যদি নির্বাসন দাও পর্ব-০৭

0
333

#যদি_নির্বাসন_দাও (পর্ব ৭)

যদি বলি, ‘ভালোবাসি’,
বলবে কি তুমি, ‘হ্যাঁ তো, ভালোবাসি’?

১.
এবার এপ্রিল মাসের শুরুতেই গরম পড়েছে। পাহাড়ে যেমন ঠান্ডা পড়ে ঠিক তেমন গরমের সময় ভীষণই গরম পড়ে। মেহুলি আজ বিকেলে ফয়সালের রিসোর্টে এসেছিল। ছুটির দিনগুলো কিছুতেই কাটতে চায় না। হাসপাতাল আর বাসা করে করে হাঁপিয়ে গেছে। তাই আজ ইচ্ছে করেই এদিকটায় ঘুরতে এসেছে।

আজ কুটুসকে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছে। বেচারাও বহুদিন তেমন কোথাও যায় না। ইতোমধ্যে সে ফয়সালের কুকুর টমের সঙ্গে খেলায় মেতে উঠেছে। দোলনায় বসে দূর থেকে তাই দেখছিল মেহুলি। এখানটায় বাতাস আছে। গরমটা অনেক কম লাগছে।

ফয়সাল হাতে একটা ট্রে নিয়ে ওর সামনে হাজির হয়। কাচের গ্লাসে ঠান্ডা লেমোনেড। গ্লাসের গায়ে বিন্দু বিন্দু জলের ফোঁটা। দেখেই তৃষ্ণা বেড়ে যায়। বিনাবাক্যব্যয়ে হাত বাড়িয়ে গ্লাস নেয়। তারপর আলতো করে এক চুমুক দেয়।

‘আপনারটা কই?’, মেহুলি প্রশ্ন করে।

‘আমি চা খাব’, ফয়সাল একটা চেয়ারে বসতে বসতে বলে।

মেহুলি ভ্রু কুঁচকে বলে, ‘এই গরমে চা খাবেন?’

ফয়সাল আকাশের দিকে ইশারা করে বলে, ‘বৃষ্টি হবে মনে হচ্ছে। দেখছেন না কালো মেঘ জমা হচ্ছে।’

মেহুলি মুখ তুলে আকাশের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়। আসলেই তো, উত্তর কোণে মেঘ জমা হচ্ছে।

মেহুলি খুশি খুশি গলায় বলে, ‘বাহ, খুব মজা হবে। বৃষ্টি এলে আমি ভিজব।’

ফয়সাল হাসে। সেদিনের পর থেকে মেহুলি অনেকটাই সহজ হয়েছে ওর সঙ্গে। মাঝে মাঝেই এখানে আসে। ফয়সালও ওর হাসপাতালে যায়। কেন যেন মনে হয় মেহুলি ওর চোট পাওয়া মনটাকে একটু হলেও মায়ার প্রলেপ লাগিয়ে দিচ্ছে।

কী মনে হতে ফয়সাল বলে, ‘আচ্ছা, আপনাকে প্রায়ই একটা কথা জিজ্ঞেস করব ভাবি। কিন্তু করা হয় না। আপনার নামের অর্থ কী?’

মেহুলি হাসে, তারপর দোলনা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে আকাশের মেঘের দিকে ইশারা করে, ‘ওই যে মেঘগুলো দেখছেন যেটা এখুনি বৃষ্টি হয়ে নামবে সেটাকে মেহুলি বলে। অনেকে আবার এর অন্য অর্থও বলে – সফল বা বিজয়ী। কিন্তু আমার কাছে প্রথম অর্থটাই ভালো লাগে – বৃষ্টির মেঘ।’

ফয়সাল আগ্রহ নিয়ে শুনছিল। ও মাথা নেড়ে বলে, ‘আমার কাছেও ভালো লাগে।’

মেহুলি থমকায়। এক মুহূর্ত তাকিয়ে থাকে। তারপর মৃদু হেসে বলে, ‘হুম।’

ফয়সাল ওর হাসিমাখা মুখের দিকে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকে। এই কটা মাস যতবারই মেহুলির কাছাকাছি এসেছে ফয়সাল একটা শান্ত নদীর দেখা পেয়েছে। ওর এলোমেলো সময়গুলো কেমন করে যেন পরিপাটি করে দেয় মেয়েটা।

মেহুলি হঠাৎ করে প্রশ্ন করে, ‘আচ্ছা, আপনার সেই প্রাক্তন স্ত্রী আর ফোন দিয়েছিল?’

ফয়সালের উজ্জ্বল মুখটা কালো হয়ে যায়। লিডিয়ার কথা ও সচেতন ভাবেই ভুলে থাকতে চায়।

ফয়সাল গোমড়ামুখে বলে, ‘না। কেন বলুন তো?’

মেহুলি মাথা নাড়ে, ‘নাহ। এমনিতেই জিজ্ঞেস করলাম। মনে হলো উনি ভুল বুঝে আপনার কাছে ফিরে আসতে চাইবে হয়তো। আপনার মতো এত ভালো একটা মানুষকে উনি দুঃখ দিয়েছেন। একটা অনুতাপ তো হয় মানুষের।’

ফয়সাল দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, ‘না, হয় না। সবাই তো আপনার মতো ভালো মানুষ না।’

মেহুলি ওর চোখের দিকে তাকায়, তারপর প্রশ্ন করে, ‘তা কী দেখে মনে হলো আমি ভালো মানুষ? আপনি আমার সম্পর্কে কতটুকু জানেন?’

ফয়সাল হাসে, ‘যতটুকু জানি এর চেয়ে আর বেশি না জানলেও বলে দিতে পারি আপনি একজন শুদ্ধ মনের মানুষ। একটাই সমস্যা সেটা হলো আপনি বাড়ির কথা শুনছেন না। আচ্ছা, আমার কথা তো আপনি এখন সবই জানেন। কিন্তু আপনি কেন বিয়ে করছেন না সেটা বলবেন?’

মেহুলি থমকে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে। ফয়সাল যে আচমকা এমন একটা প্রশ্ন করবে ভাবতেই পারেনি। লম্বা একটা নিশ্বাস নিয়ে বলে, ‘শুনতেই হবে কারণটা?’

ফয়সাল দুই হাত ঝুলিয়ে বলে, ‘আপনার ইচ্ছে। তবে জানতে পারলে ভালো লাগত।’

মেহুলি কী যেন ভাবে, তারপর বলে, ‘আসলে আমার সমস্যটা আপনার মতো নয়। আমি বাবা মায়ের বড়ো সন্তান ছিলাম। মেডিকেলে চান্স পাওয়া পর্যন্ত সব ঠিকঠাক চলছিল। কিন্তু তখন হঠাৎ করেই বাবা এক্সিডেন্ট করলেন। ছোট ভাই বোন দুটো নিয়ে আমরা পড়লাম অকূল সমুদ্রে। আমাকে জীবন যুদ্ধে নামতে হলো। ভাই, বোন মানুষ করা, বাবার চিকিৎসার খরচ। সব সামলাতে গিয়ে আমি হিমশিম খেয়ে গেলাম। এদিকে আমার নিজের পড়ার খরচ। বাবার এক বন্ধু খুব সাহায্য করেছিলেন তখন। তারপরও বাবাকে শেষ পর্যন্ত বাঁচাতে পারিনি। পুরো জীবনটা যুদ্ধ করতে করতে কেটে গেল। জীবনে যে সময়টায় মানুষ প্রেমে পড়ে, আমি সে সময়টায় রূঢ় বাস্তবতার সঙ্গে লড়ছি। সবাইকে একটু ভালো রাখতে গিয়ে কবে যে আমার মনটা মরে গেছে জানি না। সত্যি বলতে বিয়ে করার যে আগ্রহ কিংব সুন্দর একটা মন তার কিছুই আমার নেই এখন।’

কথা ফুরোয়। ফয়সাল হতবাক হয়ে মেহুলির কথাগুলো শোনে। কেন যেন মায় হচ্ছে। ভয়ংকর একটা মায়া হচ্ছে।

ফয়সাল গাঢ় গলায় বলে, ‘মেহুলি, সারাজীবন তো অনেক কষ্ট করলেন। এবার কি একটু সুখ পেতে নেই? এই যে প্রকৃতি প্রতি বছর শীতে পাতা ঝরে রিক্ত হয়। বসন্ত এলেই আবার কেমন কচি সবুজ পাতায় নিজেকে সাজিয়ে তুলে। আপনি কি পারেন না তেমন?’

মেহুলি স্থির চোখে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর বলে, ‘শুনুন ফয়সাল সাহেব, মরে যাওয়া গাছে হাজার বসন্ত এলেও নতুন করে সবুজ পাতা গজায় না, প্রাণ ফিরে পায় না।’

ফয়সাল মাথা নাড়ে। তারপর ফোঁস করে নিশ্বাস ফেলে বলে, ‘আচ্ছা, এসব ভারী আলাপ বাদ থাকুক। সামনেই বৈসাবি উৎসব। আপনি থাকবেন তো এই ছুটিতে?’

ইদানিং দু একজনের মুখে বৈসাবি উৎসবের কথা শুনতে পায়। এক দুজন পাহাড়ি আদিবাসীর সঙ্গে ওর পরিচয় হয়েছে। তারাও দাওয়াত দিয়েছে। ব্যাপারটা কেমন একটু গোলমেলে লাগে।

মেহুলি এবার সুযোগ বুঝে জিজ্ঞেস করে, ‘আচ্ছা, এই বৈসাবি উৎসবটা আমাকে একটু বুঝিয়ে বলুন তো।’

ফয়সাল হাসে। আগ্রহের গলায় বলে, ‘আমি যতটুকু জানি এটা আসলে পাহাড়ি আদিবাসীদের নতুন বছরকে বরণ করে নেবার উৎসব। আমাদের পার্বত্য অঞ্চলে প্রধান তিনটা সম্প্রদায় আছে – ত্রিপুরা, মারমা এবং চাকমা। এরা তিনটা আলাদা নামে নববর্ষ পালন করে। ত্রিপুরা যারা তাদের উৎসবের নাম বৈসু, মারমাদের সাংগ্রাই এবং চাকমাদের বিজু উৎসব। এই তিনটা উৎসবের অদ্যাক্ষর নিয়ে ‘বৈসাবি’ নামটা এসেছে। বৈ তে বৈসু, সা তে সাংগ্রাই আর বি তে বিজু। সাধারণত বাংলা বছরের শেষ দু’দিন অর্থাৎ চৈত্র মাসের শেষ দুদিন থেকে এই উৎসব শুরু। প্রথম দিন ফুল বিজু উৎসব হয়। এদিন চাকমারা ভোরে নদীর পানিতে ফুল ভাসিয়ে পুরনো বছরকে বিদায় জানায়। পরদিন বাড়িতে বাড়িতে ভোজের আয়োজন হয়। আর মারমারা নববর্ষের দিন জল-উৎসব করে।একে মাহা সাংগ্রাই পোয়ে’র জলকেলি উৎসব বলে। একে অপরের গায়ে পানি ছিটিয়ে দেয়। তাতে পুরনো বছরের সব পাপ ধুয়ে যায়। ওদের কাছে প্রকৃতিই যেন সব।’

মেহুলি তন্ময় হয়ে শুনছিল। চোখের সামনে যেন পুরো বৈসাবি উৎসবটা দেখতে পায়। মেহুলি ঘোর লাগা গলায় বলে, ‘আপনি আমাকে নিয়ে যাবেন বৈসাবি উৎসবে?’

ফয়সাল নরম গলায় বলে, ‘হ্যাঁ তো। নিয়ে যাব অবশ্যই।’

সেদিন মেহুলি বিদায় নেয়। টের পায় মনের ভেতর কোথায় যেন একটা কিছু হয়েছে। একটা মাতাল বাতাস বুঝি বা ওর বদ্ধ দুয়ারে ক্ষীণ শব্দে কড়া নাড়ছে। কেবল বুকের ভেতর কান পাতলেই সেই মিষ্টি শব্দটা শোনা যায়।

২.
আজ চৈত্র মাসের শেষ দিনের আগেরদিন। ফুল বিজু উৎসবে মেতে উঠেছে পাহাড়ি আদিবাসীরা। ভোর হতেই সবাই সাঙ্গু নদীর পাড়ে চলে এসেছে।মেয়েদের পরনে লাল খয়েরী পোশাক আর ছেলেরা ধুতি পাঞ্জাবি। সবার হাতেই কাটা কলাপাতায় নানান ধরনের ফুল সাজানো। ফুল দিয়ে সাজানো কলাপাতাগুলো পানিতে ভাসিয়ে দিয়ে পুরনো বছরকে বিদায় জানানো হবে। পুরনো বছরের দুঃখ, কষ্ট সব ভাসিয়ে দেওয়া।

ফয়সাল সেই ভোর থেকে অপেক্ষা করছে। মেহুলি আসার কথা। একসাথেই আসবে বলেছিল কিন্তু শেষ মুহূর্তে হাসপাতালে আটকে যায়। বলল, চলে আসবে। একবার ফোন করবে কি-না ভাবতেই রাস্তার দিকে চোখ যায়। মেহুলি আসছে। দূর থেকে হাত নাড়ে। মেহুলি আজ লালচে খয়েরী শাড়ী পরেছে। কাছে আসতেই মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকে। আনন্দে ওর চোখমুখ ঝলমল করছে। মুখে সূর্যের প্রথম আলো পড়ে আলোকিত, শুদ্ধ সুন্দর। চুলগুলো চিবুক ছুঁয়ে আছে গভীর মায়ায়।

‘সরি, আমার আসতে দেরি হয়ে গেল। কই, আমার ফুল কই?’

মেহুলি আগ্রহের গলায় জিজ্ঞেস করে।

ফয়সাল হাসে, ‘আসুন, ওইখানে রেখেছি।’

মেহুলি আড়চোখে একবার ফয়সালকে দেখে। আজ ফয়সাল নীল জিন্সের সঙ্গে সাদা পাঞ্জাবি পরেছে। চুলগুলো এলোমেলো, মুখে সেই খোঁচা দাড়ি। খুব সুন্দর লাগছে ওকে।

ইতোমধ্যে ফুল ভাসানো শুরু হয়ে গিয়েছে। ফয়সাল একটা কলা পাতা মেহুলির হাতে দেয়। তারপর নিজেও নেয়।

ফয়সাল নরম গলায় বলে, ‘আসুন, আমাদের জীবনের সব দুঃখ, কষ্ট ভাসিয়ে দেই।’

মেহুলি মৃদু হাসে। ওরা দু’জন নিচু হয়ে বসে ফুলসহ কলাপাতাটা পানিতে ভাসায়। নদীতে শান্ত পানির স্রোত। কলাপাতা দুটো ধীরে ধীরে ভাসতে ভাসতে দূরে সরে যায়। সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে বলে, ‘সত্যিই কি এমন করে পুরনো সব দুঃখ কষ্ট ভাসিয়ে দেওয়া যায়?’

ফয়সাল গাঢ় গলায় বলে, ‘হ্যাঁ তো। খুব যায়। আজ থেকে আমরা আমাদের পুরনো সব দুঃখ, কষ্ট ভুলে যাব।’

মেহুলি নরম চোখে ওর দিকে তাকায়। কেন যেন ফয়সালের কথাটা খুব বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছে।

আদিবাসীরা ফুল ভাসিয়ে একটুখানি পানি হাতে নিয়ে মাথায় ছোঁয়ায়। তারপর দুই হাত জোড় করে বিড়বিড় করে কী যেন প্রার্থনা করে।

‘এখন কী করবেন?’, মেহুলি প্রশ্ন করে।

ফয়সাল চুলে হাত চালিয়ে বলে, ‘আজ আর তেমন কাজ নেই। কাল ওদের মূল বিজু উৎসব। পাঁচ রকমের সবজি দিয়ে পাজন রান্না করা হবে। ওদের বিশ্বাস এটা খেলে নতুন বছরের অসুস্থতা আর দুর্ভাগ্য থেকে রেহাই পাবে। আর পরের দিন অর্থাৎ নববর্ষতে মারমাদের জল-উৎসব। এখানে রাজার মাঠে বিকেলবেলা বড়ো করে আয়োজন করা হয়।’

মেহুলি বাচ্চাদের মতো খুশি খুশি গলায় বলে, ‘আমি আসব দেখতে। এই উৎসবের কথা অনেক শুনেছি।’

ফয়সাল মাথা নাড়ে, ‘হ্যাঁ, ওরা খুব মজা করে এই সময়টাতে।’

মেহুলি দুষ্টুমির গলায় বলে, ‘আমরাও মজা করব।’

ফয়সালের আজ খুব ভালো লাগছিল। অনেকদিন পর শান্তির সুবাতাস পাচ্ছে। বুক ভরে নিশ্বাস নিতে কোনো অসুবিধা হচ্ছে না।

ফয়সাল একটু দ্বিধান্বিত গলায় বলে, ‘আপনার হাতে সময় আছে?’

মেহুলি মুখ তুলে বলে, ‘হ্যাঁ, দুপুর পর্যন্ত ছুটি নিয়ে এসেছি। কেন বলুন তো?’

ফয়সাল একটু দোনোমোনো করে বলে, ‘নৌকায় চড়বেন?’

মেহুলি উৎসাহের গলায় বলে, ‘হ্যাঁ, চড়ব তো। সময়টা কাজে লাগুক।’

ফয়সাল একটা নৌকা ভাড়া করে। সাঙ্গুর তীরেই পর্যটকবাহী কিছু নৌকা আছে। এগুলোর সঙ্গে ওর রিসোর্টের আলাদা করে জানাশোনা থাকে। অনেকে এখান থেকে নৌপথে থানচি যায়। তেমনই একটা নৌকায় ওরা দুজন উঠে পড়ে। শান্ত নদীতে নৌকাটা ধীরে ধীরে চলতে শুরু করে। যতই সামনে এগোতে থাকে প্রকৃতি যেন উজাড় হাতে সৌন্দর্য মেলে ধরে৷ একপাশে খাড়া সব পাহাড় আর তার গায়ে সবুজ গাছপালা। উপরের দিকে টুকরো টুকরো মেঘ।

মেহুলি নিচু হয়ে একটা হাত পানিতে ডুবিয়ে রেখেছে। আর ফয়সাল মুগ্ধ চোখে মেহুলিকে দেখছে। এই পথ চলা যদি শেষ না হতো!

৩.
বান্দরবান সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয় সংলগ্ন রাজার মাঠে আজ লোকে লোকারণ্য। সবাই রঙিন পোশাকে সজ্জিত। পাহাড়ি আদিবাসীরা আনন্দে মেতে উঠেছে। একপাশে প্যান্ডেল করে পাহাড়ি গান, নাচ হচ্ছে। আর মাঠের মাঝখানে জল-কেলির আয়োজন করা হয়েছে। দুপাশে দুটো দল পানি নিয়ে প্রস্তুত। একপাশে মেয়েরা আরেকপাশে ছেলেরা। এখানকার মাননীয় সংসদ সদস্য একটু আগেই উদবোধন করলেন। টিভি ক্যামেরা লাইভ দেখাবে এই অনুষ্ঠান।

বাঁশিতে ফু পড়তেই শুরু হয় পানি ছিটানো। মেয়েরা যত জোরে সামনের ছেলেদের গায়ে পানি ছুড়ে মারে ছেলেরা তার চেয়ে বেশি জোরে পানি ছিটিয়ে দিচ্ছে।

মেহুলি আজ দেরি করেনি। বিকেল হতেই চলে এসেছে। আজকে সে সবুজ পাড় দেওয়া লাল জামদানী পরেছে। ফয়সাল ধবধবে সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি। আজ ওকে একদম দেবতাদের মতো লাগছে।

মেহুলি দুষ্টুমি করে বলে, ‘আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে বিয়ে করতে এসেছেন।’

ফয়সাল হা হা করে হাসে, ‘আর আপনাকেও কিন্তু মনে হচ্ছে বিয়ের কনে। খুব সুন্দর লাগছে আপনাকে।’

মেহুলি লজ্জা পায়। একটু সামলে নিয়ে বলে, ‘আচ্ছা, ওরা কী সুন্দর পানি ছিটাচ্ছে। আমরা ছিটাব না?’

ফয়সাল অবাক গলায় বলে, ‘আপনি সত্যিই পানি ছিটাবেন?’

মেহুলি হি হি করে হাসে, ‘ওদের মতো পারব না। আমার কাছে এই পানির বোতলটা অন্তত খালি করি।’

কথা শেষ করে মেহুলি হাতে ধরে রাখা পানির বোতলটা খুলে। তারপর সেখান থেকে এক আঁজলা পানি নিয়ে ফয়সালের দিকে ছুড়ে মারে। ঘটনার আকস্মিকতায় ফয়সাল চমকে ওঠে। মেহুলি ততক্ষণে হাসছে।

ফয়সালের পাঞ্জাবিটা বুকের কাছে ভিজে গেছে। হাত দিয়ে মুছতে মুছতে বলে, ‘আপনি কিন্তু ভীষণ একটা কাজ করে ফেললেন।’

মেহুলি দুষ্টুমির গলায় বলে, ‘কী ভীষণ কাজ করে ফেললাম?’

ফয়সাল এবার রহস্যের গলায় বলে, ‘সাধাণত এই জল উৎসবে পানি ছিটিয়ে পুরনো বছরের পাপ, গ্লানি দূর করা হয়। এছাড়া আরেকটা কারণেও পানি ছিটানো হয়।’

মেহুলি ভ্রু কুঁচকে বলে, ‘আরেকটা কারণ? কী সেটা?’

ফয়সাল কৌতুকের গলায় বলে, ‘মারমা ছেলে মেয়েরা তাদের পছন্দের মানুষের গায়ে পানি ছিটিয়ে তার ভালোবাসা প্রকাশ করে।’

হঠাৎ করেই যেন মেহুলির গালে সূর্যাস্ত হয়। আর তার লাল লালিমা সারা মুখে ছড়িয়ে পড়ে। মুখটা নিচু হয়ে যায়।

ফয়সাল এবার ওর হাত থেকে পানির বোতল নিয়ে সেখান থেকে এক আঁজলা পানি নিয়ে মেহুলির গায়ে ছিটিয়ে দিতেই মেহুলি কেঁপে ওঠে।

ফয়সাল গভীর গলায় বলে, ‘আমিও আমার অনুভূতি প্রকাশ করলাম। অবশ্য আপনি না জেনে কাজটা করেছেন। আর আমি জেনেই করলাম।’

মেহুলির কেন যেন ভীষণ লজ্জা লাগছে। চোখ তুলে তাকাতে পর্যন্ত পারছে না। এমন করে ধরা পড়ে যাবে আজ ভাবেনি ও। সত্যিই কি ফয়সালকে ও মনের ভেতর জায়গা দিতে শুরু করেছে?

সেদিন পুরোটা সময় ওরা দুজন দুজনকে ঘিরে রাখে। বৈসাবি উৎসবের প্রকৃতির পবিত্র ছোঁয়ায় পুরনো বছরের সব দুঃখ, কষ্ট ধুয়ে মুছে নতুন একটা জীবন শুরু হবার ইঙ্গিত দিয়ে যায়।

(চলবে)

মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান সুবাস
শিমুলতলী, গাজীপুর
২৩/০১/২০২৫