#মেঘলা_দিনের_রোদ্দুর(১০)
#Israt_Bintey_Ishaque(লেখিকা)
নতুন বউকে নিয়ে বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত নয়টা বাজল। সারা দিনভর বিয়ের আনুষ্ঠানিকতায় ক্লান্ত কামিনী বেগম ঘরে ঢুকেই প্রথম যে কাজটি করলেন, তা হলো ছেলে-মেয়েকে একসঙ্গে একটি ঘরে পাঠিয়ে দেওয়া।
তিনি জানেন, এই বিয়ে একেবারেই আচমকা হয়েছে। দু’জনের মধ্যে এখনো কোনো বোঝাপড়া হয়নি, সম্পর্কের বাঁধন এখনো নরম কাদার মতো। একে গড়ে তুলতে সময় লাগবে, ধৈর্য ধরতে হবে। তাই তিনি চান, অন্তত একসঙ্গে কিছু সময় কাটিয়ে তারা একে অপরকে বুঝতে শিখুক, অনুভব করুক এই নতুন সম্পর্কে জড়ানোর বাস্তবতাকে।
ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসার আগে তিনি একবার পেছন ফিরে তাকালেন। নতুন বউটি একটু অসহায় ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে, আর ছেলে যেন বুঝে উঠতে পারছে না কী করবে। কামিনী বেগম মনে মনে দোয়া করলেন—আল্লাহ, তুমি এদের জন্য বরকত দিও, ভালোবাসা দিও।
তারপর ধীর পায়ে তিনি নিজ ঘরের দিকে চলে গেলেন, ছেলেমেয়েকে তাদের নতুন জীবনের শুরুটা নিজেদের মতো করে বুঝে নিতে দিয়ে।
এদিকে ঘরে ঢুকে সায়ান কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। নতুন বউটি সংকোচে এক কোণে বসে আছে। দু’জনের কেউই বুঝতে পারছে না, কী বলা উচিত বা কোথা থেকে শুরু করা উচিত।
একসময় সায়ান কাশতে কাশতে বলল,
—তুমি যদি চাও… মানে… তোমার যদি কোনো সমস্যা না থাকে, তাহলে তুমি বিছানায় ঘুমাতে পারো। আমি সোফায় শুয়ে পড়ব।
নাবিহা একটু লজ্জা পেয়ে বলল,
—আপনি… আপনি যেখানেই স্বচ্ছন্দ বোধ করেন সেখানেই থাকেন।
তার কণ্ঠে ভয় আর দ্বিধার স্পষ্ট ছাপ। এই নতুন জীবনের শুরুটা কীভাবে সামলাবে, কিছুই বুঝতে পারছে না সে।
সায়ান কথাটা এমনি বলেছে নাবিহার মনের ভাব জানার জন্য।
কিছুক্ষণ দু’জনেই চুপচাপ। বাইরের হালকা বাতাস জানালার পর্দা দুলিয়ে দিচ্ছে। হঠাৎ সায়ান বলল,
” শাড়ি পড়ে নিশ্চই অস্বস্তি বোধ করছো। চেঞ্জ করে নাও।”
“আচ্ছা।”
সায়ান এর পক্ষ থেকে নাবিহা কে দেওয়া থ্রিপিস গুলো টেইলর দিয়ে বানিয়ে নিতে হবে সে জন্য নাদিয়া আসার সময় নাদিয়ার কিছুর থ্রিপিস ট্রলিতে দিয়ে দিয়েছিল। নাবিহা ট্রলি থেকে একটা সুতির থ্রিপিস বের করলো, সূক্ষ্ম নকশার কাপড়টা আঙ্গুলের মাঝে ছুঁয়ে অনুভব করল সে। সায়ান নিঃশব্দে ওয়াশরুমের দিকটা দেখিয়ে দিল। তার ইঙ্গিত বুঝে ধীর পায়ে এগিয়ে গেল নাবিহা, কাপড়টা বুকে আঁকড়ে ধরে। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে নিঃশ্বাস নিল গভীরভাবে, তারপর দরজার হ্যান্ডেলে হাত রাখল।
নাবিহা ফ্রেশ হয়ে এসে শাড়িটা বদলে নিল। আরামদায়ক পোশাকে নিজেকে একটু হালকা লাগছিল তার। এদিকে সায়ান ইতোমধ্যে ট্রাউজার আর টি-শার্ট পরে নিয়েছে। সোফায় বসে ফোন স্ক্রল করছিল সে। নাবিহাকে ঘরে ঢুকতে দেখে ফোনটা পাশে রেখে উঠে দাঁড়াল, তারপর ধীরপায়ে ওয়াশরুমের দিকে চলে গেল ফ্রেশ হতে।
নাবিহা খাটের এক কোণে বসে রইল। চারপাশের প্রতিটি জিনিসপত্র এবার তার দৃষ্টির আওতায় এল। ঘরটা পরিপাটি, দেয়ালে নরম শেডের ওয়ালপেপার, কোণায় সাজানো বইয়ের শেলফ, আর জানালার পাশে রাখা ছোট্ট টেবিল ল্যাম্পটা যেন আলাদা এক উষ্ণতা ছড়াচ্ছে। চোখ ধীরে ধীরে পুরো ঘরটা ঘুরে এলেও, নাবিহার মনের ভেতর এক অজানা অনুভূতি খেলা করছিল…
সায়ান ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে এলো। ভেজা চুলের মাঝে হাত চালিয়ে ওয়ার্ডরোব থেকে একটা পারফিউম নিয়ে গায়ে ছিটিয়ে নিল। নাবিহার দিকে একঝলক তাকিয়েই পাশের ড্রয়ারে রেখে দিল পারফিউমটা। নাবিহা তখনও খাটের কোণে বসে, ঘরটা একদৃষ্টিতে দেখছিল।
“কী দেখছো এভাবে?”
সায়ানের কণ্ঠে কৌতূহল।
নাবিহা ধীর চোখে তাকাল ওর দিকে, যেন ভাবছিল কিছু। তারপর মৃদু স্বরে বলল,
“আপনার রুমটা বেশ গোছানো।”
সায়ান হালকা হেসে বলল,
“ধন্যবাদ! তবে এটা সবসময় এমন থাকে না। আজ একটু বেশি গোছানো আছে… বিশেষ কারণে।”
নাবিহা কিছু বুঝতে পেরে লজ্জায় চোখ নামিয়ে নিল। সায়ান তার প্রতিক্রিয়া দেখে আর কিছু বলল না।
“তোমার খিদে পেয়েছো? খেয়ে নেবে কিছু?”
সায়ান প্রশ্ন করতেই নাবিহা মাথা নাড়ল।
“না, এখনো নয়।”
সায়ান তখন কিছুটা আরাম করে সোফায় বসল। কিছুক্ষণ নীরবতা কাটিয়ে বলল,
“নাবিহা, একটা কথা বলবো?”
নাবিহা চমকে তাকাল ওর দিকে। সায়ানের চোখে তখন এক ধরনের গাম্ভীর্য খেলা করছে।
“জ্বি বলুন?”
সায়ান কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল,
“তুমি কি সত্যিই খুশি?”
নাবিহা প্রশ্ন শুনে স্তব্ধ হয়ে গেল। সে কি খুশি? নতুন জীবনের এই অদ্ভুত পরিবর্তনে তার অনুভূতি আসলে কী? সে নিজেই কি জানে?
ঘর নিস্তব্ধ হয়ে গেল। সায়ান অপেক্ষা করছিল উত্তরটার জন্য…
নাবিহা এক মুহূর্ত চুপ করে রইল। সায়ানের চোখে প্রশ্ন, আর তার নিজের ভেতর হাজারো অনুভূতির দ্বন্দ্ব। সে কি সত্যিই খুশি?
ধীরে ধীরে মাথা নিচু করে নাবিহা মৃদু স্বরে বলল,
“খুশি থাকার চেষ্টা করছি।”
সায়ান ভ্রু কুঁচকে তাকাল ওর দিকে।
“চেষ্টা? খুশি থাকা কি চেষ্টা করার বিষয়?”
নাবিহা মৃদু হাসল, একরকম তিক্ত হাসি।
“সব সময় নয়… কিন্তু কখনো কখনো মানুষকে খুশি থাকার অভিনয় করতে হয়।”
সায়ান এবার পুরোপুরি নীরব হয়ে গেল। কিছুক্ষণ নাবিহার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে ধীরে ধীরে বলল,
“আমার কাছে সত্যিটা বলতে পারো, নাবিহা।”
নাবিহা এবার চোখ তুলে তাকাল ওর দিকে। দৃষ্টি শান্ত, কিন্তু গভীরে চাপা কষ্ট লুকিয়ে আছে।
“সত্যিটা কি জানেন, ডাক্তার সাহেব? সত্যিটা হলো, আমার এখনো সব কিছু বাস্তব মনে হচ্ছে না। মনে হচ্ছে যেন একটা স্বপ্ন দেখছি, ঘুম ভাঙ্গলেই হারিয়ে যাবে।”
সায়ান কোনো উত্তর দিল না। শুধু নাবিহার মুখের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। ঘরে তখনো নীরবতা, কিন্তু সেই নীরবতার মাঝেই যেন অনেক না বলা কথা লুকিয়ে আছে…
সায়ান বুঝতে পারলো নাবিহার মধ্যকার অনূভুতি গুলো।
নাবিহার মনে শত শত প্রশ্নেরা ঘুরপাক খাচ্ছে। একসময় নিজেকে শান্ত করতে সায়ান কে জিজ্ঞেস করে ফেলে।
.
.
তাসনিয়ার সঙ্গে বিয়ে ঠিক হওয়ার পরের দিনই সায়ানের কাছে দেখা করার অনুরোধ আসে। এত তাড়াতাড়ি এবং জরুরি তলবে সে কিছুটা অবাক হলেও দেখা করতে রাজি হয়। নির্ধারিত জায়গায় গিয়ে তাসনিয়ার মুখোমুখি বসতেই স্পষ্টতই তার অস্বস্তি চোখে পড়ে।
“আমি এই বিয়েটা করতে পারবো না,”
শান্ত অথচ দৃঢ় কণ্ঠে বলে ওঠে তাসনিয়া।
সায়ান বিস্মিত হয়। কিছুক্ষণ চুপ থেকে অবশেষে জানতে চায়,
“কেন? হঠাৎ এমন সিদ্ধান্ত কেন নিলেন? আমাকে আপনার পছন্দ না হলে আগেই জানাতে পারতেন।”
তাসনিয়া কোনো ভনিতা না করে স্পষ্টভাবেই সবটা জানিয়ে দেয়। সমস্ত কথা শুনে সায়ান একেবারে স্তব্ধ হয়ে বসে থাকে। মনে মনে ভাবে,
“যাই হোক, আমি কখনোই বন্ধুর বোনকে বিয়ে করতে পারবো না। এতে আমাদের বন্ধুত্বের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি তৈরি হবে। এটা আমি কিছুতেই হতে দিতে পারি না।”
দীর্ঘ চিন্তার পর অবশেষে সায়ান এই বিয়ে ভেঙে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।
বিয়েটা ভেঙে যাওয়ার পর তাসনিয়ার উপর দিয়ে একপ্রকার ঝড় বয়ে যায়। পরিবারের সদস্যদের অসন্তোষ, আত্মীয়স্বজনদের কটূক্তি—সবকিছুই সহ্য করতে হয় তাকে। সমাজের কঠিন প্রশ্নবাণে বিদ্ধ হলেও সে আল্লাহ তাআলার উপর পূর্ণ আস্থা রাখে এবং ধৈর্যের সঙ্গে সবকিছু মোকাবিলা করে।
এক বছর পর, আল্লাহ তাআলার অশেষ রহমতে একটি ভালো পরিবারে তার বিয়ে ঠিক হয়। এবার তার জীবনসঙ্গী হন এক সৎ, দ্বীনদার এবং অসাধারণ চরিত্রের মানুষ। নতুন জীবনের জন্য আলহামদুলিল্লাহ বলেই সে নিজেকে সঁপে দেয় ভাগ্যের হাতে।
এদিকে, এই ঘটনার পর কামিনী বেগম ভীষণ রেগে যান এবং সায়ানের সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দেন। সায়ান, যে তার বাবা-মাকে হারিয়ে ছোটবেলা থেকেই কামিনী বেগমকে নিজের আপন করে নিয়েছিল, তার কাছ থেকে এমন আচরণে ভীষণ কষ্ট পায়। তবুও কাউকে নিজের সমস্যার কথা বলতে পারে না। বুকের ভেতর জমে থাকা ব্যথা নিয়েই নিঃশব্দে সব সহ্য করে যায় সে…
#চলবে…. ইনশা আল্লাহ।