#যদি_নির্বাসন_দাও (পর্ব ১)
১.
এলার্মের নরম সুরে ফয়সালের ঘুম ভাঙে। হাত বাড়িয়ে মোবাইলের এলার্মটা বন্ধ করে আবার কুণ্ডলী পাকিয়ে কিছুক্ষণ শুয়ে থাকে। বাইরে থেকে বাতাসের শোঁ শোঁ শব্দ শোনা যাচ্ছে। সেই সঙ্গে বাঁশ, শন দিয়ে বানানো ঘরের চালে টুপটাপ শব্দ হচ্ছে। মনে হচ্ছে বৃষ্টি। পৌষের এই সময়টায় বান্দরবানের নীলাচলে এমন হয়। ভোরের আবহাওয়া দেখলে মনে হবে সুদূর আমেরিকা কিংবা কানাডার মতো শীতকাল। এখুনি মেঘগুলো বরফ হয়ে ঝরে পড়বে।
ফয়সাল আরও পাঁচ মিনিট মটকা মেরে পড়ে থাকে। তারপর যখন মনে হয় এখুনি না উঠলে ভোরের কাঁচাবাজারটা আর ধরা যাবে না তখনই ধড়মড় করে উঠে পড়ে। না উঠলে আজ দুপুর আর রাতের অতিথিদের খাওয়া নিয়ে সমস্যা হবে। গতকালই ঢাকা থেকে বড়ো একটা দল এসেছে এই রিসোর্টে থাকতে। নীলাচলে যে এক দুটো ভালো রিসোর্ট আছে এসেন্স রিসোর্ট তার মধ্যে একটা। বছর চারেক ধরে ফয়সাল এই রিসোর্টের দায়িত্বে আছে। বাজারটা সে নিজ হাতেই করে। তাতে করে দুটো লাভ হয়। প্রথমত কিছু পয়সা বাঁচে আর দ্বিতীয়ত ভোরবেলা যাওয়াতে সবকিছু একদম টাটকা পাওয়া যায়। কর্মচারীদের হাতে ছেড়ে দিলে ওরা ভালো-মন্দ মিলিয়ে নিয়ে আসে। ফয়সাল আবার টাটকা না হলে কোনো কিছু আনেই না।
ফয়সাল এবার উঠে হাত মুখ ধোয়। টের পায় কলের জল ভীষণ ঠান্ডা। তোয়ালেতে মুখ মুছে দরজা খুলে ব্যালকনিতে আসতেই ঠান্ডা হাওয়া মুখে লাগে। এই রিসোর্টটা প্রায় দু হাজার ফুট ওপরে। এখান থেকে নিচের শহরটা অনায়াসেই দেখা যায়। এখন অবশ্য কুয়াশায় ঢেকে আছে। কিন্তু বেলা বাড়লে যখন রোদ উঠে তখন নিচের শহর, তার ওপর পাহাড়ের মাথা স্পষ্ট দেখা যায়।
ফয়সাল দ্রুত রেডি হয়ে বাইরে বেরোয়। কোথা থেকে টম কুঁইকুঁই করতে করতে কাছে আসে। কদিন আগেই পথের ধারে ছোট্ট একটা লাল রঙের কুকুরছানা পেয়েছিল। ওকে দেখেই তখন লেজ নাড়তে নাড়তে পিছু নিয়েছিল। ফয়সাল পথের পাশে চামপং ম্রো এর টং দোকান থেকে একটা টোস্ট বিস্কুট কিনে দিতেই ওর পিছু নেয়। তারপর থেকে সারাক্ষণ আশেপাশেই থাকে।
‘কী রে, তোর শীত করে না?’
টম কাছে এসে ওর পায়ে গা ঘেঁষে আদুরে ভঙ্গিতে দাঁড়ায়। কান দুটো নাড়তে থাকে। ফয়সাল নিচু হয়ে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। তারপর সামনের ছোট খালি জায়গাটুকু পেরিয়ে রিসেপশনের সামনে রাখা কালো জিপে উঠে পড়ে। গাড়ি স্টার্ট দিয়ে একবার জানালা দিয়ে পাশে তাকায়। টম করুণ চোখে তাকিয়ে আছে। ভেবেছিল বুঝি ওকে নিয়ে যাবে। মাঝে মাঝে সাথে করে নিয়ে যায়। কিন্তু আজ অনেক কিছু কিনতে হবে। রাতে একটা বারবিকিউ পার্টি আছে। এখানকার অতিথিরাই করবেন। তার জন্য মাংসের অর্ডার দিয়ে আসতে হবে। ফয়সাল গ্লাস নামিয়ে হাত নাড়ে। টম ছোট্ট করে একটা ‘ঘেউ’ শব্দ করে।
ফয়সাল গিয়ার পালটে এক্সিলেটরে চাপ বাড়ায়৷ গাড়িটা খাড়া পথ বেয়ে খানিকটা ওপরে উঠে তবে মূল রাস্তায় এসে পড়ে। রিসোর্টটা পাহাড়ের ঢালে বানানো হয়েছে। থাকার ঘরগুলো সব বাঁশ, শন পাতা দিয়ে করা। অনেকটা ইকো রিসোর্টের মতো। যদিও ভেতরে সব আধুনিক ব্যবস্থা আছে। ঠান্ডা পানি, গরম পানির ব্যবস্থা। গরমের দিনের জন্য এসি লাগানো আছে। সব মিলিয়ে আটটা ছোট ছোট বাঁশের ঘর আছে৷ তাতে দুই সন্তানের একটা পরিবার অনায়াসেই থাকতে পারে। প্রতিটি বাঁশের ঘর এমন করে বানানো মনে হবে শূন্যে ঝুলে আছে। আর প্রতিটি ঘরের সঙ্গে বড়ো একটা কাঠের বারন্দা। আর সেখানে দাঁড়ালে নিচের পাহাড়, সেটা পেরিয়ে দূরের আরও উঁচু পাহাড় চোখে পড়ে। কেউ যদি চায় তাহলে এখানেই পুরো একটা বেলা কাটিয়ে দিতে পারে।
পাহাড়ি উঁচুনিচু পথ বেয়ে ফয়সালের গাড়িটা নিচে নামতে থাকে। মাথায় উলের নীল সাদা কানটুপি পরা। সেদিন শহরের মার্কেট থেকে কিনেছিল। জিনিসটা বেশ ওম দেয়। গায়ে মোটা একটা ফুলহাতা গেঞ্জির ওপর বাদামি রঙের জ্যাকেট পরেছে আজ। তাতেও ঠান্ডা লাগছে ফয়সালের। রাস্তাঘাট একদম ফাঁকা। এত সকালে কেউই উঠেনি। গাড়িটা গড়িয়ে গড়িয়ে যতই নিচে নামতে থাকে ততই কুয়াশা কমতে থাকে।
নীলাচল থেকে বান্দরবান শহরটা প্রায় দুইশ ফুট নিচে। গাড়িতে দশ মিনিটের বেশি সময় লাগে না। সাঙ্গু নদীর কাছেই কাঁচা বাজারটা। ফয়সাল বাজারের মুখে ফাঁকা জায়গায় গাড়িটা পার্ক করে নেমে পড়ে। ক্ষুধা লেগেছে খুব। বাজারগুলো দ্রুত করে তারপর খেতে হবে।
বাজারের মুখেই ইয়ংরো ম্রোকে দেখতে পায়। ওকে দেখেই এগিয়ে আসে। একগাল হেসে বলে, ‘দাদা, আজ বুঝি দেরি হয়ে গেল?’
কথায় পাহাড়ি টান স্পষ্ট। প্রথম প্রথম ওদের কথা একদম বুঝতে পারত না। এখন সমস্যা হয় না। ইয়ংরো এর বয়স বিশ কি একুশ। তামাটে গায়ের রঙ। হালকা পাতলা শরীর। ওর একটা চাঁদের গাড়ি আছে। রিসোর্টের সব বাজার সদাই তার গাড়িতে করেই পৌঁছে দেয়। মৌসুমে নীলগিরিতে যায় পর্যটকদের নিয়ে। সাধারণত ছুটির দিনগুলোতেই ট্রিপ থাকে বেশি।
ফয়সাল হতাশ গলায় বলে, ‘আজ উঠতে দেরি হয়ে গেল। তুই গাড়িটা সাইড করে রাখ। আমি বাজারে ঢুকছি।’
ফয়সাল বাজারে ঢুকতেই দেখে এত সকালেই আড়তদাররা টাটকা শাক সবজি নামাচ্ছে। লাল টমেটো, ফুলকপি, বাঁধাকপি, নতুন আলু, ব্রকলি। ফয়সাল দেখে দেখে অর্ডার করে। তারপর মুরগীর দোকানে যায়। ফার্মের মুরগীর পাশাপাশি পাহাড়ি কিছু মুরগি উঠে এই বাজারে। এগুলোর স্বাদই আলাদা। পর্যটকরা এখানে এসে পাহাড়ি মুরগী খোঁজে। অনেকে সোনালি মুরগী খাইয়ে দিয়ে বলে পাহাড়ি মুরগী। ফয়সাল অবশ্য কখনোই এমন করে না। আজ একটা ব্যাম্বো চিকেনের অর্ডার আছে। বাঁশের ভেতর পাহাড়ি মুরগী রান্না। এটা ভীষণ মজার হয়। মুরগী ছোট ছোট পিস করে মসলা দিয়ে মেখে লম্বা বাঁশের খোলের ভেতর ঢুকিয়ে তারপর আগুনে পুড়ে পুড়ে রান্না করতে হয়। ঝামেলার হলেও রান্নাটা অসাধারণ হয়। অনেক হোটেলে রান্না করা মুরগী বাঁশের খোলে ঢুকিয়ে তারপর অতিথিদের সামনে পরিবেশন করে। এটা একদমই জোচ্চুরি।
ফয়সাল আজ তিনটে তাগড়া পাহাড়ি মুরগী পায়। দামদর করে কিনে ফেলে। সঙ্গে আটটা ফার্মের মুরগী নেয়।
বাজারগুলো একে একে গাড়িতে উঠায় ইয়ংরো। ফয়সাল লিস্ট দেখে মিলিয়ে নিচ্ছিল। হঠাৎ করেই মনে হয় আরে থানকুনি পাতাই তো নেওয়া হয়নি। অনেকেই এটার ভর্তা খেতে চায়। খেতে টক, টক লাগে। খুব মজা। ফয়সাল হাঁক দিয়ে বলে, ‘ইয়ংরো, হাফ কেজি থানকুনি পাতা নিয়ে আয় তো। একদম ভুলে গেছি।’
ফয়সাল চাঁদের গাড়িতে হেলান দিয়ে দাঁড়ায়। ভীষণ ক্ষুধা পেয়েছে। এমনিতেই ওর গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা। না খেয়ে থাকলেই পেট ব্যথা করে। আজ পেট ব্যথা না হলেও কেমন একটা অস্বস্তি হচ্ছে। বুকের কাছে হালকা একটা ব্যথা হচ্ছে। নাহ, এরপর এমন খালি পেটে থাকা যাবে না।
এই যখন ভাবছিল তখন ইয়ংরোকে আসতে দেখা যায়৷ ফয়সাল সোজা হয়ে দাঁড়াতে গিয়েই টের পায় বুকের ব্যথা বাড়ছে। জোরে নিশ্বাস নিতে গিয়ে পারে না। কেমন যেন দমবন্ধ লাগছে। ইয়ংরো কাছাকাছি আসতেই ফয়সাল ওকে কিছু বলতে চায়। কিন্তু বলা হয়ে উঠে না, মাথা ঘুরিয়ে পড়ে যেতে নিতেই ইয়ংরো ছুটে এসে ধরে ফেলে।
‘দাদা, দাদা! কী হলো। হায় হায়।’
ইয়ংরো এর আর্তানাদে আশেপাশের লোকজন ছুটে আসে। একজন কেউ চোখেমুখে পানির ছিটা দেয়। কেউ একজন পরামর্শ দেয় হাসপাতালে নিয়ে যেতে।
বান্দরবান সদর হাসপাতালের ইমার্জেন্সিতে যখন ফয়সালকে আনা হয় ততক্ষণে ওর জ্ঞান ফিরেছে। নিজের পায়েই দাঁড়াতে পারছে।
সব শুনে ডাক্তার বলেন, ‘মনে হচ্ছে খালি পেটে ছিলেন তাই গ্যাস চাপ দিয়েছিল। সেজন্যই বুকে অমন ব্যথা হয়েছিল। আর প্রেশারটাও লো পেলাম। নাস্তা করলেই ঠিক হয়ে যাবে। গ্যাসের কিছু ওষুধ লিখে দিলাম। আশা করি কোনো সমস্যা না। তবুও একবার ইসিজি করে একজন ভালো হার্টের ডাক্তার দেখিয়ে নেবেন। যদিও আপনার বয়স এখনও চল্লিশ হয়নি কিন্তু কাছাকাছি। এই বয়সেই এমন হঠাৎ করে বেমক্কা হার্টে ধাক্কা মারে। অবহেলা করবেন না।’
ফয়সাল বিরক্তি চেপে বলে, ‘আমার তেমন কিছুই হয়নি ডাক্তার সাহেব।’
ডাক্তার সাহেব অল্প বয়সের। উনি রাগী গলায় বলেন, ‘আপনি কি আমার চেয়ে বেশি বোঝেন? বেশি বুঝলে দেখানোর দরকার নেই। আর যদি কম বোঝেন তাহলে আজই ইসিজি করিয়ে দেখিয়ে ফেলেন। চট্টগ্রাম শহরে যেতে হবে না। এখানেই একজন ভালো কার্ডিওলজিস্ট আছেন। ক’দিন আগেই এসেছেন। ওনার একটা কার্ডিয়াক সেন্টার আছে। পারলে একবার দেখিয়ে আসুন।’
ডাক্তার সাহেব একটা কাগজে ঠিকানাটা লিখে দেন। ফয়সাল একবার চোখ বোলায় – বান্দরবান কার্ডিয়াক সেন্টার। ওর যাবার পথেই পড়ে। কিন্তু কখনও চোখে পড়েনি। আর চোখে পড়বেই বা কেন? কখনও অমন বেমক্কা বুকে ব্যথা হবে সেটা ভাবেইনি। জীবনে কত বড়ো বড়ো ঝড় গেল তখনও না। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে অবহেলা করা ঠিক হবে না। আরও কিছুদিন বেঁচে থাকার ইচ্ছে আছে। অন্তত একটা মানুষের করুণ পরিণতি না দেখে তো ও মরতে পারে না।
২.
মেহুলি একবার ঘড়ির দিকে তাকায়। সর্বনাশ, দুপুর দুইটা প্রায় বাজে। কোথা দিয়ে এতটা সময় পেরিয়ে গেল? আজ সপ্তাহের প্রথম দিন, তাই রোগীদের ভীড় ছিল। সকাল থেকে টানা রোগী দেখেছে। মাঝে পনের মিনিটের টি ব্রেক ছিল। বান্দরবান শহর থেকে একটু আগেই মূল রাস্তার পাশে নতুন একটা কার্ডিয়াক সেন্টার হয়েছে। এসব এলাকায় এই ধরনের সেন্টার থাকার কথা না। হার্টের সমস্যা যাদের হয় তারা চট্টগ্রাম চলে যান। এই সেন্টার যিনি করেছেন তার নাম রওশন জামিল, তিনিও একবার ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাক করে মরে যাওয়ার মতো অবস্থা। সে যাত্রায় বেঁচে ফিরেছিলেন। তখনই লোকটার মনে হয়েছিল হার্ট অ্যাটাকের সময় একটা প্রাথমিক সাপোর্ট দেবার মতো কার্ডিয়াক সেন্টার থাকলে মানুষের খুব উপকার হয়। সেই ভাবনা থেকেই এটা করা। মেহুলি এখানে এসেছে মাত্র ছয় মাস। এখানকার চিফ কার্ডিয়াক কনসালট্যান্ট। আর এসেই জায়গাটা ভীষণ ভালো লেগে গেছে। পাহাড়ের কোল ঘেঁষে কার্ডিয়াক সেন্টারটা। হাসপাতালের পেছনেই ওর থাকার জন্য ছোট্ট একটা বাংলোর মতো।
ফয়সাল একটু আগেই কার্ডিয়াক সেন্টারে এসে পৌঁছেছে। রিসোর্টের রিসেপশনের দায়িত্বে থাকা পলিন কাকু জোর করে এখানে নিয়ে এসেছে। একজন কম বয়েসী ডাক্তার ওর শরীরের অসুবিধের কথা শুনে প্রথমেই একটা ইসিজি করতে বললেন। তারপর নাকি আসল ডাক্তার দেখবে৷ তা ইসিজি করতে গিয়ে আরেক বিপত্তি। একজন নার্স এসে বলল জামা খুলে একদম খালি গা হতে হবে৷ তারপর বুকের ওপর এক ধরনের জেল মেখে অক্টোপাসের মতো কতগুলো সুড় লাগিয়ে দিল। নিজেকেই অক্টোপাস লাগছিল। এই সুড়গুলোই নাকি ওর হৃদয়ের সব ব্যথা বেদনার কারণ বার করে আনবে। সত্যিই কি তাই পারে?
ফয়সাল ইসিজির শেষে এবার এখানকার আসল যে ডাক্তার দেখবেন তার চেম্বারের সামনে এসে বসে। চেম্বারের কাঠের দরজার ওপর নেমপ্লেটে ডাক্তার সাহেবের নামটা বিড়বিড় করে পড়ে – ডাঃ মেহুলি রহমান, চিফ কনসালট্যান্ট, এমডি (কার্ডিওলজি)। মহিলা ডাক্তার? তাও হার্টের অসুখের। কেন যেন ফয়সালের মন দমে যায়। নাহ, শুধু শুধু সময় নষ্ট হলো। সে কথা বলতেই পলিন কাকু বলেন, ‘কী বলছ! উনি খুব ভালো ডাক্তার। আমার এক আত্মীয় ভীষণ বুক ব্যথা নিয়ে এখানে এসেছিল। তারপর চিকিৎসা নিয়ে একটু ভালো হবার পর চট্টগ্রাম গিয়ে বাইপাস সার্জারি করে এসেছে। সেখানকার ডাক্তাররা বলেছেন ওনার প্রাথমিক চিকিৎসা খুব ভালো হয়েছিল। না হলে নাকি চট্টগ্রাম যাবার আগেই টেঁসে যেত। আমি পরে খোঁজ নিয়েছি। আমার এক ভাইপো ওষুধ কোম্পানিতে কাজ করে। বলল, এমন ডিগ্রিওয়ালা ডাক্তার এখানে আসার কথাই না। ভগবানের আশীর্বাদ আমরা ওনাকে পেয়েছি।’
বাপ রে, এত এত প্রশংসা! আচ্ছা দেখাই যাক।
একটু পরেই ডাক পড়ে। ফয়সাল দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই থমকায়। ডাক্তারের চেয়ারে যিনি বসে আছেন তাকে মোটেই অমন সিনিয়র ডাক্তার মনে হচ্ছে না। মনে হচ্ছে কোন নাটকের মূল চরিত্রে অভিনয় করা নায়িকা। হালকা রঙের একটা শাড়ি পরা, গোলগাল ফর্সা মুখে বোচা নাকটা মানানসই লাগছে। সেই হিন্দি সিনেমার প্রীতি জিনতার কথা মনে পড়ে যায়। চোখে চশমা থাকাতে একটু ভারিক্কি লাগছে বটে, কিন্তু আদতে মোটেই অমন নয়।
মেহুলি চোখ তোলে। প্যাশেন্ট প্রোফাইলে বয়স আটত্রিশ লেখা ছিল। কিন্তু একে দেখে আরও কম বয়স মনে হচ্ছে। একহারা লম্বা গড়ণ, ধারালো চোয়াল, গালে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, খাড়া নাক, এক মাথা কোঁকড়া চুল। গায়ের রঙ রোদে পুড়ে তামাটে। অনেকটা গ্রিক দেবতাদের মতো। উপমাটা কি ঠিক হলো?
মেহুলি ছোট্ট করে বলে, ‘বসুন। আপনার ইসিজি-ই দেখছিলাম। কোথাও কোন গন্ডগোল নাই তো।’
কথাটা ফয়সালের মন মতো হয়। যাক, সবাই ওকে ভুল বোঝাচ্ছিল। চেয়ারে বসতে বসতে বলে, ‘এই কথাটাই তো আমি কাউকে বোঝাতে পারছিলাম না। আমার হৃদয়ে কোনো গোলমাল নেই। আমি তাহলে যাই?’
মেহুলি ওর কথা বলার ভঙ্গিতে হেসে ফেলে, তারপর বলে, ‘হ্যাঁ যাবেন তো অবশ্যই। তার আগে শুনি কেন হঠাৎ অমন হয়েছিল? আমাকে একটু সকালের ঘটনাটা খুলে বলুন।’
ডাক্তার সাহেবকে বেশ ভালো লাগছে। অন্যদের মতো না। ফয়সাল ঘটনাটা খুলে বলে। মেহুলি মনোযোগ দিয়ে শুনছিল।
শেষে ফয়সাল বলে, ‘দেখুন, শুধু শুধু কতটা সময় নষ্ট হলো। আমার ওদিকে রাজ্যের কাজ পড়ে আছে।’
মেহুলি মাথা নাড়ে, কৃত্রিম গম্ভীরমুখে বলে, ‘তাই তো। সত্যিই অনেকটা সময় নষ্ট হলো। কিন্তু সত্যি সত্যি যদি কোনো সমস্যা থাকত, তখন?’
ফয়সাল থমকায়, তারপর চিন্তিত গলায় বলে, ‘সত্যিই কোনো সমস্যা আছে নাকি ডাক্তার সাহেব?’
মেহুলি আশ্বাস দিয়ে বলে, ‘নাহ, নেই। তবে আপনার খাদ্যাভ্যাস পালটাতে হবে৷ অমন পুরো একটা বেলা না খেয়ে থাকা যাবে না। বাড়ির মানুষকে বলবেন যেন খাবারে তেল মসলা কম দেয়।’
ফয়সাল উত্তরে কিছু বলতে গিয়ে থেমে যায়। তারপর প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে বলে, ‘আপনি তো এখানে নতুন এসেছেন। আমাদের রিসোর্টটা কাছেই, সময় পেলে একদিন ঘুরে যাবেন। এই আমাদের রিসোর্টের ঠিকানা।’
কথাটা বলে একটা ভিজিটিং কার্ড বাড়িয়ে দেয়। মেহুলি সেটা হাতে নিয়ে বলে, ‘বাহ! সে তো খুব ভালো কথা। আমি সপ্তাহে একবার হলেও আপনাদের ওদিকটায় যাই। আপনাদের রিসোর্ট পার হয়ে একটু পরেই তো নীলাচল স্পট। খুব ভালো লাগে ওখানটায় বসে বসে পাহাড় দেখতে। এরপর ওদিকে গেলে আপনার রিসোর্ট দেখে আসব।’
ফয়সাল হাসে, ‘অবশ্যই আসবেন। আমি তাহলে যাই?’
মেহুলি হাসে। লোকটা খুব ছটফট স্বভাবের। যেন ডাক্তারের চেম্বার থেকে পালাতে পারলে বাঁচে।
মেহুলি মাথা নাড়ে, তারপর বলে, ‘আচ্ছা আসুন। তবে কখনও বুকে ব্যথা অনুভব করলে দ্রুত চলে আসবেন। অবহেলা করবেন না।’
ফয়সাল ঘাড় কাৎ করে, ‘আচ্ছা আসব।’
তারপর ফয়সাল চলে যেতেই মেহুলি শব্দ করেই হাসে। কেমন বাধ্যগত ছাত্রের মতো মাথা নেড়ে ‘আচ্ছা’ বলল। লোকটা যে সহজ, সরল মানুষ সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। অবশ্য মানুষকে চেনা এতটা সহজ না। সেটা ওর চেয়ে কে এত ভালো জানে।
(চলবে)
মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান সুবাস
শিমুলতলী, গাজীপুর
১৫/০১/২০২৫