হৃদয়ের দখিন দুয়ার পর্ব-৪১+৪২

0
206

#হৃদয়ের_দখিন_দুয়ার
#পর্ব-৪১
নাতাশা শ্বশুরের প্রস্তাব শুনে খুব অবাক হয়েছিল। একমাত্র মানুষ তিনি যার সঙ্গে ওর সম্পর্কের সমীকরণ বদলে যায় নি। এখনো যখন তিনি তার নাতনিকে দেখতে আসেন তখন ও বাবা সম্বোধন ই করে। সেই মানুষ টা ও’কে এরকম একটা প্রস্তাব দিলো! এরকম স্বার্থপর ভাবনা! নাতাশা কাতর গলায় জিজ্ঞেস করেছিল,

“বাবা আপনি আমাকে নিয়ে এভাবে ভাবছেন?”

“মা আমি তোমার ভালোর জন্যই এরকম কিছু ভাবতে বাধ্য হয়েছি। আমার দাদুমনির মুখের হাসিটা অমলিন থাকুক। এটুকু ছাড়া আমার আর চাওয়ার কিছু নেই। ”

নাতাশা পরের বাক্যটা আর বলতে পারলো না। শব্দ করে কেঁদে উঠলো। বৃদ্ধ মানুষ টা হাত রাখলেন নাতাশার মাথায়। পালক অদ্ভুত চোখে মা’কে দেখলো। দাদুবাড়ির সবাই ই ওর মা’কে কাঁদায়। কিন্তু দাদু তো কাঁদাতো না। এখন কেন কাঁদাচ্ছে!

****
“কোথায় যাচ্ছিস?”

“একটা জবের ইন্টারভিউ আছে মা।”

প্রকৃতি ব্যাগ গোছাতে গোছাতে বলল কথাটা স্বপ্নাকে। স্বপ্না স্বাভাবিক গলায় প্রশ্ন করলেন,

“জব করার পারমিশন তোমাকে কে দিয়েছে? তোমার বাবা?”

প্রকৃতি তুলনামূলক ভাবে সুপ্রীতির চেয়ে ভুল ত্রুটি কম করেছে। মায়ের পছন্দ, মেজাজ মর্জি বুঝে চলেছে বলে কেস কম খেয়েছে। মা’কে সরাসরি অপছন্দ কখনো করে নি ও কিন্তু সুপ্রীতির ঘটনার পর থেকে করতে বাধ্য হচ্ছে। প্রকৃতি মায়ের সঙ্গে কথা বলার সময় গলার স্বরের ব্যাপারে সচেতন থাকে। গলার স্বর নমনীয় হলে কনভার্সেশন চালিয়ে যাওয়া সহজ নাহলে মায়ের মেজাজ তিরিক্ষি হয়ে গেলে হাত উঠে যায় সোজা। এই প্রথম প্রকৃতি মাপজোপ ছাড়া কথা বলছে।

“গ্রাজুয়েশন শেষ। সিজিপিএ ভালো, জবের জন্য চেষ্টা করব অফ কোর্স। কারো পারমিশন এর তো দরকার নেই।”

স্বপ্না নিজেও ছোট মেয়ের গলার স্বর শুনলেন। তার স্বামী বেশ ভালো খেলা খেলছেন তার সঙ্গে। মেয়েরা এখন মায়ের সঙ্গে অন্য সুরে কথা বলার সুযোগ পাচ্ছেন।

“প্রকৃতি, মা শোনো তোমাকে চাকরির পিছনে ছুটতে হবে না। তোমার বড় বোন কিন্তু চাকরির সুযোগ পায় নি। তুমিও পাবে না। বিয়ের প্রিপারেশন নাও, আর চাকরি করতে হলে বিয়ের পর হাজবেন্ডের ইচ্ছেতে করবে। ”

প্রকৃতির প্রতিক্রিয়া ভীষণ শান্ত। বোতল থেকে অনেকটা পানি খেয়ে বলল,

“মাই লাইফ, মাই রুলস মা। পোষালে বাড়িতে থাকব, আদারওয়াইজ বাড়ি ছেড়ে দেব। তোমার নাটক দেখে জাস্ট ক্লান্ত হয়ে গেছে। ”

স্বপ্না স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। কাঁপা গলায় বললেন,

“কী বললি?”

“আসলেই তোমার নাটক দেখে ক্লান্ত হয়ে গেছি মা। কারণ আপুর বিয়ে তোমার পছন্দে হয়েছে। আর তারপর যেসব কান্ড করেছ ছি:!”

এই ছি: শব্দটা স্বপ্নার মাথায় আগুন জ্বালিয়ে দেয় যেন। প্রকৃতির হাত চেপে ধরে শক্ত করে। প্রকৃতি এক ঝটকায় হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলে,

“তুমি লিমিট ছাড়িয়ে গেছ মা। আর বাড়াবাড়ি কোরো না।”

সেই সময়ে বাবা এলেন। এসে প্রকৃতিকে বললেন,

“চল বের হই আমরা। ”

স্বপ্না বলেন,

“ও’কে চাকরি করার পারমিশন তুমি দিচ্ছো? শুনলাম আজকাল তুমি দুই মেয়েকে নিয়ে খুব সিদ্ধান্ত নেয়া শিখে গেছ। ”

“ঠিক শুনেছ। ”

“আচ্ছা। আমাকে কোনঠাসা করার প্ল্যান চলছে? ”

“না। আমরা তোমার নোংরা প্ল্যান থেকে বাঁচতে চাই। ”

“নোংরা প্ল্যান? ”

“হ্যাঁ। অর্ণবের ব্যাপার টার পর আমার মনে হয়েছে আর চুপ থাকা উচিত না। কিন্তু তোমার লেভেলেও তো নামা সম্ভব না। তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে তুমি তোমার লেভেলেই থাকো। আমরা নাহয় তোমাকে বর্জন করব।”

স্বপ্না উপহাসের সুরে বলল,

“কী করবে?”

“প্রকৃতির চাকরি হয়ে গেলে আমি এই বাসা ছাড়ব। খুব প্রয়োজন মনে হলে সংসারের সঙ্গে সঙ্গে তোমাকেও ত্যাগ করব। তুমি তোমার অহংকার, সো কল্ড সোসাইটি আর থার্ড ক্লাশ মানুষজন নিয়ে থাকো। বাচ্চাদের জন্য তোমার নোংরা মস্তিষ্কের চিন্তাভাবনা অনেক মেনে নিয়েছি। কিন্তু কী হলো! সুপ্রীতিকে কতো বড় একটা যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে যেতে হলো। তোমার আদরের ছেলের চোখগুলো রাত জেগে পড়ার জন্য নয় বরং কোকেন দেয়ার জন্য লাল হয়েছে। এখন তো আর আমার কোনো কিছু মেনে নেবার প্রয়োজন নেই।”

স্বপ্না স্থির চোখে তাকিয়ে রইলেন। স্বামীর সহজ গলায় বলা কথাগুলো তার কাছে ভয়ংকর লাগলো। সব তাহলে সত্যিই বেরিয়ে যাচ্ছে তার হাত থেকে।

***
“আমার মনে হয় তোমার জন্য আমরা শুধু শুধু ছোটাছুটি করছি। কোনোকিছু করা সম্ভব না।”

ফাহাদ হতভম্ব গলায় জিজ্ঞেস করলো,

“সম্ভব না মানে?”

“কোর্টে মামলা উঠলে ইকরা সহজে জিতে যাবে। ওর কাছে প্রমাণ আছে। ও’কে তুমি আঘাত করেছ আগে।”

“হ্যাঁ কিন্তু কেন করেছি? ওর কাজের জন্যই তো। ”

“দূর্বল পয়েন্ট এটা ভাইয়া। এবোর্শনের আগে তুমি ও’কে থাপ্পড় মেরেছ।”

“ইকরার সঙ্গে তোর কথা হয়েছে?”

“না। সোশ্যাল মিডিয়ায় ইকরার পোস্ট বেশ আলোড়ন তুলেছে আবারও। ”

ফাহাদ হাত মুষ্টিবদ্ধ করলো। হঠাৎ মনে পড়ে গেল এমন ভঙ্গিতে বলল,

“আমার বন্ধু মিরাজের সাথে কথা বল। নাতাশাকে আসতে বলেছিলাম ও আসলো না কেন?”

ইশরাক একটু চুপ থেকে বলল,

“ভাইয়া তুমি একটা ডার্টি গেম খেলতে চাইছ নাতাশা ভাবীর সঙ্গে। নাতাশা ভাবী তোমার হয়ে কোর্টে কথা বলবে ইকরার বিরুদ্ধে এমনটা চাইছ তো?”

“হ্যাঁ। আমি নাতাশার সঙ্গে সব মিটমাট করব।”

“সরি। ঠিক এই কারণে আমি কেস টা থেকে হাত ধুয়ে নিচ্ছি। আমি আর কিছু করব না। তোমার আসলেই কোনো মনুষ্যত্ব নেই। বাড়ির লোক তোমার ব্যাপারে কী ভেবেছে সেটাও এখন তোমার জেনে নেয়া উচিত। বংশের মান সম্মান খোয়ানোর জন্য বাবা চাইছেন না আমি তোমাকে জেল থেকে ছাড়াই। কারণ তোমার কখনো শিক্ষা হবে না। একটা শিক্ষা তোমার হওয়া উচিত। আর তোমার বাবা কী চাইছেন জানো? সে চাইছেন নাতাশা ভাবী আর পালক কে দেশের বাইরে পাঠিয়ে দিতে। যতদিন পর্যন্ত ওরা ভালোভাবে দেশের বাইরে সেটল্ড নাহয় ততদিন তুমি যেন এখানে থাকো সেই ব্যবস্থা করতে। প্রয়োজনে উকিল কে টাকা দিয়ে তোমাকে এখানে রাখার ব্যবস্থা করা হবে। কারণ তুমি বের হলে নাতাশা ভাবীর জীবন টা নরক বানিয়ে দিবে। ”

ফাহাদ ভাষা হারিয়ে ফেলল। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো ইশরাকের দিকে। ইশরাক আবারও বলল,

“আজকের পর আমি বা ঝিলিক কেউই আর আসব না দেখা করতে। নাতাশা ভাবী আসলে এতো অন্যায় ডিজার্ভ করে না। তবে তার সঙ্গে যা করেছ আর যেভাবে তাকে ছোট করে দেখছ তাতে এটুকু শাস্তি তুমি ডিজার্ভ করো।”

***
সুপ্রীতি আর অর্ণব নাতাশাকে বলল পালকের দাদার প্রস্তাব মেনে নিতে। নাতাশা ভরসা পায় না। অর্ণব বলেছে সব ব্যবস্থা ও করে দিবে। টাকা, পয়সা যেখানে যা লাগবে সেগুলো নিয়ে নাতাশা যেন না ভাবে। এখন ওরা টাকা দিবে ধার হিসেবে। নাতাশা একটু থিতু হয়ে যখন ইনকাম শুরু করবে তখন টাকা শোধ দেবার কথা ভাবলেই হবে। সকলে বলার পর নাতাশা রাজী হলো। হতে বাধ্য হলো। সত্যি তো, মেয়েটার মানসিক অবস্থা কী হবে এখানে থাকলে। ফাহাদ এসে নিশ্চয়ই টানা হ্যাচড়া করবে মেয়েকে নিয়ে। তাও যদি ভালোবেসে মেয়েকে চাইতো। ও তো এখন এসে জেদ দেখাবে নাতাশাকে হারিয়ে দেবার জন্য। নাতাশা আর হারতে চায় না, হারবেও না।

চলবে….