গল্প: অমানিশার মধ্যরাত
লেখিকা: আতিয়া আদিবা
#৮ম_পর্ব (১৮+ সতর্কতা)
পরেরদিন অমানিশা আর স্কুলে গেলো না। অসুস্থতার বাহানায় বাসায় রয়ে গেলো। দুপুরে যখন রাহেলা ঘুমাচ্ছিল ঠিক সেসময় আহনাফ এলো অমানিশার সাথে দেখা করতে।
বাসার সামনে ছোট্ট একটি গলি আছে। সেই গলি দিয়ে কিছুটা পথ হাঁটলে বামদিকে একটি পঁচা পাগাড়ের দেখা মিলে। সেখানে দাঁড়িয়েই আহনাফ অপেক্ষা করছিল।
অলস দুপুর। খাবারের পর্ব চুকিয়ে প্রায় সবাই বিশ্রাম নিচ্ছে। কারেন্টের তারে বসে কাকগুলোও ক্লান্ত ভঙ্গিতে ঝিমাচ্ছে।
অমানিশা নিঃশব্দে বাসা থেকে নেমে আহনাফের কাছে চলে গেলো। সৌভাগ্যক্রমে, পরিচিত কারো সাথে পথে দেখা হলো না।
পাগাড়ের পাশে বেশ কয়েকটি পরিত্যক্ত টিনের ঘর রয়েছে। বড় বড় গাছে ঘেরা এই ঘরগুলোতে বহু আগে একটি হিন্দু পরিবার থাকত। তারা চলে যাওয়ার পর এই স্থানটি অনেকটা জংলা স্থানে পরিণত হয়েছে। আশেপাশের বিল্ডিং গুলোর শুকনো ময়লাও সামনের ওই পাগাড়ে ফেলা হয়।
অমানিশা গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে গেলো আহনাফের কাছে। গাছের ফাঁকে বসে নাম না জানা কোন পাখি যেন ডাকছে! মৃদুমন্দ বাতাসে ময়লার দুর্গন্ধ। তবুও প্রেমিককে দেখার ইচ্ছার কাছে পারিপার্শ্বিক পরিবেশ বড় ঠুনকো।
আহনাফ অমানিশাকে দেখে হাসল। একটু কাছে এগিয়ে যেতেই তাকে টান দিয়ে নিজের বুকের সাথে মিশিয়ে ফেলল।
একটি টিনের ঘরের দরজা ভাঙ্গা ছিল। সেই ঘরের ভেতর ঢুকল তারা। আহনাফ হাঁটু গেড়ে বসে অমানিশার পেটে আলগোছে চুমু খেল। অস্ফুট স্বরে বলল,
আমার বাচ্চা!
এরপর অমানিশার ঠোঁটে গভীরভাবে চুমু খেল। শক্ত করে জড়িয়ে ধরে অনুনয়ের স্বরে বলল,
আমি সত্যিই অনেক লজ্জিত, নিশা। যেসময় আমার তোমাকে মানসিক সাপোর্ট দেওয়া প্রয়োজন ছিল, সেসময় আমি তোমার পাশে থাকতে পারিনি।
অমানিশা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
তুমি তো ইচ্ছা করে করো নি। পরিস্থিতিই তোমার বিপরীতে ছিল। এখন এসব বাদ দাও।
ঠিকাছে, বাদ দিলাম।
আংকেল কেমন আছেন এখন?
ওষুধ খাচ্ছেন। বাবা আসলে মেন্টালি অনেক ভেঙ্গে পড়েছেন। পরিবারের এই অবস্থা। টাকা পয়সার টানাটানি। আমার পড়াশোনাটাও তার জন্য ছাড়তে হল। তিনি এত চাপ একসাথে নিতে পারছেন না। নিজের মৃত্যু কামনা করে চলেছেন সবসময়।
‘আহারে!’ অমানিশা বেদনাগ্রস্ত হয়ে বলল,
আসলে উনারও তো খারাপ লাগে তোমাদের এ অবস্থায় দেখে। তুমি চিন্তা করো না। খুব শিঘ্রই সব ঠিক হয়ে যাবে।
আহনাফ অমানিশার কপালে চুমু খেয়ে বলল,
তুমি যখন বলছো, তাহলে হয়ত সব অবশ্যই ঠিক হয়ে যাবে। আমি তোমাকে অনেক বিশ্বাস করি। আমার বউ তুমি!
অমানিশা মিষ্টি করে হাসল। পরক্ষণেই শঙ্কিত চোখে চারিদিকে চোখ বুলিয়ে বলল,
এতক্ষণ আমার বাইরে থাকা যাবে না। মা ঘুম থাকতে থাকতেই ফিরে যেতে হবে।
আহনাফের চেহারায় দুঃখ প্রকাশ পেল। বলল,
আরেকটু সময় থেকে যাও প্লিজ?
অমানিশা বলল,
মা জাগনা পেয়ে আমাকে খুঁজবে। না পেলে বিশাল বড় ঝামেলায় পড়ে যাব।
আচ্ছা, তাহলে আর তোমাকে আটকে রাখা উচিত হবে না। টাকাগুলো দাও। আমি গিয়ে এবোরশনের ব্যবস্থা করি।
অমানিশা অন্তর্বাসের ভেতর থেকে দশ হাজার টাকা বের করে আহনাফকে দিল। চকচকে টাকাগুলো অত্যন্ত মনযোগের সহিত গুনে দেখল সে। এরপর অমানিশার দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে বলল,
চলো সামনের দোকান থেকে তোমাকে কিছু কিনে দেই।
কি কিনে দিবে? – আগ্রহের সাথে জিজ্ঞেস করল অমানিশা।
তুমি না আচার পছন্দ করো? চলো তোমাকে অনেকগুলো আচার কিনে দেই। আর এমনিতেও এসময় তো মেয়েদের টক খেতে ইচ্ছে করে!
অমানিশার চোখ হঠাৎ ভিজে উঠল। ব্যথিত কণ্ঠে বলল,
আর মাত্র কয়েকদিন! এরপর তো আমাদের বাবুটা আর দুনিয়াতে থাকবে না।
আহনাফের চোখেও জল এলো। এ জলে আবেগ নেই। অনুশোচনা নেই। অনুতাপ নেই। আছে শুধু ভণিতা। কিন্তু এই ভণিতা অমানিশা বুঝতে পারল না। অমানিশার মত সহজ সরল মেয়েরা আবেগহীন মায়াকান্নাকে বিশ্বাস করেই সর্বস্ব হারায়।
অমানিশা আহনাফের চোখ দুটো নিজের ওড়না দিয়ে মুছে দিল।
আহনাফ বলল,
আমাদের অনেকগুলো সুন্দর সুন্দর বাবু হবে। বাবা একটু সুস্থ হলেই আমি বাসায় আমাদের বিয়ের কথা বলব। তোমার থেকে দূরে থাকতে আর ভালো লাগে না। আমার আগোছালো জীবনটা গুছিয়ে দেওয়ার জন্য তোমাকে প্রয়োজন। আমাকে জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে গাইড করার জন্য হলেও তোমাকে প্রয়োজন। তুমি ছাড়া আজকাল আমি আমার অস্তিত্ব খুঁজে পাই না।
এপর্যায়ে আহনাফ অমানিশার হাতজোড়া নিজের বুকে আঁকড়ে ধরে বলল,
আমায় ছেড়ে কখনো যাবে না তো, অমানিশা? সবসময় আমার পাশে থাকবে তো?
অমানিশার কোমল হৃদয় আহনাফের প্রতিটি জটিল কথার গোলকধাঁধায় আটকে গেল। অবিশ্বাস তার দুয়ারে বেশ কয়েকবার কড়া নাড়লেও আহনাফ নিখুঁত কথার জাল বিছিয়ে, দ্বিধাগ্রস্ত করে বিদায় সেই অবিশ্বাসকে বিদায় জানিয়েছে! তার এই দক্ষতার কাছে সত্যিগুলোও আজ বড় অসহায়।
এভাবেই সমাজে ভালো মানুষের মুখোশ পরিধেয় আহনাফরা শুষে খাচ্ছে কতশত অমানিশাকে! নষ্ট করছে সম্মান, কেড়ে নিচ্ছে বেঁচে থাকার অধিকার। ধ্বংস হচ্ছে তাদের জীবন আর পরিবার।
অমানিশার চোখের জল গাল গড়িয়ে পড়ার আগেই সেই জল আলগোছে মুছে দিল আহনাফ। ভেজা গালে চুমু এঁকে পুনরায় জিজ্ঞেস করল,
কি থাকবে না আমার পাশে? হবে না আমার জীবনের রাণী?
হব। – শক্ত করে আহনাফকে জড়িয়ে ধরে আবেগমিশ্রিত কণ্ঠে জবাব দিল অমানিশা।
তার দৃষ্টি এড়িয়ে নিঃশব্দে দীর্ঘশ্বাস ফেলল আহনাফ। যেটুকু সন্দেহের পরগাছা অমানিশার মনে জন্মেছিল তা উপড়ে ফেলে দিতে পেরেছে সে। আহনাফ বলল,
অনেক কান্নাকাটি হয়েছে। এবার চলো তোমাকে আচার কিনে দেই।
আমার আচার লাগবে না।
একদম চুপ! অবশ্যই লাগবে। চলো।
খানিকটা জোর করেই অমানিশাকে অনেকগুলো আচার কিনে দিল আহনাফ। এরপর বিদায় জানিয়ে চলে গেল।
অমানিশার মাঝে যেটুকু সন্দেহের বীজ স্থাপিত ছিল, তা একদম শিকড় ছিড়েখুঁড়ে বেরিয়ে এলো। ধোঁকাবাজ হলে আহনাফের চোখে জল কেন আসবে? এ কঠিন প্রশ্নের উত্তর অমানিশার কাছে নেই বলেই হয়তো আরোও একবার বিশ্বাস করে ফেলল আহনাফকে।
অমানিশাকে বাসায় পাঠিয়ে দিয়ে আহনাফ রিক্সায় উঠে আবিরকে ফোন করল।
রাফির কাছে কয় পিস ই*য়া*বা আছে রে এখন?
আবির জবাব দিল,
পঁচিশ পিসের মত এখনো আছে।
ওকে বিশ পিস নিয়ে আমার বাসায় আসতে বল।
আবির বিস্মিত স্বরে জিজ্ঞেস করল,
টাকা ম্যানেজ করা শেষ?
আহনাফ প্রত্যুত্তরে গর্বিত ভঙ্গিতে শব্দ করে হাসল। আবির খুশিতে গদগদ হয়ে বলল,
তুই মামা পাকা খেলোয়াড়! কথা দিয়েই কিভাবে পটিয়ে টাকা পয়সা হাতিয়ে নিস বল তো?
তোকে বলে লাভ নেই। তুই সবকিছু জেনেশুনেও এভাবে টাকা নিতে পারবি না। গার্লফ্রেন্ডের কাছে এক হাজার টাকা চাইতেই যে নাটক শুরু করিস! – হতাশ গলায় বলল আহনাফ।
লজ্জা লাগে বন্ধু। – মিনমিন করে বলল আবির।
বন্ধুর গার্লফ্রেন্ডের টাকায় নেশা করতে লজ্জা লাগে না, বা*ই*ঞ্চো*দ কোথাকার? – আহনাফের রূঢ় গলা শোনা গেল।
আবির গলা উঁচু করে বলল,
তোকে সাপ্লাইয়ারদের ইনফরমেশন কে দেয় রে, হারামজাদা?
একদম ধন্য করে ফেলিস আমার জীবন, শালা। তুই না খবর দিলে বোধহয় ওদের আমি খুঁজে পেতাম না? আজাইরা না বকে, রাফিকে নিয়ে বাসায় আয়।
উল্লাসিত স্বরে আবির বলল,
সারারাত আজ পার্টি হবে বস!
দুইজন মিলে কি আর পার্টি করব? টসটসে দুটো ফুলকলিও ম্যানেজ কর। চারজন একসাথে পার্টি করব নি। পাশের ইউনিট একদম ফাকা। রুমও আছে দুটো। কোনো সমস্যা হবে না।
আবির দুষ্টমির হাসি হাসল। বলল,
ফুলকলিদের ব্যবস্থা হয়ে যাবে। আমি আসছি রাফিকে নিয়ে। রাখছি।
আহনাফ ঠোঁটের কোণে হাসি ঝুলিয়ে ফোন কেটে দিল। মাঝে মাঝে নিজেকে নিয়ে তার বড় গর্ব হয়। সুন্দর চেহারা আর কথার জালে অল্পবয়স্ক মেয়েদের সে কয়েকবছর ধরেই আবদ্ধ করে চলেছে। বিষয়টি তার কাছে আনন্দদায়ক। অগুনিত মেয়ের সাথে তার পরিচয় হয়েছে। তবে তারা কেউই অমানিশার মত অবুঝ এবং বোকা ছিল না।
মাঝে মাঝে অমানিশার জন্য তার সহানুভূতি কাজ করে। মনে হয়, মেয়েটাকে আর ঠকানো উচিত হবে না। কিন্তু ওকে ছেড়ে দিলে নেশার টাকাগুলো আসবে কই থেকে? আহনাফের জীবনে নেশা আর নারীর চেয়ে চরম সত্য কিছু নেই।
(চলবে…)