অমানিশার মধ্যরাত পর্ব-০৩

0
4603

#অমানিশার_মধ্যরাত
লেখিকা: আতিয়া আদিবা
#পর্ব_৩ (১৮+)

প্রেগনেন্সি কীট হাতে নিয়ে ধপাস করে বাথরুমের ফ্লোরে বসে পড়ল অমানিশা। তার শরীর থরথর করে কাঁপছে। চারিদিকে যেন অমাবস্যার আঁধার ঘনিয়ে আসছে। স্টিকে লাল টকটকে দুটো দাগ স্পষ্ট। অমানিশার পেটে একটি নতুন জীবনের সম্ভাবনার জানান দিচ্ছে এই দাগ দুটো।

অমানিশার বিস্ময় সীমা অতিক্রম করেছে। অথচ তার বিস্মিত হবার কথা নয়। এরকম কিছু হতে পারে তা সে পূর্বেই আঁচ করেছিলো। তাও মনের কোথাও হয়তো টিমটিমিয়ে আশার লণ্ঠন জ্বলছিল! অনেক মেয়েরই পিরিয়ড যথাযথ সময়ে হয় না। মাঝেমধ্যে দশ পনেরো দিন লেট হয়। তারও হয়েছে দু এক বার!

বাথরুমের এক কোণায় জড়োসড়ো হয়ে ক্ষণিককাল বসে রইল অমানিশা। আতঙ্কে মুখখানি ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। সমাজের আগেও মা-বাবাকে নিয়ে তার চিন্তা। কিভাবে তাদের সামনে নিজের এই নিষিদ্ধ সত্য তুলে ধরবে সে?
তবে এভাবে বসে থাকাও তো সমাধান নয়! আহনাফ তাকে বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। সে নিশ্চয়ই তার প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করবে না।

অমানিশা নিজের ঘরে গেলো। দরজা ভালো করে লক করে, স্কুলব্যাগে লুকিয়ে রাখা নিজের ফোনটি বের করল। ডায়াল করল আহনাফের নাম্বার। স্বভাবমত সে ফোন ধরল না।
অমানিশা পুনরায় তাকে কল করল। রিং হচ্ছে। কিন্তু আহনাফ ফোন ধরছে না।

অমানিশা ক্ষান্ত হল না। বিরতিহীন আহনাফের সাথে যোগাযোগ স্থাপনের চেষ্টা চালিয়ে গেলো। এক পর্যায়ে একটি সুমধুর নারী কণ্ঠ শোনা গেল_
‘আপনার ডায়ালকৃত নাম্বারটিতে সংযোগ প্রদাণ করা সম্ভব হচ্ছে। অনুগ্রহ করে একটু পরে আবার চেষ্টা করুন ধন্যবাদ’।

অমানিশার চোখদুটো রক্তজবার মত লালবর্ণ ধারণ করল।

এমন সময় ঘরের দরজায় টোকা পড়ল। রাহেলার কণ্ঠস্বর শুনতে পাওয়া গেল।
‘এই অমানিশা, দরজা খোল! তোকে না কতবার বারণ করেছি দরজা লক করবি না? তোর বাবাকে বলে দরজার লক আমি ভেঙ্গে দিব এবার।’

অমানিশা দ্রুত নিজের স্কুলব্যাগে মোবাইল এবং প্রেগনেন্সি কীট লুকিয়ে ফেলল। চোখেমুখে কৃত্রিম স্বাভাবিকতার ছাপ এনে দরজা খুলল।

রাহেলা বিরক্ত হয়ে বললেন,
কেন নিজেকে এভাবে ঘরবন্দী করে রাখিস? শরীরটাও তো ভালো না। মাঝরাতে একবার এসে দেখে গেছি। জ্বর ছিল না। এখন কি অবস্থা দেখি? থার্মোমিটার টা কই যে রাখলাম!
রাহেলা ব্যস্ত হয়ে থার্মোমিটার খুঁজতে খুঁজতে অন্য ঘরে চলে গেলেন।

অমানিশা বিছানায় গা এলিয়ে দিল। তার ঠোঁটদুটো অল্প অল্প কাঁপছে। দুশ্চিন্তায় গলা শুকিয়ে আসছে বারবার।

‘চোখের সামনে জিনিস থাকে খুঁজে পাইনা। কি রোগ যে ধরল আমাকে!’ – হাতে থার্মোমিটার নিয়ে হন্তদন্ত হয়ে পুনরায় ঘরে ঢুকল রাহেলা। মেয়ের বগলের নিচে যত্ন সহকারে থার্মোমিটার রাখল। মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। বলল,
তোর শরীর তো এখনো অনেক গরম। আজ আর স্কুলে যাওয়ার দরকার নেই।

অমানিশা তার টেবিলের নষ্ট ঘড়িটার দিকে তাকাল। গত তিনদিন ধরে সাতটা পঁচিশ বেজে আছে।
কয়টা বাজে মা?

নয়টা। একটা দুর্ঘটনা ঘটেছে।

কি দুর্ঘটনা?

পাশের বাসার রোদেলা কোন এক হিন্দু ছেলের সাথে যেন পালিয়ে গেছে! আহারে! মেয়েটার জীবন এখনো শুরুই হল না কত বড় ভুল পথে পা বাড়ালো চিন্তা কর?

অমানিশা কোনো উত্তর দিল না। আলগোছে ঢোক গিলল।

আমি তোর সাথে ছোটবেলার থেকেই বন্ধুসুলভ আচরণ করেছি। যাতে তুই কখনো ভুল পথে পা না বাড়াস। আমি সবাইকে গর্ব করে বলি, আমার মেয়ের বেস্ট ফ্রেন্ড আমি!

মায়ের কথা শুনে অমানিশার ভেতরটা দুমড়েমুচড়ে গেল। মনে মনে চিৎকার করে বলতে লাগল, এ আমি কি করে ফেললাম, মা! তোমার বিশ্বাস আমি খণ্ডবিখণ্ড করে ফেললাম। আমি নিজেকে কোনোদিনও ক্ষমা করতে পারব না। কোনোও দিনও না!

মেয়ের বগলের নিচ থেকে থার্মোমিটার বের করল রাহেলা। জ্বর ১০১। সে ব্যস্ত ভঙ্গিতে বলল,

আমি তোর জন্য স্যুপ বানিয়ে আনছি।

অমানিশা নিচু স্বরে বলল,
আমি স্যুপ খাব না। আমার কিছু খেতে ইচ্ছা করছে না।

লিকুইড কিছু তো খেতে হবেই। জ্বর হলে যত লিকুইড খাবার খাবি তত দ্রুত সুস্থ হবি। স্যুপ ওষুধ ভেবে খেয়ে ফেলবি। এখনকার জ্বর ভালো না। শরীর একদম দুর্বল করে ফেলে। তুই চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাক।

রাহেলা চলে যেতেই অমানিশা পুনরায় দরজা লাগিয়ে দিল। যেভাবেই হোক আহনাফকে প্রেগনেন্সির বিষয়টা জানাতে হবে।

***

এলুমিনিয়াম ফয়েলের ওপর ই*য়া*বা ট্যাবলেট রাখল আহনাফ। দিশা ফয়েলের ওপর প্রান্তে লাইটার ধরল। গোলাপি ট্যাবলেটটি গলে যাচ্ছে। সেই বাষ্প বুকভরে নাক দিয়ে গ্রহণ করছে আহনাফ। প্রতি টানে একবার করে অস্ফুট স্বরে বেরিয়ে আসছে ‘আহ!’।

এক ফাঁকে সে দিশাকে জিজ্ঞেস করল,
তুমি নিবে না?
না। আমার আজকের কোটা পূরণ হয়ে গেছে।
আহনাফ হেসে পুনরায় নেশায় ব্যস্ত হয়ে গেল।

দিশা আহনাফের বন্ধ ফোনটির দিকে দৃষ্টি স্থির রেখে জিজ্ঞেস করল,
মেয়েটা তোমায় এতবার ফোন করল আর তুমি মোবাইল অফ করে রাখলে?

মুড নষ্ট করার ইচ্ছে নেই আমার।

গার্লফ্রেন্ডের সাথে কথা বললে বুঝি মুড নষ্ট হয়?

গার্লফ্রেন্ড? – আহনাফের তাচ্ছিল্যভরা হাসি দেখে কপালে ভাঁজ পড়ল দিশার।

তুমি আমার গার্লফ্রেন্ডকে দেখেছো? – প্রশ্ন করল আহনাফ।

হুঁ।

আমার সাথে ওকে মানায়?

দিশা মুচকি হাসল। কোনো উত্তর দিল না।
আহনাফ দিশার ঠোঁটের দিকে ঝুঁকে এসে বলল, আমি তো তোমার মত কাউকে গার্লফ্রেন্ড হিসেবে চেয়েছিলাম। একবার পেলে সরাসরি বিয়ের পীড়িতে।

দিশা আহনাফের ঠোঁটের সাথে নিজের ঠোঁট ঘষে উত্তর দিল, তোমার মত নষ্ট ছেলের সাথে আমি বসব বিয়ের পীড়িতে? নো। নেভার।

আহনাফ উদাস ভঙ্গিতে বলল,
নষ্টামি করতে আপত্তি নেই অথচ বিয়ে করতে আপত্তি আছে। চমৎকার বিচার তোমার!

দিশা হেসে বলল,
আমি জীবনটা ইঞ্জয় করছি। এসব প্রেম ভালোবাসায় জড়ানোর বিন্দুমাত্র ইচ্ছা আমার নেই। দাও সিগারেটের প্যাকেটটা দাও।

আহনাফ সিগারেটের প্যাকেট এগিয়ে দিতে দিতে উত্তর দিল, আমিও ইঞ্জয় করছি।

আমার সাথে না অমানিশার সাথে?

আহনাফ হেসে ফেলল।
তুমি দেখি ওর নামও জানো।

দিশা ঠোঁটে সিগারেট রেখে অস্পষ্ট স্বরে বলল,
তোমার গার্লফ্রেন্ড গোটা শহরতলীতে ফেমাস হয়ে যায়। এভাবে মেয়েদের কাছ থেকে টাকা পয়সা নিয়ে আর কতদিন চলবে?

আহনাফ মুচকি হেসে বলল, যতদিন যৌবন আছে।

দিশা আহনাফের চোখে চোখ রেখে অদ্ভুতভাবে সিগারেট টানতে লাগল। তার চোখেমুখে কামনা। সেই কামনার ছলনায় আরোও একবার ডুবে গেল আহনাফ।

সকাল গড়িয়ে বিকাল হয়ে গেলো। অমানিশা হাতে ফোন নিয়ে পড়ে রইল ঘরের কোণে। আহনাফের কোনো খোঁজ নেই। অবশেষে, গোধুলি লগ্নে মোবাইল ভাইব্রেট করে উঠল।
এক মুহুর্ত সময় নষ্ট করল না অমানিশা। ফোন রিসিভ করেই প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল।
সারাদিন কোথায় ছিলে তুমি?

আহনাফ বাজখাঁই গলায় উত্তর দিল,
তার কৈফিয়ত কি তোকে দিতে হবে খাংকি মাগি?

অমানিশার চোখে পানি চলে এলো। সে ভাঙ্গা গলায় বলল,
তুমি আবারো নেশা করেছো তাই না?

হ্যাঁ করেছি। এখন কি নেশা করতেও তোর পারমিশন নিতে হবে?

অমানিশা বলল,
গত এক মাস ধরে প্রতি সপ্তাহে আমি তোমাকে সাড়ে সাত হাজার করে টাকা দিচ্ছি আহনাফ। তুমি ডাক্তার দেখাও নি। টাকাগুলো দিয়ে তুমি নেশা করছো, তাই না?

আহনাফ রাগান্বিত স্বরে বলল,
মাগি, তুই এখন আমার ওপর গোয়েন্দাগিরি করছিস?

অমানিশা এবার কেঁদে ফেলল,
গালাগালি করবে না আহনাফ। আমি এখন তোমার গালি শোনার মত অবস্থায় নেই।

আমিও তোর প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার মত অবস্থায় নেই। একটা কথা বলছি, মন দিয়ে শোন। আমি তোকে কল না দিলে আমাকে তুই ফোন দিবি না। ক্লিয়ার?

অমানিশা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলল,
আমি প্রেগন্যান্ট।

আহনাফ ক্ষণিককাল চুপ করে রইল। এরপর ফোন কেটে দিল।

অমানিশা আহনাফকে ফোন করার সাহস পেল না।
তার সম্পর্কটা ভীষণ বিষাক্ত। দূর থেকে দেখলে মনে হয় বাকি আট দশটা সম্পর্কের মতই সাধারণ। সন্নিকটে এ সম্পর্ক শ্বাসরুদ্ধকর, অভিশপ্ত।

হঠাৎ অমানিশার ফোনে একটি ম্যাসেজ এলো। তার সবচেয়ে কাছের বান্ধবী শিরিন লিখেছে,
তুই নাকি প্রেগন্যান্ট?

অমানিশা আশ্চর্যান্বিত হল। সে তো তার কোনো বান্ধবীকে এ বিষয়ে বলে নি! তাহলে শিরিন জানলো কিভাবে?

অমানিশা রিপ্লাই করল,
তোকে কে বলেছে?

সাথে সাথে রিপ্লাই এলো,
তোর প্রেগনেন্সির কথা পুরো স্কুল জানাজানি হয়ে গেছে।

অমানিশার হাত পা থরথর করে কাঁপতে লাগল। তার মনে হল ঘনিষ্ঠ বান্ধবী মুনার নাম মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগল। মুনা আপাদমস্তক কালো বোরখা পরে। স্কুল ইউনিফর্মে প্রেগন্যান্সি কীট কেনা দৃষ্টিকটু বলে অমানিশা তাকে অনুরোধ করে বলেছিল সে যদি কিনে দিত! বোরখার আড়ালেই থেকে যেত তার চেহারা। কিন্তু সে রাজি হয় নি।

অমানিশা নিজের মাথা ছুঁইয়ে মুনাকে প্রতিজ্ঞা করিয়েছিল, এবিষয়ে যেন কেউ কিচ্ছুটি জানতে না পারে।
তবে কি মুনা-ই তার এতবড় সর্বনাশ করল?

(চলবে…)