অমানিশার মধ্যরাত পর্ব-০৫

0
3702

#অমানিশার_মধ্যরাত
লেখিকা: আতিয়া আদিবা
#পর্ব_৫ (১৮+)

জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হয়। দাঁড়িপাল্লার একপাশে আবেক রেখে অপরপাশে বিবেক-কে স্থান করে দিতে হয়। দুটোর অবস্থান সমান হলে আমরা যে সিদ্ধান্তে উপনীত হই, তাকে যুক্তিসঙ্গত মীমাংসা বলে আখ্যায়িত করেন জ্ঞানী ব্যক্তিরা।
চৌদ্দ অথবা পনেরো বছর বয়সী কোনো মেয়ের মাঝে এই ক্ষমতা নেই। তাই সৃষ্টির সেরা জীব হয়েও নিকৃষ্টতম ভুল করতে একটি মুহুর্তই যথেষ্ট!

অমানিশার ম্যাসেজ পেয়ে শিরিন তাকে রিপ্লাই করল,
তুই কি এখন কথা বলতে পারবি?

অমানিশা প্রত্যুত্তরে লিখল,
পারব।

শিরিন সাথে সাথে কল করল। অমানিশা কথা বলতে বারান্দায় চলে গেলো।

ভাগ্যিস! এই মাত্র মা খালার বাসায় গেল, তাই সরাসরি তোকে ফোন করতে পারলাম। – স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল শিরিন। পরক্ষণেই উদ্বিগ্ন স্বরে জিজ্ঞেস করল,
তুই শিওর এবোরশন করবি?

আর কোনো উপায় নেই, দোস্ত।

আহনাফের জন্য আরেকটু ওয়েট করলে হত না? এবোরশন তুই কেন করবি? এটা কি ওর দায়িত্ব নয়?

দায়িত্ব? – অমানিশার তাচ্ছিল্যে ভরা হাসি হাসল। বলল,
যে ছেলে আমার প্রেগনেন্সির কথা শুনে যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছে, তার কাছ থেকে এসব আশা করাও তো বোকামি! এমনিতেও, এতদিন বোকার রাজ্যেই ছিল আমার বসবাস। মিথ্যা মোহে অন্ধ হয়ে ছিলাম।

শিরিন রূঢ় ভঙ্গিতে বলল,
এত বড় অন্যায় করে ছেলেটা পার পেয়ে যাবে?

অমানিশার গলা চেপে কান্না এলো। সে ঢোক গিলে জবাব দিল,
বিষয়টা নিয়ে জালঘোলা করলে আমার নিজের ক্ষতি। আহনাফ হয়তো কখনো আমাকে ভালোবাসে নি। আমি এক তরফা ভালোবেসে নিজের সব হারিয়েছি। আত্মসম্মান, মর্যাদা, সম্ভ্রম। সবকিছু।

শিরিন চুপ করে রইল।

জানিস? সেদিন মা গর্ব করে আমায় বলছিল, আমরা নাকি বেস্টফ্রেন্ড! আমি তাকে না জানিয়ে কিছু করি না – বিষয়টি নিয়ে সে ভীষণ প্রাউড ফিল করে। আমি আমার মায়ের সামনে কিভাবে দাঁড়াব দোস্ত? – কথাগুলো বলতে বলতে অমানিশা কেঁদে ফেলল।

শিরিন কাতরস্বরে বলল,
তুই প্লিজ কাঁদিস না, অমা। আমি আছি তো তোর সাথে। কেউ আর কিচ্ছু জানতে পারবে না। তুই এবোরশন করে ফেল। কিন্তু কোথায় করবি?

জানি না। এত ছোট্ট একটা মফস্বল শহর। তার ওপর বাবাকে আবার সবাই চিনে। শহর থেকে একটু দূরে কোনো ক্লিনিকে যেতে হবে। – দীর্ঘশ্বাস ফেলল অমানিশা।

শিরিন চিন্তিতস্বরে বলল,
কিন্তু শুধুমাত্র তোর আর আমার যাওয়াটা তো বেশ রিস্কি! বড় কেউ সাথে থাকলে ভালো হত।

কাকে বলব আর? পরিবারের বাইরে এমন পরিচিত কেউ আমার নেই।

দুজনেই বেশ চিন্তায় পড়ে গেল। আচমকা শিরিন উত্তেজিত হয়ে বলল,
দোস্ত, আরবির একজন খালা আছেন ডাক্তার। শহর থেকে একটু দূরে সরকারি একটি ক্লিনিকে বসেন। উনার সাথে যোগাযোগ করলে হয় না?

আমি তো আরবিকে এ বিষয়ে কিছুই জানাই নি।

শিরিন বলল,
আগামীকাল স্কুলে ওর সাথে কথা বলে দেখতে পারিস। আমি যতদূর জানি ওর খালা এজাতীয় কেসগুলোই দেখে। পরিচিত কেউ থাকাটা অনেক জরুরি। তুই যদি বলিস আমিও কথা বলতে পারি ওর সাথে।

অমানিশা বলল,
না তোর বলার দরকার নেই। আমি আগামীকাল স্কুলে ওর সাথে কথা বলব।

তুই খাওয়া দাওয়া করিস ঠিকমতো, দোস্ত। দেখিস, সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে।

এসময় অমানিশার ঘরের দরজায় টোকা পড়ল। সে ফিসফিস করে বলল,
দোস্ত মা আসছে মনে হয়। আমি রাখছি। আগামীকাল স্কুলে দেখা হবে।

অমানিশা ফোন লুকিয়ে দরজা খুলতে গেল। রাহেলা হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে। তার হাতে মেলামাইনের প্লেট। তাতে পাঁচ পিস আলুর চপ।
রাহেলা ধমকের সুরে বলল,
দরজা লাগিয়ে নিজেকে ঘরবন্দী করে রাখার স্বভাব কি তোর যাবে না? তোর জন্য বেশি করে কাচামরিচ দিয়ে আলুর চপ বানিয়েছি। জ্বরের কারণে তো মুখ নষ্ট হয়ে আছে তোর। সস মাখিয়ে খা। ভালো লাগবে।

মায়ের দিকে অসহায় অমানিশা তাকিয়ে রইল ক্ষণিককাল। এরপর শক্ত করে তাকে জড়িয়ে ধরল। ঘটনার আকস্মিকতায় অবাক হল রাহেলা। বুকটা অজানা ভয়ে কেঁপে উঠল।
অজ্ঞাত বিপদের আশঙ্কায় গত কয়েক রাত নির্ঘুম কেটেছে রাহেলার। চোখের পাতাজোড়া এক করলেই ভয়ংকর যতসব দু:স্বপ্ন দেখছে সে। সামনে কোনো বিপত্তি তো অবশ্যই আছে, এবিষয়ে রাহেলা নিশ্চিত। কিন্তু এর পরিধি ঠাহর করা যাচ্ছে না। সারাক্ষণ আল্লাহর নাম জপছেন রাহেলা।

কি হয়েছে মা, তোর? শরীর খারাপ লাগছে? কেন স্কুলে গেলি? শরীর তো এখনো পুরোপুরি সুস্থ হয় নি!- রাহেলার শঙ্কিত গলা শুনে নিজেকে সামলে নিল অমানিশা।
স্বাভাবিকভাবে বলল,
কিছু হয় নি মা। অনেকদিন তোমায় জড়িয়ে ধরি না। তাই আজকে ধরলাম। দাও চপ খাই।

প্লেট থেকে একটি চপ নিয়ে খেতে লাগল অমানিশা। রাহেলা মেয়ের নিষ্পাপ মুখের দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইল। তার মেয়েটা শ্যামলা। মাথার কোকড়া চুলগুলো পিঠ স্পর্শ করতে না করতেই কেমন যেন রুক্ষ হয়ে যায়। ঠোঁটের চারিপাশে কালো। অমানিশা তার মায়ের রূপের এক ছটাকও পায় নি!
সে যদি কোনো হতদরিদ্র ঘরে জন্মাতো, বিয়ে দিতে বড় ভুগতে হত।
সৌভাগ্যক্রমে, রাহেলার স্বামীর অঢেল টাকা-পয়সা! একথা ভেবে মুচকি হাসল সে। মেয়ের কপালে চুমু খেয়ে আলগোছে স্বস্তির শ্বাসও ফেলল।

পরদিন স্কুল ছিল হাফ ডে। ছুটির পর অমানিশা আরবির কাছ থেকে তার ডাক্তার খালার নাম্বার নিয়ে নিল। আকুল স্বরে বলল,
দোস্ত, কেউ যেনো জানতে না পারে!

আরবি তাকে আশ্বস্ত করে বলল,
কেউ জানতে পারবে না৷ তুই আজই গিয়ে খালামণির সাথে যোগাযোগ কর। বেশি দেরি করা উচিত হবে না।

অমানিশা মাথা ঝাঁকিয়ে সহমত পোষণ করল। করুণভাবে নিজের অনুভূতি ব্যক্ত করল, আমার ভীষণ ভয় করছে আরবি।

ভয় পাস না। খালামণি অনেক ভালো। তিনি খুব যত্ন নিয়ে কাজ করেন। তবে তুই বাসায় গিয়েই আবার খালামণিকে ফোন করিস না। আমি আগে তাকে পুরো বিষয়টা জানিয়ে নেই।

পুরো পরিস্থিতি জানাবি বলতে?

আরবি খানিকটা ইতস্তত করে বলল,
যদি হিস্ট্রি জানতে চায় তখন কি বলব?

বলবি যে এক্সিডেন্ট হয়ে গেছে। তাই এবোরশন করছি। শেষ।

আহনাফের কথা বলব না?

না। দরকার নেই। আমার আর শিরিনের সাথে তুইও কি যাবি সেদিন?

আরবি তড়িৎ গতিতে উত্তর দিল, না না! আমি এসবে জড়াতে চাই না।

অমানিশা ফ্যাকাসে হেসে বলল,
আমি এমনেই জিজ্ঞেস করেছি। তোকে এসবের মাঝে জড়ানোর ইচ্ছা আমারো নেই রে! হেল্প যে করলি এইতো ঢের বেশি। থ্যাংক্স রে। – কথাটা বলে আরবিকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল সে। এরপর বিদায় নিয়ে স্কুলের মেইন গেটের দিকে অগ্রসর হল অমানিশা। আরবি অনেকক্ষণ চেয়ে রইল তার প্রস্থানের পথে। অস্ফুট স্বরে মুখ দিয়ে বেড়িয়ে এলো,
আহারে! বেচারি।

বাসায় ফিরে অমানিশা অধির আগ্রহে অপেক্ষা করতে লাগল। কখন আরবির খালামণির সাথে কথা বলতে পারবে।
সময় যেন ফুরোতেই চাইছিল না। বিয়ের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গকারী আহনাফকে হঠাৎ করেই প্রচন্ড ঘৃণা করতে শুরু করেছে অমানিশা। যে লোমশ বুকে লজ্জায় মুখ লুকাতো, সেই বুকের প্রতি বিতৃষ্ণা কাজ করছে আজ।
অমানিশা আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। নিজের গায়ের কালসিটে দাগগুলো আজ বড্ড পীড়া দিচ্ছে তাকে। শরীরের যে অঙ্গপ্রত্যঙ্গে আহনাফের গন্ধ লেগে আছে, সেসব জায়গা ধ্বংস হয়ে যাক – এমন প্রত্যাশার শরনাপন্ন হল অমানিশা।
এ জীবন আজ তার অনর্থক বলে মনে হচ্ছে। অর্থহীন মনে হচ্ছে তার প্রতিটি নিশ্বাস।

(চলবে…)