মেঘলা দিনের রোদ্দুর পর্ব-০৫

0
906

#মেঘলা_দিনের_রোদ্দুর(৫)
#Israt_Bintey_Ishaque(লেখিকা)

নরম আলোয় ভেজা একটি শান্ত সকাল। সূর্যের কোমল রশ্মি আস্তে আস্তে ঘরের জানালা দিয়ে উঁকি দিচ্ছে। হালকা শীতের পরশে বাতাসে মিশে আছে সদ্য ফুটে ওঠা ফুলের ঘ্রাণ। পাখিরা যেন নিজেদের মিষ্টি গানে নতুন দিনের আগমনী বার্তা দিচ্ছে। দূরে কোথাও তাদের কিচিরমিচির শোনা যাচ্ছে, যা মনটাকে আরো প্রশান্ত করে দিচ্ছে।

এক কাপ গরম চা হাতে বারান্দায় বসে নরম রোদ গায়ে মাখে নাবিহা। আকাশে মেঘের সাদা তুলোর মতো ভেলা, মাঝেমাঝে ঠান্ডা বাতাস এসে চুল এলোমেলো করে দিচ্ছে তার। চারপাশে সবুজের ছোঁয়া, দূরে শিশিরে ভেজা ঘাসের উপর ছোট। পায়ের ছাপ রেখে কিছু পাখি হাঁটছে। এমন সকালে যেন পৃথিবী একটু থেমে গেছে, শুধু প্রকৃতি আর মনের একাত্মতায় মিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে নাবিহা। আগে সে প্রকৃতি নিয়ে এতো ভাবতো না কিন্তু ইদানিং প্রকৃতির মায়া তাকে ভীষণ টানে।

নাবিহার এসএসসি পরীক্ষা আসন্ন, আর মাত্র কয়েক মাস বাকি। এই কারণেই সে এখন আর স্কুলে যায় না। তবে স্কুলে না যাওয়ার আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ রয়েছে—স্কুলে গেলে পর্দার খেলাপ হয়। তার আগের বন্ধুরা এসে নিজে থেকেই কথা বলতে শুরু করে, যা নাবিহার জন্য অস্বস্তিকর হয়ে ওঠে।

পর্দা রক্ষা এবং পড়াশোনার প্রতি মনোযোগী থাকার জন্য নাবিহা তার মাকে জানায় যে, বাসায় এসে পড়ানোর জন্য একজন শিক্ষিকা ঠিক করা উচিত। মাও মেয়ের কথায় রাজি হয়ে একটি অনার্স পড়ুয়া মেয়েকে ঠিক করেন, যিনি নিয়মিত নাবিহার বাসায় এসে পড়িয়ে যান। এতে নাবিহার পড়াশোনা যেমন ঠিকঠাক চলছে, তেমনি তার পর্দার বিষয়েও কোনো ব্যাঘাত ঘটছে না।
.
.
নাবিহার নতুন শিক্ষিকা, তাসনিয়া, প্রথম দিন থেকেই খুব আন্তরিক। তিনি নাবিহাকে শুধু পড়াশোনায় সাহায্য করেন না, বরং তার আত্মবিশ্বাস বাড়ানোর জন্যও পরামর্শ দেন। নাবিহার পর্দার প্রতি আগ্রহ এবং দ্বীনদার জীবনের প্রতি তার মনোযোগ তাসনিয়ার মনেও প্রভাব ফেলে।

তাসনিয়া নিজেও আগে কিছু বিষয়ে উদাসীন ছিলেন, কিন্তু নাবিহার সরলতা এবং দ্বীনদার জীবনধারার প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি দেখে তার মনে পরিবর্তন আসতে শুরু করে। তিনি নিজেও ধীরে ধীরে নিজেকে দ্বীনের পথে আরও গভীরভাবে যুক্ত করার সিদ্ধান্ত নেন।

একদিন তাসনিয়া পড়ানোর সময় নাবিহাকে জিজ্ঞেস করলেন,
“তুমি এত কম বয়সেই কীভাবে এমন শক্তভাবে নিজের সিদ্ধান্তে অটল থাকতে পারো? আমি তোমার জায়গায় থাকলে হয়তো এতটা পারতাম না।”
নাবিহা মৃদু হেসে বলল,
“আপু, আমাদের জীবনে সবার আগে আল্লাহর সন্তুষ্টি। আমি যদি জানি যে আমার এই ছোট্ট চেষ্টা আল্লাহ পছন্দ করবেন, তবে কেন করব না?”

তাসনিয়া গভীরভাবে নাবিহার কথা ভাবতে লাগলেন। এভাবে পড়ানোর পাশাপাশি তাদের মধ্যে একটি সুন্দর বোনের মতো সম্পর্ক গড়ে উঠল।

এর মধ্যে নাবিহার পড়াশোনা আরও গুছিয়ে চলছে। কিন্তু একদিন, নাবিহা তাসনিয়াকে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত অবস্থায় দেখতে পায়। নাবিহা জিজ্ঞেস করলে তাসনিয়া জানায়,
“আমার পরিবার থেকে আমার ওপর বিয়ের চাপ দিচ্ছে, যা আমার দ্বীনদার জীবনের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে।”

এরপর নাবিহা তাসনিয়া আপুকে সান্ত্বনা দিয়ে বলে,
“আপু, আল্লাহর ওপর ভরসা রাখুন। যেই পরিস্থিতিই আসুক, আপনি দ্বীনের পথে থাকবেন। আমি আপনার পাশে আছি।”

নাবিহার কথা শুনে তাসনিয়া নতুন করে সাহস পান এবং নিজের পরিবারকে বুঝিয়ে বলেন। এভাবেই তারা একে অপরের জীবনকে দ্বীনের পথে এগিয়ে নিতে সাহায্য করতে থাকে।

এদিকে, নাবিহার পরীক্ষার সময়ও ঘনিয়ে আসে। শেষ পর্যন্ত তাসনিয়া আপুর সাহায্য এবং নিজের অধ্যবসায়ে নাবিহা পরীক্ষায় চমৎকার ফলাফল করে। এরপর তাদের সম্পর্ক আরও দৃঢ় হয় এবং তারা একসঙ্গে দ্বীনের কাজে অংশগ্রহণ করতে থাকে, যা তাদের জীবনে সত্যিকারের শান্তি এনে দেয়। যখন কেউ আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য নিজের পথ ঠিক করে নেয়, তখন আল্লাহ তাদের জন্য সাহায্যের রাস্তা খুলে দেন।
.
.
এখন নাবিহা আপাতত অবসর সময় পার করছে। তাই ঘরে বসে না থেকে কোথাও ঘুরতে যেতে ইচ্ছে করছে তার। একা একা কোথাও যেতে দিবে না তার ভাই, সে জন্য তাসনিয়া কে সাথে নিয়ে নেয় নাবিহা।
নাবিহা আর তাসনিয়া মিলে সিদ্ধান্ত নিলো শহরের কোলাহল থেকে একটু দূরে কোনো শান্ত পরিবেশে ঘুরতে যাবে। অনেক খোঁজাখুঁজির পর তারা ঠিক করলো শহরের উপকণ্ঠে অবস্থিত একটি ছোট নদীর পাড়ে যাবে। জায়গাটি সবুজে ঘেরা, যেখানে প্রকৃতির ছোঁয়া মনকে শান্তি এনে দেয়।

তারা দুপুরের দিকে রওনা হলো। নদীর পাড়ে পৌঁছে প্রথমেই তাদের দৃষ্টি কাড়ে বিশাল কাশফুলের বন। হালকা বাতাসে কাশফুলগুলো দুলছে, যেন প্রকৃতি নিজেই তার সৌন্দর্যের গান গাইছে। নাবিহা মুগ্ধ হয়ে বলে উঠল,
“আপু, এখানে এসে মনটা যেন কেমন হালকা লাগছে!”
“আমারো ভীষণ ভালো লাগছে গো….”

নদীর পানি ছিল স্বচ্ছ, যেন আকাশের নীল রঙ পানিতে মিশে গেছে। তাসনিয়া পা ডুবিয়ে বসে পড়ে, আর নাবিহা মাটিতে বসে নদীর স্রোতের দিকে তাকিয়ে থাকে। পাখির কিচিরমিচিরে পরিবেশ আরও মোহনীয় হয়ে উঠেছিল। পাশেই ছিল একটি বড় গাছ, যার নিচে ছায়ায় তারা দু’জনে বসে গল্প করছিল।

একসময় সূর্যটা পশ্চিম আকাশে ঢলে পড়ে, চারপাশে কমলা আভার সৃষ্টি করে। নাবিহা হঠাৎ বলে উঠল, “আপু, জীবন যদি প্রকৃতির মতো এতটাই শান্ত হতে পারতো, কী ভালো হতো, তাই না?”
তাসনিয়া হাসি দিয়ে সায় দেয়।
তারপর জিজ্ঞাসা করে,
” আচ্ছা বনু তোমার মধ্যে কেমন করে দ্বীনের দাওয়াত পৌঁছালো? আমাকে বলা যাবে?”

নাবিহা কিছুক্ষণ পায়ের কাছে থাকা ঘাস গুলো নাড়াচাড়া করতে করতে বলল,
” আমি তোমাকে বলবো কিন্তু তুমি কাউকে এইসব বলতে পারবে না, ঠিক আছে?”

তাসনিয়া মাথা দুলিয়ে বলল,
” আচ্ছা বলবো না, তুমি নিশ্চিন্তে বলতে পারো।”

নাবিহা কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকল, যেন কথাগুলো ঠিকভাবে সাজিয়ে নিচ্ছে। তারপর ধীরে ধীরে বলতে শুরু করল, “একজন ডাক্তারকে আমার ভীষণ ভালো লাগে! তিনি খুবই ধার্মিক একজন মানুষ।”

তাসনিয়া একটু অবাক হয়ে বলে উঠল, “ডাক্তার! তার মধ্যে এমন কী দেখলে যে তুমি এতটা মুগ্ধ হলে?”

নাবিহা মুচকি হেসে বলল, “তুমি জানো না, তিনি কেবল একজন ভালো ডাক্তারই নন, বরং একজন উত্তম মানুষ। রোগীদের সাথে কথা বলার সময় তার ব্যবহার, তার সহমর্মিতা—সবই যেন দ্বীনের আদর্শের প্রতিচ্ছবি। তিনি সবসময় রোগীদের শরীরের চেয়েও তাদের আত্মার যত্ন নেওয়ার কথা বলেন।”

তাসনিয়া মুগ্ধ হয়ে শুনছিল। নাবিহা আবার বলতে শুরু করল, “আমি প্রথম তার কাছে গিয়েছিলাম আমার ভাইয়া যে গিধড় তার একটা সার্টিফিকেট নিতে।

তারপর একদিন তিনি আমার পোশাক দেখে বলেছিলেন, “কি সব পোশাক আশাক পরেছেন? মৃত্যুর ভয় নেই আপনার? তাছাড়া আপনি আপনার স্বামীর আমানত। এভাবে পরপুরুষের সামনে নিজেকে প্রদর্শন করে বেড়াবেন না।”
সেই দিন থেকে আমি দ্বীনের পথে আরো গভীরভাবে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করি।”

তাসনিয়া চুপচাপ শুনে যাচ্ছিল, আর নাবিহা বলে চলল, “তার নাম ড. সায়ান চৌধুরী। তার মতো একজন মানুষ আমার জীবনে আলোর পথ দেখিয়েছে। তার মাধ্যমে আমি বুঝতে পেরেছি, দুনিয়ার সৌন্দর্য একদিন ফুরিয়ে যাবে, কিন্তু আখিরাতের সৌন্দর্য চিরন্তন।”

তাসনিয়া গভীরভাবে বলল, “আলহামদুলিল্লাহ, নাবিহা। আল্লাহ তাকে তোমার জন্য হিদায়াতের মাধ্যম বানিয়েছেন। সত্যিই ভাগ্যবান তুমি।”

নাবিহা মৃদু হাসল। বলল,
” আমি ভাগ্যবান সেদিন হবো, যেদিন এমন একজন কে নিজের করে পাবো। যেদিন তিনি আমাকে সাহায্য করবেন দ্বীনের পথে চলতে।”

তাসনিয়া নাবিহার কথা মন দিয়ে শুনছিল, কিন্তু তার চোখ পড়ল নাবিহার মুখের এক অদ্ভুত মায়াবী হাসিতে। নাবিহা যখন ড. সায়ান চৌধুরীর কথা বলছিল, তার চোখে এক অন্যরকম উজ্জ্বলতা দেখা যাচ্ছিল।

তাসনিয়া নীরবে নাবিহার দিকে তাকিয়ে অনুভব করল, নাবিহা এই ডাক্তারকে শুধু শ্রদ্ধা বা প্রশংসাই করে না, বরং তার হৃদয়ে এক গভীর অনুভূতিও বয়ে বেড়ায়।

একটু মুচকি হেসে তাসনিয়া বলল, “নাবিহা, তুমি কি জানো? তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে, তুমি তাকে শুধু পছন্দ করো না, তাকে খুব মনের গভীর থেকে ভালোও বাসো।”

নাবিহা হঠাৎ চমকে গেল। তার গাল লজ্জায় লাল হয়ে উঠল। ঘাসের দিকে তাকিয়ে মৃদুস্বরে বলল, “আপু, এমন কিছু না। আমি শুধু তার ব্যক্তিত্ব আর দ্বীনদারি দেখে মুগ্ধ হয়েছি।”

তাসনিয়া হেসে বলল, “হ্যাঁ হ্যাঁ, আমি বুঝেছি। তবে তোমার এই মুগ্ধতা যেন কোথাও হারিয়ে না যায়। আল্লাহর কাছে দোয়া করো, যেন তোমার ভালোবাসা হালাল পথেই পূর্ণতা পায়।”

নাবিহা মাথা নিচু করে বলল, “ইনশাআল্লাহ। তবে আমি জানি, এটা হয়তো কখনো সম্ভব হবে না। তিনি অনেক বড় মাপের মানুষ, আর আমি তো স্রেফ সাধারণ এক মেয়ে।”

তাসনিয়া তার হাত ধরে বলল, “তুমি জানো না আল্লাহ কী পরিকল্পনা করেছেন। সবকিছু তাঁর ইচ্ছাতেই ঘটে। তোমার দোয়া করতে কোনো বাধা নেই। আর যাই হোক, তার মতো একজন মানুষ তোমার জীবনে হিদায়াতের কারণ হয়ে এসেছে—এটাই অনেক বড় পাওয়া।”

নাবিহা একটু হাসল, তবে তার চোখের কোণায় লুকিয়ে থাকা অনুভূতিগুলো তাসনিয়া ঠিকই ধরে ফেলল।
তারপর আরো কিছুক্ষণ এইভাবে প্রকৃতির মাঝে একটি বিকেল কাটিয়ে, মন শান্ত আর স্মৃতিতে ভরা তারা ফিরে আসে, নিজেদের ভেতরে এক নতুন প্রশান্তি নিয়ে।

#চলবে.. ইনশা আল্লাহ।