#মেঘলা_দিনের_রোদ্দুর(২)
#Israt_Bintey_Ishaque(লেখিকা)
ফোনের ওপাশে ফারিস এতটাই রেগে ছিল যে তার কথাগুলো যেন আগুনের মতো ঝরে পড়ছিল। সায়ান কিছুটা ভয় পেয়ে গিয়েছিল, কিন্তু তবুও সে শান্তভাবে বলল, “ফারিস, তুই যা ভাবছিস, ব্যাপারটা আসলে তেমন নয়। আমাকে একটু কথা বলার সুযোগ দে।”
কিন্তু ফারিস আর কিছু শুনতে রাজি ছিল না। ফোনের ওপাশ থেকে শেষ কথা শোনা গেল, “কথা বলার কোনো দরকার নেই! তুই এখন আমার কাছে আসবি।”
ফারিস ফোন কেটে দিল। সায়ান ফোন হাতে নিয়ে স্তব্ধ হয়ে বসে রইল। কীভাবে ফারিস এত বড় ভুল বোঝায় পড়ল, আর এই পরিস্থিতি কীভাবে সামাল দেবে, সেটাই ভাবতে লাগল।
ফোনে মেসেজ টোন বেজে উঠলে সায়ান চেক করে দেখে, ফারিস একটা ঠিকানা দিয়েছে, সেখানে তাকে যেতে বলেছে।
সায়ান দ্রুত ওয়ারড্রোব খুলে একটা শার্ট বের করল। হুট করে পরতে গিয়ে বোতামগুলো ভুল জায়গায় লাগিয়ে ফেলল। তবু সময় নষ্ট না করে সে আবার ঠিকঠাক করে নিল। দরজার দিকে পা বাড়াতেই তার মা পিছন থেকে ডাক দিলেন।
“এই সময় কোথায় যাচ্ছিস?”
সায়ান থমকে দাঁড়াল। কিছুটা গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
“ফারিস এর সাথে দেখা করতে যাচ্ছি।
মা আর কিছু বলতে পারলেন না। সায়ান দ্রুত দরজা খুলে বেরিয়ে পড়ল।
.
.
সায়ান বাইক চালিয়ে দ্রুত পৌঁছে যায়। গিয়ে দেখে ফারিস আগেই এসে দাঁড়িয়ে আছে। জায়গাটা ছিল একটা টং দোকান, সাথে একটা বড় খেলার মাঠ। এখানে সময় পেলেই সায়ান আর ফারিস বন্ধুরা মিলে আসতো কিছু সময় কাটানোর জন্য। আজও সায়ান আশা করছিল, হয়তো কিছু ভুল বোঝাবুঝি হবে, কিন্তু পরিস্থিতি ছিল ভিন্ন।
সায়ান এগিয়ে যেতেই ফারিস এক হাত বাড়িয়ে তাকে এক ঘুষি মারল। সায়ান চমকে গিয়ে বলল,
“এটা কী করলি?”
ফারিস চোখে রা*গ আর অভিমান নিয়ে বলে উঠল,
“আজকে তোর জন্য নাদিয়ার সাথে ব্রেকআপ হয়ে যাচ্ছিল! তুই এসব কেন লিখেছিস?”
সায়ান মুখে একটা আহঃ শব্দ করে বলল,
“আরে আমার কী দোষ? ঐ মেয়েটা এসে তার ভাইয়ের নামে এসব লিখে দিতে বলল। আমি জানতাম না যে সেটা তোর বোন।”
ফারিস তীব্র রাগে তার দিকে তাকিয়ে বলল,
“একজন এসে বলল আর তুই লিখে দিবি? তোর আক্কেল দেখে তো আমি রীতিমত নির্বাক হয়ে যাচ্ছি।”
সায়ান একটু ক্ষণস্থায়ী চুপ থেকে উত্তরে বলল,
“তোর যে বোন আছে, সেটা তো কখনো বলিস নাই। উল্টো তো বলেছিলি, ‘তোরা তিন ভাই’—একদিন সাদিক তো জিজ্ঞাসা করেছিল, তোর বোন আছে কিনা? তখনও মিথ্যা বলেছিলি। বলেছিলি, তোর কোনো বোন নেই।”
ফারিস কিছুক্ষণ চুপ রইল, তারপর শান্ত কণ্ঠে বলল,
” এসব পাগল ছাগলের কথা বলি নাই কেন আজকেই তো দেখতে পেলি। তাছাড়া বন্ধুরা বোনকে নিয়ে কথা বলুক এটা আমার পছন্দ না।”
সায়ান মাথা নেড়ে বলল,
“বুঝতে পেরেছি। চল, বসে কথা বলি।”
দুজনে কাছের একটা দোকানে বসে পড়ল। ফারিস দোকানি মামাকে চায়ের অর্ডার দিয়ে সায়ানের দিকে তাকাল।
সায়ান বলল,
“এবার বল, এত ছোট ব্যাপারের জন্য তোদের ব্রেকআপ হতে যাচ্ছিল কেন?”
ফারিস গভীর শ্বাস নিয়ে বলল,
“নাদিয়া সবসময় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকতে পছন্দ করে। কিন্তু ও মনে করেছে, আমি নাকি প্রতিদিন গোসল করি না! যা লিখেছিস তাতে ভুল বুঝে সবকিছু অন্যভাবে দেখেছে। আর এসব মিলিয়েই নাদিয়া আমাকে ভুল বোঝে।”
সায়ান আফসোসের সুরে বলল,
“তোদের যদি সত্যিই ব্রেকআপ হয়ে যেত, তাহলে আমি তোর বোনকে চকলেট কিনে দিতাম!”
ফারিস চোখ পাকিয়ে তাকালে সায়ান হেসে বলল,
“দেখ, এত সামান্য বিষয়ে যে ব্রেকআপ করতে পারে, সে তো কিছু হলেই ডিভোর্সের কথা বলবে। তার চেয়ে ভালো, এই হারাম সম্পর্কটা এখনই শেষ কর। এসব সম্পর্কে কোনো শান্তি নেই।”
সায়ানের কথা শুনে হঠাৎ উঠে দাঁড়াল ফারিস। সায়ানের দিকে তাকিয়ে বলল,
“খুব শিগগিরই তুই আমার বিয়ের দাওয়াত পাবি!”
কথা শেষ করেই ফারিস চলে গেল।
সায়ান হতভম্ব হয়ে ফারিসের চলে যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে রইল।
নিজে নিজেই বলল,
“আমি কী বললাম আর এই ছেলে কী বলে গেল? আজব ব্যাপার!”
.
.
বেশ কিছুদিন পরের কথা। একদিন হঠাৎ করেই নাবিহা এসে উপস্থিত হলো সায়ানের কেবিনে। সায়ান তাকে দেখে একটু অবাক হলেও কিছু বলার সুযোগ পেল না। নাবিহা সামনে রাখা চেয়ারে বসে পড়ল এবং মুচকি হেসে বলল,
“আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। নিন, চকলেট খান। আপনার জন্য আমার অনেক উপকার হয়েছে। তাই আপনাকে চকলেট দিতে এসেছি।”
নাবিহার গায়ে তখনো স্কুলের ইউনিফর্ম। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, সে সরাসরি স্কুল থেকে এসেছে।
সায়ান গম্ভীর মুখে বলল,
“আমি চকলেট খাই না।”
নাবিহা সায়ানের গম্ভীর মুখ দেখে কিছুটা থমকে গেল। তারপর চকলেটটি সায়ানের টেবিলের ওপর রেখে বলল,
“আপনি চকলেট খান বা না খান, এটা আপনার জন্য। আমি না হয় খাওয়ার চাপ দেব না। তবে ধন্যবাদ জানাতে এসেছিলাম, সেটা তো নিতে পারবেন, তাই না?”
” আমি যদি জানতাম আমার বন্ধু আপনার ভাই তাহলে কখনোই আপনার এই উপকার করতাম না। আপনার জন্য ফারিস আমাকে ভুল বোঝে।”
নাবিহা গালে হাত দিয়ে চিন্তায় ডুবে ভাবল, “আমিও তো বড়সড় একটা থাপ্পড় খেয়েছি। কিন্তু সেকথা কিছুতেই বলা যাবে না।”
সায়ান দৃষ্টি নিচে রেখেই বলল,
“আচ্ছা, আপনি ফারিসের ফোনে ঢুকে এত কিছু করলেন কীভাবে? ওর ফোনের পাসওয়ার্ড তো আপনাকে বলার কথা নয়।”
নাবিহা মুচকি হেসে দুষ্টু ভঙ্গিতে বলল,
“ভাইয়া তখন ঘুমাচ্ছিল। আমি তার ফোন নিয়ে তার হাতের ফিঙ্গার দিয়ে লক খুলে ফেলেছি। কেমন দারুণ না ব্যাপারটা?”
সায়ান হতভম্ব হয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর মাথা নেড়ে বলল,
“আপনি তো একেবারে ডেঞ্জারাস মেয়ে!”
নাবিহা মুখ টিপে হেসে বলল,
“কী করব বলুন? ওই সময়ে আর কোনো উপায় ছিল না।”
সায়ান মৃদু হেসে বলল,
“আপনি হয়তো এটাকে মজার বিষয় ভাবছেন, কিন্তু বুঝতেই পারছেন না, এমন কাজ সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে। ফারিসের মতো রাগী মানুষ হলে তো কথাই নেই।”
নাবিহা কিছুটা লজ্জা পেয়ে নিচু গলায় বলল,
“হয়তো ভুল করেছি কিন্তু এতে আমার উপকার হয়েছে। ভাইয়া আর আমাকে বিরক্ত করে না এখন।”
” আচ্ছা আপনি এখন বাসায় যান। আর এখানে আসবেন না ফারিস ভুল বুঝতে পারে। তাছাড়া এভাবে আপনার আসা উচিৎ ও নয়।
শেষের কথাটায় নাবিহার মন খারাপ হয়ে গেল কেন সে নিজেও বুঝতে পারলো না তাই কিছু না বলেই কেবিন থেকে বেরিয়ে গেল।
সায়ান সেসবে পাত্তা দিল না। খুব ছোট বেলায়ই মাকে হারিয়েছিল সে। মায়ের শূন্যতা পূরণ করতে বাবা একসময় তার জন্য নতুন মা নিয়ে আসেন। সায়ান ধীরে ধীরে বড় হতে থাকে। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস—একদিন বাবাও তাকে ছেড়ে চলে যান।
বাবার মৃত্যু সায়ানকে গভীরভাবে নাড়া দেয়। সেই দিনই সে উপলব্ধি করেছিল, এই দুনিয়া ক্ষণিকের। এখানে কেউ চিরস্থায়ী নয়। একদিন তাকেও এই পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হবে। তাই এই অল্প সময়কে কোনোভাবেই অপচয় করা যাবে না। সায়ান দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়েছিল, জীবনের বাকি সময় আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের (সা.) নির্দেশিত পথে চলবে, কারণ এটাই একমাত্র সঠিক পথ। সে সর্বদা চেষ্টা করে পরনারীর থেকে দুরত্ব বজায় রাখতে।
.
.
এদিকে, নাবিহা সায়ানের হাসপাতাল থেকে আসার পর থেকেই কিছুটা মনমরা হয়ে থাকে। তার এই পরিবর্তন তার মা লক্ষ্য করেন এবং ফারিসকে জানিয়ে দেন। প্রথমে ফারিস এ ব্যাপারে তেমন গুরুত্ব না দিলেও, কিছুদিন পর সে আর চুপ থাকতে পারে না। নাবিহাকে সরাসরি জিজ্ঞেস করে, “তোর কিছু হয়েছে কি? মনখারাপ করে থাকিস কেন?”
নাবিহা ভাইয়ের প্রশ্নে কিছুটা অবাক হলেও দ্রুত উত্তর দেয়, “না, কিছু হয়নি। আমি ঠিক আছি।”
তবে তার চোখে একটা অজানা বিষণ্নতা ছিল, যা সে আড়াল করার চেষ্টা করছিল।
ফারিস, যদিও প্রথমে বিশ্বাস করেনি, তবে সে বুঝতে পারে নাবিহার মধ্যে কিছু সমস্যা আছে, যা সে অন্যদের কাছে বলতে চাইছে না। সে সিদ্ধান্ত নেয়, নাবিহাকে একটু সময় দেয়ার জন্য, যেন সে নিজে থেকে খোলামেলা হয়ে তার মন খুলে বলতে পারে।
#চলবে… ইনশা আল্লাহ।