মেঘলা দিনের রোদ্দুর পর্ব-০৮

0
290

#মেঘলা_দিনের_রোদ্দুর(৮)
#Israt_Bintey_Ishaque(লেখিকা)

ফারিস গভীর চিন্তায় মগ্ন, নাবিহার আচরণে সন্দেহ দানা বাঁধতে থাকে। তার মনে প্রশ্ন জাগে, সায়ানের সাথে নাবিহার কোনো সম্পর্ক আছে কিনা। সিউর হওয়ার জন্য সরাসরি নাবিহাকে জিজ্ঞাসা করে,
“সায়ানের সাথে তোর কিছু হয়েছে?”

নাবিহা শান্ত গলায় জবাব দেয়,
“না।”
“তাহলে কি হয়েছে? এত গম্ভীর কেন?”

নাবিহা মৃদু হেসে বলে,
“মন খারাপ, কিছুদিন পর ঠিক হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ। আমাকে নিয়ে তোমরা এতো ভেবো না, সব ঠিক হয়ে যাবে।”

প্রথমে নাবিহা ভেবেছিল ফারিসকে সব জানিয়ে দেবে। কিন্তু তাসনিয়া আর তার পরিবারের কথা চিন্তা করে সে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে। ফারিস যদি জানতে পারে, তাহলে কিছুতেই এই বিয়ে হতে দেবে না। অন্যদিকে বিয়ে ভেঙে গেলে তাসনিয়া আর তার পরিবার সমাজের সামনে ছোট হয়ে যাবে। জেনেশুনে কারও এত বড় ক্ষতি করতে পারবে না নাবিহা। তাই নিজের কষ্ট গোপন করে সে চুপ থাকার পথ বেছে নেয়।
এর কয়েকদিন পর নাবিহা কলেজে ভর্তি হয়ে হোস্টেলে চলে যায়। প্রথমে কথা ছিল, বাসা থেকে প্রতিদিন কলেজে আসা-যাওয়া করবে। কিন্তু সবকিছুর থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখার জন্য নাবিহা হোস্টেলে থাকার সিদ্ধান্ত নেয়।

নাবিহার মা এই সিদ্ধান্তে প্রথমে একদমই রাজি ছিলেন না। একমাত্র মেয়েকে কাছছাড়া করার চিন্তা তাকে ব্যথিত করেছিল। কিন্তু নাবিহার জেদ আর অদ্ভুত এক নিরুপায়ত্ব দেখে তিনি শেষমেশ বাধ্য হয়ে নাবিহার ইচ্ছার কাছে আত্মসমর্পণ করেন। মায়ের মনে তীব্র কষ্ট থাকলেও, মেয়ের মনের অবস্থা বুঝে তিনি আর কোনো আপত্তি করেননি।
.
.
নাবিহার হোস্টেল জীবন শুরু হলো। নতুন পরিবেশ, নতুন মানুষ—সবকিছুই তার জন্য একদম অপরিচিত। প্রতিদিন সকালে ক্লাসে যায়, বিকেলে লাইব্রেরিতে সময় কাটায়, রাতে হোস্টেলের ঘরে ফিরে আসে। বাইরে থেকে সবকিছুই স্বাভাবিক মনে হয়, কিন্তু ভেতরে ভেতরে নাবিহা নিজের কষ্টগুলো বুকের ভেতরেই চেপে রাখে।

কলেজের বন্ধুরা তার সাথে মিশতে চেষ্টা করলেও তার মধ্যে একটা অদৃশ্য দেয়াল তৈরি হয়ে গেছে। কেউ তার কাছে আসার চেষ্টা করলেই সে দূরে সরে যায়। হোস্টেলের রুমমেটরা তার একাকিত্ব লক্ষ্য করলেও বুঝতে পারে না, কী কারণে নাবিহা এতটা নিঃসঙ্গ।

এদিকে, ফারিস নাবিহার দূরে সরে যাওয়াটা মেনে নিতে পারে না। তার মনে একটা প্রশ্নই বারবার ঘুরপাক খায়,
“নাবিহা কেন হঠাৎ করে হোস্টেলে চলে গেল?”
সে বুঝতে পারে, এই সিদ্ধান্তের পেছনে নিশ্চয়ই কোনো গভীর কারণ লুকিয়ে আছে।

নাবিহার দুই বড় ভাই, যারা জমজ, বর্তমানে বিদেশে পড়াশোনা করছে। ফারিস তাদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখে। একদিন নাবিহার হোস্টেলে চলে যাওয়া এবং তার নিঃসঙ্গ জীবনযাপনের বিষয়ে ছোট দুই ভাইয়ের সঙ্গে আলোচনা করে ফারিস।
“নাবিহা ঠিক আগের মতো নেই”
ফারিস গভীর উদ্বেগ নিয়ে বলে।
“হোস্টেলে চলে গেছে, কারও সঙ্গে তেমন কথা বলে না। একা একা সময় কাটায়। এটা কি ঠিক?”

ছোট ভাইদের একজন বলে,
“এতটা বদলে গেল কেন ও? তুমি কি কিছু বুঝতে পারছো?”

ফারিস মাথা নাড়ে।
“না, কিন্তু মনে হচ্ছে ওর জীবনে এমন কিছু ঘটেছে, যা আমাদের অজানা। কী সেটা, বুঝতে পারছি না।”

নাবিহার করুণ অবস্থা শুনে দুই বড় ভাইও ভীষণ ব্যথিত হয়। তাদের একজন বলে, “ও তো কখনো এমন ছিল না। আমাদের প্রাণবন্ত ছোট বোনটা হঠাৎ এত নিঃসঙ্গ হয়ে গেল কেন?”

আরেকজন গম্ভীর গলায় বলে,
“ভাইয়া, যেভাবেই হোক এই রহস্য উদঘাটন করতে হবে। কেন ও নিজেকে সবকিছু থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে চাইছে? একমাত্র বোনের কষ্ট আমরা সহ্য করতে পারব না।”

ফারিস দৃঢ় সংকল্প নিয়ে বলে,
“আমি অবশ্যই কারণ খুঁজে বের করব। যদি কোনো সমস্যায় জড়িয়ে থাকে, তাহলে তা সমাধান করব ইনশা আল্লাহ। নাবিহাকে এইভাবে একা ছেড়ে দেওয়া সম্ভব না।”

ছোট ভাইদের সমর্থন পেয়ে ফারিস আরও আত্মবিশ্বাসী হয়। সে ঠিক করে, নাবিহার জীবনে যা-ই ঘটুক, সত্যিটা বের করতেই হবে।

অন্যদিকে, নাবিহা কলেজের লাইব্রেরিতে প্রায়ই একা বসে থাকে। একদিন, লাইব্রেরিতে তার সাথে দেখা হয় একজনের—একজন যে তাকে বোঝার চেষ্টা করে, যার চোখে মায়া আর প্রশ্ন জড়িয়ে থাকে। মেয়েটা তার সিনিয়র, ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে পড়ে সে।

মহুয়া জিজ্ঞেস করে,
“তুমি সবসময় একা একা বসে থাকো কেন?”

নাবিহা মাথা তুলে তাকায়, তারপর নিচু গলায় বলে, “জ্বি, একা থাকতেই ভালো লাগে।”
মহুয়া মৃদু হেসে বলে,
“সব সময় একা থাকা ভালো নয়। কারও সাথে কথা বললে হয়তো মনে একটু প্রশান্তি আসবে।”

মহুয়ার এই কথায় নাবিহা চুপ করে থাকে। কিন্তু তার মনে একধরনের অস্বস্তি হয়। মহুয়া সেটা বুঝতে পেরে নাবিহা কে একা থাকতে দিয়ে চলে যায় অন্য বেঞ্চে।
.
.
দুই বছর পর…
নাবিহা তার এইচএসসি পরীক্ষা শেষ করেছে। এখন সে নিজের বাড়িতেই থাকে। এই দুই বছর ছিল নাবিহার জন্য দীর্ঘ সময়। এই সময়ের মধ্যে সে পড়াশোনায় মনোযোগ দিয়েছে এবং আল্লাহ তাআলার ভয় হৃদয়ে স্থান দিয়েছে। এর ফলে সে সায়ানকে ভুলতে সক্ষম হয়েছে।

অবশেষে নাবিহা বুঝতে পেরেছে, অন্যের স্বামীকে মনে পুষে রাখা শুধু বেহায়াপনা নয়, এটি নৈতিকতারও চরম লঙ্ঘন। যদি নাবিহার মতো সব নারী এই সত্যটি উপলব্ধি করতে পারত, তবে হয়তো “পরকীয়া” নামক শব্দটি দুনিয়া থেকে মুছে যেত।

নাবিহার জীবনে নতুন একটা অধ্যায় শুরু হয়। নিজের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে সে আল্লাহর পথে আরও দৃঢ়ভাবে চলার সিদ্ধান্ত নেয়। নাবিহা এখন সময় কাটায় ইবাদত, পড়াশোনা, আর পরিবারের পাশে থেকে। এই পরিবর্তন তাকে এক অন্যরকম প্রশান্তি এনে দেয়।

একদিন নাবিহার বাবা-মা তার জন্য একটি ভালো প্রস্তাব নিয়ে ঝআসে। ছেলেটি একজন ধার্মিক এবং সৎ মানুষ, নাম তার আরিফ। আরিফ পেশায় একজন শিক্ষক, যার জীবনবোধ এবং চরিত্র নাবিহার মনের মতো। প্রথমদিকে নাবিহা দ্বিধাগ্রস্ত ছিল, কিন্তু আরিফের ব্যক্তিত্ব এবং আল্লাহর প্রতি তার ভালোবাসা দেখে নাবিহার মনে আস্তে আস্তে প্রশান্তি আসে। রাজি হয়ে যায় বিয়েতে।
নাবিহা প্রতিদিন আল্লাহর কাছে দোয়া করে যেন তিনি তার ভুলগুলোকে ক্ষমা করেন এবং তার জীবনের নতুন পথে বরকত দান করেন।
.
একদিন নাবিহা নাদিয়ার সঙ্গে হাসপাতালে যাওয়ার জন্য বের হয়। ফারিসের ছেলে মোহাম্মদ হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছে, তাই তাকে ডাক্তার দেখানো জরুরি। কিন্তু ব্যস্ততার কারণে ফারিস অফিস থেকে আসতে পারছে না। উপায় না পেয়ে নাদিয়া তার ননদ নাবিহাকে সঙ্গে নিয়েই হাসপাতালে চলে আসে।

হাসপাতালে পৌঁছে তারা ডাক্তারের সিরিয়ালে অপেক্ষা করতে বসে। আশপাশে রোগী এবং স্বজনদের ব্যস্ত চলাফেরা, হাসপাতালের চিরচেনা স্নিগ্ধ পরিবেশ—সবকিছুই স্বাভাবিক মনে হচ্ছিল।

ঠিক তখনই রিসেপশনের মেয়েটি হঠাৎ বলে উঠল, “তাসনিয়া!”

পরিচিত এই নামটি শুনে নাবিহা চমকে তাকায়। কী এক অজানা শঙ্কায় তার হৃদস্পন্দন দ্রুত হয়ে ওঠে। সে আশপাশে চোখ বুলিয়ে দেখে—
একজন নারী তার ছোট্ট মেয়েকে নিয়ে ডাক্তারের কেবিনে ঢুকল, সাথে এক পুরুষ। কিন্তু সেই পুরুষটি নাবিহার কাছে সম্পূর্ণ অপরিচিত।

নাবিহার মনে হলো, হয়তো সে ভুল দেখেছে। তবুও পরিচিত নাম শুনে মনে পড়ে গেলো তাসনিয়া আপুর কথা। কিন্তু যদি সত্যিই তাসনিয়া আপুই হয়, তাহলে তার সাথে তো সায়ান থাকার কথা! এখানে তো অন্য কেউ রয়েছে।

নাবিহার ভেতরে এক অদ্ভুত অস্বস্তি কাজ করে। মনে হচ্ছে, কেন যেন মনে হচ্ছে কোনো রহস্য লুকিয়ে আছে এই দৃশ্যের মাঝে…

সেই দিনের পর থেকে নাবিহা তাসনিয়ার সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। কারণ তাসনিয়ার সাথে যোগাযোগ হলে সায়ান এর কথা মনে পড়বে তার। তাসনিয়া বেশ কয়েকবার নাবিহার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করে কিন্তু নাবিহা সেই সুযোগ দেয়নি।….

#চলবে… ইনশা আল্লাহ।