মেঘলা দিনের রোদ্দুর পর্ব-১৩

0
254

#মেঘলা_দিনের_রোদ্দুর(১৩)
#Israt_Bintey_Ishaque(লেখিকা)

অন্ধকার ঘর। নিস্তব্ধতা গা ছমছমে হলেও দু’জনের শ্বাস ফেলার নরম শব্দ সেই নিরবতার এক আশ্চর্য সঙ্গীত হয়ে বাজছে। শীতল বাতাসে এক অদ্ভুত শিহরণ খেলে যায়।

নাবিহার হাত মুষ্টিবদ্ধ। বুকের ভেতর অস্থির ঢেউ। এই সম্পর্ক, এই অনুভূতি… তার কাছে নতুন। অথচ ভয় লাগছে না, বরং এক অনির্বচনীয় উত্তেজনা তার রক্তে ছড়িয়ে পড়ছে।

সায়ান তার দিকে তাকিয়ে আছে গভীর, অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টিতে।
“ভয় পাচ্ছ?”
নাবিহা চোখ তুলে তাকায়। শব্দ করে কিছু বলতে পারছে না, শুধু মাথা নাড়ে।

সায়ান এক চুল হাসে।
“ভয় পাওয়ার কিছু নেই। আমি তো আছি…”

তার কণ্ঠে আশ্বাস, নাবিহা জানে এ আশ্বাসে এক নিশ্চিত গহ্বর লুকিয়ে আছে।

ঘরের বাতাস ভারী হয়ে আসে। দু’জনেই অনুভব করে, আজ একটা সীমারেখা পেরিয়ে যাচ্ছে।

নাবিহার বুকের ভেতর অস্থিরতা— নতুন এক অনুভূতি, নতুন এক যাত্রার সূচনা! সায়ান পলকহীন চেয়ে আছে তার দিকে, দৃষ্টির গভীরতা যেন সীমানাহীন।

সায়ান এক চুল হাসল। বলল,
“এই পথটা সহজ নাও হতে পারে, কিন্তু আমি তোমার হাত ছাড়বো না।”

নাবিহার চোখের পাতায় হালকা কম্পন। তার কথাগুলো অনুভব করল অন্তরের গভীরে। সায়ান এমন একজন, যার চোখে ভরসা আছে, যাকে বিশ্বাস করা যায়।

একটা ঠাণ্ডা বাতাস এসে পর্দা দুলিয়ে দিল, যেন প্রকৃতিও সাক্ষী হচ্ছে তাদের এই মুহূর্তের।

সায়ান একটু এগিয়ে এলো, কাঁপা কণ্ঠে বলল, “তাহলে চল, একসঙ্গে শুরু করি আমাদের গল্পটা!”

নাবিহা মৃদু হাসল, যেন ওদের ভবিষ্যৎটা দেখতে পাচ্ছে, যেখানে শুধুই ভালোবাসা…
.
.
নাবিহা সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে পড়েছে। শাশুড়ি মা নাস্তার আয়োজন করছেন, আর সে হাতে হাতে সাহায্য করে চলেছে। শীতের সকাল, চারপাশে হিমেল হাওয়া বইছে। কিন্তু তার শীত লাগার কারণ ভিন্ন। মাঝরাতে গোসল করে, ঠান্ডা পানি তার সারা শরীরে কাঁপুনি ধরিয়ে দিয়েছিল। এখনো তার হাত-পা জমে আসছে, শরীরে কেমন একটা শিরশিরে অনুভূতি। তবু মুখ ফুটে কিছু বলতে পারছে না। লজ্জা যেন পায়ে শিকল পরিয়ে দিয়েছে।

নিজেকে শক্ত করে নিয়ে নাস্তার আয়োজনে ব্যস্ত হয়ে পড়ে নাবিহা, যেন নিজের শীতলতা ভুলে থাকতে পারে।

বিপত্তি ঘটল খাবার খেতে বসার পর। গরম গরম রুটি ছিঁড়ে মুখে তুলতে গিয়েই নাবিহার সর্দি চেপে বসলো। একের পর এক হাঁচি আসতে লাগল, যেন থামতেই চাইছে না। শাশুড়ি মা অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছেন, আর নাবিহা নিজেই নিজের অবস্থায় বিব্রত। নাক টানতে টানতে, চোখ পানি পানি হয়ে এল।

শেষ পর্যন্ত আর সহ্য করতে না পেরে হাতের রুটি প্লেটে নামিয়ে রেখে দ্রুত উঠে দাঁড়াল। কাঁপতে কাঁপতে রুমের দিকে হাঁটতে শুরু করল সে, যেন একটু উষ্ণতা পেলেই এই বেহাল দশা থেকে মুক্তি পাবে।
সায়ানের হঠাৎ মনে পড়ল—নাবিহার তো অসময়ে, বিশেষ করে রাতে, ঠান্ডা পানি দিয়ে গোসল করার অভ্যাস নেই! তাহলে সে এমন ভুল করল কীভাবে? নিজেই নিজের ওপর অবাক হলো সায়ান।

সে তো হসপিটাল থেকে ফিরেই রাতের বেলা গোসল করে অভ্যস্ত। তার কাছে এটা স্বাভাবিক, কিন্তু বেচারি নাবিহার জন্য এটা যে কী বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়াবে, সেটা একবারও ভেবে দেখেনি! এখন সেকথা ভাবতেই যেন অপরাধবোধে মনটা খারাপ হয়ে যাচ্ছে।

কামিনী বেগম আর সানজিদা বুঝতে পেরেও কিছু বললেন না। এখন কিছু বললে সায়ান লজ্জায় পড়ে যাবে। তাই কামিনী বেগম শুধু মৃদু স্বরে বললেন,
“বউয়ের খাবারটা ঘরে নিয়ে যা, সায়ান। সর্দির জন্য কিছুই খেতে পারল না বেচারি।”

সায়ান এক মুহূর্ত দেরি করল না। দ্রুত নিজের খাবার শেষ করে উঠে দাঁড়াল। তারপর নাবিহার খাবার প্লেটে তুলে নিয়ে সোজা ঘরের দিকে রওনা দিল।

সায়ান ঘরে ঢুকে দেখল, নাবিহা কম্বলের মধ্যে গুটিসুটি মেরে শুয়ে আছে। নাক লাল হয়ে গেছে, মাঝে মাঝেই হালকা কাশছে। সায়ান ধীরে ধীরে তার পাশে গিয়ে বসল।
“নাবিহা, একটু উঠে বসো। তোমার জন্য খাবার এনেছি।”

নাবিহা চোখ বন্ধ রেখেই মাথা নাড়ল,
“খেতে ইচ্ছে করছে না…”

সায়ান নরম স্বরে বলল,
“এভাবে না খেয়ে থাকলে তো শরীর আরও খারাপ হবে। অন্তত অল্প খাও।”

নাবিহা কিছু না বলেই কম্বলের ভেতর আরও গুটিয়ে গেল। সায়ান গভীর শ্বাস ফেলল।
কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর সে খাবারের ট্রে রেখে বাইরে চলে গেল। কিছুক্ষণ পর হাতে এক কাপ গরম আদা-লেবুর চা নিয়ে ফিরে এল। ধীরে ধীরে বলল,
“শুধু এটা খেয়ে দেখো, শরীরটা একটু গরম লাগবে।”

নাবিহা এবার কাঁথার ভেতর থেকে একটু উঁকি দিল। সায়ানের হাতের ধোঁয়া ওঠা চায়ের কাপ দেখে একটু দ্বিধা করল, তারপর আস্তে করে উঠে বসল। সায়ান তার দিকে কাপটা বাড়িয়ে দিল, মুখে হালকা হাসি রেখে বলল,
“এই তো ভালো মেয়ে!”

নাবিহা কিছু না বলে কাপটা হাতে নিল। সায়ান সন্তুষ্ট মনে তার পাশে বসল। ঠান্ডা কেটে যাক, নাবিহা সুস্থ হোক, এটাই তো তার একমাত্র চাওয়া!

নাবিহা ধীরে ধীরে চায়ের কাপে ফুঁ দিল। উষ্ণ ভাপ তার নাকের কাছে এসে লাগতেই যেন একটু আরাম পেল। গরম চা ঠোঁট ছুঁইয়ে এক চুমুক খেলো, হালকা আদার ঝাঁঝ গলায় নামতেই শরীরটা একটু গরম হয়ে উঠল।

সায়ান তার পাশে চুপচাপ বসে ছিল, নাবিহাকে খেয়াল করছিল গভীর মনোযোগে। সে জানে, নাবিহা চুপ করে থাকলে বোঝা কঠিন সে কী ভাবছে। কিছুক্ষণ পর নাবিহা মৃদু স্বরে বলল,
“এত রাতে গোসল করার অভ্যাস নেই আমার সে জন্য…

সায়ান একটু অপ্রস্তুত হয়ে হেসে বলল,
“সেটাই তো ভাবছি! তোমার এত ঠান্ডা লাগবে বুঝতেই পারিনি, নাহলে বলতাম না।”

নাবিহা এবার চোখ পাকিয়ে তাকাল বলল,
“একটু গরম পানি তো করে দিতে পারতেন?”

সায়ান মাথা চুলকালো, বলল,
“মানে, আমি সত্যি বুঝতে পারিনি…”

“কিছু বুঝাতে হবে না! আপনার জন্যই আজ এত কষ্ট হচ্ছে।”

সায়ান আর কিছু বলল না, চুপচাপ নাবিহার গাল ফুলিয়ে থাকা মুখটা দেখল। একটু রাগ, একটু অভিমান মেশানো চেহারা দেখে তার হাসি পেল। কিন্তু হেসে দিলে তো বিপদ আরও বাড়বে!

সে একটু গম্ভীর মুখে বলল,
“ঠিক আছে, এটা আমার ভুল। এখন বলো, কী করলে তোমার রাগ কমবে?”

নাবিহা কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল, যেন ভেবে দেখছে কী দাবি করবে। তারপর নিচু গলায় বলল,
“কাল সারাদিন আমাকে এই শহর ঘুরিয়ে দেখাতে হবে।”

সায়ান অবাক হয়ে তাকাল। বলল,
“মানে? আমার তো কাল হসপিটালে যেতে হবে।”

নাবিহা আবারো মুখ গোমড়া করে বসে রইল।
সায়ান তখন হাল ছেড়ে দিয়ে বলল,
“আচ্ছা ঠিক আছে, নিয়ে যাব ইনশা আল্লাহ।”

নাবিহা এবার তৃপ্তির হাসি হেসে চায়ের শেষ চুমুক দিল। সায়ান মাথা নাড়ল। এই মেয়ে কখন যে রেগে যায়, কখন যে মিষ্টি হয়ে যায়, তা বোঝা সত্যিই কঠিন!
.
.
সন্ধ্যার আগের সেই নরম আলোয় চারপাশ একদম স্বপ্নিল হয়ে উঠেছে। আকাশে সূর্যটা ঢলে পড়ছে পশ্চিমে, কমলা আর গোলাপি রঙ মিশে এক অসাধারণ দৃশ্য তৈরি করেছে। হালকা ঠান্ডা বাতাস বইছে, গাছের পাতাগুলো মৃদু দুলছে তার ছোঁয়ায়।

বিকেলের এই সময়টায় রাস্তা-ঘাটে একটা প্রশান্তির আমেজ। ছোট্ট শিশুরা মাঠে খেলায় মেতে আছে, কেউ কেউ সাইকেল চালাচ্ছে, কেউ আবার আকাশের দিকে তাকিয়ে ডানা মেলার স্বপ্ন দেখছে। বৃদ্ধদের কেউ বসে আছে চায়ের দোকানে, গল্পের আসর জমে উঠেছে।

নদীর ধারে কেউ একা বসে, কেউ বা প্রিয়জনের সাথে গল্পে মগ্ন। ঘরে ফেরার তাড়া থাকলেও মন চাইছে, এই বিকেলটা একটু লম্বা হোক, এই প্রশান্তি যেন আরেকটু স্থায়ী হয়…

এই মায়াবী পরিবেশের মাঝেই সায়ান রিকশা ভাড়া করে ধীর গতিতে শহর ঘুরছে নাবিহাকে নিয়ে। নাবিহার মনে আজ এক অদ্ভুত প্রশান্তি। যেন নতুন করে বাঁচার স্বাদ পাচ্ছে সে। রিকশার হালকা দুলুনির মাঝে মাঝে আকাশের দিকে তাকায়, মনে মনে আল্লাহ তাআলার শুকরিয়া আদায় করে।

একসময় একটা রেস্টুরেন্টের সামনে এসে রিকশা থামায় সায়ান। নাবিহার দিকে তাকিয়ে বলে,
“নামো, এখানে তোমার জন্য একটা চমক আছে!”

নাবিহা মৃদু হাসে, রিকশা থেকে নেমে দাঁড়ায়। সায়ান ভাড়া মিটিয়ে তার পাশে এসে দাঁড়ায়, তারপর একসঙ্গে রেস্টুরেন্টের ভেতরে প্রবেশ করে।

ভেতরটা বেশ নিরিবিলি, হালকা সুরভি মিশে আছে বাতাসে। মৃদু আলোয় সাজানো সুন্দর পরিবেশে এক পাশে গিয়ে বসে তারা। কিছুক্ষণ নীরব থাকার পর সায়ান নাবিহার দিকে তাকিয়ে বলল,
“এখানের হালিম আর লুচি ভীষণ স্বাদের! আমি আর ফারিস প্রায়ই এখানে আসতাম, শুধুমাত্র এগুলো খাওয়ার জন্য।”

সায়ানের কণ্ঠে একটা অদ্ভুত উচ্ছ্বাস। নাবিহা আগ্রহ নিয়ে শুনছে। কিছুক্ষণ পর সায়ান উঠে গিয়ে খাবারের অর্ডার দিয়ে এলো। ফিরে এসে বসতেই নাবিহা জানতে চাইলো,
“আপনার সাথে ভাইয়ার বন্ধুত্ব কবে থেকে?”

সায়ান এক মুহূর্ত ভাবল, তারপর স্মৃতিচারণের ভঙ্গিতে বলল,
“কলেজের শেষের দিকে আমাদের বন্ধুত্বটা পাকা হয়। এর আগে তেমন ঘনিষ্ঠ ছিলাম না। এরপর পড়াশোনার পাশাপাশি আড্ডা দিতাম, আমাদের আরও কয়েকজন বন্ধু ছিল, তারাও থাকত সাথে।”

নাবিহা মনোযোগ দিয়ে শুনছে, কিন্তু সায়ান হঠাৎ এক রহস্যময় হাসি দিয়ে বলল,
“আচ্ছা শোনো, তোমার জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে! এখান থেকে বের হয়েই নিয়ে যাবো!”

নাবিহার চোখে কৌতূহল খেলে গেলো। সারপ্রাইজ? কী হতে পারে সেটা? উত্তরের অপেক্ষায় থাকলো সে, আর সায়ান রহস্যময় হাসিটা ধরে রাখলো…

#চলবে…. ইনশা আল্লাহ।