মেঘলা দিনের রোদ্দুর পর্ব-০৭

0
290

#মেঘলা_দিনের_রোদ্দুর(৭)
#Israt_Bintey_Ishaque(লেখিকা)

তাসনিয়ার পরিবার ও পাত্রপক্ষ বিয়ের দিন-তারিখ ঠিক করার জন্য একটি আনুষ্ঠানিক আলোচনার আয়োজন করে। নাবিহাও এতে আমন্ত্রিত হয়, কারণ তাসনিয়া চায় তার সবচেয়ে কাছের বোনটি এই বিশেষ মুহূর্তের অংশ হোক।

সেই দিন সকালে তাসনিয়া নাবিহাকে ফোন দিয়ে বলল,
— “নাবিহা, তুমি কিন্তু ঠিক সময়ে আসবা। তুমি না থাকলে আমার সাহসই হবে না।”

নাবিহা হেসে বলল,
— “তুমি এতটাই নার্ভাস হচ্ছো কেন? সব তো ঠিকঠাকই চলছে। চিন্তা ক‌ইরো না, আমি সময়মতো আসব ইনশা আল্লাহ।”

বিকেলের আয়োজন শুরু হয়েছে। পাত্রপক্ষের আগমন ঘিরে চারপাশে উৎসবমুখর পরিবেশ। তাদের মধ্যে হাসি-আনন্দে মুখরিত আলোচনা চলছে। সবাই একসঙ্গে বসে তাসনিয়ার বিয়ের দিনক্ষণ ও অন্যান্য আনুষ্ঠানিকতা নিয়ে কথা বলছে।

নাবিহা যথাসময়ে এসে পৌঁছায়। তাসনিয়াকে সুন্দর করে সাজিয়ে তোলে সে। তাসনিয়া লজ্জায় কিছুটা নীরব, কিন্তু তার চেহারায় এক ধরণের মিষ্টি আভা ফুটে উঠেছে। সাজানোর কাজ শেষ হলে তাসনিয়ার হবু শাশুড়ি এবং ননদ এসে তাকে দেখতে যান। তাসনিয়ার পাশে বসা নাবিহার সঙ্গেও তাদের সৌজন্য সাক্ষাৎ হয়।

একসময় নাবিহা হাসিমুখে পাত্রের বোন সানজিদার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে,
“আপু, আমার দুলাভাই কোন বিষয়ে বিশেষজ্ঞ?”

সানজিদা মিষ্টি হেসে উত্তর দিলেন,
“জ্বি, উনি মেডিসিন বিশেষজ্ঞ।”

নাবিহা হেসে বলল,
“আসলে তাসনিয়া আপু লজ্জায় কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করতে পারছিল না। তাই আমি আপনাকে জিজ্ঞেস করলাম। কিছু মনে করবেন না আপু।”

সানজিদা হেসে আশ্বস্ত করলো,
“ওহ, না না! কিছুই মনে করিনি। তুমি তো খুব আদুরে করে জিজ্ঞেস করলে।”

নাবিহা বরাবরের মতোই বোরকা পরে এসেছে, তবে মুখ খোলা রেখেছে। এ ঘরে কোনো পুরুষ মানুষ নেই বলে সে স্বাভাবিকভাবে ছিল। তার সৌম্য চেহারা আর শালীন আচরণ সানজিদার মন ছুঁয়ে যায়। সানজিদা মনে মনে ভাবল, এ মেয়েটি সত্যিই মার্জিত এবং ভদ্র, দেখতেও কি মিষ্টি মা শা আল্লাহ।

আলোচনার মাঝে চারপাশের আনন্দ আরও প্রাণবন্ত হয়ে উঠল, আর এই বোনালী সম্পর্কের সূচনা যেন আরও মধুর হয়ে উঠল।

তাসনিয়ার বাবা, মোজাম্মেল হক, সায়ানের সঙ্গে আলোচনা শেষে বিয়ের বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেন। দীর্ঘ আলাপ-আলোচনার পর তারা ঠিক করেন, আগামী শুক্রবার, অর্থাৎ এক সপ্তাহ পর, তাসনিয়া ও সায়ানের শুভবিবাহ সম্পন্ন হবে।
বিয়ের তারিখ শোনার পর সবাই ভীষণ খুশি হয়। আনন্দের এই মুহূর্তে নাবিহা উচ্ছ্বসিত হয়ে তাসনিয়াকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে বলল,
“নতুন জীবনের জন্য অনেক অনেক শুভকামনা রইল, আপু।”

তাসনিয়া নাবিহার কথায় মৃদু হেসে জবাব দিল।

এরপর কামিনী বেগম আংটি হাতে নিয়ে তাসনিয়ার কাছে এসে বললেন,
“সানজিদা, আংটিটা তো এখনও পড়ানো হয়নি। আমি পড়াবো নাকি সায়ান এসে পড়াবে?”

নামটা শুনে নাবিহার ঠোঁটের কোণে লেগে থাকা হাসি যেন মুহূর্তেই মিলিয়ে গেল। চমকে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলো,
“আন্টি, কী নাম বললেন?”

কামিনী বেগম শান্ত স্বরে বললেন,
“সায়ান। আমার ছেলের নাম সায়ান চৌধুরী।”

নামটা শুনে নাবিহার মনে হলো, যেন তার মাথায় বাজ পড়েছে। চারপাশ থেকে সব শব্দ হারিয়ে গিয়ে বুকের ভেতর ভারী কিছুর চাপ অনুভব করলো। পুরো নিথর হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো সে।

এদিকে তাসনিয়াও বিষয়টা নিয়ে ভাবতে শুরু করলো। নাবিহার চেহারায় পরিবর্তন দেখে সে একটু এগিয়ে এসে তার কাঁধে হাত রাখলো। কিন্তু নাবিহা কোনো কথা না বলে হঠাৎ দৌড়ে যায়। যে রুমে পাত্র বসে আছে, সেই রুমের দরজার কাছে গিয়ে থেমে দাঁড়ায়। একটুখানি পর্দা সরিয়ে ভেতরে উঁকি দেয়।

আর তখনই তার চোখে পড়ে সেই চেহারা। সোফায় বসে থাকা সেই অনাকাঙ্ক্ষিত মানুষটি, যার উপস্থিতি এখানে কোনোদিন চায়নি। হৃদয় যেন মুহূর্তে চুরমার হয়ে যায়।

দৃশ্যটা দেখে তার চোখের কোণ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। কোনো শব্দ না করে নিজের অজান্তেই সে পেছনে সরে আসে। নিস্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা তাসনিয়ার দিকে তাকিয়ে, যেন কিছু বলার চেষ্টা করেও থেমে যায়। চারপাশটা নিস্তব্ধ হয়ে যায়, আর নাবিহা ভেতরে ভেতরে ভেঙে পড়ে।

এদিকে কামিনী বেগম ব্যাগ থেকে আংটি বের করে তাসনিয়ার দিকে এগিয়ে দিলেন। তাসনিয়া কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে গেল, কিন্তু পরিস্থিতি এমন ছিল যে, সে চাইলেও সরাসরি না বলতে পারলো না। ধীরে ধীরে আংটি তার আঙুলে পরিয়ে দিলেন কামিনী বেগম।

নাবিহা এই দৃশ্য দেখে আরও ভেঙে পড়লো। তার হৃদয়ের ক্ষত যেন আরও গভীর হয়ে গেল। ভাঙ্গা ভাঙ্গা গলায় সে হঠাৎ বলল,
“তুমি ভীষণ সুখী হবে, আপু। আমার দুআ রইলো তোমার জন্য। আমি এখন বাসায় যাচ্ছি।”

সবার দৃষ্টি তখন তার দিকে চলে গেল। তাসনিয়ার মা দ্রুত এগিয়ে এসে বলল,
“এখনো তো খাওয়া-দাওয়া হলো না! তুমি না খেয়ে চলে যাবে কেন মা?”

তাসনিয়া কিছু বলতে চেয়েছিল, কিন্তু নাবিহা তাকে হাত তুলে থামিয়ে দিল। কাঁপা কণ্ঠে বলল,
“আমার একদম খিদে নেই। আমাকে জোর করো না, প্লিজ।”

আর কোনো কথা না বলে নাবিহা দ্রুত পায়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। কারও কিছু বলার সুযোগ হলো না। তার ভেঙে পড়া মন নিয়ে, সে অশ্রুসজল চোখে বাসার পথ ধরলো।
.
.
সন্ধ্যা সাতটা। নাবিহা বাসায় এসে কলিং বেল চাপতেই দরজাটা খুলে যায়। ফারিস দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে, বোনকে দেখে অবাক হয়ে বলে,
“একাই চলে আসলি কেন? বলেছিলাম না, আমাকে কল দিতে? আমি তোকে নিয়ে আসতাম!”

নাবিহা কোনো জবাব না দিয়েই চুপচাপ নিজের রুমের দিকে পা বাড়ায়। তার এমন আচরণে ফারিস বিরক্ত হয়ে পড়ে। একবার কথা বললে উত্তর না পেলে যে কেউ বিরক্ত হবে—এটাই তো স্বাভাবিক।

ফারিস বিরক্ত হয়েই নাবিহার রুমের দরজার কাছে গিয়ে বলে,
“নাবিহা, এমন আচরণ করার মানে কি? আমি কিছু বলেছি কিনা তোকে?”

নাবিহা দরজা খুলে বাইরে আসে। চোখেমুখে ক্লান্তি স্পষ্ট। কিন্তু তার চেহারায় অদ্ভুত একটা অস্বস্তি। ফারিস বিষয়টা খেয়াল করে, তার সুর এবার নরম হয়ে যায়।
“সব ঠিক আছে তো? কিছু বলছিস না কেন?”

নাবিহা একটু থেমে, নিচের দিকে তাকিয়ে মৃদু স্বরে বলে,
“ভাইয়া, তোমার বন্ধুর বিয়ে আগামী শুক্রবার। দাওয়াত পেয়েছো?”
“হ্যাঁ জানি। কিন্তু তোর কি হয়েছে?”

নাবিহা আর নিজেকে সামলাতে পারে না চোখের পানি ফেলে দেয়। ফারিস তখন আরও চিন্তিত হয়ে যায়। বোনের কাধ জাঁকিয়ে জিজ্ঞাসা করে,
“কী হয়েছে বল, নাবি! আমি তোর ভাই। তোর কোনো সমস্যা হলে সেটা আমাকে না বললে কি ঠিক হবে?”

নাবিহা মাথা নাড়ল।
“ভাইয়া, আমি নিজে থেকেই বলব। তুমি প্লিজ আমাকে একটু একা থাকতে দাও।”

ফারিস অনিচ্ছাসত্ত্বেও আর কিছু না বলে নাবিহাকে তার মতো থাকতে দেয়। কিন্তু তার মন শান্ত হয় না। সে মনে মনে ঠিক করে, যাই হোক না কেন, সে নাবিহার এই আচরণের পেছনের কারণটা বের করবে।
.
.
নাবিহা ধীরে ধীরে নিজেকে আরও গুটিয়ে নেয়। তার মা বুঝতে পারে, কিছু একটা গভীরভাবে নাড়া দিয়েছে তার মেয়েকে। আগে যে মেয়েটা প্রাণবন্ত ছিল, হাসিখুশি থাকত, সেই নাবিহা এখন দিনের পর দিন রুমের ভেতরেই কাটিয়ে দেয়।

ফারিস আর নাদিয়া একদিন নাবিহার রুমে গিয়ে দেখে, জানালার পাশে বসে নাবিহা বাইরে তাকিয়ে আছে। তার চোখে যেন শূন্যতা। ফারিস ধীরে ধীরে কাছে গিয়ে বলে,
“নাবি, তুই যদি এভাবে চলতে থাকিস, আমি আর সহ্য করতে পারব না। বল, কী হয়েছে?”

সাথে নাদিয়া ও কাছে গিয়ে নাবিহার এলোমেলো চুল গুলো ঠিক করে দিতে দিতে বলল,
“আমাদের কে বলো না তোমার কি হয়েছে? তুমি যদি না বলো তাহলে তো সমস্যার সমাধান হবে না। তুমি বললে আমরা তোমাকে সাহায্য করতে পারবো।”

ফারিস তখন চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল। নাবিহাকে কিছুক্ষণ লক্ষ্য করে সেদিন নাবিহার বলা কথাটা মনে পড়ে তার, “ভাইয়া, তোমার বন্ধুর বিয়ে আগামী শুক্রবার। দাওয়াত পেয়েছো?”

তখন ভাবতে থাকে সায়ান এর সাথে নাবিহার কোন যোগসূত্র আছে কিনা??…..

#চলবে…. ইনশা আল্লাহ।