অমানিশার মধ্যরাত পর্ব-০৬

0
3367

#অমানিশার_মধ্যরাত
লেখিকা: #আতিয়া_আদিবা
#৬ষ্ঠ_পর্ব (১৮+)

নিজেকে শেষ করে দেওয়ার মত অযৌক্তিক চিন্তা ভাবনাও অমানিশাকে ঘিরে ধরছে বারবার। রণক্ষেত্র থেকে পালানোর পথ তবুও থাকে। কিন্তু জীবনই যখন রণক্ষেত্রের অনুরূপ, তখন মৃত্যু ছাড়া বাঁচার পন্থা কই?

অমানিশা ঘড়ির দিকে তাকাল। প্রতিটি মুহুর্ত যেন বছরে পরিণত হয়েছে তার। কাটা কবুতরের মত ছটফট করতে করতে আরোও একটি রাত পারি দিল সে।

পরের দিন দুপুরবেলা।
পূর্ব দিকের জানালার গ্রিলে মাথা ঠেকিয়ে বিছানায় বসে আছে অমানিশা। শরীরটা আজ বড় দুর্বল তার। খেতে পারছে না। পেটে কিছু পড়লেই বমি হচ্ছে। গায়ে পুনরায় জ্বর জ্বর ভাব। হাতের ফোনের দিকে অসহায় ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে সে। আহনাফকে সকাল থেকে প্রায় বিশ বারের মত ফোন করেছে। কোনো রেসপন্স নেই।

এমন সময় অপরিচিত একটি নাম্বার থেকে ফোন আসল। কপালে ভাঁজ পড়ল অমানিশার। কল রিসিভ করে চুপ করে রইল।

অপরপাশ থেকে একজন মধ্যবয়সী মহিলার কণ্ঠ শোনা গেল।
হ্যালো? অমানিশা বলছো?

জ্বি। আপনি কে? – কপালে ভাঁজ রেখেই উত্তর দিল সে।

আরবির সুরভী খালা বলছিলাম, মা। ভালো আছো?

অমানিশা স্বস্তির দীর্ঘশ্বাস ফেলল। আন্তরিকতার সাথে সালাম জানাল। হাসার চেষ্টা করে বলল,
জ্বি খালামণি। আপনি ভালো আছেন?

ড. সুরভী বললেন,
আলহামদুলিল্লাহ। তোমার কথা শুনলাম আরবির কাছে। তুমি এবোরশন করতে চাইছো। তুমি বুঝে শুনে সিদ্ধান্ত নিয়েছো তো, মা?

জ্বি খালামণি। আসলে বয়স অল্প তো। নিজেদের অজান্তেই এরকম একটা ভুল হয়ে গেছে। তাই এরকম সিদ্ধান্ত নিয়েছি। – খানিকটা ইতস্ততভাবে উত্তর দিল অমানিশা।

বুঝতে পেরেছি।

এবোরশন করতে কেমন খরচ হতে পারে খালামণি?

ক্ষণিককাল চুপ থেকে ড. সুরভী বললেন,
শুনো, মা। তোমার বয়স অনেক কম। এরকম আর্লি প্রেগনেন্সিতে এবোরশন করা বেশ রিস্কি। তুমি কি বুঝতে পারছো আমার কথা?

জ্বি, খালামণি।

আমাদের খুব সাবধানে আগাতে হবে। – উদ্বেগের সাথে বললেন ড. সুরভী।

তাহলে এ অবস্থায় আমরা কি করতে পারি? – কৌতূহল নিয়ে প্রশ্ন করল অমানিশা।

ড. সুরভী হেসে জিজ্ঞেস করলেন,
বাচ্চার বাবা কি বলে? সেও তোমার সিদ্ধান্তের সাথে একমত?

প্রশ্ন শুনে অমানিশার বুকের ভেতরে যেন ঝড় বয়ে গেল। দুমড়ে মুচড়ে গেল সব। সে কিভাবে ড. সুরভীকে বলবে প্রেগনেন্সির কথা শুনে আহনাফ তার সাথে যোগাযোগ পর্যন্ত করছে না! সে হয়ত নেশা করে অন্য নারীর শরীরে ডুবে আছে। এ যাত্রায় তাকে মিথ্যা বলতে হবে।
অমানিশা কান্না গিলে বলল,
না, খালামণি। ও আমাকে বিয়ে করতে চেয়েছে। বার বার বলছে আমি যেন বাচ্চাটা রাখি। কিন্তু আমার ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করেই আমি এবোরশন করতে চাচ্ছি।

ওহ! বুঝতে পেরেছি। এ বয়সে বাচ্চা হওয়া বা এবোরশন করা দুটোই ঝুকিপূর্ণ। বুঝেছো, মা? তুমি সাত হাজার টাকার মত হাতে রাখো।

ঠিকাছে খালামণি। কেমন সময় লাগতে পারে? – জানতে চাইল অমানিশা।

ড. সুরভী বললেন,
সারাদিন লাগবে। সকাল বেলা চলে এসো। একটা ইঞ্জেকশন
দিয়ে এবোরশন প্রসেস শুরু হবে। ব্লিডিং শুরু হলে অবজারভেশনে রাখতে হবে। বিকাল পর্যন্ত সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে সন্ধ্যার আগ দিয়ে তোমাকে ছেড়ে দিব।

আচ্ছা। আমি আপনাকে জানাবো।

বেশি দেরী করো না। যত দেরী করবে বিষয়টা তত জটিল হবে। বুঝেছো?

জ্বি। আমি আগামীকালকের মধ্যেই আপনাকে জানাবো।

ঠিকাছে, মা। ভালো থাকো।

সালাম জানিয়ে ফোন রেখে দিল অমানিশা। পুনরায় জানালায় মাথা ঠেকিয়ে সুনীল আকাশের দিকে তাকাল সে। এই অলস দুপুরেও আকাশে একটি ঘুড়ি উড়তে দেখা গেলো। পাশের মেহগনি গাছটায় বসে নাম না জানা একটি পাখি বিরামহীন ডাকছে। অমানিশা আপনমনে ভাবছে, আকাশে উড়তে থাকা ঘুড়ি আর ওই মেহগনি গাছের পাখিটির মত সেও আজ একা। এই লড়াই একান্তই তার নিজের লড়াই। আর সে মোটেও হার মানবে না।

আহনাফ টং এ বসে চা খাচ্ছে। অবশ্য সে একা নয়। আবির আছে তার সাথে।
এই মামা, আরেকটা গোল্ডলীফ দিও তো! – টং এর মামার কাছে আগ্রহভরে সিগারেট চাইল আহনাফ।

আবির চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলল,
রাফি ফোন করেছিল সকালে।

কি বলল?

নতুন জিনিস আনছে চিটাগাং থেকে। সেই কড়া মাল নাকি!

পার পিস কত করে চাচ্ছে?

৫৫০ টাকা করে।

মামা সিগারেট লন। – টং এর মধ্যবয়স্ক লোকটি সিগারেট এগিয়ে দিল আহনাফের দিকে। আহনাফ ঠোঁটে সিগারেট রেখে লাইটার ধরল। সিগারেট জ্বালিয়ে বিশাল বড় একটি সুখটান দিয়ে বলল,
কয় পিস নিতে চাস?

আবির দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বলল,
নিতে চাইলেও উপায় নেই। আমার পকেট একদম ফাঁকা।

কেন তোর ফুলটুসি কই? তাকে একটু বল পকেটটা ভরিয়ে দিতে।

মা বাবার সাথে সিলেট ট্যুরে গিয়েছে। তোরটাকে বললেও তো পারিস। ওইটা তো আপাদমস্তক টাকার খনি।

আহনাফ বিরক্তি নিয়ে বলল,
আর বলিস না বাল! অঘটন তো একটা হয়ে গেছে।

আবির আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করল,
কি অঘটন?

মাগীটা প্রেগন্যান্ট হয়ে বসে আছে।

বলিস কি? কনগ্রেচুলেশন দোস্ত। বিয়ে করে ফেল!

আহনাফ আবিরের দিকে চোখ পাকিয়ে তাকাল।

আরে চেতিস না দোস্ত। মজা করছিলাম। – আহনাফের পিঠ চাপড়ে স্বাভাবিকভাবে বলল আবির। জিজ্ঞেস করল,
এখন কি করবি?

কি করব বুঝতে পারছি না। দিন নাই রাত নাই ননস্টপ ফোন দেয়। ইগ্নোর করছি। মোবাইল অফ করে রেখে দেই। কিন্তু এভাবে আর কত দিন?

তাহলে কি রাফিকে মানা করে দিব? – করুণস্বরে জিজ্ঞেস করল আবির।

না। আগেই কিছু বলিস না। আমাকে একটু ভাবতে দে। দেখি কি করা যায়। চিটাগাং এর জিনিস তো এমনেই পাওয়া যায় না।

আবির কৌতূহল নিয়ে জিজ্ঞেস করল,
তুই যে নতুন একটা মেয়ের সাথে কথা বলছিস না?

আহনাফ গর্বিত ভঙ্গিতে বলল,
অনেকগুলোর সাথেই তো বলছি। মেয়ের অভাব আছে নাকি?

ক্লাস এইটে পড়ে একটা আছে না?

ওহ! মাহির কথা বলছিস?

হ্যাঁ, মাহি। মেয়েটার নাম শুধু ভুলে যাই। ওর কাছ থেকে নেওয়া সম্ভব না?

আহনাফ বলল,
উহুঁ। মাত্র কয়েকদিন হল কথা বলছি। এখনি টাকা পয়সা চাওয়া যাবে না।

তাহলে কিভাবে ম্যানেজ করবি?

সিগারেটে শেষ টান দিয়ে আহনাফ বলল,
করে ফেলব কোনো ভাবে বা না কোনো ভাবে। তুই এক কাজ কর। ১০ পিস রেখে দিতে বল। আর চেষ্টা কর পার পিস ৫০০ টাকায় ফিক্সড করতে। পারবি না?

আবির মুচকি হেসে বলল,
আবার জিগায়। এখন তাহলে তোর বাসায় চল? আরেকটা জিনিস আছে।

কি জিনিস?

আবির পকেট থেকে একটা পলিথিন অর্ধেক বের করে আবার ঢুকিয়ে ফেলল।
আহনাফ ফিঁক করে হেসে উচ্চস্বরে গান ধরল,
গাজার নৌকা পাহাড়তলী যায়, ও মীরাবাঈ…
গাজার নৌকা পাহাড়তলী যায়।

মফস্বল শহরে নতুন একটি সুপারশপ খুলেছে। রাহেলা তৈরি হয়ে নিলেন। তিনি এখন স্বামীর সাথে সুপারশপে যাবেন। বের হওয়ার আগে একবার অমানিশার ঘরে গেলেন। তার মেয়েটা বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। সারাদিন ঠিকমতো কিছু খেতে পারে নি। তিনি মেয়ের কপাল ছুঁয়ে দেখলেন। তাপমাত্রা স্বাভাবিক আছে। রাহেলা আদুরে গলায় ঘুমন্ত অমানিশাকে ডাকলেন,
মারে, ও মা! আমি আর তোর বাবা একটু বাইরে যাচ্ছি।
অমানিশা চোখ পিটপিট করতে লাগল।
ঘুমজড়ানো কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,
কোথায় যাচ্ছো তোমরা?

ওই যে নতুন সুপারশপ হল। ওখানেই যাচ্ছি। কিছু জিনিসপত্র কিনে আনি। তোর জন্য কি আনব?

চকলেট নিয়ে এসো।

আচ্ছা। দরজাটা লাগিয়ে দিয়ে এসে ঘুমা।

চলো।

অমানিশা দরজা লাগিয়ে দিয়ে সোজা মায়ের ঘরে চলে এলো। আলমারিতে চাবি ঝুলছিল। তার চোখদুটো চিকচিক করে উঠল। এইতো সুযোগ! টাকার ব্যবস্থা এক্ষুনি করতে হবে।
আলমারির দ্বিতীয় ড্রয়ারে পঞ্চাশ হাজার টাকার একটি বান্ডেল পাওয়া গেল। অমানিশা সেই বান্ডেল থেকে গুনে গুনে দশ হাজার টাকা নিয়ে নিল।
নিজের জন্য কখনো সে একটা টাকাও চুরি করেনি। প্রয়োজন পড়ে নি। কারণ, তার জীবনে একজন জাদুকর আছেন। অমানিশার যখন যা দরকার হয়েছে, চাওয়া মাত্রই তার সামনে তা হাজির করেছে।
আর সেই জাদুকর হল অমানিশার বাবা, মুশফিক আহমেদ।

(চলবে…)