রান্না পড়ে সেদিন ভুলেও ঝিলিক রান্নাঘরে পা দেয় না। মুভি দেখে ঘরে বসে। চা পর্যন্ত খায় ইলেক্ট্রিক কেতলি তে বানিয়ে। ইশরাকের জেদ রাগ সবকিছু এখন নিয়ন্ত্রণে। ঝিলিকের লজিক অনুযায়ী সত্যিই ও দোষী। দোষ কাটানোর সর্বোচ্চ চেষ্টা করবে।

“বাইরে ঘুরতে যাবি। একটু আমার জন্য ওয়েট কর। আমিও যাব তোর সঙ্গে? ”

ঝিলিক হেসে বলল,

“আচ্ছা। ”

ইশরাক স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। অনেকদিন বাদে ঝিলিক বোধহয় একটু সহজ হলো ওর সঙ্গে।

ইশরাক ওয়াশরুমে ঢুকবে সেই মুহুর্তে ঝিলিক ডেকে বলল,

“আজ তোমাকে এতো খুশি লাগছে? শু’য়ে এসেছ কারোর সঙ্গে? ”

ইশরাক বাকরুদ্ধ হয়ে গেল। পায়ের তলার মেঝেটুকুর অনুভবও হালকা লাগছে। গলা দিয়ে কেবল একটা শব্দই বেরোলো।

“কীহ!”

“আফটার সে/ক্সের পর তোমাকে এতো প্রফুল্ল লাগে। ”

ইশরাক তাকিয়েই আছে। চোখে পলক ফেলতে ভুলে গেছে। সমস্ত শরীরে যেন আগুন জ্বলছে। নিজের মধ্যে নেই, ভুলে গেছে যে ওর এখন ওয়াশরুমে যাবার কথা। ঘরে ঝিলিক ছাড়া আর আছে কিছু আসবাবপত্র। যেগুলোর জীবন নেই, সেই জড়বস্তুগুলোকেও ওর এখন লজ্জা লাগছে।

ইশরাক টলমল পায়ে এসে বিছানার উপর বসলো। ঝিলিক বসে আছে সোফার উপর। ফোনে কিছু একটা দেখতে ব্যস্ত। ইশরাক নিজেকে ধাতস্থ করে ঝিলিক কে বলল,

“ঝিলিক, তোর আমাকে এতো নোংরা কেন মনে হলো? আর মনেই যখন হয়েছে নিশ্চয়ই সেরকম কিছু এভিডেন্ট আছে তোর কাছে তাই তো? ও’কে প্রুভ ইট। ”

ঝিলিক হেসে ফেলল। বলল,

“কিচ্ছু নেই আমার কাছে। ”

ইশরাক মেঘস্বরে বলল,

“তাহলে এতো বড় একটা কথা কোন সেন্স থেকে বললি? আনসার মি। ”

ঝিলিক ইশরাকের মুখোমুখি তাকিয়ে বলল,

“ওকে লেট মি এক্সপ্লেইন। বিয়ের পর ফুচকা খেতে গিয়েছিলাম মনে আছে। আমি জোর করায় বাধ্য হয়ে তুমি নিয়ে গিয়েছিলে। তোমার পছন্দের প্লেস। সেখানে আমাকে অপমান করিয়েছিলে। কাকে দিয়ে? ফুচকার দোকানের ছেলেটা।

সুপ্রীতিকে আমি ছবি পাঠাই এই চক্রান্ত কে করেছিল? তুমি না? তাহলে আমার আজকের কথায় তুমি অসুস্থ হয়ে যাচ্ছ কেন? আমি যদি এই দুইটা অপমান হজম করতে পারি তাহলে তুমি কেন পারছ না। আমি তো কোনো মানুষের সামনে তোমাকে অপমান করি নি। তুমি কিন্তু করেছিলে। শোনো অপমান করতে হলে নিতেও শিখতে হয়। ”

ইশরাক কাঁপা গলায় প্রশ্ন করলো, আজকের প্রশ্নটা খুবই জঘন্য ছিলো।

“তোমার আর সুপ্রীতির ছবি পাঠানোর অপবাদ টা এর থেকেও জঘন্য ছিলো। ”

ইশরাক রাগে কাঁপছে। পলকহীন চোখে তাকিয়ে আছে ঝিলিকের দিকে। ঝিলিক তীর্যক হেসে বলল,

“ওকে সরি। এবার ম্যুড ঠিক করো। এটাও তোমার থেকে শিখা। কিভাবে আঘাত দিয়ে সরি বলে আদর করতে হয়। চাইলে আদরও করতে পারি। ”

ইশরাক কাঁপা গলায় বলল,

“গেট আউট। ”

ঝিলিক শব্দ করে হাসলো। বলল,

“আরে যাব যাব। যেমন করে আগ বাড়িয়ে ঘাড়ে চেপেছিলাম ঠিক তেমন প্রায়শ্চিত্ত করেই যাব। ”

***
ফাহাদ কে দুই থাপ্পড় দেবার পরদিন সকালে ইকরা বাসা থেকে অল্প কিছু জামা কাপড় নিয়ে বেরিয়ে যায়। ফাহাদ কল করে না পেয়ে ইকরার মায়ের বাসায় যায়। সেখানে ইকরার মা ভাই ফাহাদ কে ইচ্ছেমতো অপমান করে, কিন্তু ইকরা সেখানে ছিলো না। ফাহাদ এবার আর নিজের মেজাজ কে কন্ট্রোল করতে পারে নি। ও ইচ্ছেমতো গালি ব্যবহার করেছে ইকরার ভাইয়ের উদ্দেশ্যে।

ইকরা বাসায় ফিরলো আটদিন পর। বাসায় এসে এমন ভাবে রইলো যেন কিছুই হয় নি। রিলাক্স ট্যুর দিয়ে এসেছে। ফাহাদ অফিস থেকে ফিরে ইকরাকে দেখে প্রশ্ন করলো,

“কোথায় ছিলে এতদিন? ”

ইকরা স্বাভাবিক গলায় বলল,

“ইটস নট ইওর হেডেক। বাট ফারদার ডোন্ট হিট মি। ”

“ওকে ফাইন। বাচ্চাটা আছে নাকি মেরে ফেলেছ। ”

ইকরা স্বাভাবিক গলায় বলল,

“হ্যাঁ এবোর্শন করেছি। এজন্যই কন্টাক্ট করিনি। কোনো নাটক চাই নি। ”

ফাহাদ কিছু না বলে চলে গেল বারান্দায়। বারান্দার রেলিংএ কিছু ঝোলানো গাছ আছে। সেগুলো ঠিক করার জন্য ও একটা লাঠি রেখেছে। সেটা এনে ইকরাকে এলোপাথাড়ি মারতে শুরু করলো। ইকরা আকস্মিক আক্রমনে তেমন একটা সুযোগ পেল না আত্মরক্ষার। হাত দিয়ে ঠেকাতে গিয়ে আঙুলে আঘাত পেল বাজেভাবে। একটা লাত্থি দেবার সুযোগ পেয়েছিল। এরপর ফাহাদ মারতে শুরু করলো পায়ে। ঠিক কতগুলো আঘাত করেছে সেটা গুনেও শেষ করা যাবে না। এক পর্যায়ে ইকরা চিৎকার শুরু করলো। ফাহাদ তাতেও থামছে না। লাঠি ভেঙে যাওয়ায় ইকরা নিস্তার পেল। হাটুতে ভর করে মেইন দরজার দিকে যেতে গেলে টের পেল ফাহাদ ওর জামা ধরে টান দিয়েছে। পিঠের একটা অংশ ছিড়ে গেছে। ফাহাদের হাতে তখন কাঠের একটা ফুলদানি। ইকরার পিঠে সেটা দিয়েও বেশ কয়েকবার আঘাত করলো। ইকরা কোনোভাবে দরজা খুলে বেরিয়ে গেল। পাশের বাসার দরজায় নক করলো। তারা ইকরার অবস্থা দেখেও সাহায্য করতে এলো না। এইসব ঝামেলায় তারা যেতে চায় না। লিফটে করে নিচে নেমে গেল। দারোয়ান, কেয়ারটেকার সবাই হতভম্ব। কেয়ারটেকার ফাহাদ কে কল করলো। কী কথা হলো ইকরা জানে না, কিন্তু কেয়ারটেকার এসে ইকরাকে বলল, ঘরের ঝামেলা ঘরে সামলান ম্যাডাম। হাউজিং এ ঝামেলা হলে আমাদের সমস্যা আছে। আজ রাতে আর গেট খোলা যাবে না। ইকরা শরীর ভর্তি আঘাত নিয়ে বসে রইলো রিসিপশনে। হঠাৎ খেয়াল হলো ওর জামা বাজেভাবে ছিড়ে গেছে। পরনে অন্তর্বাসও নেই। রাতে ঘুমানোর পোশাক পড়েছিল।

চলবে…..