অমানিশার মধ্যরাত পর্ব-১১

0
3169

#অমানিশার_মধ্যরাত
#পর্ব_এগারো
লেখিকা: #আতিয়া_আদিবা
(১৮+ সতর্কতা)

মোবাইল স্ক্রিনে আহনাফের নাম দেখে দ্বিধাগ্রস্ত অমানিশা আরোও জোরে জোরে শ্বাস ফেলতে লাগল। সে ফোন রিসিভ করল না। মাটির দিকে অসহায় ভঙ্গিতে তাকিয়ে রইল।
প্রথমবার রিং হতে হতে কল কেটে গেল। তবে আহনাফও যেন ক্ষান্ত হল না!
কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানে পুনরায় ফোন ভাইব্রেট করে উঠল অমানিশার।
এবার অমানিশা কাঁপা হাতে কল কেটে দিল।

মুনা জোভানের সাথে কথা শেষ করে ফিরে এল। অমানিশার হাতে খাবারগুলো আগের অবস্থাতেই রয়েছে। সে বেশ বিরক্ত হল। কঠিন গলায় বলল,
তোকে না বললাম কেকটা খেয়ে নে?

অমানিশা শান্তভাবে বলল,
খেতে ইচ্ছে করছে না, দোস্ত। খেলেই বমি হয়ে যাবে।

বমি হলে হবে। তুই তাও কেকটা খেয়ে পানি খাবি। এক্ষুণি খাবি।
বেশ কড়াকড়ি ভাবে আদেশ করল মুনা।

অমানিশা মুচকি হাসল। সে হাসিতে কোনো জ্যোতি নেই। মুখমন্ডলে যেন অন্ধকারের দৌরাত্ম্য। অনিচ্ছা সত্ত্বেও বান্ধবীর মন রক্ষার্থে কেক খাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল সে।
মুনা বলল,
জোভানকে বললান ল্যাপটপ বিক্রি করে দেওয়ার কথা।

মুখে খাবার নিয়েই অমানিশা আগ্রহভরে জিজ্ঞেস করল,
কি বলল ভাইয়া?

কত টাকাতে বিক্রি করতে পারবে তা সঠিক বলতে পারল না।

অমানিশা হড়বড়িয়ে বলল,
দোস্ত আমার হাজার দশেক টাকা হলেই চলবে।

মুনা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বলল,
জোভান এখন কোন এক গুরুত্বপূর্ণ কাজে ব্যস্ত আছে। বিকালের আগে আসতে পারবে না।

অমানিশা মুনাকে আশ্বস্ত করে বলল,
পাঁচটার মধ্যে আসলেই চলবে।

মুনা ইতস্তত করে বলল,
দোস্ত, আমার বাসায় জানে আজকে স্কুল বন্ধ। আমি এতক্ষণ বাহিরে থাকতে পারব না।

অমানিশার কপালে পুনরায় চিন্তার রেখা স্পষ্ট হল। তাহলে এখন উপায়? বিকাল পর্যন্ত সে একা কোথায় থাকবে? মুনাকে অনুরোধ করে বলল,
জোভানকে একটু বল না দ্রুত আসতে। ল্যাপটপটা নিয়ে গেলেই হবে।

আমি বলেছি। ওর একদমই সময় নেই।

জোভান ভাইয়ার এমন কোনো বিশ্বস্ত কেউ নেই যার কাছে ল্যাপটপটা দিয়ে দেওয়া যাবে? – ভ্রুঁ কুচকে জিজ্ঞেস করল অমানিশা।

দাঁড়া, শুনে দেখছি। – মুনা পুনরায় জোভানকে ফোন দিয়ে বিষয়টি নিয়ে কথা বলল। কিন্তু কোনো উপায়ের সন্ধান মিলল না। জোভানের তেমন বিশ্বস্ত কেউ নাকি নেই!

দুঃসময়ে মানুষ ভুল সিদ্ধান্তে উপনীত হয়। অমানিশার ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রমী কিছু ঘটল না।
আহনাফ আরোও একবার অমানিশাকে ফোন করতেই সে রিসিভ করল।
আহনাফ বাজখাঁই গলায় বলল,
ফোন দিলে ফোন ধরস না কেন, মাগী? কোন ভাতারের সাথে মারাইতে গেছস?

গলার স্বর কিছুটা শক্ত করে অমানিশা বলল,
বাজে কথা বলো না, আহনাফ।

মাগী দেখি আমাকে চুপ করতে বলে! – আহনাফ আরোও ক্ষেপে গেল।
তুই আজকে বাসা থেকে বের হয়েছিস কেন? আজকে তো স্কুল বন্ধ!

অমানিশা বিস্মিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,
তোমাকে কে বলেছে?

সেটা তোকে কেন বলব? ওওও… বে*শ্যা*গিরি ধরা পড়ে গিয়েছে সেজন্য চিন্তা হচ্ছে? কোন বয়ফ্রেন্ডের সাথে দেখা করতে বের হয়েছিস?

আহনাফের ব্যবহারে অমানিশার চোখজোড়া টলমল করতে লাগল। সে ভাঙ্গা গলায় বলল,
বিশ্বাস করো, কোনো বয়ফ্রেন্ডের সাথেই বের হই নি। আমি একটা বিশেষ কাজে বের হয়েছি।

তোর আবার কিসের বিশেষ কাজ রে মাগী ? – আহনাফ মনে সন্দেহের বীজ নিয়ে প্রশ্ন করল।

অমানিশা এবার নিজেকে ঠিক রাখতে পারল না। রাস্তার পাশে দাঁড়িয়েই চিৎকার করে বলে উঠল,
এবোরশনের টাকা জোগাড় করতে। ল্যাপটপ বিক্রি করতে। তোমার কি কোনো টেনশন আছে আমাকে নিয়ে? ফোন দিয়ে বেশিরভাগ সময় তোমাকে পাওয়া যায় না। ভুলে যদি কখনও কল রিসিভও করো, উল্টো পাল্টা কথা বলো। অযথা গালাগাল দাও। মাঝে মাঝে মনে হয় নিজেকে শেষ করে দেই। আমি কি পাপ করে ফেলেছি তোমাকে ভালোবেসে?

মুনা পাশ থেকে অমানিশাকে শান্ত রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করতে লাগল।
দোস্ত! চিৎকার করিস না। আস্তে কথা বল। রাস্তার সবাই শুনতে পাবে।

অমানিশা শান্ত হল না। হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল। অবস্থা বেগতিক দেখে মুনা দ্রুত একটা রিক্সা ডাক দিল। অমানিশাকে নিয়ে রিক্সায় উঠে বসল। এরপর রিক্সাচালককে বলল,
মামা, টান দেন।

রিক্সাচালক অদ্ভুতভাবে অমানিশার দিকে একবার তাকাল। এরপর মুনাকে জিজ্ঞেস করল,
যাবেন কোথায়?

ঘারিন্দা।

রিক্সা চলতে শুরু করল। মুনা অমানিশার কাছ থেকে ফোন নিয়ে সুইচড অফ করে দিল। বলল,
তুই এখন আর আহনাফের সাথে কথা বলিস না। আগে ঠান্ডা হ।

অমানিশা মুনার কাধে মাথা রেখে নিঃশব্দে কাঁদতে থাকল। তার ভুলগুলো অনেকটাই উপলব্ধি করতে পেরেছে সে। কিন্তু সময় চলছে তার বিপরীতে।

ঘারিন্দা পৌঁছে ভাড়া মিটিয়ে দিল মুনা। রেল লাইনের কিনারা ঘেঁষে হাঁটতে লাগল তারা। রেললাইনের একপাশে বিশাল বড় একটি পার্ক। অপরপাশে সবুজ গাছগাছালি ঘেরা ছোট্ট একটি গ্রাম। বলা হয়, এই ছোট্ট গ্রামটির পাশেই সর্বহারা দের আতুরনিবাস।

খানিকটা পথ পেরোতেই অমানিশা অসহায় কণ্ঠে বলল,
আমি আর হাঁটতে পারছি না রে! আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে।

মুনা বলল,
আয় আমরা রেল লাইনের ওপর বসি। তুই একটু বিশ্রাম নিয়ে নে।

সূর্যটা ঠিক মাথার ওপর। গাছের ফাঁকফোকড়ে বসে পাখিগুলো মুখ হা করে ঝিমাচ্ছে। কি কাঠফাটা রোদ!
অমানিশা দরদর করে ঘামছে। আচমকা কোথা থেকে যেন বাচ্চা একটি ছেলে দৌঁড়ে এলো। প্লাস্টিকে মুড়িয়ে ঠান্ডা পানির বোতল বিক্রি করছে সে। অমানিশা বাচ্চা ছেলেটির কাছ থেকে এক বোতল পানি কিনে নিল। আয়েশ করে অর্ধেক বোতল পানি খেল।

মুনা ছটফট করছে। তার বাসায় ফিরতে হবে। ব্যাগ থেকে ফোন বের করে দেখল তার ফোনটাও বন্ধ হয়ে গেছে।
শীট! – দাঁতের ফাঁক আলগোছে বলে উঠল মুনা।

কি হয়েছে? – জিজ্ঞাসু চোখে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল অমানিশা।

মুনা বলল,
আমার ফোনে চার্জ নেই। মোবাইল বন্ধ হয়ে গেছে। আম্মু যদি আমাকে ফোন করে না পায়?

আমার মোবাইল থেকে কল করে কথা বল। সমস্যা নেই তো! – এ কথা বলে অমানিশা মোবাইল সুইচড অন করল।

ফোন অন করতে যা দেরি! আহনাফের কল ঢুকতে এক মুহুর্ত সময়ও লাগল না।

মুনা বিরক্ত হয়ে বলল,
এই ছেলে কি এতক্ষণ যাবৎ তোর নাম্বারে বিরামহীন ট্রাই করে গেছে?

জানি না। একটু রিসিভ করে শুনব কি বলে? – অনুনয়ের স্বরে জিজ্ঞেস করল অমানিশা।

মুনাও এবার রাজি হয়ে গেল।

ফোন রিসিভ করার সাথে সাথে আহনাফ নরম কণ্ঠে বলল,
তুমি কোথায় আছো, জান?

ঘারিন্দা।

ঘারিন্দা কি করো?

কিছুই না।

স্কুলের সামনে চলে আসো তুমি। এ অবস্থায় এভাবে ঘোরাঘুরি করছো কেন? শরীর খারাপ করবে তো! – আহ্লাদী গলায় বলল আহনাফ।

অমানিশা ক্ষিপ্র গতিতে উত্তর দিল,
শরীর খারাপ হলে হবে। সেটা নিয়ে তোমার দুশ্চিন্তা করার কোনো প্রয়োজন নেই।

আমি কথা বাড়াবো না। শুধু এটুকু বলব, তোমার স্কুলের সামনে অপেক্ষা করছি। তোমাকে না দেখে আমি আজ বাড়ি ফিরব না। এখন কি করবে ভেবে দেখ। – আহনাফ ফোন কেটে দিল।

অমানিশা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। মুনা ভ্রুঁ কুঁচকে জিজ্ঞেস করল,
কি হয়েছে? কি বলল আহনাফ?

স্কুলের সামনে নাকি আমার জন্য অপেক্ষা করছে। না দেখা করে বাড়ি ফিরবে না। – হাসার চেষ্টা করল অমানিশা।

তুই কি করতে চাস?

চল তাহলে স্কুলের সামনে ফিরে যাই আবার। – একথা বলতে বলতে অমানিশা বসা থেকে উঠে দাঁড়াল।
তৎক্ষণাৎ এক অপ্রত্যাশিত বিপত্তি ঘটল।
পুনরায় অমানিশার ফোনটি ভাইব্রেট করে উঠল। স্ক্রিনে ভেসে থাকা নাম্বার দেখে অমানিশার চোখ দুটো বড় বড় হয়ে গেলো। হাত পা জমে যায় যায় অবস্থা! শরীর কাঁপতে লাগল অনবরত।
অমানিশার হাল দেখে মুনা বেশ ভড়কে গেল। বলল,
কি হয়েছে তোর? এমন করছিস কেন?

অমানিশা কাঁপা গলায় বলল,
আমার ফোনে মায়ের নাম্বার থেকে কল আসছে!

কি বলছিস এসব? তোর নাম্বার কোথা থেকে পেল?

জানি না। কিচ্ছু বুঝতে পারছি না আমি।

আন্টি কি জেনে গেলো নাকি সব? কি করবি এখন? – ভয়ার্ত গলায় মুনা জিজ্ঞেস করল।

আমার মাথা কাজ করছে না। চল আগে স্কুলের সামনে যাই। আহনাফের সাথে দেখা করি। রিক্সা ডাক দে।

কল রিসিভ না করলেও অনবরত অমানিশার নাম্বারে রাহেলা ফোন করতে লাগল। চোখ দিয়ে অনর্গল পানি পড়ছে তার। কাঁপা হাতে ধরে রয়েছে পুরোনো একটি প্রেগনেন্সি কীট।

(চলবে..)