#যদি_নির্বাসন_দাও (পর্ব ৪)
১.
‘আচ্ছা, তুই তখন হুট করে উঠে গেলি কেন? বাপ্পী কি খারাপ কিছু বলেছে?’
জাহানারা তির্যক গলায় মেহুলিকে প্রশ্নটা করে।
মেহুলি সোফার ওপর পা তুলে বসেছিল। সন্ধ্যা হতেই হাড় কাঁপানো ঠান্ডা পড়েছে। সেই সঙ্গে হিম বাতাস। তাই সবাই বাংলোর ভেতর কম্বল গায়ে দিয়ে বসে আছে। তুলি খাটের এককোণে বসে ফেসবুক ঘাঁটছে।
মেহুলি ঘুরে তাকায়, তারপর চশমাটা ঠিক করে বলে, ‘খারাপ কিছু বলবে কেন? কিন্তু এই সুফিয়া আন্টি কে? তার কথা তো কখনও শুনিনি?’
জাহানারা কপাল কুঁচকে বলে, ‘তুই আমার সব কথা শুনিস? উনি আমার পরিচিত একজন। ছেলেটা কী ভাবল? তোর কি দিন দিন বুদ্ধি বিবেচনা লোপ পাচ্ছে? মানুষের সঙ্গে কেমন ব্যবহার করতে হয় সেটাও ভুলে যাচ্ছিস।’
মেহুলি চোখা গলায় বলে, ‘ভুলে যাচ্ছি না। বরং যা করেছি ঠিক করেছি। তোমার এই সুফিয়া আন্টির ছেলে নিশ্চয়ই হিমেলের অফিসে চাকরি করে সেই ইঞ্জিনিয়ার পাত্রটা, তাই না?’
জাহানার থমকান। কিছুক্ষণ কোনো কথা খুঁজে পান না। এত দ্রুত মেহুলি সব বুঝে ফেলল! লম্বা একটা নিশ্বাস নিয়ে বলেন, ‘হ্যাঁ, এটা সেই ছেলে। কিন্তু তাতে কী সমস্যা হলো? তোকে তো বলেছিলাম ওরা তোর ছবি দেখে পছন্দ করেছে।’
মেহুলি মায়ের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলে, ‘আর অমনি ওদের দাওয়াত দিয়ে নিয়ে এলে মেয়ে দেখাতে? আমার কি বিন্দুমাত্র সম্মান নেই?’
তুলি ফোন রেখে উঠে বসেছে। প্ল্যানটা ওর। আপু জানলে খুব রাগ করবে৷
জাহানারা সমানে উত্তর দেন, ‘তোর মান সম্মানের কথা ভেবেই ওদের তোর হাসপাতালের বাসায় ডাকিনি। তার চেয়ে এই রিসোর্টে দেখা হলো, কেউ জানতেও পারল না।’
মেহুলি গনগনে চোখে তাকিয়ে থাকে, তারপর বলে, ‘আমি তো বলেছি বিয়ে করব না। কেন তোমরা এমন নাটক সাজাচ্ছ?’
এই সময় তুলি উঠে আসে। মেহুলির পাশে বসে জড়িয়ে ধরে বলে, ‘আপু, তুই রাগ করিস কেন? তুই তো আমাদের কাছে বাবার মতো। আমাদের জন্য সারাজীবন কষ্ট করে গেলি। নিজের সুখ বিসর্জন দিয়ে ভাইয়াকে, আমাকে মানুষ করলি। তুই বিয়ে না করলে যে আমাদের ভীষণ অনুতাপ হয়।’
বলতে বলতে তুলি কেঁদে ফেলে। মেহুলির বুকের ভেতর যেন কেমন করে। ছোট বোনটাকে কাছে টেনে নেয়। ওর পিঠে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে, ‘আমাকে নিয়ে কষ্ট পাস না। বিধাতা চেয়েছেন তাই অমন হয়েছে। আমার আসলে বিয়ের মনটাই আর নেই। যদি কখনও মন সায় দেয় আমি জানাব। তার আগে তোরা আর এমন করে আমায় কষ্ট দিস না।’
জাহানারা গম্ভীরমুখে বলে, ‘তোর মন কবে সায় দেবে তার জন্য বসে থাকবি? এখন তাও পাত্র পাওয়া যাচ্ছে, কদিন পর তো আর কেউ বিয়েই করতে চাইবে না। একা একা সারাজীবন থাকতে হবে। তখন বুঝবি কেমন লাগে।’
মেহুলি রাগী গলায় বলে, ‘আমারটা আমাকেই বুঝতে দাও মা। আমি কাল সকালেই হাসপাতালে চলে যাব। তোমরা দুপুর পর্যন্ত থেকে তারপর এসো।’
জাহানারা ভ্রু কুঁচকে বলেন, ‘সে কী কথা! কাল সকালে না নীলগিরি যাব আমরা? ওদেরও বলেছি।ওরা যাবে আমাদের সঙ্গে। আল্লাহর দোহাই লাগে তুই এমন পাগলামি করিস না এখন।’
আগে থেকেই ঠিক করা ছিল মা, তুলি আর ও কাল সকালে নীলগিরি যাবে। তারপর ওখান থেকে সরাসরি হাসপাতালে ফিরে আসবে। কিন্তু এখন আর কিছুতেই যেতে ইচ্ছে করছে না। এরা একদম সিনেমার মতো করে সব সাজিয়েছে। রাগে গা জ্বলে যায়।
মেহুলি উষ্ণ গলায় বলে, ‘ওদের সঙ্গে তোমরা যাও, আমি যাব না।’
এবার তুলি অনুনয়ের গলায় বলে, ‘আপু প্লিজ, তুই না গেলে আমরা যাবই না। একটাবার না হয় সহ্য কর। ওই ছেলেকে গাড়ির সামনে বসিয়ে রাখব। আর আমি থাকব তোর সাথে সাথে। তবুও চল প্লিজ।’
মেহুলি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। এদের সঙ্গে পারা যাবে না আজ। মাথা নেড়ে নিচু গলায় বলে, ‘যা ইচ্ছে কর। আমি একটু বাইরে থেকে হেঁটে আসি।’
তারপর তুলিকে ছেড়ে দিয়ে উঠে পড়ে। কালো শালটা জড়িয়ে বাইরে আসে৷ এখানে থাকলে তিক্ত কথাই হবে শুধু।
ছোট ছোট সিঁড়ি ভেঙে মেহুলি ওপরের সমতলভূমিটায় আসে। বাতাসে দোলনাটা শূন্যে একা একা দুলছে। মেহুলি পায়ে পায়ে এগিয়ে যেতেই থমকে দাঁড়ায়। ফয়সাল সাহেব দোলনার পাশেই গাছটার আড়ালে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে।
কাছে গিয়ে গলাখাঁকারি দিতেই ঘুরে তাকায়, তারপর হাসিমুখে বলে, ‘আপনার ভাগ্য ভালো। আজ কিন্তু পূর্ণিমা। দেখুন কেমন রুপোলী চাঁদ উঠেছে।’
মেহুলি এতক্ষণে ব্যাপারটা খেয়াল করে। আসলেই তো। এজন্যই চারপাশ এত আলোকিত লাগছিল। আকাশের দিকে তাকাতেই চাঁদটা দেখতে পায়। চারপাশে বিন্দু বিন্দু রুপার তারা ঝিকঝিক করছে। মেহুলির খারাপ হয়ে থাকা মনটা ভালো হয় এতক্ষণে।
গাছের পাতাগুলো উত্তুরে হাওয়ায় ডানা ঝাপটানো পাখির মতো ছটফট করছে। তার ফাঁক দিয়ে চাঁদটা দেখতে ভীষণ ভালো লাগছে।
সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে মেহুলি বলে, ‘কাল আপনি একটু ফ্রি আছেন?’
ফয়সাল বলে, ‘কেন বলুন তো?’
মেহুলি বলবে না ভেবেও বলে ফেলে, ‘আমরা কাল নীলগিরি যাচ্ছি। আপনি একটু আমাদের সঙ্গে যেতে পারবেন?’
নীলগিরি যাবার জন্য গাড়ির ব্যবস্থা ও-ই করে দিয়েছে। বিকেলে মেহুলির আম্মা আর সেই ছেলেটা এসেছিল। ওদের পাঁচজনের জন্য একটা চাঁদের গাড়ি ঠিক করে দিয়েছে তখন।
ফয়সাল বুঝতে না পেরে বলে, ‘কেন, ভয় পাচ্ছেন বুঝি? কোনো ভয় নেই। নিশ্চিন্ত মনে যেতে পারেন।আপনার আম্মা বিকেলেই এসেছিল গাড়ির ব্যাপারে কথা বলতে। আর আপনাদের পরিচিত ওই পরিবারটাও তো যাচ্ছে।’
মেহুলি রাগত গলায় বলে, ‘থাক, আপনাকে যেতে হবে না। আপনি নিশ্চয়ই অনেক ব্যস্ত।’
কথাটা বলে মেহুলি পেছন ঘুরে হাঁটতে থাকে। ভেবেছিল ফয়সাল সাহেবকে সঙ্গে নিয়ে গেলে ওই ছেলেটা আর কাছে ঘেঁষবে না। কিন্তু ইনি তো যেতেই চাচ্ছে না। কেন যেন সবকিছু বিরক্ত লাগছে। ভেবেছিল সবার কাছ থেকে দূরে নিরিবিলি একা একা থাকবে। কিন্তু মানুষের তা সহ্য হলো না।
এই সময় পেছন থেকে ফয়সালের গলা পাওয়া যায়, ‘অন্ধকারে অমন করে হাঁটবেন না। এই যে টর্চ লাইটটা নিন।’
মেহুলি থামে। ঘাড় ঘুরিয়ে একবার ওকে দেখে। তারপর আগের মতই আবার হাঁটতে থাকে। রিসোর্টের সামনের পিচঢালা পথটা একদম শান্ত নির্জন। ল্যাম্পপোস্টগুলো অনেক দূরে দূরে। সেখান থেকে টিমটিমে আলো জ্বলছে। অবশ্য চাঁদের আলোতে চারপাশ অনেকটাই পরিষ্কার।
ফয়সাল টর্চের আলো ফেলে ওর পাশাপাশি হাঁটতে থাকে। একটা সময় মেহুলি মুখ খুলে, ‘আপনি এখানে কত দিন ধরে আছেন?’
ফয়সাল বলে, ‘প্রায় তিন বছর।’
মেহুলি ওর দিকে ঘুরে তাকিয়ে বলে, ‘এর আগে কোথায় ছিলেন?’
ফয়সাল ইতস্তত করে বলে, ‘এই তো ঢাকায় ছিলাম।’
মেহুলি থেমে যায়। ফয়সালও দাঁড়িয়ে পড়ে।
‘তাহলে ঢাকা ছেড়ে এমন একটা জায়গায় কেন এলেন?’
ফয়সাল গলাখাঁকারি দিয়ে বলে, ‘আপনার হাসপাতালের লোকজন বলছিল আপনার মতো এমন বড়ো ডাক্তার নাকি এর আগে এখানে আসেনি। আপনি কেন এলেন এখানে?’
পালটা প্রশ্ন আসবে এটা বুঝতে পারেনি। মেহুলি গম্ভীরমুখে বলে, ‘একেকজনের আলাদা আলাদা কারণ থাকে। আপনার বলতে অসুবিধে থাকলে বলবেন না।’
ফয়সাল কেমন একটা গলায় বলে, ‘আমার সত্যিই বলতে অসুবিধে আছে। প্লিজ কিছু মনে করবেন না।’
মেহুলি মাথা নাড়ে। মনে মনে ভাবে, তাই তো। মাত্র এই কয়েকদিনের পরিচয়ে মানুষটা ওকে কেনই বা তার লুকানো ব্যথার কথা বলবে? ও নিজেও তো বলবে না।
চাঁদের আলোয় দুটো একাকী মানুষ আলাদা আলাদা কষ্ট নিয়ে হাঁটতে থাকে।
২.
ভোর সাড়ে ছয়টায় চাঁদের গাড়ির ড্রাইভার সিকান্দার আলির হাঁকডাকে সবাই অনিচ্ছাসত্ত্বেও বের হয়। কাল রাতেই ফয়সাল বলে রেখেছিল ভোর বেলাতেই বেরিয়ে যেতে। না হলে নাকি মেঘের আসল সৌন্দর্য দেখা যাবে না। কিন্তু এখন এত ভোরে উঠে চারপাশে শুধু কুয়াশা আর হাড় হিম করা বাতাস দেখে সবাই হতাশ হয়। তুলি তো বলেই বসে, ‘নিশ্চয়ই ম্যানেজার সাহেব ইচ্ছে করেই আমাদের এত ভোরে উঠিয়েছে। ঘোড়ার ডিম, মেঘ তো দূরের কথা চারদিক কেমন হুড়মুড় করে কুয়াশায় ঢেকে যাচ্ছে।’
মেহুলি শেষ পর্যন্ত ওদের সঙ্গে বেরিয়েছে। সুফিয়া আন্টি আর তার ছেলে বাপ্পীও। সবাই দুই তিনটে করে মোটা গরম কাপড় পরেছে।
এমন সময় ফয়সালকে দেখা যায়৷ মাথায় উলের টুপি, গায়ে ভারী জ্যাকেট। কাছে এসে কথা বলতেই মুখ দিয়ে ধোঁয়া বেরোয়, ‘আপনার শীগগির রওনা হয়ে যান।’
মেহুলি তেড়ছা গলায় বলে, ‘এই অন্ধকারে বেরিয়ে কী হবে?’
ফয়সাল হাসে, ‘বেরিয়েই দেখুন না, কী ম্যাজিক হয়!’
বাপ্পী পাশ থেকে বলে, ‘কী আর ম্যাজিক হবে ম্যানেজার সাহেব? ওই তো কুয়াশার মতো একটু মেঘ দেখা।’
মেহুলি একবার কড়া চোখে তাকায় বাপ্পীর দিকে। কিন্তু কেন অমন করে তাকায় সেটা ঠিক বোঝা যায় না।
সবাই অনিচ্ছাসত্ত্বেও গাড়িতে উঠে পড়ে। চাঁদের গাড়িটা পিকআপ ভ্যানের মতো অনেকটা।গাড়ির পেছনে দুপাশে লম্বা দুটো সিট পাতা। তাতে দুপাশে ছয় জন করে মোট বারো জন বসতে পারে। একপাশে জাহানারা, তুলি, মেহুলি বসে। অন্য পাশে সুফিয়া, বাপ্পী উঠে বসে।
গাড়ি ছাড়ার মুহূর্তে ফয়সাল বাপ্পীর পাশে উঠে বসতেই মেহুলি অবাক গলায় বলে, ‘আপনি যাচ্ছেন?’
ফয়সাল মাথা নাড়ে, ‘নীলগিরিতে আমাদের ছোট্ট একটা রিসোর্ট আছে। ওটার হিসেব পত্তরও আমি দেখাশোনা করি। ভাবলাম আপনাদের সঙ্গ দেওয়া হলো আবার আমার কাজটাও হলো।’
মেহুলি আনন্দিত গলায় বলে, ‘বাহ, এটা খুব ভালো হলো। থ্যাংকিউ ফয়সাল সাহেব।’
জাহানারা কড়া চোখে মেয়ের দিকে তাকায়। বাপ্পীও কেমন বিরক্ত মুখে বসে আছে। মেহুলির ছবিটা যখন দেখেছিল তখন খুব পছন্দ হয়েছিল। আর এখানে সামনাসামনি দেখার পর সেই পছন্দটা একটা মোহে পরিণত হচ্ছে। মেয়েটা কী সুন্দর! কিন্তু কেন যেন ওকে পাত্তাই দিচ্ছে না। উল্টো এই সাধারণ একটা ম্যানেজারের সঙ্গে আহ্লাদী করছে।
গাড়িটা ছাড়তেই ঠান্ডা বাতাস যেন গায়ে হুল ফোটায়। সবাই নাক, মুখ ঢেকে বসে। পাশে বসা বাপ্পী নামের ছেলেটা কাঁপছে। আর তার কারণও আছে। ইনি মাথা ঢাকার জন্য মাফলার বা টুপি কিছুই নিয়ে আসেনি। ফয়সাল ওর উলের ক্যাপটা খুলে বাড়িয়ে দেয়, ‘নিন, এটা পরে নিন। না হলে হুট করে ঠান্ডা লেগে যাবে।’
বাপ্পী কৃতজ্ঞ চোখে তাকায়। তারপর হাত বাড়িয়ে টুপিটা নেয়। মেহুলি ভ্রু কুঁচকে ব্যাপারটা দেখছিল। চেচিয়ে বলে, ‘এই যে মশাই, আপনি যে অমন টুপিটা দিয়ে দিলেন, আপনার বুঝি ঠান্ডা লাগে না?’
ফয়সাল হাত তুলে আশ্বস্ত করে, ‘আমার অভ্যাস আছে।’
তুলিও উশখুশ করতে থাকে। একটা সময় মেহুলি ওর সাইড ব্যাগ থেকে একটা মাফলার বের করে বাড়িয়ে দেয়, ‘এটা জড়িয়ে নিন। আমি একটা এক্সট্রা নিয়ে এসেছিলাম।’
জাহানারা আর সুফিয়া দুজনেই কড়া চোখে তাকায়। মেহুলি ওদের কঠিন চোখ অগ্রাহ্য করে মাফলারটা ছুড়ে দেয় ফয়সালের কোলে। ওর ভীষণ মজা লাগছে। মাকে পাত্র দেখানোর উপযুক্ত শাস্তি দেওয়া গেছে। যত পারে আরও বেশি করে ফয়সাল সাহেবের সঙ্গে ও আহ্লাদী করবে।
এদিকে ফয়সাল বিব্রত ভঙ্গিতে মাফলারটা হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ বসে থাকে। তাই দেখে তুলি বলে, ‘পরে ফেলুন।’
শেষ পর্যন্ত ফয়সাল মাফলারটা মাথায়, গলায় জড়ায়। একটা সুন্দর ঘ্রাণ পায়। অনেক দিন পর মন উদাস হয়ে যায়।
আধা ঘন্টা পর সত্যিই ম্যাজিক হয়। গাড়িটা যত ওপরে উঠতে থাকে ততই ঝলমলে রোদ সঙ্গে নীল আকাশের দেখা মেলে। সবাই অবাক বিস্ময়ে দেখে পাহাড়ের গায়ে সাদা সাদা মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে।
তুলি প্রথমে কথা বলে, ‘আপুউউ, দেখ। কী সুন্দর মেঘ উড়ে যাচ্ছে।’
সবাই হাতে মোবাইল নিয়ে ছবি তুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। মেহুলি শুধু মেঘগুলো দেখছিল। আর ফয়সাল গলায় জড়ানো মাফলার থেকে আসা ঘ্রাণটুকু আরও গভীরভাবে নিচ্ছিল।
ওরা যখন নীলগিরি পৌঁছে ততক্ষণে রোদ উঠে গেছে। সবাই গরম কাপড়গুলো গাড়িতে রেখে টিকেট কেটে ভেতরে ঢোকে। তারপর হাঁটতে হাঁটতে মেঘ দেখার স্পটে আসতেই থমকায়। যতদূর চোখ যায় শুধু সাদা মেঘ। হঠাৎ করে দেখলে সমুদ্র বলে বিভ্রম হয়।
জাহানারা এবার সবাইকে তাড়া দেয়, ‘আসো, আমরা ছবি তুলি। এই যে ম্যানেজার সাহেব, আমাদের একটু ছবি তুলে দিন তো।’
মেহুলি নিচু গলায় বলে, ‘ওনার একটা নাম আছে মা।’
জাহানারা সে কথার কোনো পাত্তাই দেয় না।
ওরা সবাই একসঙ্গে দাঁড়ায়। ছবি তোলার আগ মুহূর্তে জাহানারা আর সুফিয়া ইচ্ছে করে নিজেদের জায়গা এমন করে বদল করে যাতে বাপ্পী আর মেহুলি পাশাপাশি থাকে। কিছু বুঝে উঠার আগেই ফয়সাল ছবি তুলে।
মেহুলি কপাল কুঁচকে মায়ের দিকে তাকায়। হঠাৎ মাথায় একটা দুষ্টু বুদ্ধি আসে। গলা বাড়িয়ে বলে, ‘ফয়সাল সাহেব, একটু এদিক আসুন তো।’
ফয়সাল কাছে আসতেই মেহুলি ওর পাশে দাঁড়ায়। তারপর তুলিকে চিৎকার করে বলে, ‘আমাদের একটা ছবি তুল তো। হাজার হলেও আমার প্যাশেন্ট।’
তুলি হাসে। পটাপট কয়েকটা ছবি তুলে। জাহানারার মুখ দেখে মনে হচ্ছে উনি মূর্ছা যাবেন।
ছবিগুলো দেখতে দেখতে তুলি ফিসফিস করে বলে, ‘আপু, লোকটা কিন্তু স্মার্ট আছে। দেখতেও খুব সুন্দর।’
মেহুলি দুষ্টুমির গলায় বলে, ‘তোর পছন্দ হয়েছে? টুটুলকে না করে দেব তাহলে?’
টুটুল হলো তুলির হবু বর। তুলি চোখ পাকিয়ে বলে, ‘আপুউউ৷ তুই যা মুখে আসে তাই বলিস। তার চেয়ে তুই ওনাকেই বিয়ে করে এখানেই থেকে যা। তাহলে আমরা মাঝেমধ্যে এসে ফ্রি রিসোর্টে থেকে যেতে পারব।’
মেহুলি হাসতে গিয়েও মুখ গম্ভীর হয়ে যায়। তারপর হঠাৎ করেই হাঁটা শুরু করে।
ইতোমধ্যে অনেক পর্যটক এসে পৌঁছেছে। সবাই ওদের মতোই অবাক হয়ে মেঘের সৌন্দর্য দেখছে। মেহুলি হাঁটতে হাঁটতে একটা কিনারায় এসে দাঁড়ায়। এখান থেকে তাকালে দিগন্ত বিস্তৃত সাদা মেঘ দেখা যাচ্ছে। মেঘের ওপারে পাহাড়ের মাথা দেখা যাচ্ছে।
সেদিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে ফয়সাল কাছে এসে বলে, ‘একটু পর যখন আরও রোদ উঠবে তখন দূরের পাহাড়গুলো আরও বেশি করে দৃশ্যমান হবে।’
মেহুলি ঘুরে তাকায়, তারপর আনমনে বলে, ‘হ্যাঁ, মেঘের মায়া হার মেনে যায় রোদের কাছে। যত রোদ উঠবে ততোই মায়াগুলো মিলিয়ে গিয়ে পাথুরে পাহাড় দৃশ্যমান হবে। মানুষের জীবনটাও কিন্তু এমন।’
ফয়সাল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে, ‘হ্যাঁ, একদম ঠিক কথাটাই বললেন। আচ্ছা, ওনারা বুঝি আপনার জন্য পাত্র দেখাতে নিয়ে এসেছে?’
মেহুলি রাগ করতে গিয়েও হেসে ফেলে। তারপর কৃত্রিম গম্ভীর গলায় বলে, ‘তা পাত্র কেমন দেখলেন? বিয়ে করা যায়?’
ফয়সাল একটু থতমত খেয়ে যায়, তারপর বলে, ‘উনি কি মেঘ ভালোবাসে? এই পাহাড়? বিয়ে হলে এখানে থাকতে দেবে আপনাকে? নাকি নিয়ে যাবে?’
মেহুলি ওর চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে। ধীরে ধীরে মুখে একটা হাসি ফোটে। তারপর স্মিতমুখে বলে, ‘আমাকে কেউ নিয়ে যেতে পারে না। আমি ওই পাহাড়ের মতো স্থির। কেউ একবিন্দু সরাতে পারবে না আমাকে।’
ফয়সালের চোখেমুখে একটা খুশির ছাপ ফুটে উঠে। মুখের পেশিতে ঢিল পড়ে। কেন যেন এখন নির্ভার লাগছে। কিন্তু এমনটা লাগার কথা না। হয়তো নীলগিরির এমন নীল আকাশ, সাদা মেঘের ভেলা আর মৌন পাহাড় সব এলোমেলো করে দিয়েছে।
(চলবে)
মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান সুবাস
শিমুলতলী, গাজীপুর
১৮/০১/২০২৫