যদি নির্বাসন দাও পর্ব-০২

0
426

#যদি_নির্বাসন_দাও (পর্ব ২)

১.
আজ ছুটির দিন। বান্দরবান শহরের আগে মেঘলা নামে একটা দর্শনীয় স্থান আছে। যারাই বান্দরবান ঘুরতে আসেন তারা একবার হলেও মেঘলা স্পটে আসেন। ভেতরে বড়ো একটা লেক আছে, তাতে বোটিং এর ব্যবস্থা আছে। পাহাড়ি ঢাল বেয়ে নিচে নামলেই লেক। একটা ছোট্ট ক্যাবল কার আছে যা লেকের ওপর দিয়ে একপাশ থেকে আরেক পাশে যাওয়া যায়।

মেঘলা স্পটের সামনেই রাস্তার ওপর পাহাড়িদের বাজার বসে। এরা মূলত মৌসুমি ফল, সবজি, বিন্নি ধানের চাল নিয়ে আসে৷ পর্যটকরা যাবার সময় কলা, বড়ই, পেপে অথবা সবুজ কমলা কিনে নিয়ে যায়। মেহুলি আজ এদিকটায় এসেছিল কিছু টাটকা পাহাড়ি ফল কিনতে। সবুজ কমলাগুলো খেতে খুব মজা। এর আগে একবার নিয়েছিল। কদিন আগেই আম্মা ঢাকা থেকে এসেছে। এবার কিছুদিন ওর সঙ্গেই থাকবে। আম্মার জন্যই ফল কিনতে আসা।

মেহুলি ঘুরে ঘুরে দেখতে দেখতে হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ে। একজন পাহাড়ি মহিলা একটা বেতের ঝুড়িতে সবুজ এলাচের মতো কিছু জিনিস নিয়ে বসে আছে। কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করতেই মহিলাটা পাহাড়ি টানে কী কী যেন বলে ও ঠিক বুঝতে পারে না। এরা বাংলায় কথা বললেও উচ্চারণ যেন কেমন। এখনও ঠিকঠাক ও বুঝে উঠতে পারে না। সময় লাগবে।

মেহুলি যখন আবার জিজ্ঞেস করে, ‘এটা কী? এলাচ?’

ঠিক তখুনি পেছন থেকে একটা ভারী গলা পাওয়া যায়, ‘এটা ক্যারাগুলা। নিয়ে নিন, খুব মজা খেতে।’

মেহুলি ভ্রু কুঁচকে পেছন ফিরতেই দেখে সেই লোকটা। আজ লাল একটা পুলওভার সঙ্গে জিন্স পরেছে। তাতে করে বয়স যেন আরও কমে গেছে।
দুদিন আগেই ওর চেম্বারে এসেছিল। হার্টে কোনো সমস্যা নেই তাই শুনে চেম্বার থেকে পালাতে পারলে যেন বাঁচে। সেই কথাটা মনে হতেই হাসি পায়।

মেহুলি হাসে, ‘আরে আপনি? ভালো আছেন তো?’

ততক্ষণে ফয়সাল কাছে চলে এসেছে।

‘হ্যাঁ, খুব ভালো আছি। আপনি বুঝি ক্যারাগুলা কিনতে এসেছিলেন?’

মেহুলি মাথা নাড়ে, ‘নাহ। আমি এই সবুজ কমলাগুলো নিতেই এসেছিলাম। কিন্তু এটা দেখে ওদের জিজ্ঞেস করলাম জিনিসটা কী, তা ওদের কথা আমি এখনও ঠিক করে বুঝতে পারি না।’

‘বুঝে যাবেন। আমিও প্রথম দিকে কিছুই বুঝতাম না। এগুলো এলাচের মতো দেখতে হলেও এগুলোকে বলে ক্যারাগুলা। ইদানিং পাহাড়িদের মধ্যে এটার চাষ জনপ্রিয় হয়েছে। শুঁটকি অথবা কাঁচামরিচ দিয়ে ভর্তা খেতে খুব মজা। নিতে পারেন। আমিও এটা নিতেই এসেছি। আমার রিসোর্টে অনেক অতিথি আসেন যারা একটু টক, ঝাল ভর্তা খেতে চান। তাদের জন্য।’

মেহুলি মাথা নাড়ে। তারপর অল্প করে একটু নেয়। আগে খেয়ে দেখা যাক। ভালো লাগলে পরে না হয় আবার নেওয়া যাবে।

মেহুলি বাজার সেরে একবার এদিক-ওদিক তাকাতেই দেখে ফয়সাল একটু দূরে পাহাড়ি কলা দামদর করছে। লোকটা একটু অন্যরকম। গায়ে পড়া স্বভাব না। অন্য কেউ হলে এতক্ষণ ওর পিছেই লেগে থাকত। সারাজীবন তাই দেখে এসেছে।

মেহুলি একবার বিদায় নেবার কথা ভেবেও ক্ষান্ত দেয়। আজ ও নিজের ছোট্ট লাল গাড়িটা নিয়ে এসেছে। গাড়ির দিকে এগিয়ে যেতেই ফয়সালের হাঁক শোনা যায়, ‘চলে যাচ্ছেন বুঝি?’

মেহুলি এবার ঘুরে তাকাতেই দেখে ফয়সাল এগিয়ে আসছে সঙ্গে ছোট একটা কুকুরছানা। কাছে আসতেই মেহুলি অবাক গলায় বলে, ‘একে আবার কোথায় পেলেন?’

ফয়সাল হেসে বলে, ‘পথে কুড়িয়ে পাওয়া। ওর নাম দিয়েছি টম। আমার সব সময়ের সঙ্গী।’

টম ততক্ষণে কুঁইকুঁই করতে করতে মেহুলির পায়ের কাছে চলে এসেছে৷ ফয়সালকে অবাক করে দিয়ে মেহুলি ওকে দুই হাত দিয়ে কোলে তুলে নেয়।

মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলে, ‘কী কিউট একটা বাচ্চা! জানেন, আমারও একটা আছে। অবশ্য এত ছোট না, একটু বড়ো, কালো রঙের। ডাক্সহান্ড জাতের। খুবই লক্ষ্মী। ওর নাম কুটুস।’

কুকুরের জাত নিয়ে ফয়সালের খুব একটা জানা নেই। ও মাথা নেড়ে বলে, ‘আমি অবশ্য কুকুরের জাত নিয়ে খুব একটা জানি না। আপনি যখন বলছেন তখন নিশ্চয়ই ভালো হবে।’

মেহুলি হেসে বলে, ‘আমি বললেই ভালো হবে? বাহ, ভালো বললেন তো। আচ্ছা, এটাকে ভ্যাক্সিন দিয়েছেন তো?’

ভ্যাক্সিন দেবার কথা ওর মাথাতেও এসেছিল। কিন্তু আজ দেই কাল দেই বলে আর হয়ে উঠেনি। ইতস্তত গলায় বলে, ‘না, এখনও দেওয়া হয়ে উঠেনি। এবার ঠিক দিয়ে দেব।’

মেহুলি এবার আদর করে টমকে নিচে নামায়, তারপর বলে, ‘হ্যাঁ, দিয়ে দেবেন। ওর জন্য যেমন দরকার তেমন অন্যদের নিরাপত্তার জন্যও দরকার। কখন কাকে কামড়ে দেয়। একটা ভ্যাক্সিন দিলে একদম নিশ্চিন্ত। কামড়ালেও ক্ষতি হবে না।’

ফয়সাল বিড়বিড় করে বলে, ‘মানুষের জন্যও যদি এমন ভ্যাক্সিন থাকত।’

মেহুলি ভ্রু কুঁচকে বলে, ‘কিছু বললেন?’

ফয়সাল মাথা নাড়ে, তারপর বলে, ‘আজ বুঝি আপনার হাসপাতাল ছুটি?’

মেহুলি মাথা নাড়ে, ‘আমার ছুটি। একটা দিন আমি ছুটি কাটাই।’

ফয়সাল একটু ভেবে বলে, ‘তাহলে আজ বুঝি নীলাচল আসবেন? এলে আমার রিসোর্টে একবার ঢুঁ দিয়ে যাবেন।’

আজ সত্যিই নীলাচল যাবার কথা আছে। লোকটা ঠিক ধরেছে। মেহুলি মাথা নাড়ে, ‘আচ্ছা, ফেরার সময় পারলে একবার ঢুঁ মেরে যাব।’

মেহুলি বিদায় নিয়ে ওর লাল গাড়িটায় উঠে। তারপর ধোঁয়া উড়িয়ে পথের বাঁকে অদৃশ্য হয়ে যায়।

ফয়সাল ওর চলে যাবার পথের দিকে আনমনে তাকিয়ে থাকে। ডাক্তার সাহেব আজ সাদা ফুলহাতা সাদা ফতুয়ার ওপর খয়েরি লাল চাদর জড়িয়েছিল। দেখতে খুব পরিশুদ্ধ লাগে।

‘ঘেউ’ শব্দে ঘুরে তাকায়। টম অসহিষ্ণু হয়ে মাথা নাড়ছে। ফয়সাল তেড়ছা গলায় বলে, ‘কী, ডাক্তার আপাকে বুঝি তোর খুব পছন্দ হয়েছে?’

টম মুখ তুলে আবার ‘ঘেউঘেউ’ করে। ফয়সাল হাসে, তারপর বলে, ‘চল, এবার ফেরা যাক।’

ফয়সালের পিছু পিছু টম ছোট ছোট পায়ে ছুটতে থাকে।

২.
যতদূর চোখ যায় শুধু সবুজ পাহাড়ের সারি। কাঁধে কাঁধ রেখে জড়াজড়ি করে মৌন দাঁড়িয়ে। আর পাহাড়ের গায়ে সাদা সাদা মেঘেরা হেলান দিয়ে ঘুমুচ্ছে যেন। মেহুলির ভীষণ ইচ্ছে হয় ঐ সাদা মেঘের মতো নিশ্চিন্তে বোকা পাহাড়ের গায়ে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে থাকতে।
নীলাচলের এই স্পটটা মেহুলির খুব প্রিয়। যখনই মন খারাপ লাগে এখানে এসে ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকে। বেশিরভাগ দিন কুটুস সঙ্গে থাকে। আজও এসেছে।

দূর থেকে কুটুস ছুটে এসে ওর গায়ে মুখ ঘষে আবার ছুটে যাচ্ছে। কান দুটো বড়ো, তাতে করে আদুরে লাগে।

কুটুস আবার ফিরে আসতেই মেহুলি উঠে দাঁড়ায়, তারপর বলে, ‘চল কুটুস, ফিরে যাই।’

কুটুস কী বোঝে কে জানে, মাথা নেড়ে ওর পিছু নেয়।

মেহুলি ড্রাইভিং সিটে উঠে কুটুসকে পাশের সিটে বসায়। তারপর গাড়ি ছাড়তেই কুটুস জানালা দিয়ে বাইরে আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে থাকে।

এক কিলোমিটার রাস্তা পার হতেই হঠাৎ এসেন্স রিসোর্ট এর সাইনবোর্ড নজরে আসে। কী মনে হতে মেহুলি গাড়ির গতি কমায়। তারপর ডানদিকের ইন্ডিকেটর লাইট জ্বেলে রিসোর্টে ঢোকে। মেইন গেট খোলাই ছিল। কেউ কিছু জিজ্ঞেস করে না। একটা সরু রাস্তা নিচের দিকে নেমে গেছে। মেহুলি ব্রেক চেপে চেপে নিচে নামতে থাকে। অল্প কিছুদূর যেতেই সমতল ভূমি পায়৷ একটা কালো জিপ দাঁড়িয়ে আছে পার্কিংয়ে। ফয়সাল সাহেবের? আচ্ছা লোকটা তো নাও থাকতে পারে। নাহ, বোকামো হয়ে গেল।

এই সময় একজন হালকা-পাতলা বুড়ো মতো লোক এগিয়ে আসে। কাছে এসে বলে, ‘বুকিং ছিল ম্যাডাম? আমি পলিন বিশ্বাস। এখানকার রিসেপশনের দায়িত্বে আছি।’

মেহুলি মাথা নেড়ে বলে, ‘না, আমি এখানে থাকতে আসিনি। ফয়সাল সাহেব কি আছেন?’

এবারে পলিন যেন চিনতে পারে। সম্ভ্রমের সঙ্গে বলে, ‘ডাক্তার আপা আপনি এসেছেন। হ্যাঁ, হ্যাঁ, উনি আছেন। আমি ডেকে দিচ্ছি।’

এই লোকটা ওকে চেনে?

পলিন ওকে সামনের ছোট্ট একটা মাঠের মতো জায়গায় কতগুলো ইজিচেয়ার পাতা যেখানটায় সেখানে নিয়ে যায়। তারপর বলে, ‘এখানটায় একটু বসুন। ফয়সাল নিচে নেমেছে, জলের পাম্পে কী সমস্যা হয়েছে তাই দেখতে।’

মেহুলি মাথা নাড়ে। কুটুস সমতল ভূমি পেয়ে ছুটোছুটি করছে। কোথা থেকে টম ছুটে আসে। কিছুক্ষণ থমকায়। দুজন দুজনকে দেখে। তারপর কাছে এসে নাকে নাক ছোঁয়ায়। তারপর গলা দিয়ে গরগর শব্দ করতে থাকে আর লেজ নাড়তে থাকে। যাক, এদের ভাব হয়ে গেল।

মেহুলি আশেপাশে চোখ বোলায়। সমতলভূমিটার একদম শেষ মাথায় দুটো গাছ। আর সেখান থেকে একটা দোলনা ঝুলছে।

মেহুলি পায়ে পায়ে এগিয়ে যায়। কাছে যেতেই অবাক হয়ে খেয়াল করে এখান থেকে দূরের শহর দেখা যাচ্ছে। নিচে পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে বাঁশের ছোট ছোট ঘর। অতিথিরা বুঝি এখানেই থাকে?

মেহুলি দোলনায় উঠে। একটা বাতাস এসে মুখে লাগে। একটু একটু করে ও দুলতে থাকে। কী সুন্দর একটা জায়গা! এত কাছে অথচ কখনও আসা হয়নি।

এই সময় ফয়সালকে দেখা যায়। আজ কালো একটা টিশার্ট পরা। মাথার চুলগুলো এলোমেলো। কাছে এসে আন্তরিক হাসি হাসে, ‘আপনি সত্যিই এসেছেন? বাহ, খুব ভালো লাগল। পলিন কাকু বলল ডাক্তার আপা এসেছেন। প্রথমটায় বুঝতে পারিনি।’

মেহুলি ততক্ষণে দোলনা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছে। মুচকি হেসে বলে, ‘এখন তো বুঝতে পারলেন। এক কাপ চা খাওয়ান। চা খেয়ে বিদায় নেই।’

ফয়সাল মাথা নাড়ে, তারপর চায়ের কথা বলতে গিয়েও থেমে যায়, ‘আপনারা কজন এসেছেন? বাচ্চারা কই? আপনার হাসব্যান্ড, ওনারা কোথায়?’

মেহুলি থমকায়। কিছুক্ষণ চুপ থাকে। তারপর ম্লান হেসে বলে, ‘সবার কি সব থাকতে আছে? আমি আর আমার কুটুস। এই দুজনই এসেছি। যেহেতু কুটুস চা খাবে না, সেক্ষেত্রে এক কাপ চা হলেই হবে।’

হঠাৎ করেই ঝলমলে পরিবেশটা কেমন আকাশে কেটে যাওয়া ঘুড়ির মতো গোত্তা খায়। ফয়সাল নিজেকে সামলে নিয়ে বলে, ‘ওহ, কুটুস এসেছে। বাহ, এর মধ্যেই টমের সঙ্গে খাতির হয়ে গেছে।’

মেহুলি কেমন একটা গলায় বলে, ‘ওদের জীবন এত জটিল না। খুব সহজেই বন্ধুত্ব হয়ে যায়৷ একা কেন, সে কথা জানার দরকার হয় না ওদের।’

ফয়সাল বিব্রত বোধ করে, তারপর বলে, ‘সরি, আমি ঠিক বুঝতে পারিনি।’

মেহুলি এবার স্বাভাবিক গলায় বলে, ‘আচ্ছা ছাড়ুন এসব। আপনার এখানে মোট কতগুলো এমন বাংলো আছে?’

প্রসঙ্গ পরিবর্তন হতে ফয়সাল স্বস্তি পায়।

‘এই ধরুন গিয়ে আটটা। এছাড়া দশ বারোটা সিংগেল রুম আছে। যারা একটু নিরিবিলি থাকতে চায় তাদের জন্য আমাদের রিসোর্টটা আদর্শ। পূর্ণিমার সময় এখানটায় বসে আপনি উপভোগ করতে পারবেন। চাইলে প্লুংক বাঁশি শুনতে পারবেন।’

মেহুলি থমকায়, জিজ্ঞাসু গলায় বলে, ‘প্লুংক বাঁশি কী?’

ফয়সাল এবার আগ্রহের গলায় বলে, ‘এটা হলো এখানকার ম্রো সম্প্রদায়ের এক ধরনের বাঁশি। লাউয়ের একটা শুকনো খোলের দুপাশে ছিদ্র করে বাঁশের কঞ্চি ঢুকানো হয়। কোনটায় চারটা, আবার কোনটায় ছয়টা। বিভিন্ন উৎসবে এরা এই বাঁশি বাজায়। রাতের বেলা শুনলে অদ্ভূত একটা অনুভূতি হয়।’

মেহুলি মন্ত্রমুগ্ধের মতো ওর কথা শুনছিল। আগ্রহের গলায় বলে, ‘তাহলে একদিন পূর্ণিমায় আপনাদের এখানে থাকতে হয় তো।’

ফয়সাল উৎসাহের গলায় বলে, ‘অবশ্যই থাকবেন। আমি আগামী পূর্ণিমাতেই আপনাকে দাওয়াত দেব।’

মেহুলি হাসে, তারপর বলে, ‘আচ্ছা সে দেখা যাবে।একটা কথা বলুন তো, এই এত বড়ো রিসোর্ট চালাতে তো অনেক পানির দরকার হয়। এত উঁচুতে মাটির নিচ থেকে পানি তুলে আনা তো বেশ কষ্টসাধ্য এবং খরচের ব্যাপার।’

ফয়সাল ছোট্ট একটা নিশ্বাস নিয়ে বলে, ‘মাটির নিচ থেকে পানি উঠিয়ে আনতে গেলে সত্যিই অনেক খরচ হয়ে যেত। কিন্তু প্রকৃতির আশীর্বাদে আমাদের তা করতে হয় না। এই রিসোর্টের সব পানি আসে পাহাড়ি ঝিরি থেকে। পাহাড়ের গা বেয়ে যে পানির ধারা ঝর্ণা হয়ে নেমে আসে সেগুলো আমরা নিচে বড়ো একটা পুকুরে সংগ্রহ করি। এই পানিই ফিল্টার করে ওপরে নিয়ে আসি। এ দিয়ে অতিথিদের গোসলসহ অন্যান্য কাজ হয়। খাবার পানি অবশ্য আলাদা করে দেওয়া হয়।’

মেহুলি মুগ্ধ হয়ে শুনছিল।
‘এ তো দারুণ ব্যাপার। আমি তো ভেবেই কুল পাচ্ছিলাম না।’

তারপর একটা দিকে ইশারা করে, ‘এগুলো কাশফুল না?’

মাঠের একটা পাশে লম্বা লম্বা শনের মতো গাছটা মাথা তুলে ওপরে উঠে গেছে। তার মাথায় সাদা কাশফুল বাতাসে অল্প অল্প দুলছিল।

ফয়সাল সেদিকে তাকিয়ে বলে, ‘হ্যাঁ, কাশফুল।’

এই সময় ছোট্ট একটা ছেলে দুকাপ চা দিয়ে যায়। মেহুলি চা নিয়ে চেয়ারে বসে। চুমুক দিতেই টের পায় চা-টা খুব ভালো বানিয়েছে।

ফয়সালও চা নিয়ে চুমুক দেয়। আজ ডাক্তার সাহেবকে অন্যরকম লাগছে। বাদামি একটা লং ওভারকোট পরেছে, নিচে জিন্সের সঙ্গে সাদা কেডস।

মেহুলি চা খেতে খেতে বলে, ‘তা আপনার ফ্যামিলি কি এখানেই থাকে? মানে এই রিসোর্টেই? তারা কোথায়?’

ফয়সাল এবার হাসে, তারপর বলে, ‘সবার কি সবকিছু থাকতে আছে? আমি আর আমার টম, এই দুজনেই, ব্যস।’

মেহুলি কপাল কুঁচকে তাকায়। লোকটা কি ইচ্ছে করে ওর মতো বলল? সেটা বুঝতেই মেহুলি গম্ভীরমুখে বলে, ‘আপনি কি আমার বলা কথাগুলোই ঠাট্টা করে বললেন?’

ফয়সাল মাথা নাড়ে, ‘ঠাট্টা কেন করব? আপনি জানতে চাইলেন তাই বললাম। হ্যাঁ উত্তরটা আপনার কথার মতো হয়ে গেছে বটে। কিন্তু সত্যি কথাটা হলো আমিও আপনার মতোই। আমি আর টম।’

কয়েকটা মিনিট চুপচাপ কেটে যায়। দুজন দুদিকে তাকিয়ে নীরবে চা খেতে থাকে। চা শেষে মেহুলি উঠে দাঁড়ায়। তারপর বিদায় নেবার গলায় বলে, ‘আচ্ছা আমি যাই। বাসায় মা একা আছেন।’

যাবার বেলায় কুটুস একটু বিরক্ত করে। কেন যেন যেতে চাচ্ছে না। নতুন সঙ্গীর সঙ্গে আরও কিছুক্ষণ খেলবে। মেহুলি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। ওদের জীবনটা কী সহজ! কোনো জটিলতা নেই। বন্ধুত্ব হয়ে গেলেই হলো। অযথা অতীত এসে প্রশ্নের দেয়াল তোলে না।

মেহুলি চলে যায়। হঠাৎ করেই উত্তর দিক থেকে হিম হাওয়া আসে। সেই হাওয়ায় ফয়সাল কেঁপে ওঠে।

(চলবে)

মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান সুবাস
শিমুলতলী, গাজীপুর
১৭/০১/২০২৫