যদি নির্বাসন দাও পর্ব-০৮

0
353

#যদি_নির্বাসন_দাও (পর্ব ৮)

১.
ঢাকা শহরের অভিজাত এলাকার একটা বাসার সামনে আজ বিকেলবেলা সবুজ রঙের একটা সিএনজি এসে থামে। সেখান থেকে যে দুজন এসে নামে তার একজন মেহুলির মা জাহানারা আরেকজন মেহুলির ছোট বোন তুলি।

বাসাটা দশ কাঠা জায়গার ওপর। তিনতলা একটা আধুনিক বাসা, সামনে ছোট একটা সবুজ লন। দু’পাশে পাম গাছের সারি। যেমনটা সিনেমায় দেখা যায় তেমন। ভেতরে ঢুকে তুলি অবাক গলায় বলে, ‘ইফতেখার আংকেল এত বড়োলোক মা? তোমার ভুল হচ্ছে না তো?’

জাহানারা মাথা নাড়ে, ‘ভুল হলে আমাদের ঢুকতে দিত? মানুষটা এত বড়োলোক কিন্তু কখনোই তোর বাবাকে ভুলে যায়নি। বন্ধুত্বের মর্যাদা সে সবসময় দিয়েছে।’

ইফতেখার আংকেলের এই গল্প অনেকবার করে শোনা। বাবা এক্সিডেন্টে করার পর থেকে উনি প্রায়ই টাকা দিয়ে সাহায্য করতেন। ওদের পুরো পরিবারে তাই ওনার প্রভাবটা অনেক বেশি। সেজন্যই আজ ওনাকে তুলির বিয়ের দাওয়াত দিতে আসা। এবার মেহুলির ওখান থেকে ঘুরে আসার পর এটা বুঝেছেন ওর জন্য তুলির জীবন নষ্ট করে লাভ নেই। তাই আর দেরি না করে বিয়ের তারিখ ফাইনাল করে ফেলেছেন।

একজন গৃহপরিচারিকা ওদের দোতলায় নিয়ে বসায়। সোফাগুলো এত সুন্দর যে তুলির সংকোচ হয় তাতে বসতে। দেয়াল জুড়ে সুন্দর সব পেইন্টিং। মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে।

পায়ের শব্দে ওরা মুখ তুলে তাকায়। জাহানারা উঠে দাঁড়িয়ে সালাম দেয়, ‘আসসালামু আলাইকুম ভাইজান।’

তুলি মায়ের সাথে সাথে উঠে দাঁড়ায়। এই লোকটাকে এক দুবার দেখেছে। মাথায় কাঁচাপাকা চুল ছোট করে ছাঁটা। ধারালো চোখমুখ, মাঝারি উচ্চতা, গায়ের রঙ উজ্জ্বল শ্যামলা। একবার তুলির দিকে তাকান, তারপর বলেন, ‘বাহ, তুলি এত বড়ো হয়ে গেছে! বসুন ভাবি।’

জাহানারা বসতে বসতে বলেন, ‘হ্যাঁ ভাই, বড়ো হয়ে গেল ওরা। তুলির বিয়ের দাওয়াত দিতেই এলাম।’

ইফতেখার স্মিত হাসেন, ‘বাহ, খুব ভালো তো। তা বিয়ে কবে?’

এবার জাহানারা ব্যাগ থেকে সুন্দর একটা বিয়ের কার্ড বের করে। বাড়িয়ে দিতেই ইফতেখার আগ্রহ নিয়ে দেখেন। তারপর বলেন, ‘আচ্ছা আমি আসব। আমার ছেলেমেয়ে সব আমেরিকা থাকে। ওদের মা বছরে ছয় মাস ওদের সঙ্গেই থাকে।’

জাহানারা কথার পিঠে বলেন, ‘তাহলে তো আপনাকে একা একা থাকতে হয়।’

ইফতেখার ছোট্ট একটা নিশ্বাস ফেলে বলেন, ‘ওই আর কী। আচ্ছা, মেহুলি এখন কোথায়? অনেক দিন ওর খোঁজ নেই। আর বিয়েই করল না?’

জাহানারা মন খারাপ গলায় বলে, ‘আমরা সবাই ওর কাছে দোষী। একটা সময় সংসারের সব দায়িত্ব তার ঘাড়ে পড়েছিল। সেসব সামলাতে অনেকটা সময় চলে যায়। এখন বিয়েই করতে চাচ্ছে না। সবার কাছ থেকে দূরে থাকার জন্য বান্দরবান চলে গেছে। ওখানকার একটা কার্ডিয়াক সেন্টার চালায়। আপনিই বলুন, ওর মতো এত ভালো একটা ডাক্তার ঢাকা ছেড়ে সেই পাহাড়ে গিয়ে পড়ে আছে। ভাই, আপনার কথা ও খুব মানে। আপনি একবার ওকে বোঝাবেন?’

ইফতেখার কপাল কুঁচকে তাকান। তারপর গম্ভীরমুখে বলেন, ‘এটা তো ঠিক না। একটা সময় জীবন কঠিন গেছে। তাই বলে যখন সুসময় এসেছে তার স্বাদটা কেন নেবে না? আপনি বলে ভালো করেছেন। আমার ব্যাবসার কাজে বান্দরবান যাবার কথা আছে। ওর ফোন নম্বর আর ঠিকানাটা দিয়ে রেখেন।’

সেদিন রাতে বাসায় ফিরেই জাহানারা মেহুলিকে ফোন দেন।

মেহুলি সবে রোগী দেখে শেষ করেছে। ঘড়িতে রাত আটটা বাজে প্রায়। এমন সময় মায়ের ফোন আসে। ফোন ধরতেই ওপাশ থেকে জাহানারা অনুযোগের গলায় বলে, ‘তুই তো ফোন করিসও না আবার আমরা করলে ফোন ধরিস না।’

কথাটা সত্য। মেহুলি ইচ্ছে করেই ফোন ধরে না। ফোন ধরলেই সেই একই কথা – কেন বিয়ে করছে না। যেন বিয়ে করলেই ওরা সব বেঁচে যায়। আচ্ছা, ওরা কি অপরাধবোধে ভোগে?

মেহুলি তাড়াহুড়ো করে বলে, ‘মা, আমি খুব ক্লান্ত। কেন ফোন দিয়েছ, তাই বলো।’

জাহানারা এবার গলাখাঁকারি দিয়ে বলে, ‘তুলির বিয়ের তারিখ তো ঠিক করেছি জানিস। সবাইকে দাওয়াত দিচ্ছিলাম। আজ তোর বাবার বন্ধু ইফতেখার ভাইয়ের বাসায় গিয়েছিলাম। ওনাকে দাওয়াত দিয়ে এলাম।’

মেহুলি খোঁচা দেবার গলায় বলে, ‘কেন? ওনাকে কেন? নাকি সবাইকে দেখাতে চাও তোমার ধনী আত্মীয়স্বজন আছে?’

জাহানারা বিরক্ত গলায় বলে, ‘সেটা হবে কেন? ওনার কথা তো আমরা ভুলে যেতে পারি না। উনি যেমন করে আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছেন সেটা অস্বীকার করা যায় না।’

মেহুলি রাগী গলায় বলে, ‘হ্যাঁ, তোমাদের কাছে উনিই তো সব। আমি কিছুই না।’

জাহানারার মেজাজ চড়ে যায়, কঠিন গলায় বলেন, ‘তোকে একটা কথা বলি। তোর মধ্যে নিজেকে মহান ভাবার একটা অসুখ হয়েছে৷ তুই সারাক্ষণ ভাবিস আমাদের জন্য তুই সারাজীবন কষ্ট করেছিস। আমাদের জন্য তোর জীবনের সুন্দর সময়গুলো তুই উপভোগ করতে পারিসনি। আমরা কি কম কষ্ট করেছি? তোর জায়গায় যদি আমার ছেলে থাকত তাকেও এই কষ্ট করতে হতো। তুই এমন ভাব দেখাস যেন আমাদের দয়া করেছিস। ছেলেমেয়েরা বাবা-মাকে দেখবে এটাই তো স্বাভাবিক। কিন্তু তুই সেটাকে এমন করে রেখেছিস যে আমাদের সবসময় একটা অপরাধবোধে ভুগতে হয়।’

মেহুলি টের পায় ওর বুকের ভেতরটা খালি হয়ে যাচ্ছে। ভাটার টানে যেমন সমুদ্রের পানি হুশ করে দূরে সরে যায় তেমনি একটা কিছু। এতদিনকার মায়া, ভালোবাসার জোয়ার এক মুহূর্তে উধাও। চোখ দুটো জ্বালা করে উঠে, হাত পা কেমন অবশ হয়ে আসছে৷

কোনোমতে বলে, ‘মা, আমি ভীষণ ক্লান্ত। পরে তোমার সঙ্গে কথা বলব।’

ফোনটা কেটে সাবার আগে সুইচড অফ করে। তারপর শূন্য চোখে সামনের দেয়ালের দিকে তাকিয়ে থাকে। আচ্ছা, ও কার জন্য বেঁচে থাকবে?

ঠিক এমন সময় কেউ একজন চেম্বারের দরজায় টোকা দেয়। মেহুলি দ্রুত চোখ মুছে তাকাতেই দেখে ফয়সাল।

‘আপনার ফোন বন্ধ কেন? ক’বার ফোন দিলাম দেখি বন্ধ বলছে। শহরের দিকে যাচ্ছিলাম, ভাবলাম আপনার কিছু লাগবে কিনা জিজ্ঞেস করে যাই।’

কথাগুলো বলতে বলতে ফয়সাল হঠাৎ থমকে তাকায়। মেহুলির মুখে আষাঢ়ের মেঘ। চোখ ভেজা।

উদবিগ্ন গলায় বলে, ‘আপনি ঠিক আছেন তো? বাসার সবাই ভালো আছে?’

মেহুলি নাক টেনে বলে, ‘হ্যাঁ, সবাই ভালো আছে৷’

ফয়সাল জিজ্ঞাসু গলায় বলে, ‘তাহলে আপনি এমন মন খারাপ করে বসে আছেন কেন?’

মেহুলির খুব বলতে ইচ্ছে করে, আপনি আমাকে নিয়ে কোথাও চলে যেতে পারবেন যেখানে কেউ আমাকে খুঁজে পাবে না? কিন্তু সেটা বলা হয় না৷ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, ‘মন খারাপ না, ক্লান্ত লাগছে খুব। আপনি যান, আমার আপাতত কিছু লাগবে না।’

ফয়সাল হাসে, ‘আমারও শহরে তেমন কোনো কাজ নেই। একটা ছুতো করে আপনার সঙ্গে দেখা করতে এলাম।’

মেহুলি ওর দিকে তাকায়। ফয়সালের চোখেমুখে একটা অদ্ভুত সারল্য খেলা করছে। মন ভালো হয়ে যায় মেহুলির।

একটু হেসে বলে, ‘খুব ভালো করেছেন। আপনি আমাকে একটু দূরে কোথাও ঘুরিয়ে আনতে পারবেন?’

ফয়সালের হঠাৎ করেই মনে হয় মেহুলির মন আজ সত্যিই ভালো নেই। নরম গলায় বলে, ‘আচ্ছা, চলুন। আমি গাড়ি নিয়ে এসেছি।’

মেহুলি ওর পাশে বসতেই ফয়সাল গাড়ি ছেড়ে দেয়। শহর পেরিয়ে নীলগিরি যাবার রাস্তা ধরে৷ চারপাশ সুনসান অন্ধকার। মাঝে মাঝে এক দুটো চাঁদের গাড়ির হেডলাইটের আলো আলোকিত করে দিয়েই আবার আঁধারে ডুবে যাচ্ছে। মেহুলি গাড়ির গ্লাসে মাথা ঠেকিয়ে সামনে তাকিয়ে আছে। ফয়সাল নীরবে গাড়ি চালাচ্ছে৷ বাড়তি কোনো প্রশ্ন করেনি।

মেহুলি মাথা তুলে ফয়সালের দিকে ফিরে বলে, ‘আচ্ছা, পৃথিবীর সব সম্পর্কই বুঝি লেনদেন দিয়ে নিয়ন্ত্রিত হয়? এমন কী আমাদের কাছের মানুষের বাবা, মা, ভাইবোনদের বেলাতেও এই নিয়ম খাটে, তাই না?’

ফয়সাল সাবধানে একটা বাঁক ঘোরে। এখানে রাস্তায় একটু পরপরই বাঁক। যদিও এই রাস্তা ওর মুখস্ত, তবুও রাতের বেলা বলেই আরও সাবধান হয়।

মেহুলির প্রশ্নটা বিষাদময়। হয়তো পরিবারের মানুষজন কোনো কারণে কষ্ট দিয়েছে।

ফয়সাল গলাখাঁকারি দিয়ে বলে, ‘নিঃশর্ত সম্পর্ক বলে আসলেই কিছু নেই। বিধাতা, যার কোনো কিছুর অভাব নেই, তিনিও নিয়ম করে তার সৃষ্টির আনুগত্য আশা করেন। মানুষ বিধাতাকে খুশি করতে নিয়ম করে প্রার্থনা করে৷ তাতে উনি খুশি হয়ে পরকালে ভালো কিছুর আশ্বাস দিয়েছেন। ঠিক একইভাবে মা, বাবার সঙ্গেও সন্তানদের একটা লেনদেনের সম্পর্ক আছে। এই যে মা না খেয়ে থাকেন, ছেলের জন্য কষ্ট করেন সেখানে মাতৃত্বের একটা অপার সাধ উনি পান। উনি যদি সন্তানের জন্য অমন ত্যাগ না করতেন তাহলে কিন্তু মাতৃত্বের সুখটা পরিপূর্ণ হতো না। আবার সন্তান যখন মা বাবার জন্য কিছু করে তখন সেও একটা আত্মতৃপ্তি পায়। সে যদি মা বাবার জন্য কিছু না করতে পারে তাহলে নিজের কাছেই ছোট হয়ে থাকে। তাই সম্পর্কে লেনদেনটা খুবই স্বাভাবিক।’

মেহুলি মনোযোগ দিয়ে ফয়সালের কথা শুনছিল। মৃদু হেসে বলে, ‘আপনি তো দেখি পেশাদার মনোবিজ্ঞানীদের মতো কথা বললেন। আপনার কথাগুলো কেন যেন ঠিক বলেই মনে হচ্ছে।’

ফয়সাল দুষ্টুমির গলায় বলে, ‘সেক্ষেত্রে আমার ফিস প্রাপ্য।’

মেহুলি জিজ্ঞাসু গলায় বলে, ‘কী চান বলুন?’

ফয়সালের বলতে ইচ্ছে করে, আপনি কি আমার হাতটা একটু ধরবেন? কিন্তু বলা হয় না।

ফয়সাল কৃত্রিম চিন্তিত হবার ভঙ্গিতে বলে, ‘আপাতত এক কাপ চা। সামনেই সেনাবাহিনীর একটা রেস্টুরেন্ট আছে। ওদের চা-টা খুব ভালো।’

মেহুলি হাসে। একটু পর একটা রেস্টুরেন্টের সামনে গাড়ি থামতেই ওরা নেমে পড়ে। ফয়সাল চা আনতে যেতেই পেছন থেকে মেহুলি ডেকে বলে, ‘টাকা কিন্তু আমি দিব।’

ফয়সাল হেসে মাথা নাড়ে।

চায়ে চুমুক দিতেই মন ভালো হয়ে যায়। এদের চা সত্যিই খুব ভালো।

মেহুলি হঠাৎ করে বলে, ‘আচ্ছা, আপনি যে বললেন সম্পর্কে একটা লেনদেন থাকে, তা আমার সঙ্গে আপনার কী ধরনের লেনদেন, শুনি?’

ফয়সাল থমকায়। তারপর একটু ভেবে বলে, ‘আমার নির্বাসিত মন আশ্রয় পায় আপনার কাছে। ভেবেছিলাম দূরে এসে পালিয়ে থাকব। কিন্তু পালিয়ে থাকা হয় না। কাজের ফাঁকে অতীততের প্রেতাত্মা ঠিক তাড়া করে ফেরে। আপনিও আমার মতোই নিজেকে নির্বাসন দিয়েছেন। আপনিও হয়তো আমার কাছে সেই আশ্রয় খোঁজেন।’

মেহুলি অপলক চেয়ে থাকে। হ্যাঁ, ওর এই পুড়ে যাওয়া মনের আজ কোথাও আশ্রয় নেই। ফয়সালের কাছে কেমন করে যেন ওর মন ছোট্ট পাখির বাসার মতো আশ্রয় খুঁজে পেয়েছে। ভয় হয়, আবার না অজানা কোনো এক ঝড়ে এই আশ্রয়ের বাসাটুকুও ভেঙে যায়।

২.
জুন মাসের ত্রিশ তারিখ তুলির বিয়ে। মা মেহুলিকে এক সপ্তাহের ছুটি নিতে বলেছে। ও হ্যাঁ-না কিছুই বলেনি। মনে মনে ঠিক করে রেখেছে তিনদিন ছুটি নেবে। বিয়ের দাওয়াতে মেহুলির কেউ যাবে কি-না মা জানতে চেয়েছিল। একবার ভেবেছিল ফয়সালের কথা বলে। কিন্তু বলা হয়নি। শুধু শুধু ঝামেলা বাড়িয়ে লাভ নেই। ফয়সালকে ও আরও অনেকখানি বুঝতে চায়। মানুষকে হুট করে বিশ্বাস করতে ভয় হয়৷

ভাবনার এই পর্যায়ে দারোয়ান এসে খবর দেয় একজন বয়স্ক লোক ওর সঙ্গে দেখা করতে এসেছে। নাম জিজ্ঞেস করতেই বলে, ‘ইফতেখারুল আলম। খুব দামী একটা গাড়ি নিয়ে এসেছেন।’

মেহুলির ভ্রু কুঁচকে উঠে। ইফতেখার আংকেল এখানে? এই সন্ধ্যেবেলা?

দ্রুত হাতে নিজেকে একটু গুছিয়ে নিয়ে তাকে ভেতরে নিয়ে আসতে বলে। একটা অজানা আশঙ্কায় মেহুলির বুক কাঁপছে।

ইফতেখার ভেতরে ঢুকেই উচ্ছ্বসিত গলায় বলে, ‘মেহুলি, কতদিন পর তোমার সঙ্গে দেখা হলো। সেদিন তোমার মা তুলিকে নিয়ে বিয়ের দাওয়াত দিতে এসেছিলেন। আমি তো ভাবলাম তোমার বিয়ের দাওয়াত বুঝি।’

মেহুলি চেয়ে দেখে। অনেক দিন পর এই মানুষটাকে দেখল। বয়স বেড়েছে কিন্তু আগেরমতোই পরিপাটি। দাঁড়ানোর ভঙ্গিতে আভিজাত্যের ছাপ স্পষ্ট।

মেহুলি সালাম দেয়, তারপর বলে, ‘বসুন। হঠাৎ এদিকে, কোনো কাজ ছিল?’

ইফতেখার বসতে বসতে বলে, ‘কেন, কাজ ছাড়া বুঝি আসতে নেই?’

মেহুলি সামনের সোফায় বসে। তারপর বলে, ‘কাজ ছাড়া তো আপনি নড়ার মানুষ না। আচ্ছা, কী খাবেন বলুন?’

ইফতেখার মাথা নাড়ে, ‘এক কাপ চা খাব। রাতে আমার একটা ডিনার পার্টি আছে এখানে৷’

মেহুলি উঠে গিয়ে চা বসায়। এই লোক এখানে কেন? মা কি পাঠাল? ওর বিয়ের ব্যাপারে কথা বলতে? চা বানাতে গিয়ে টের পায় ওর হাত কাঁপছে।

কী ভেবে মেহুলি ফয়সালকে মেসেজ দেয়, ‘আপনি কাছাকাছি থাকলে আমার বাসায় একটু আসতে পারবেন?’

চা এনে সামনে বাড়িয়ে দিতেই ইফতেখার চটুল গলায় বলেন, ‘তুমি তো দেখি আগের চেয়েও সুন্দর হয়েছে। তা বিয়ে করছ না কেন?’

মেহুলির মুখ কঠিন হয়ে যায়। গম্ভীরমুখে বলে, ‘আপনি কি আমার বিয়ের ব্যাপারে কথা বলতে এসেছেন? যদি তাই হয় সেক্ষেত্রে আপনি চা খেয়ে বিদায় হবেন।’

ইফতেখার আহত গলায় তাকান। তারপর চায়ে চুমুক দিতে দিতে বলেন, ‘দেখো, মেয়েদের একা থাকা ঠিক না। আর তোমার মা কষ্ট পাচ্ছেন। সবাইকে কষ্ট দিয়ে লাভ কী তোমার?’

মেহুলি কোনো উত্তর দেয় না। পাথুরে মুখে বসে থাকে।

ইফতেখার চা শেষ করে বলে, ‘নাকি অন্য কাউকে পছন্দ আছে?’

মেহুলির মুখে ফয়সালের নাম প্রায় এসে গিয়েছিল। নিজেকে সামলায়। তারপর বলে, ‘আপনার কি মনে হয় না আমি যথেষ্ট বড়ো হয়েছি? নিজেকে দেখেশুনে রাখার সামর্থ্য আর বুদ্ধি বিবেচনা সবই আছে।’

ইফতেখার একটা সিগারেট ধরায়, ‘হ্যাঁ, তুমি তো সেই মেডিকেলে পড়া ভীতু মেয়েটার মতো না। এখন অনেক বড়ো ডাক্তার। কিন্তু আমার কাছে তুমি সেই আগেরমতোই আছ।’

মেহুলি তীক্ষ্ণ গলায় বলে, ‘আপনি ভুল ভাবনার মধ্যে আছেন।’

ইফতেখার সামনে ঝুঁকে বলে, ‘তাই?’

ঠিক এমন সময় দরজায় বেল বাজে। ফয়সাল বুঝি এল। মেহুলি হাঁপ ছেড়ে বাঁচে। দ্রুত উঠে গিয়ে দরজা খুলতেই ফয়সাল কিছু বলতে গেলেই মেহুলি চোখের ইশারায় থামায়। তারপর অবাক গলায় বলে, ‘আরে ফয়সাল সাহেব আপনি? যাক এসে ভালো হয়েছে। সন্ধ্যায় এক কাপ চা বেশি বানিয়েছিলাম। ভেতরে এসে বসুন, খাবেন।’

ফয়সাল একটা ধন্দে পড়ে যায়। মেহুলি আজ এমন বেখাপ্পা আচরণ করছে কেন? হঠাৎই ওকে মেসেজ দিয়ে ডেকে আনল কেন?

ভেতরে ঢুকতেই থমকে তাকায়। একজন বয়স্ক মানুষ বসে আছেন। মেহুলি পরিচয় করিয়ে দেয়, ‘উনি আমার বাবার বন্ধু। ব্যাবসার কাজে এখানে এসেছিলেন, তাই দেখা করতে এসেছেন। আর আংকেল, উনি ফয়সাল। এখানকার একটা রিসোর্টের ম্যানেজার।’

ইফতেখার ভালো করে ফয়সালকে দেখে। তারপর উঠে হাত মেলায়, উচ্ছ্বসিত গলায় বলে, ‘বাহ, আপনার সঙ্গে পরিচয় হয়ে খুব ভালো হলো। আমি মূলত এখানে একটা নতুন রিসোর্ট বানানোর পরিকল্পনা নিয়ে এসেছিলাম। যাক, আপনার কাছে সাজেশন পাওয়া যাবে।’

ফয়সাল মাথা নাড়ে, ‘হ্যাঁ অবশ্যই। বলুন আপনি কী কী জানতে চান।’

ইতোমধ্যে মেহুলি চা নিয়ে আসে। ফয়সাল হাত বাড়িয়ে চা নেয়।

ইফতেখার মিটিমিটি হেসে বলে, ‘এখানে বসে বিজনেস নিয়ে কথা বলতে ভালো লাগবে না। আপনার রিসোর্ট এর ঠিকানাটা আমাকে দিন। আমি কাল সকালে আপনার সঙ্গে দেখা করব।’

ফয়সাল পকেট থেকে ভিজিটিং কার্ড বের করে দিয়ে বলে, ‘আসুন, আমি অপেক্ষা করব।’

ভিজিটিং কার্ডে একবার চোখ বোলান। তারপর হুট করে উঠে দাঁড়ান, বিদায় নেবার গলায় বলেন, ‘মেহুলি আসি। কাল বিকেলে ফ্রি থাকলে তোমার এখানে আসব। একটু দরকার আছে।’

মেহুলি ভ্রু কোঁচকায়, তারপর বলে, ‘আচ্ছা।’

ইফতেখার বেরিয়ে যেতেই ফয়সাল জিজ্ঞাসু গলায় বলে, ‘কী ব্যাপার, বলুন তো? মনে হলো আপনি ভয় পেয়েছেন।’

মেহুলি মাথা নাড়ে, ‘উহু। মা পাঠিয়েছেন আমার বিয়ে নিয়ে কথা বলতে৷ তাই ভাবলাম আপনাকে একটু ডেকে আনি। তাহলে আমাকে আর বিয়ে নিয়ে জ্বালাবে না।’

ফয়সাল হাসে৷ তারপর বলে, ‘আমি তাহলে সারাজীবন আপনার বিয়ে ভাঙার জন্য এমন একা থেকে যাব।’

মেহুলি হাসে। কিছু একটা বলতে চায়। আর ফয়সাল তাকিয়ে থাকে, কিছু একটা শোনার প্রতীক্ষায়।

(চলবে)

মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান সুবাস
শিমুলতলী, গাজীপুর
২৪/০১/২০২৫