সুগন্ধি ফুল পর্ব-১৪

0
1359

#সুগন্ধি_ফুল
#পর্ব_১৪
#জান্নাত_সুলতানা

আবরাজ ঘুমচ্ছে। কলিং বেল এর শব্দে ফিজার ঘুম ছুটছে। পাশের দেয়ালে টানানো সোনালী রঙের ঘড়ি টা দেখে। সকাল আটটা বেজে সাত মিনিট। ফিজা বিছানা ছাড়লো। গায়ের পোশাক কোনো রকম ঠিকঠাক করে জুতো জোড়া পড়ে দরজার দিকে এগিয়ে এলো। দরজা খুললো খুব সাবধানের সহিত। আবরাজ এর যেন ঘুম না ভাঙে সে দিকে সম্পূর্ণ সচেতন রইলো মেয়ে টা। আলগোছে বাইরে থেকে দরজা টা চাপিয়ে লিভিং রুমে উপস্থিত হলো।
একজন ওয়েস্টার্ন পরিহিত রমণী সার্ভেন্ট এর সাথে কিছু নিয়ে তর্কাতর্কি করছে। বারবার ওদের মাস্টার বেডরুমে এর এদিকে আসার চেষ্টা করছে। তবে মহিলা দু’জন সামনে দাঁড়িয়ে আছে বিধায় সেটা পারছে না। ফিজা পেছন থেকে গম্ভীর স্বরে জিজ্ঞেস করলো,

-“কে?”

ফিজার প্রশ্নে দু’জন মহিলা সরে গেলো সামনে থেকে। বাংলা বুঝতে পারেন তারা। ফিজা সামনের দাঁড়ানো রমণী তৃণা কে দেখে ভ্রু জোড়া কুঁচকে নিলো। বিরক্তিকর স্বরে বলে উঠলো,

-“এতো সকালে কারোর বাসায় এসে এভাবে চিৎকার করছেন! মিনিমাম কমনসেন্স টুকু নেই না-কি?”

তৃণা যতোটা না অবাক হয়েছে ফিজার কথা শুনে তার থেকে বেশি মেয়ে টার রাগ হচ্ছে। চোখ দু’টো রাগে লাল হয়ে আছে। ফিজার ড্রেসআপ দেখে তৃণা হিতাহিত জ্ঞান হারালো যেন। তর্জনী আঙুল উঁচিয়ে শাসানোর ভঙ্গিতে বললো,

-“এই মেয়ে মাইন্ড ইউর ল্যাঙ্গুয়েজ। তুমি আমাকে কমনসেন্স শিখাতে এসো না। কমছে কম তোমার থেকে ভালো সেন্স রয়েছে আমার।”

ফিজা নিজের শরীর এর দিকে তাকিয়ে থমথম খেলো। গায়ের পোশাক এর অবস্থা নাজেহাল। কিন্তু বিষয় টা পাত্তা দিলো না। ভাব এমন করলো বিবাহিত একজ নারীর এতো সকালে এমন পোশাকআশাকে থাকা টা খুব সাধারণ। আসলেই তো তাই। সে নিজের বাসায় কিভাবে থাকবে এটা সম্পূর্ণ তার ব্যাক্তিগত ব্যাপার। সেখানে যদি কেউ এতো সকালে হস্তক্ষেপ করতে আসে তাহলে সেটা তার ভুল। এরজন্য তার কি করনীয়! ফিজা কিছু বলার জন্য মুখ খুলবে তার আগেই পেছন থেকে গম্ভীর রাশভারী কণ্ঠে স্বর ভেসে এলো,

-“তুমি এখানে! আমি তোমায় এদিকে খুঁজে পাচ্ছি না। কাম সুগন্ধি ফুল আমি আরো ঘুমব।”

আবরাজ চোখ ডলতে ডলতে এসে ফিজা কে কোলে তুলে। ফিজা চমকালো তবে গলা জড়িয়ে ধরলো আবরাজ এর। অন্য দিনের তুলনায় আজ গভীর করে গলা জড়িয়ে ধরে। আবরাজ বিষয় টা বুঝতে পারে। বউ তাকে নিয়ে জেলাস। আর তৃণা কে জেলাস করাতে এভাবে ধরেছে। ইশ এটা যদি প্রতিহিংসা থেকে নয় হয়ে ভালোবাসা থেকে হতো এই গভীরতা টুকু। আবরাজ বুঝি বউ কে ভালোবাসায় মুড়িয়ে রাখতো। আবরাজ এরমধ্যে একবার ও তৃণার দিকে তাকায় নি। রুমের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিয়ে আবার দাঁড়িয়ে গম্ভীর স্বরে তৃণা কে উদ্দেশ্য করে বলে,

-“বাই দ্য ওয়ে, সকাল সকাল একটা কাপল এর বাসায় এসে এভাবে ডিসটার্ব করা টা কোনো সভ্যতার কাতারে পড়ে না। পরে দেখা হচ্ছে।”

ফিজা মাথা টা একটু উঁচু করে পেছনে তৃণার দিকে তাকিয়ে বাঁকা হাসলো।
তৃণার চোখ টলমল করে। রাগ না-কি কষ্ট পেয়েছে ফিজা বুঝতে পারে না। বোঝার চেষ্টা ও করে না। শুধু জানে এই মেয়ে টা এবং মেয়ে টার বাবা এরা বাপবেটি দুইটাই নাটক বাজ।

——-

তৃণা কিছু সময় আগে বাড়ি থেকে চলে গিয়েছে। ফিজা ফ্রেশ হয়ে এসে আর দেখে নি তৃণা কে। এনিয়ে অবশ্য তার মাথাব্যথা নেই। সে গুনগুন করতে করতে কিচেনে গেলো। বেশ ফুরফুরে মুডে আছে মনে হচ্ছে। আবরাজ এর ভ্রু কুঁচকে আসে। লিভিং রুমে আর কিচেনের দরজায় দাঁড়ানো দু’জন মহিলা রয়েছে। তারা নিজেদের মতো কাজ করছে। আবরাজ সে-সব তোয়াক্কা করে না। নিজেও নাইটশার্ট এর হাতার ভাঁজ করা খুলতে খুলতে কিচেনে গেলো।

-“দূরে থাইক্কাই ও তুমি এমন মায়ায় জড়াইছো পুরুষ। তোমার সত্যি জাইনাও এখন ছাইড়া যাইবার পাড়ি না।”

ফিজা খুন্তি দিয়ে একটা পাত্রে কিছু নাড়তে নাড়তে গুনগুন করে। পেছনে যে আবরাজ দাঁড়িয়ে সেদিকে মেয়ে টার খেয়াল আছে না নেই বোঝা মুশকিল। গেঞ্জির ফাঁক দিয়ে নিজের মসৃণ পেটে কোমল স্পর্শে সাথে সাথে ঘাড়েও থুঁতনি ঠেকিয়েছে আবরাজ অনুভব করে ফিজা। বলে,

-“কোনো দিন ছেড়ে যেতে দেবোও না। আমার মৃত্যুই তোমার মুক্তি পাওয়ার এক মাত্র রাস্তা সুন্দরী রমণী।”

ফিজা মুচকি হাসলো। সেকেন্ড সময় পরপরই আবরাজ কিছু টা ছিটকে দূরে সরে এলো। ডান হাতে বা হাত টা চেপে ধরে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে বউয়ের দিকে। ফিজা খুন্তি টা উলটে পালটে দেখতে দেখতে তাচ্ছিল্য স্বরে বলে উঠলো,

-“একদম ভুল সেটা। প্রমাণ নিশ্চয়ই হাতেনাতে পেয়েছেন। আপনি কেনো আমি না চাইলে আমাকে আপনি আঁটকাতে কখনো পারবেন না।”

আবরাজ হাত টা লাল হয়েছে। সুন্দর চামড়ায় চোখে লাগছে খুব। ফিজার মন টা আচমকাই খারাপ হয়। বারবার সে মানুষ টাকে ক্ষতবিক্ষত করছে। অথচ আবরাজ খান তাকে এখনো একবার ছুঁয়ে অব্ধি দেখে নি। আঘাত তো দূর। তার তো এমন উদ্দেশ্য ছিলো না। তার উদ্দেশ্য তো ছিলো মানুষ টা তাকে যেমন মানসিক অশান্তি দিয়েছে তাকেও সেই অশান্তির সাথে পরিচয় করানো। ফিজা খুন্তি রেখে রান্না ঘরে রাখা ফাস্টএইড বক্স খুঁজে বের করে। আবরাজ তখন ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে। ফিজা আবরাজ এর হাত টেনে ধরে সেখানে ঔষধ লাগালো। আবরাজ ফিজার দিকে বিনাবাক্য তাকিয়ে ছিলো এতো সময়। ফিজার কাজ শেষ হতে আবরাজ বলে উঠলো,

-“সময় হউক। এমন কাঁদান কাঁদাবো। সবকিছুর উশুল তখন একটু পরপর করে নেব সুগন্ধি ফুল।”

চোখ গুলো ছোট ছোট আবরাজ এর। ফিজা ভ্রু জোড়া আড়াআড়ি ভাবে রাখলো। জিজ্ঞেস করলো,

-“রুমে যান। খাবার নিয়ে আসছি।”

আবরাজ ঘাড় নেড়ে কিচেন ছেড়ে বেরিয়ে এলো। দু’জন মহিলা বেশ অবাক হয়েছে। মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছে। যে আবরাজ খান এর সামনে দাঁড়িয়ে কেউ কথা বলার সাহস করে না। একটু এদিক-ওদিক হলে তুলকালাম কান্ড ঘটিয়ে ফেলে সেই আবরাজ খান একজন মেয়ে কে কত টা প্রায়োরিটি দিচ্ছে। আবরাজ কে দেখে যে যার কাজে লেগে পড়লো। আবরাজ লিভিং রুমের ঠিক মাঝে দাঁড়িয়ে মহিলা গুলো কে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো,

-“এটাই লাস্ট এন্ড ফার্স্ট। নেক্সট টাইম যদি আমার সুগন্ধি ফুল রান্না ঘরে গিয়েছে খুব খারাপ হবে। ইট’স মাই প্রমিস।”

ফিজা শুনলো রান্না ঘর থেকে। বিরক্তিতে চোখ মুখ বিকৃতি করে ফোঁস করে বলে উঠলো,

-“আজব পুরুষ।”

সাব্বির সবেমাত্র নিজের কক্ষ থেকে বেরিয়েছিল। বেচারার সবেমাত্র ঘুম ভেঙেছে বোধহয়। চোখ ডলছে তখনও। তারপর লিভিং রুমে এসে আবরাজ এর রাগী কণ্ঠস্বর। কেনো রেগে আছে কি কারণ, কিছু বুঝে উঠার আগেই আবরাজ তাকেও উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো,

-“আজ সারাদিন তোমার ফোন পানিতে ভিজিয়ে রাখবে। আর তুমি শাওয়ার দিবে না। এগুলো কিসের শান্তি যদি জিজ্ঞেস করো তাহলে আজ থেকে আগামী সাত দিন বউয়ের সাথে ও কথা বলতে পারবে না।”

সাব্বির ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। ঘুমের রেশ এখনোও কাটে নি। সকাল সকাল স্যার তাকে কিসের শাস্তি দিচ্ছে জিজ্ঞেস করবে মনস্থির করেও লাস্ট এর কথায় সেটাও গিলে নিলো। আবরাজ এরমধ্যে নিজের রুমে চলে গিয়েছে। ফিজা এলো তখন। সাব্বির ফিজা কে দেখে জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভেজাল। এরপর আমতা আমতা করে প্রশ্ন করলো,

-“ম্যাম স্যার রেগে আছেন কেনো?”

-“রেগে নয়। খুশি আছে। গার্লফ্রেন্ড এসছিলো তাই।”

ফিজা মেকি হেঁসে বলে। সাব্বির থতমত খেলো। গতকাল এর কথা স্মরণ হতে বুঝতে পারে তৃণা এসছিলো। এইজন্যই স্যার রেগে আছেন। সাব্বির দাঁত দ্বারা জিহ্বা কাটে। মাথায় হাত দিয়ে আফসোস করে বলে,

-“ওহ্ শিট।”

এরপর দ্রুত নিজের রুমের দিকে চলে গেলো। ফিজা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখে সাব্বির এর হন্তদন্ত হয়ে ছুটে যাওয়া। এরপর নিজেও রুমে এলো।
আবরাজ তখন ওয়াশ রুমে হয়তো। ফিজা হাতের ট্রে টা একটা টেবিলের উপর রাখে। এরপর ফোন হাতে নিয়ে থাই ঠেলে ব্যালকনিতে এলো। বাড়িতে কল করে মায়ের সাথে বোনের সাথে কথা বলে। যদিও সেখান তখন সন্ধ্যায়। এরপর কল কাটতে আবরাজ এর কণ্ঠস্বর ভেসে এলো।

-“সুগন্ধি ফুল এদিকে এসো।”

ফিজা রুমে এসে দেখলো আবরাজ শুধু একটা টাওয়াল পড়ে দাঁড়িয়ে আছে। ফরসা শরীরে অল্পস্বল্প পানির বিন্দু চিকচিক করে। চওড়া বুক খানায় একটা পশমের চিহ্ন নেই। হাতের পেশিগুলো ফুলেফেঁপে রয়েছে। ফিজার হাত থেকে আবরাজ ফোন টা বিছানায় ছুঁড়ে ফেলতে ফিজা ধ্যান ভাঙে। আবরাজ ফিজার ডান হাত টেনে ওয়াশ রুমের দিকে হাঁটা ধরে বলে উঠলো,

-“চুল শ্যাম্পু করতে হবে সুগন্ধি ফুল।”

আবরাজ বাথটবে বসে। ফিজা কোনো কথা না বলে শ্যাম্পু নিয়ে আবরাজ এর চুলে লাগিয়ে দেয়। একটু একটু অনুশোচনা ও হয় নিজের কাজের জন্য। ভাবে এমন টা আর কখনো করবে না। কথা দিয়ে আঘাত করবে যতোদিন না বিয়ের দিন রাতে কেনো তাকে ফেলে চলে এসেছিলো এটা সম্পূর্ণ ক্লিয়ার করছে।

নিজের গায়ে ঠান্ডা পানির ঝাপটা পেতে ফিজা চমকে আবরাজ এর চুল খামচে ধরলো। দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠলো,

-“একদম অসভ্যতামি করবেন না আবরাজ।”

-“করবো।”

-“আমি শাওয়ার নিয়েছি একবার।”

ফিজা কণ্ঠ খাদে এনে বললো। আবরাজ সাথে সাথে আবদার করে,

-“আবার নাও আমার সাথে।”

-“গতকাল করেছি।”

-“সেটা ইচ্ছে করে নয়।”

-“আপনি জোর করেন কেনো? আমি আমার প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেলে আপনার জোর করতে হবে না। উত্তর টা খারাপ ভালো যা-ই হউক।”

আবরাজ শুনে। কিছু না বলে ফিজা কে নিজের কোলের উপর বসিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। গভীর করে বাঁধন। ফিজা জোর করে না। সেভাবে পড়ে থাকে।

-“ভালোবাসি কি-না জানা নেই। বাট তোমার জন্য যা ফিল করি আমি তা আগে কখনো কোনো মেয়ের জন্য করি নি। এটা নিয়ে আমি নিজের সাথে ফাইট করছি। আই ওয়ান্ট ইউ। এন্ড আই নিড ইউ, এট এনি কস্ট।”

#চলবে…..

[ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।]

#জান্নাত_সুলতানা