যদি নির্বাসন দাও পর্ব-০৯

0
524

#যদি_নির্বাসন_দাও (পর্ব ৯)

১.
আজ ভীষণই গরম পড়েছে। এই সকাল দশটাতেই সূর্য যেন তেতে উঠেছে। পলিন কাকু একটা হাত পাখা নিয়ে বাতাস করছে। যদিও মাথার ওপর ফ্যান ঘুরছে তবুও এটা অভ্যাস। হাতপাখার বাতাস নাকি বেশি ঠান্ডা।

এই সময় একটা কালো জিপ গাড়ি এসে থামে। পলিন কাকু দ্রুত হাতপাখা রেখে জামা ঠিক করে নেয়। একজন ভদ্রলোক গাড়ি থেকে নামতেই পলিন এগিয়ে যায়। দেখেই বোঝা যাচ্ছে ইনি উঁচুতলার মানুষ। এই চাকরিতে এতদিনে অন্তত এটা বোঝার ক্ষমতা হয়েছে। উঁচুতলার মানুষদের চলনে-বলনে একটা আত্মবিশ্বাস টের পাওয়া যায়।

ভদ্রলোক কাছে আসতেই পলিন জিজ্ঞাসু গলায় বলে, ‘স্যার, বুকিং ছিল?’

ভদ্রলোক স্মিত হেসে বলেন, ‘না। আমি আপনাদের ম্যানেজার সাহেব, ফয়সালের সঙ্গে দেখা করতে এসেছি। উনি আছেন তো?’

পলিন মাথা নাড়ে। তারপর বলে, ‘আপনি এখানটায় বসুন। ডেকে দিচ্ছি।’

একটু পর পলিন কাকুর সঙ্গে ফয়সাল আসে। সহাস্যে বলে, ‘ইফতেখার সাহেব, আপনি এসেছেন? আসুন প্লিজ। পলিন কাকু, আমাদের ঠান্ডা স্মুথি দিন।’

ইফতেখার হাত নেড়ে না করে, ‘না, কিছু খাব না। আপনার সঙ্গে জরুরি কিছু কথা ছিল। চলুন একটু ওদিকটায় গিয়ে বসি।’

রিসোর্টের মাঠের এককোণে একটা কাঠবাদাম গাছ। তার সুশীতল ছায়ার নিচে দুটো চেয়ার পাতা৷ ওরা দুজন সেদিকে এগিয়ে যায়।

পলিন ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থাকে। কে এই লোক? এর ব্যাপারে আগে তো কিছু বলেনি ফয়সাল।

পলিন আবার নিজের চেয়ারে বসে হাতপাখাটা হাতে নেয়। তারপর চোখ বন্ধ করে ধীর লয়ে হাতপাখা নাড়তে থাকে। কেমন একটু ঝিমুনি আসে।

হঠাৎ তীক্ষ্ণ একটা আর্ত চিৎকারে পলিন ছিটকে ওঠে। শব্দের উৎস লক্ষ করে অবাক চোখে দেখে ফয়সাল সেই ভদ্রলোকটাকে এলোপাতাড়ি চড়, থাপ্পড় মারছে। কী হচ্ছে এটা!

পলিন লাফ দিয়ে উঠে ছুটে যায়। ইতোমধ্যে রিসোর্টের অন্যান্য স্টাফও ছুটে এসেছে। সবাই এসে জোর করে ফয়সালকে সাপটে ধরে। তাও কী ধরে রাখা যায়! আজ যেন ওর শরীরে অসুর ভর করেছে। এমন শান্ত, চুপচাপ একটা ছেলের এমন বিধ্বংসী চেহারা কোনোদিন ওরা দেখেনি। ফয়সাল হাত, পা ছুড়ে চিৎকার করছে, ‘বাস্টার্ড। ভদ্রলোকের মুখোশ টেনে ছিড়ে ফেলব।’

পলিন লোকটাকে টেনে সরিয়ে নেয়। লোকটার ঠোঁট কেটে রক্ত বেরোচ্ছে। একটা চোখ ফুলে গেছে। চশমার একটা ডান্ডি ভেঙেও গেছে। লোকটা তীব্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে, ‘আপনি আমার গায়ে হাত তুলে ভীষণ ভুল করলেন। আপনাকে আমি জেলের ভাত খাইয়ে ছাড়ব।’

ততক্ষণে জিপের ড্রাইভার নেমে এসেছে। অবাক চোখে দেখে ওর স্যারের অবস্থা সংগিন। কী হলো হঠাৎ করে? গাড়ির ভেতর থেকে এতক্ষণ কিছুই শুনতে পায়নি সে।

কথাগুলো বলে ইফতেখার দুদ্দাড় করে জিপে উঠে পড়ে৷ ড্রাইভারকে কড়া গলায় বলে, ‘এখনই থানায় চল।’

গাড়িটা একগাদা কালো ধোঁয়া ছেড়ে চলে যায়। আর ফয়সালকে কেমন বিধ্বস্ত লাগছে। চোখে পাগলাটে দৃষ্টি। পলিন কাকু সবাইকে ধমকে যার যার কাজে পাঠায়। তারপর ফয়সালকে টেনে রিসেপশনের দিকটায় নিয়ে আসে।

হাঁপ ধরে গেছে। দম নিয়ে বলে, ‘তুমি আর এখানে থেকো না। আপাতত ক’টা দিন গা ঢাকা দাও। এই লোক পুলিশের হুমকি দিয়ে গেল।’

ফয়সাল কঠিন গলায় বলে, ‘আসুক পুলিশ। আমি জেলে যেতে হলে যাব। কিন্তু ওই বুড়ো বদমাশটাকে শিক্ষা দিয়ে ছাড়ব।’

পলিন ভ্রু কুঁচকে বলে, ‘এই লোকটা কে ছিল? আর কেনই বা তুমি অমন রেগে গেলে?’

ফয়সাল চুপ করে থাকে৷ অর্থাৎ এই কথার কোনো উত্তর সে দেবে না। পলিন আরেকবার বলে, ‘ফয়সাল, আমি তোমাকে আজ পর্যন্ত এমন রাগতে দেখিনি। বুঝলাম লোকটার দোষ আছে৷ কিন্তু তুমি যেহেতু গায়ে হাত তুলেছ, পুলিশ তোমাকে ছাড়বে না।’

ফয়সাল গোঁয়ারের মতো বসেই থাকে। পলিন কাকু হতাশ চোখে তাকিয়ে থাকেন।

দুপুর নাগাদ পুলিশ আসে৷ ফয়সাল প্রস্তত ছিল। পলিন কাকুকে ডেকে মোবাইলটা দিয়ে বলে, ‘মেহুলির ফোন এলে বলবেন আমি রিসোর্টের কাজে বাইরে গেছি। আর একজন ভালো উকিল ঠিক করুন।’

এস আই রফিক ভ্রু কুঁচকে বলে, ‘ফয়সাল ভাই, আপনার সম্পর্কে এমন অভিযোগ আসবে ভাবিইনি। লোকটার হাত অনেক লম্বা। এসপি স্যারকে দিয়ে ফোন দিয়েছে। তাই আসতেই হলো।’

রফিক ছেলেটা ভালো। একবার একটা ঘটনায় পরিচয় হয়েছিল। তারপর থেকে সময় পেলে মাঝে মাঝেই আসত।

ফয়সাল মাথা নেড়ে বলে, ‘সমস্যা নেই। তোমার কাজ তুমি করেছ। চলো, তোমাদের থানাটা ঘুরে আসি।’

রিসোর্টের সবাই অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে। ফয়সাল স্যারকে এমন করে ধরে নিয়ে যাচ্ছে, অবিশ্বাস্য লাগে।

পলিনের কেমন দিশেহারা লাগছে। ছেলেটার তিন কূলে কেউ নাই এক বোন ছাড়া। তাকে জানাবে? নাহ থাক। ভালো উকিল ধরলে ঠিক ছাড়িয়ে আনা যাবে।

ঠিক এমন সময় ফয়সালের রেখে যাওয়া মোবাইল বাজে। পলিন ভ্রু কুঁচকে নাম দেখে, ডা: মেহুলি। ফোনটা ধরতেই ওপাশ থেকে মেহুলির গলা পাওয়া যায়, ‘ফয়সাল সাহেব, ইফতেখার আংকেল আপনার ওখানে গিয়েছিল?’

পলিন নিজের পরিচয় দিয়ে বলে, ‘ম্যাডাম, আমি পলিন বিশ্বাস। ফয়সাল তো নেই। মোবাইল আমার কাছে রেখে গেছে।’

মেহুলি অবাক গলায় বলে, ‘নেই মানে?’

ফয়সাল যেটা বলতে বলেছিল সেটা বলতে গিয়েও থেমে যায়। কেন যেন মনে হচ্ছে সত্যটা বলা উচিত।

পলিন গলাখাঁকারি দিয়ে বলে, ‘ম্যাডাম, আপনি যে ভদ্রলোকের কথা বললেন তিনি এসেছিলেন কিনা জানিনা। তবে একজন অপরিচিত ভদ্রলোক কালো রঙের একটা জীপ নিয়ে এসেছিলেন। তার সঙ্গে ফয়সালের হঠাৎ করে মারামারি বেঁধে যায়। একটু আগে পুলিশ এসেছিল, ধরে নিয়ে গেল ফয়সালকে।’

ওপাশ থেকে আর্তনাদ করে উঠে মেহুলি, ‘কী বলছেন এসব! আচ্ছা, আপনি এখনই থানায় আসুন। আমি যাচ্ছি।’

পলিনের জানে যেন পানি আসে। কেন যেন মনে হচ্ছে এই ডাক্তার আপা ফয়সালকে মায়া করে। এখন একটু জোর পাচ্ছে বুকে।

পলিন আর দেরি করে না। দ্রুত থানার পথ ধরে।

২.
বান্দরবান থানার ওসি লিয়াকত মেহুলিকে দেখেই উঠে দাঁড়ায়, ‘ম্যাডাম, আপনি এখানে? প্লিজ বসুন না।’

লিয়াকত ওর নিয়মিত রোগীদের মধ্যে একজন। ভদ্রলোক অনিয়ন্ত্রিত রক্তচাপের রোগী।

মেহুলি চেয়ারে বসতে বসতে বলে, ‘এলাম আপনাদের থানা দেখতে। এসেন্স রিসোর্টের ম্যানেজার ফয়সাল সাহেব কোথায়?’

লিয়াকত একটু অবাক হয়। তারপর বলে, ‘উনি বুঝি আপনার পরিচিত, ম্যাডাম? আসলে যিনি কমপ্লেইন করেছেন তিনি একদম উঁচুতলার মানুষ। আর ফয়সাল সাহেবও দোষ স্বীকার করেছেন। সেজন্য ওনাকে ধরে আনতে হয়েছে। আজকেই কেস হয়ে যাবে।’

মেহুলি আসতে আসতে পলিন কাকুর কাছে পুরো ঘটনাটা সবিস্তারে শুনেছে। আসার সময়ই ইফতেখার আংকেলের সঙ্গে ফোনে মিনিট দশকের মত কথা হয়েছে।

মেহুলি হেসে বলে, ‘আর বাদী যদি এখনই তার অভিযোগ তুলে নেয়?’

লিয়াকত হেসে বলে, ‘তাহলে কেস হবে না। কিন্তু উনি এত সহজে অভিযোগ তুলে নিবে?’

লিয়াকতের কথা শেষ হতে না হতেই ফোন আসে। ফোনটা ধরে কিছুক্ষণ কথা বলেন। ফোন রেখে মেহুলির দিকে তাকিয়ে বলে, ‘আপনার কথাই দেখি সত্যি হলো ম্যাডাম। যাক, আমিও ঝুটঝামেলা থেকে বাঁচলাম। ম্যাডাম একটু নাস্তা পানি আনায়? আধা ঘন্টা সময় লাগবে কাগজপত্রের ঝামেলার সারতে।’

মেহুলি মাথা নাড়ে, ‘অসুবিধে নেই। আমি অপেক্ষা করছি। না নাস্তা খাব না, একটু চা দিতে পারেন।’

আধা ঘণ্টা পর ফয়সাল যখন বেরিয়ে আসে মেহুলিকে দেখে অবাক হয়, ‘আপনি এখানে!’

মেহুলি হেসে বলে, ‘আমাকে যে আসতেই হতো। চলুন, আমার ওখানে যাবেন আগে৷ আমি পুরো ঘটনাটা শুনতে চাই।’

পলিন কাকুর মুখে হাসি ফোটে। যাক, এতদিনে এই নিঃসঙ্গ মানুষটাকে নিয়ে ভাবার একজন লোক হলো।

পুরো পথে কোনো কথা হয় না।

গাড়ি থামতেই মেহুলি ওকে নিয়ে বাসায় ঢোকে। বসবার ঘরের ফ্যান ছেড়ে দেয়। তারপর বলে, ‘একটু নুডুলস করি?’

ফয়সাল মাথা নাড়ে, ‘না৷ কিছু খাব না এখন। এক গ্লাস পানি হলেই চলবে।’

মেহুলি ছোট্ট একটা নিশ্বাস ফেলে পানি আনতে যায়। একটা ছোট পিরিচে কয়েকটা কাজু বাদাম আর গ্লাসে পানি দেয়। ফয়সাল ঢকঢক করে পানি খায়।

মেহুলি ওর দিকে ঝুঁকে এসে বলে, ‘এবার বলুন, আপনি হঠাৎ করে ইফতেখার আংকেলের ওপর অমন ঝাঁপিয়ে পড়লেন কেন?’

ফয়সাল চুপ করে থাকে। মুখ গম্ভীর।

মেহুলি আবার তাড়া দেয়, ‘কই বললেন না?’

ফয়সাল এবার নিচু গলায় বলে, ‘উনি আপনার সম্পর্কে বাজে কথা বলছিল।’

মেহুলি ভ্রু কুঁচকে বলে, ‘কী বাজে কথা?’

ফয়সাল মাথা নাড়ে। চোখমুখ শক্ত করে বলে, ‘আমি বলতে পারব না?’

মেহুলি একটু ভাবে, তারপর বলে, ‘উনি কি এমনটা বলেছে যে তার সঙ্গে আমার একটা সময় ফিজিক্যাল রিলেশন ছিল?’

ফয়সাল কেঁপে উঠে। দাঁতে দাঁত চেপে বলে, ‘হ্যাঁ, হারামজাদাটা এ কথাই বলছিল।’

মেহুলি গভীর চোখে তাকিয়ে বলে, ‘আমাকে কেউ বাজে কথা বললে আপনার কী?’

ফয়সাল মুখ তোলে, তারপর বলে, ‘জানি না। কিন্তু আপনাকে নিয়ে কেউ বিন্দুমাত্র মিথ্যে বাজে কথা বললে আমার মাথা খারাপ হয়ে যায়। ওই বুড়ো বদমাশ যে কি-না আপনার বাবার বন্ধু সে এমন মিথ্যা, জঘন্য একটা কথা বলতে পারল?’

মেহুলি লম্বা একটা নিশ্বাস নেয়। তারপর কেটে কেটে বলে, ‘আর এই জঘন্য কথাটা যদি সত্যি হয়?’

ফয়সাল চমকায়। কপাল কুঁচকে বলে, ‘আপনি কী বলছেন এইসব! আমি বিশ্বাস করি না।’

মেহুলির শরীর কাঁপছে। কেন যেন ভীষণ কান্না পাচ্ছে। নিচের ঠোঁট কামড়ে কান্না সামলায়। তারপর দৃঢ় গলায় বলে, ‘উনি আমার সম্পর্কে যা বলেছে তার পুরোটাই সত্য। বাবার এক্সিডেন্টের পর উনি একদিন আমাদের নরসিংদীর বাড়িতে আসেন। আমি তখন ঢাকা মেডিকেলে চান্স পেয়েছি। উনি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন। সেসময় আমার ওপর দায়িত্ব পড়ে ওনার অফিস গিয়ে টাকা নিয়ে আসার। মাঝে মাঝেই টাকার দরকার হতো। আমি ওনার অফিস যেতাম। উনি আমাকে ভালো ভালো খেতে দিতেন। মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেন। আমি ভাবতাম বাবার মতো একজন। এরপর আমি টিউশনি শুরু করলাম। কিন্তু তাতে অত টাকা আসত না। দুটো ভাইবোনের পড়াশোনা, পঙ্গু বাবা, সব মিলিয়ে এত বড় দায়িত্ব সামলাতে প্রায়ই ওনার কাছে হাত পাততে হতো। একটা সময় ইফতেখার সাহেব নিজে থেকেই বললেন কষ্ট করে টিউশনি করবার দরকার নেই। আমাদের সংসার চালাতে মাসে যা লাগে পুরোটা উনি দেবেন। আমি যেন মন দিয়ে ডাক্তারি পড়ি। তখন সত্যিই পড়াশোনার ভীষণ চাপ ছিল। আমি টিউশনি ছেড়ে দেই। মাঝে মাঝে গাড়ি নিয়ে আসতেন। আমাকে নিয়ে লংড্রাইভে যেতেন, ভালো ভালো রেস্টুরেন্টে খাওয়াতেন। খুব দামি দামি জামা কাপড় কিনে দিতেন। ধীরে ধীরে এইসব টাকা দিয়ে কেনা সুখগুলো পাবার জন্য আমি উন্মুখ হয়ে থাকতাম। আর এই সুযোগে উনি যেদিন আমার শরীরের দখল নিতে চাইলেন আমি বাধা দিয়েছিলাম। একদিন ওনার অফিসে আমাকে আচমকা জড়িয়ে ধরতে নিলে ধাক্কা মেরে চলে এসেছিলাম। কিন্তু কিছুদিন পর বাড়ি থেকে মায়ের ফোন আসলো। টাকা দরকার। আমি ততদিনে আবার নতুন করে টিউশনি শুরু করেছি। কিন্তু তাই দিয়ে কিছুতেই সংসারের খরচ সামলাতে পারছিলাম না। তবুও হার মানিনি। হার মানলাম যখন কয়েক মাস পর হঠাৎ করে মায়ের জরায়ুতে টিউমার ধরা পড়ল। জরুরি অপারেশন লাগবে। দিশেহারা হয়ে আমি ইফতেখার সাহেবের কাছে গেলাম। উনি সাথে সাথে টাকাটা দিয়ে দিলেন। কোনো প্রশ্নই করলেন না। কিন্তু এরপর যেদিন উনি শরীরের দখল নিতে চাইলেন আমি আর না করতে পারিনি। সেদিনের পর থেকে ব্যাপারটা নিয়মিত হয়ে গেল। আপনি সেদিন একটা অদ্ভুত সত্য কথা বলেছিলেন, পৃথিবীর সব সম্পর্কে একটা লেনদেন থাকে। ইফতেখার আঙ্কেলের সঙ্গে আমারও তেমন একটা লেনদেন ছিল। এরপর যখন নিজের পায়ে দাঁড়াতে শিখলাম তখন আমি মাথা উঁচু করে বাঁচার চেষ্টা করলাম। কিন্তু কিছুতেই আর একটা মানুষকে বিয়ে করতে পারিনি। মনের ভেতর ভীষণ অপরাধবোধ হতো। আমার এই অতীত ইতিহাস জানলে কেউ আমাকে বিয়ে করবে না। আর আমিও কাউকে ঠকাতে চাইনি। এ কারণে আমি কোনদিন বিয়ে করব না। এ সত্যিটা শুধু আপনাকে আজ বললাম। মা হয়তো কিছুটা আঁচ করতে পারেন, কিন্তু পুরোটা না। সেজন্য মা বিয়ের জন্য অমন পাগলের মতো করেন। হয়তো একটা আত্মগ্লানি মাকেও কুড়ে কুড়ে খায়। গতকাল সন্ধ্যায় ভয় পেয়েই আমি আপনাকে ডেকে পাঠিয়েছিলাম। এই নির্জনে আমাকে একা পেয়ে ওনার মাঝে পুরনো সেই শয়তানটা মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছিল। আপনি আসাতে পারেনি। আপনাকে দেখে সে হয়তো ঈর্ষান্বিত হয়ে আমার পচা গলা অতীতটা বলে গেল। যাতে আমি কারও হতে না পারি। কেউ যেন আমাকে একটু মায়া করতে না পারে।’

ফয়সাল স্তম্ভিত হয়ে তাকিয়ে থাকে। সামনে বসে থাকা মানুষটা কী নিদারুণ যন্ত্রণা বুকে নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে এই এতটা বছর! বুকটা দুমড়ে মুচড়ে উঠে।

ফয়সাল উঠে দাঁড়ায়, তারপর কাছে এসে হাঁটু গেড়ে বসে মেহুলির হাত ধরে। মেহুলি মাথা নিচু করে কাঁদছিল। ওর স্পর্শে চমকে তাকায়।

ফয়সাল গাঢ় গলায় বলে, ‘মেহুলি, আমি আপনার কষ্টটুকু নিয়ে নিতে চাই। আমার কাছে আপনার এই দুর্মর কষ্টটুকু জমা রাখবেন?’

মেহুলির বুকের ভেতরটা কাঁপছে। চোখের জল আজ বাধা মানছে না। ইচ্ছে করছে হাউমাউ করে কাঁদে।

নিজেকে শক্ত করে সামলায়। নাক টেনে বলে, ‘ফয়সাল, আপনি একজন ভীষণই ভালো মানুষ। আপনার কাছে সারা জীবনের জন্য সব কষ্টগুলো জমা দিয়ে রাখতে পারলে খুব ভালো হতো। কিন্তু আপনার মত একটা ভালো মানুষকে ঠকাই কি করে বলুন তো? আপনি চাইলেও যে আমি পারি না। মনের ভেতর আমার এই পুরনো অতীত বার বার কুড়ে কুড়ে খায়। আপনি যতবার এক সমুদ্র মায়া নিয়ে আমার সামনে এসে দাঁড়াবেন, ততবার আমি নিজের কাছে সংকুচিত হয়ে যাব। মনে হবে আপনি করুণা করছেন। আপনি আমার বন্ধুই থাকেন। ভালোবাসতে যাবেন না।’

ফয়সাল সজোরে মাথা নাড়ে, ‘না, আমি আপনাকে আর একটা দিন একা থাকতে দিতে পারি না। তুলির বিয়ের আগেই আমরা বিয়ে করব। আপনার মাকে বলুন প্লিজ।’

মেহুলি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, ‘আপনি রিসোর্টে ফিরে যান। ওখানে সবাই আপনার অপেক্ষায় আছে।’

ফয়সাল গোঁয়ারের মতো বলে, ‘না, আমি যাব না। আপনি আন্টিকে ফোন করুন।’

মেহুলির মায়া হয়। ফয়সালের হাত ধরে বলে, ‘আপনি বরং কয়েকটা দিন সময় নিন। খুব করে ভাবুন। যদি সত্যিই মনে হয় আমি আপনার কাছে কষ্ট জমা রাখতে পারি তাহলে অবশ্যই মাকে ফোন দেব। সে অবধি আমিও একটু ভাবি। আবেগের বশে কোন সিদ্ধান্ত আমি নিতে চাই না।’

ফয়সাল উঠে দাঁড়ায়। মাথা নেড়ে বলে, ‘আমার ভাবনার দরকার নেই। আমি আজ যা বলে গেলাম কয়েকদিন পরে ভেবে আসলেও সেই একই কথা বলব। মেহুলি, আমি আপনাকে ভালোবাসি।’

কী সুন্দর একটা কথা! মানুষ সারা জীবন তার প্রিয় মানুষের কাছ থেকে এই কথাটা শুনতে চেয়েছে। ফয়সাল নিঃসন্দেহে ওর একজন প্রিয় মানুষ। আর ওর মুখ থেকে সেই সুন্দর কথাটা শোনার পরেও কেন যেন ও খুশিতে ঝলমল করে উঠতে পারছে না। উল্টো বিষের নীল দংশনে দংশিত হয়ে যাচ্ছে। জীবন এমন কঠিন একটা বাঁকে এসে দাঁড় করাবে, ভাবেনি।

(চলবে)

মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান সুবাস
শিমুলতলী, গাজীপুর
২৪/০১/২০২৫