#অমানিশার_মধ্যরাত
লেখক: আতিয়া আদিবা
#৭ম_পর্ব (১৮+)
একজন মেয়ের জীবনে তার বাবার ভূমিকা জাদুর চেরাগের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। বায়না করতেই যত দেরি তবে পেয়ে যাওয়ার মাঝে সময়ের অপচয় নেই। অমানিশা সন্তপর্ণে নিজের স্কুলব্যাগের ফিজিক্স বইয়ের ভাঁজে চকচকে টাকাগুলো লুকিয়ে ফেলল। তার দীর্ঘশ্বাসগুলো বন্দি হয়ে রইল চার দেয়ালের মাঝে। কেউ দেখল না, কেউ বুঝল না। অমানিশার প্রতিটি দীর্ঘশ্বাসে মিশে আছে অপরাধবোধ।
এই অপরাধবোধ মানুষকে বেপরোয়া করে তুলে। কলুষিত হৃদয়ও টের পায় অসম্ভব যন্ত্রণা। এ যন্ত্রণা হয়ত মৃত্যুযন্ত্রণার চেয়েও ঢের বেশি। তাই অমানিশা হাউমাউ করে কাঁদছে। মুখে বালিশ চেপে ধরে সে কি আর্তচিৎকার! প্রকৃতি যেন থমকে গেছে সেই চিৎকারে। বাতাসে কামিনীর সুবাস নেই।আকাশের চাঁদও অনুজ্জ্বল। শুধু গাছের পাতাগুলো বোধহয় ঝিরিঝিরি ছন্দ তুলে সহানুভূতি দেখাতে চাইছে অমানিশাকে।
কাঁদতে কাঁদতে যখন কণ্ঠ ভেঙ্গে যাওয়ার উপক্রম, ঠিক তখন ফোন বেজে উঠল অমানিশার। ঝাপসা চোখে দেখল স্ক্রিনে আহনাফের নাম সুস্পষ্ট। কৌতূহল সীমা অতিক্রম করল অমানিশার। কপাল কুঁচকে ফোন রিসিভ করল সে।
হ্যালো?
অপরপক্ষ নি:শ্চুপ।
আরোও একবার নিচুস্বরে বলল,
হ্যালো?
এবার কারো ফুঁপিয়ে কাঁদার ক্ষীণ আওয়াজ পাওয়া গেল।
অমানিশার বুকটা ধক করে উঠল। তবে মুখে কিছু বলল না।
আহনাফ কানতে কানতে বলল,
আব্বুকে সেদিন রাতে হসপিটালে নিয়ে যেতে হয়েছে, নিশা। তাই তোমার সাথে আর যোগাযোগ করতে পারিনি।
অমানিশাকে একরাশ চিন্তা ঘিরে ধরল। কিন্তু তার কণ্ঠে তা প্রকাশ পেল না। সে অনেকটা অবিশ্বাসের সুরে জিজ্ঞেস করল,
কেন কি হয়েছে উনার?
আব্বু সুইসাইড এটেম্পট করেছে। নিজেকে মেরে ফেলতে চেয়েছিল সে।
কিভাবে?
তুমি তো জানো আব্বুকে প্রতিদিন রাতে ঘুমের ওষুধ খাওয়াতে হয়। আম্মু ওষুধের বাক্সটা উনার বালিশের পাশে রেখে কোনো এক কাজে রান্নাঘরে গিয়েছিলেন। ঘরে ফিরে দেখেন দুটো ঘুমের ওষুধের পাতা একদম খালি! আব্বু নিজেকে শেষ করে ফেলতে চেয়েছিল। – আহনাফ এবার গলা ছেড়ে কাঁদতে লাগল।
অমানিশা ঢোক গিলে বলল,
আমাকে একটা ম্যাসেজ করা যেত। যোগাযোগ কেন বন্ধ করে দিয়েছিলে?
আহনাফ অনুযোগ মিশ্রিত গলায় বলল,
কিভাবে যোগাযোগ করব অমানিশা? সে রাতে বাবাকে নিয়ে হাসপাতালের ইমার্জেন্সিতে যাই। আই সি ইউ তে নিতে হয়েছিল তাকে। ওয়াশ করাতে হয়েছে। নিশ্বাস নেওয়ার সময় পাচ্ছিলাম না। মা বার বার অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছিলেন। তুমি ভাবতেও পারছো না আমি কিসের মাঝে ছিলাম।
অমানিশা চুপ করে রইল। কোনো উত্তর দিল না।
আমার কথা বিশ্বাস হচ্ছে না তাই না? – কৃত্রিম হাসি হেসে জিজ্ঞেস করল আহনাফ। এক কাজ করি, মায়ের সাথে তোমাকে কথা বলিয়ে দেই। তুমি বরং তাকেই জেরা করে দেখো। যদিও মা এখনো ট্রমাটাইজড। তোমার প্রশ্ন তাকে বড় পীড়া দিবে। তবুও আমি আমার ভালোবাসার জন্য যেকানো কিছু করতে রাজি আছি। অন্তত, তোমার বিশ্বাসের জায়গাটা পোক্ত হোক!
এপর্যায়ে অমানিশার মন আহনাফের মিথ্যার আঁচে মোমের মত গলতে শুরু করল। কোনো ছেলে আর যাই করুক, মিথ্যের মাঝে তার মাকে জড়াবে না। এই আশ্বাসটুকু অমানিশাকে পুনরায় বাধ্য করল আহনাফের মিথ্যাকে সত্য বলে গ্রহণ করতে। সে ব্যথিত গলায় জিজ্ঞেস করল,
এখন কেমন আছেন আংকেল?
বেঁচে আছেন। ডাক্তার অনেকগুলো ওষুধ দিয়েছে। সেসব কিনতে গিয়ে আম্মুর হাত ফাঁকা। জানো নিশা? বাসার গ্যাসের লাইট কেটে দিয়েছে। কয়েকমাস ধরে বিল দিতে পারি না। মা এমাসে একবারে বিল দিতে চেয়েছিল। কিন্তু তা সম্ভব হল না। বাবার পিছে সব টাকা খরচ হয়ে গেল। মানুষের বাসায় গিয়ে রান্না করতে হচ্ছে। – আহনাফ আবারো ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল। কাঁপা কণ্ঠে আরোও যোগ করল,
মাঝে মাঝে মনে হয় আমি মরে যাই। ছেলে হয়ে মা বাবার জন্য কিচ্ছু করতে পারছি না। আমার জন্ম কেন হয়েছিল বলতে পারো? জীবনটা অভিশপ্ত বলে মনে হয়।
অমানিশা আহনাফকে আশ্বস্ত করে বলল,
খামোখা এসব অর্থহীন কথা বলো না। তোমাকে বহুদিন বাঁচতে হবে। আংকেল আন্টির জন্য হলেও বাঁচতে হবে। বুঝেছো?
শুধু আম্মু আব্বুর জন্য বাঁচতে হবে? তোমার জন্য বাঁচতে হবে না? আমাদের বাবুর জন্য বাঁচতে হবে না? উত্তর দাও? – অনুনয়ের সুরে জিজ্ঞেস করল আহনাফ।
অমানিশা কাঁপা গলায় বলল,
তোমার সাথে অনেকগুলো মেয়ের ছবি দেখলাম। ক্লোজ অবস্থায়। মেয়েগুলো কে?
আহনাফ কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে জিজ্ঞেস করল,
আমার ছবি?
অমানিশা সহজ গলায় বলল,
হ্যাঁ। একসাথে বসে নেশা করছো। গলায়, ঘাড়ে, ঠোঁটে চুমু খাচ্ছো, মুখ থেকে সিগারেটের ধোঁয়া নিচ্ছো এজাতীয় ছবি।
আহনাফ স্বাভাবিকভাবে বলল,
তোমার সাথে আমার যখন সম্পর্ক হয়, একটা কথা বলেছিলাম মনে আছে?
কি কথা?
আমি মানুষটা অনেক খারাপ। জঘন্য। কিন্তু তোমার জন্য আমি সব ছাড়তে চাই। কি বলেছিলাম?
হুঁ।
আমি প্রচুর নেশা করতাম, অমানিশা। গাঁ*জা, ই*য়া*বা, ম*দ আমার নিত্যদিনের সঙ্গী ছিল। কিন্তু তুমি আমার জীবনে আসার পর আমি স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার চেষ্টা করছি। এখন যদি আমার অতীত নিয়ে আমায় খোঁচাও, আমি কিভাবে পাল্টাবো বলো? – রূঢ় গলায় প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল আহনাফ।
আমি তো তোমায় খোঁচা মারি নি! একটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করেছি।
এসব ছবি তোমাকে কে দেখিয়েছে? শিরিন?
নাম বলব না।
শিরিন ছাড়া আর কেউ না আমি জানি। ও তো মাহাদীর সাথে প্রেম করে। মাহাদীর সাথে আমার সম্পর্ক ভালো না। ওই এসব ছড়িয়ে বেড়ায়।
অমানিশা চুপ করে রইল। আহনাফ পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে জিজ্ঞেস করল,
আচ্ছা, এখন বলো আমাদের বাবু কেমন আছে? আমার বউয়ের শরীরও বা কেমন?
আমি একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, আহনাফ।
কি সিদ্ধান্ত?
আমি এবোরশন করব।
কি? – বিস্মিত গলায় জিজ্ঞেস করল আহনাফ।
অবশ্যই তুমি এবোরশন করবে না। তোমার পেটের বাচ্চা শুধু তোমার একার নয়। আমারোও বাচ্চা। তুমি একা সিদ্ধান্ত নিতে পারো না।
অমানিশা স্বাভাবিক গলায় বলল,
তোমার সাথে যোগাযোগ করার অনেক চেষ্টা করেছিলাম। ব্যর্থ হয়েছি। তাই আমি নিজে ডাক্তারের সাথে কথা বলে এবোরশনের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। টাকাও ম্যানেজ করে ফেলেছি।
ফোনের অপরপ্রান্তে থাকা আহনাফের চোখদুটো চিকচিক করে উঠল। সে আগ্রহের সাথে জানতে চাইল,
কত টাকা?
দশ হাজার।
তুমি আগামীকালকেই ওই টাকা আমাকে দিয়ে দিবে। আমি তোমাকে বিন্দুমাত্র বিশ্বাস করতে পারছি না। তোমার কাছে টাকা থাকলে তুমি আমার বাচ্চাকে মেরে ফেলবে।
অমানিশা ভ্রুঁ কুঁচকে বলল,
এসব কি বলছো তুমি?
ঠিকই বলছি। আগামীকাল আমাকে পুরো দশ হাজার টাকাই দিয়ে দিবে।
তুমি কি আমাকে বিয়ে করবে?
বিয়ে করার প্ল্যান ছিলো। কিন্তু বাবার এই অবস্থায় বিয়ে করা কিভাবে সম্ভব বলো?
বিয়ে করা সম্ভব না, আবার এবোরশন করতে দিবে না! মাথা ঠিক আছে তোমার?
আচ্ছা তোমার যদি এবোরশন করতেই হয়, আমি নিয়ে গিয়ে করাবো। তুমি একা গিয়ে করতে পারবে না।
কিন্তু আহনাফ! – অমানিশা কিছু একটা বলতে চাইছিল। তাকে থামিয়ে দিয়ে আহনাফ বলল,
প্রথমবারের মত বাবা হতে যাচ্ছিলাম। পরিস্থিতির জন্য তাকে দুনিয়ার আলো দেখাতে অক্ষম আমি। অত্যন্ত তার মৃত্যুর সময়টায় আমাকে কাছে থাকতে দাও, নিশা! আমি অনুরোধ করছি।
আহনাফের কথা শুনে নিজেকে আর শক্ত রাখতে পারল না অমানিশা। কেঁদে ফেলল। বলল,
ঠিকাছে, তুমি যা বলবে তাই হবে। কিন্তু আমায় কথা দাও, কখনোই এভাবে যোগাযোগ ছাড়া থাকবে না আর?
কথা দিলাম, বউ আমার! – আদুরে স্বরে বলল আহনাফ।
তাহলে আমরা কিভাবে আগাবো এখন? – চিন্তিত গলায় জিজ্ঞেস করল অমানিশা৷
আমার এক ফুপাতো বোন আছে ডাক্তার। আমি ওর সাথে কথা বলে তোমাকে জানাবো কেমন?
ঠিকাছে।
আই লাভ ইউ, বউ।
আই লাভ ইউ টু।
আমাদের বাবুটাকেও জানিয়ে দিও, পাপ্পা লাভ হিম অর হার সো মাচ।
অমানিশা ভেজা চোখে হাসল। ফোন কেটে দিয়ে স্বস্তির শ্বাসও ফেলল। শুধু শুধু অতিরিক্ত চিন্তা করছিল সে! আর শিরিনেরও বলিহারি যাই। ছবিগুলো এভাবে দেখানোর কি আছে? মানুষের অতীত থাকতেই পারে। সেখান থেকে ফিরে আসাটাই মুখ্য। আহনাফ, তাকে ভালোবাসে। সেও আহনাফকে ভালোবাসে। এই চরম সত্যকে ঠেকাবে কার সাধ্য?
(চলবে…)