অমানিশার মধ্যরাত পর্ব-০৪

0
3874

গল্প: #অমানিশার_মধ্যরাত
লিখা: আতিয়া আদিবা
#পর্ব_৪ (১৮+)

পরের দিন অমানিশা স্কুলে গেল। গার্লস স্কুলের গেট দিয়ে ঢোকার পরক্ষণেই মনে হল প্রতিটি শিক্ষার্থী ঘৃণ্য চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। বিষয়টি নিশ্চিত হতে চারিদিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিল সে। সত্যিই তো! সবাই তার দিকেই তাকিয়ে আছে। মুচকি মুচকি হাসছে। এক বান্ধবী আরেক বান্ধবীকে ডেকে ইশারায় অমানিশাকে দেখাচ্ছে। কানাকানি করছে।

স্কুলের এই পরিচিত শরগোলও অচেনা লাগছে। অসহায় অমানিশা এক ছুটে চলে গেল তার ক্লাসরুমে। সীমাহীন সমুদ্রে এক টুকরো দ্বীপ খুঁজে পেতেই যেন তার এই প্রচেষ্টা। এখানেও বিপত্তি তার ছায়াসঙ্গী হয়ে রইল। নিজের ক্লাসের সবাইও বিষদৃষ্টিতে দেখতে লাগল তাকে। অমানিশা ভাবল, হায় হায়! আমার প্রেগন্যান্সি নিয়েই বোধহয় পুরো গার্লস স্কুল আজ সরগরম!

ক্লাসরুমে ঢুকতেই শেষের বেঞ্চে মুনাকে দেখতে পাওয়া গেল। আরবীর সাথে বসে আছে। অমানিশাকে দেখেও সে ভ্রুক্ষেপহীন। সহজ গলায় জিজ্ঞেস করল,
কিরে গতকাল স্কুলে আসলি না কেন?

অমানিশা কাঁপা গলায় বলল,
তোর সাথে আমার কথা আছে। একটু ক্লাসরুমের বাইরে চল।

আরবীও আসুক। ও একা ক্লাসরুমে বসে থেকে কি করবে?

অমানিশা কঠিন স্বরে বলল,
না, তুই একা আসবি।

আরবী মুনাকে আশ্বস্ত করে বলল,
তুই যা। সমস্যা কি?

স্কুলের লম্বা বারান্দার এক কোণায় এসে দাঁড়াল তারা। অমানিশা সরাসরি মুনার চোখের দিকে তাঁকিয়ে প্রশ্ন করল,
আমার প্রেগন্যান্সির খবর গোটা স্কুল কিভাবে জানল?

মুনা আকাশ থেকে পড়ল।
বলিস কি? তুই প্রেগন্যান্ট এটা সবাই জানে? কিন্তু আমি তো কাউকে বলি নি!

অমানিশার চোখেমুখে সন্দেহ। সে নিচু স্বরে বলল,
আমি প্রেগনেন্সি কীট কিনতে যাচ্ছি এটা তুই ছাড়া আর কেউ জানত না, মুনা!

মুনা বিস্মিত স্বরে বলল,
তুই আমাকে সন্দেহ করছিস?

অমানিশা তাচ্ছিল্যের হাসি হাসল। বলল,
বিশ্বাসও তো করতে পারছি না। কারণ তুই ছাড়া এবিষয়ে কেউ কিছুই জানত না।

বিশ্বাসই যখন করিস না, ফ্রেন্ডশিপ রাখার কি দরকার? – অনুযোগের সুরে কথাগুলো বলে মুনা ক্লাসে ফিরে গেলো।

অমানিশা ভেজা চোখে বারান্দার রেলিং এ হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। মুনাকে সে বিশ্বাস করতে পারছে না। আবার এতদিনের বন্ধুত্বকে সাগ্রহে অবিশ্বাস করাও দুরূহ। দোটানার মাঝে আবদ্ধ হয়ে রইল সে।

শিরিন স্কুলে আসলো ক্লাস শুরু হওয়ার ঠিক দশ মিনিট আগে। অমানিশা তখন জানালার পাশের বেঞ্চে বসে শূণ্যদৃষ্টি মেলে আকাশ দেখছিল। শিরিন তার হাত ধরে টানতে টানতে বাথরুমে নিয়ে গেল।
ব্যস্ত শিরিনকে দেখে শঙ্কিত অমানিশা বলল,
কি হল? এভাবে ক্লাস থেকে বাথরুমে নিয়ে এলি কেনো?

শিরিন নিজের বুকের মাঝে হাত ঢুকিয়ে দিল। অন্তর্বাসের ভেতর থেকে একটি এন্ড্রয়েড ফোন বের করল। গ্যালারি তে ঢুকে একটি ছবি বের করে অমানিশাকে দেখালো।

ছবিতে আহনাফ এবং আবির দুটো মেয়ের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সোফায় বসে আছে।
অমানিশার চোখেমুখে তখনও অবিশ্বাস। সে বিস্মিত স্বরে জিজ্ঞেস করল,
এই ছবি তুই কই পেলি?
শিরিন ফিসফিস করে বলল,
মাহাদী গতকাল আমায় ম্যাসেঞ্জারে পাঠিয়েছে। আরোও ছবি আছে। দেখ।

অমানিশা দেখল আরোও অনেকগুলো মেয়ের সাথে একদম গা ঘেঁষে ছবি তুলেছে আহনাফ। বেশ কিছু ছবি অন্তরঙ্গ মুহুর্তের। ঠোঁটে চুমু খাচ্ছে। গলায় চুমু খাচ্ছে বা অন্য নারীর মুখ থেকে সিগারেটের ধোঁয়া নিচ্ছে!

অমানিশা অশ্রুসিক্ত চোখজোড়া বন্ধ করে ফেলল। বুকের প্রতিটি জায়গা ক্ষতবিক্ষত হয়ে যাচ্ছে তার। চোখে মুখে সেই যন্ত্রণার পূর্ণবিকাশ দৃশ্যমান। হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে বারবার চোখ মুছতে লাগল সে।

বিষাদগ্রস্ত কণ্ঠে শিরিন বলল,
আহনাফ তোর সাথে টাইম পাস করছে দোস্ত। ও একদমই তোকে নিয়ে সিরিয়াস না। ওর কাছে তুই শুধুমাত্র একটি ভোগের বস্তু। সোনার খনি। ওই ছেলে নাকি সবসময় পয়সাওয়ালা মেয়েদের সাথে সম্পর্কে জড়ায়। তাদের সাথে শারীরিক সম্পর্ক করে। টাকা পয়সা লুফে নেয়। এরপর নষ্ট মেয়েদের সাথে ফূর্তি করে বেড়ায়। একসাথে বসে নেশা করে।

অমানিশা ভাঙ্গা গলায় বলল,
এসবও কি তোকে মাহাদী বলেছে?

শিরিন দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বলল,
আমি জানি দোস্ত। তোর এসব কথা বিশ্বাস হচ্ছে না। প্রথমে আমারোও হয় নি। কিন্তু এই ছবিগুলো তো মিথ্যে না!

অমানিশা এবার কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল। অপ্রস্তুত শিরিন বুঝল না কিভাবে তাকে সান্ত্বনা দেওয়া যায়! প্রিয় বান্ধবীর কান্না দেখে সেও ছটফট করতে লাগল।
অস্থির হয়ে বলল,
প্লিজ দোস্ত কান্না বন্ধ কর! এক্ষুণি ক্লাস শুরু হয়ে যাবে।
– গলায় ঝুলানো সাদা স্কার্ফ দিয়ে অমানিশার চোখের জল মুছে দিল শিরিন।

অমানিশা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলল,
আমি সত্যিই প্রেগন্যান্ট দোস্ত। একথা শোনার পর থেকে আহনাফ আমার ফোন ধরছে না।

শিরিন ক্ষীণস্বরে বলল,
জানি। তোর এই বিষয়টা পুরো তল্লাটে জানাজানি হয়ে গেছে। আমাকে গতকাল মাহাদীই বলেছে তোর প্রেগনেন্সির কথা।

অমানিশা হেঁচকি তুলে বলল,
দোস্ত, আমার ভীষণ ভয় করছে। আমি এই পরিস্থিতি একা একা কিভাবে সামালাবো? বাবাকে যদি কেউ বলে দেয়? গলায় দড়ি দেওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় রইল না আমার!

শঙ্কিত অমানিশাকে আলগোছে জড়িয়ে ধরল শিরিন। মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে ধমকের সুরে বলল,
একদম বাজে কথা বলবি না। আমি আছি তো! কখনো নিজেকে একা মনে করবি না। আহনাফের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা কর। দেখ কি বলে। আর যেকোনো প্রয়োজনে আমাকে ম্যাসেজ করবি। ঠিকাছে?

অমানিশা হ্যাঁ সূচক মাথা ঝাঁকাল।
চল, ক্লাসে যাই। দেরি হয়ে যাচ্ছে। এতক্ষণে মনে হয় স্যার নাম ডাকা শুরু করে দিয়েছেন।- একথা বলে শিরিন অমানিশার হাত শক্ত করে ধরে ক্লাসের দিকে এগোতে লাগল।

সারাদিন স্কুলে অন্যমনস্ক হয়ে বসে রইল অমানিশা। অনর্থক কথা বলা মেয়েটির স্থিরতা শিক্ষকদের দৃষ্টি এড়ালো না। ক্লাস ক্যাপ্টেনও আজ বিরক্ত। ব্ল্যাক বোর্ডে সাদ চক ঘষে এক নম্বর দিয়ে অমানিশার নামটি সে লিখতে পারেনি। ক্লাসে কথার ফুলঝুরি ছড়ানো মেয়েটি আজ শান্ত, অনুত্তেজিত। অবশ্য এর কারণ তারা ভাসা ভাসা শুনেছে। তবে, সত্য মিথ্যা যাচাই এর বাড়তি সময় তাদের কাছে নেই।

বাসায় ফিরে অমানিশা পুনরায় আহনাফকে ফোন করল। কোনো সাড়া মিলল না। যদিও সে নিরুৎসাহিত হল না। নতুন উদ্যমে ক্রমাগত আহনাফের নাম্বারে ডায়াল করতে লাগল। এক পর্যায়ে বুঝল আহনাফ ফোন বন্ধ করে ফেলেছে।
এভাবে আর কতদিন? কোনো একটি সিদ্ধান্তে উপনীত হতে হবে। অন্তত আজকে আহনাফের ছবিগুলো দেখার পর তাকে আর বিশ্বাস করা যাচ্ছে না।

অমানিশা ক্লান্ত শরীরে গোসলঘরে ঢুকল। ঝর্ণা ছেড়ে দিয়ে ফ্লোরে বসে রইল অনেকক্ষণ। সম্পর্কের ফ্ল্যাশব্যাকে গিয়ে হন্যে হয়ে খুঁজতে লাগল আহনাফের এমন কোনো ক্রিয়াকলাপ, যার মাধ্যমে প্রমাণ হয় সে তাকে ভালোবাসে।
দুর্ভাগা অমানিশা, কিচ্ছুটি খুঁজে পেল না।

এই বিষাক্ত সম্পর্কটি টিকে আছে টাকার জোরে। যেদিন আহনাফের টাকার প্রয়োজন পড়েছে সেদিন সে নিজ থেকে অমানিশাকে ফোন করেছে। সারারাত কথা বলেছে।
অথচ অমানিশা ফোন করে কথা বলতে চাইলে গালাগাল ছাড়া মেয়েটির ভাগ্যে আর কিছু জুটে নি।
আহনাফের সাথে দেখা করতে গেলে রেস্টুরেন্টের বিল অমানিশা দিত।

মাসখানেক আগে ওয়ালটন তাদের নতুন থ্রিজি সাপোর্টেড মোবাইল লঞ্চ করেছিল। আহনাফ আবদার করেছিল, ফোনটা যেন অমানিশা তাকে কিনে দেয়। এই আবদার অমানিশা ফেলতে পারে নি। মায়ের আলমারির ড্রয়ার থেকে টাকা চুরি করে ফোনটা সত্যিই কিনে দিয়েছিল সে।

প্রতিদানে আহনাফ তাকে কি দিয়েছে?
‘নষ্টা মাগি’ অথবা ‘বেশ্যা’ বলে গালি! – যা অমানিশার পরিবারের কেউ কোনোদিন ভুলেও উচ্চারণ করে নি।

অমানিশা গোসল সেড়ে বেরিয়ে এলো। বিশাল বড় একটি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে সে। সিদ্ধান্তটি ঠিক নাকি বেঠিক তা সে জানে না। এখন আর জানতেও চাইছে না। অনেক দেরি হয়ে গেছে।
মোবাইল ফোনটা হাতে নিয়ে সে শিরিনকে ম্যাসেজ করল,
_’দোস্ত, আমি এবোরশন করতে চাই।’
(চলবে…)