#যাতনা_আমার
#সানজিদা_ইসলাম_সূচনা
#পর্ব: ১৩
গাড়িতে ব্যাগ পত্র সব ঠিকঠাক করে রেখে পিছনে ফিরে ইনায়া। বাড়ির প্রতিটি সদস্য তার দিকে অসহায় চোখে তাকিয়ে আছে। এই সুন্দর মেয়েটার সাথে এটা কাম্য নয়। শুভ্র রাঙা চুড়িদারে ইনায়া কে পুরো শুভ্র পরীর ন্যায় লাগছিল। ইনায়া সোহানা মির্জার দিকে এগিয়ে যায়। তাকে অনেকটাই বিধ্বস্ত লাগছে। ইনায়া মুচকি হেঁসে সোহানা জড়িয়ে ধরে শান্ত গলায় বলে,
-” তুমি এতো ভেঙে কেনো পড়ছো মামনী? হাসি খুশি বিদায় দাও। দেখবে, এখন থেকে আমি ভাল থাকব। আর কোনো সমস্যা হবেনা। ”
ইনায়ার কথায় সোহানার চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। তিনি নিজেও মানতে পারছেন না ইনায়ার চলে যাওয়াটা। সবটা তার একটা মাত্র ভুলের জন্যই হয়েছে। এই ভুলের শাস্তি তিনি কি দিয়ে চুকাবেন?
-” ক্ষমা চাওয়ার মত মুখ আমাদের নেই ইনায়া। তবুও মাফ করে দিস। ”
নাহিদ মির্জার কথায় তার দিকে তাকায় ইনায়া। সোহানা কে ছেড়ে দিয়ে শুষ্ক হেসে বলে উঠল,
-” এতে তোমাদের কোনো দোষ নেই। হয়তো এটাই আমার নিয়তি। ”
অতঃপর ইনায়া সবার থেকে বিদায় নেয়। নিপা কখন থেকেই কেঁদে যাচ্ছেন। তিনি ইনায়াকে খুব পছন্দ করতেন। আয়েশা মির্জার থেকে বিদায় নেওয়ার সময় তিনিও ইনায়া কে জড়িয়ে ধরে কাঁদলেন। যতই হোক ইনায়ার জন্য মন তার একটু হলেও কাঁদত। কিন্তু নাভানের জন্য তিনি নিরুত্তর ছিলেন। ইনায়া গাড়িতে উঠে বসে বাড়িটার দিকে তাকালো। ভেতর থেকে দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে। বাবা মা ঘরবাড়ি ফেলে যে বাড়িতে ঠাঁই হয়েছিল স্বামীর বাড়ি নামে। সেটাও আজ তাকে ফেলে যেতে হচ্ছে। আয়েশা মির্জা ঠিকই বলত, স্বামীর বাড়ির সুখই স্বামী দিয়ে হয়। বাকি সবতো আজ আছে কাল নেই ভাবছে ইনায়া। নিধি যাবে ইনায়ার সাথে। সোহানা মির্জা একবারের জন্যে ইনায়ার সাথে কোনো বাক্য বিনিময় করেনি। তিনি এক ধ্যানমগ্ন ইনায়ার গাড়ির দিকে। যেটি ধিরে ধিরে শান্তি ভিলার মূল ফটকের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। ইনায়া ও জানলা দিয়ে মাথা বের করে তাকিয়ে থাকে প্রাসাদের ন্যায় মির্জা ভিলার দিকে। ভেতর থেকে কেউ যেন বলে উঠছে
” রেখো না আর পিছুটান, ছেড়ে দাও আশা। মন গহীনে থাকুক শুধু তোমার একার ভালবাসা। ”
পুরো রাস্তা চুপচাপ বসে ছিল ইনায়া। নিধিও তাকে আর কিছু বলেনি। হলে ডুকে নির্ধারিত রুমে চলে আসে তারা। রুমের দরজা ভিতর থেকে ভিড়ানো। নিধি দরজা খুলে ভিতরে ব্যাগ নিয়ে ঢুকে পরে। রুমের ভেতর কাউকেই পায়না তারা। রুমে তিনটা স্টিলের বেড। একপাশটা সাজানো, অন্য পাশের খাটে ইনায়া আর নিধি অনেক্ক্ষণ সময় নিয়ে সব ঠিকঠাক করে নেয়। প্রায় দুপুর গড়িয়ে বিকাল হয়ে আসে। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে তারা। কিন্তু তিথির কোনো দেখা পায়না।
-” ভাবি কেউই তো আসছে না। আমি আর কতক্ষণ বসে থাকব? ”
-” তাইতো, তুমি বরং বাড়ি যাও। আমি এদিকটা সামলে নেব। ”
নিধি সায় জানিয়ে চলে যায়। ইনায়া দরজা লাগিয়ে ওয়াশরুমে যায়। অনেকটা সময় যাওয়ার পরে ইনায়া গোসল শেষে রুমে আসে। ব্যাগ থেকে সাদা রঙের বক্স নিয়ে খেতে বসে। নিপা বিরিয়ানি করে দিয়েছিল তার জন্য। মনটা খারাপ করে ইনায়ার। আজকে যেন সত্যিই তার পৃথিবী শুন্য মনে হচ্ছে। খাওয়া শেষে শুয়ে পরে ইনায়া। চোখটা হালকা ভিড়তেই দরজার খটখট শব্দে ঘুম ভাঙ্গে ইনায়ার। দরজার আওয়াজ কঠিন থেকে কঠিন হচ্ছে। ইনায়া হন্তদন্ত হয়ে দরজা খুলতেই ওপাশে ট্রি শার্ট আর প্যান্ট পরহিত একটা সুন্দর মেয়েকে দাড়িয়ে থাকতে দেখে। ইনায়া বুঝে নেয় ওই হয়তো তিথি। সে মুখে হাসি নিয়ে জিজ্ঞেস করে,
-” আমি ইনায়া! তুমি বোধহয় তিথি? ”
-” সামনে থেকে সরো। ”
কর্কশ কন্ঠে বলে উঠা তিথির দিকে তাকিয়ে রয় ইনায়া। ঠোঁট নাড়িয়ে কিছু বলতে যাবে তার আগেই তিথি তাকে ধাক্কা দিয়ে ভেতরে চলে যায়। আচমকা ধাক্কা খেয়ে দেয়ালে পিঠ ঠেকে যায় ইনায়ার। সে চোখ বড়সড় করে তিথির দিকে তাকিয়ে থাকে। তিথি রুমে ঢুকে ওয়াশরুমে চলে যায়। ফাহাদ বলেছিল তিথি প্রচুর রাগী। তাই বলে এমন ব্যবহার?
ইনায়া পিঠে প্রচন্ড ব্যথা পেয়ে খাটে বসে পরে। কিছুক্ষণ বাদে রুমের ভিতর আরও দুটো মেয়ে ঢুকে। তারা ইনায়ার সামনে এসে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে বলে ওঠে,
-” নাম কি? ”
-” ইনায়া ”
-” শুধু ইনায়া আগে পিছে কিছু নাই?
ইনায়া ভ্রু কুঁচকে মেয়ে দুটোর দিকে তাকিয়ে থাকে। তাদের বেশভুশা কিছুটা তিথির মতোই। ইনায়া নিজেকে ধাতস্থ করে চৌকস কন্ঠে বলে,
-” আমার পুরো নাম জেনে তোমারা কি করবে? আর কে তোমরা? ”
-” এই রুমের প্রাক্তন বাড়িওয়ালী আমরা। যাদের, তোমার জন্য ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দেওয়া হয়েছে। ”
ইনায়া কিছুই বুঝতে পারল না। তখনই তিথি ওয়াশরুম থেকে বেড়িয়ে ওদের মাঝখানে এসে দাঁড়ায়। হাত দুটো ভাজ করে কঠিন স্বরে ইনায়াকে ব’লে,
-” বের হও রুম থেকে। আমরা এখন আড্ডা দেবো।”
ইনায়া একটু অ বাক হয়ে বলল,
-” তা দাও আড্ডা! আমি বের হবো কেন? ”
তিথি এবার গলা চেচিয়ে বলে ওঠে,
-” একদম কারণ জিজ্ঞেস করবে না। তোমার মতো থার্ড ক্লাস মার্কা কোথাকার কোন ফুপাতো বোনের জন্য ভাইয়া আমার ফ্রেন্ড’দের অন্য রুমে শিফট করিয়েছে। এমনিতেই মেজাজ গরম আছে। আরও বেশি কথা বললে ওই সুন্দর মুখশ্রী আর থাকবেনা। বেড় হও এক্ষুনি বলছি।
ইনায়া ঠাঁই বসে রয়। কি বলবে খুঁজে পাচ্ছে না। এখানে এসে এমন পরিস্থিতিতে পরতে পারে মাথাতেই আসেনি। তিথির পাশে দাঁড়ানো তার দুই বান্ধবী মিশু আর দিবা এবার ইনায়ার হাত চেপে ধরে। বসা থেকে উঠিয়ে টানতে টানতে দরজার বাইরে নিয়ে দার করিয়ে মেকি হেঁসে বলে,
-” টেনশন করো না বেবি গার্ল। আমরা চলে গেলে রুমে এসো। ”
বলেই দরজাটা হুট করে লাগিয়ে দেয় তারা। ইনায়া এবার কেদে ফেলে। এই রকম পরিস্থিতিতে কি করবে এখন? আর কতক্ষণ এভাবে দরজার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা যাবে। ইনায়া এবার আসে পাশে তাকায়। সন্ধা হয়ে যাওয়া তে মেয়ে গুলো হলে ঢুকে যাচ্ছে সবাই। এখানে রাত আটটার পর হলের গেইট বন্ধ হয়ে যায়। আসে পাশের রুমের মেয়েরা তার দিকে অদ্ভুত নজরে তাকিয়ে আছে। ইনায়া এবার চোখের পানি মুছে দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। রাত বাড়ছে, সময় প্রায় নয়টারও বেশি। কিন্তু এখনো মেয়ে গুলোর দরজা খুলার নামও নেই। ইনায়া দুএকবার ডেকেও সাড়া পায়নি। তিথির ব্যবহারে ইনায়া অনেক রুষ্ট। যেখানে বাবা-মা বড় ভাই এতো ভাল। সেখানে তিথির এমন উগ্রতা মানছে না। হঠাৎ জায়ানের কথা মনে হলো ইনায়ার। আছে তো, গুন্ডার বোন তো গুন্ডামীই করবে। এ পুরো জায়ানের মতোই হয়েছে। ভাই গুন্ডামি করে মিশু দিবাকে রুমের বাইরে বের করছে। আর বোন এখন ইনায়াকে। কে বলেছে এভাবে তাকে হলে আনতে? প্রচন্ড রাগ হয় ইনায়ার।
অফিসের বারান্দায় ইজি চেয়ারে বসে আছে ফাহাদ আর জায়ান। একটু পরেই তাদের গুরুত্বপূর্ণ মিটিং আছে একটা। জায়ানের হাতে বিপ, সে একটু পর পর সেটা ফুঁকছে। চোখ তার নিচে হাইওয়ের দিকে। কিছু একটা গভীর ভাবনায় তার। ফাহাদ গভীর মনে একটা ফাইল ঘাটাঘাটি করছে। সে ডিসিশন নিয়েছে সামনে আর ইলেকশন করবে না। এই জীবনে এসে শুধু প্যারা। বাবা ঠিকই বলে মন মতো নিজের লাইফ লিড করা যায়না রাজনীতিতে। তবু সে বাবার কথার বিরুদ্ধে থাকত। তার মনে হত পাওয়ায়ই জীবনের সবচেয়ে বড় বিষয়। কিন্তু প্রেমে ছ্যাঁকা খেয়ে তার চোখমুখ খুলেছে।
-” সামওয়ান হিট মি ভেরি হার্ট। ”
হঠাৎ জায়ানের কথায় ফাহাদের ভাবনারা গত হয়। সে ফাইল থেকে মুখ উঠিয়ে বিস্ময় নিয়ে বলে,
-” কখন? কোথায়? বল আমাকে। ”
-” সাপ্তাহ খানেক আগে। আমার মনে। ”
জায়ান অন্ধকারে তাকিয়ে গম্ভীর মুখে বলে।
ফাহাদ চোখমুখ কুঁচকে বিরক্ত সহিত ব’লে,
-” এতো দিনে বলছিস গাধা? লোকে তো এবার আমাকে ছি ছি করবে। যে মেয়র ফাহাদ করিমের ভাইয়ের মনে কেউ আঘাত করেছে। আর গাধা মেয়র তার ভাইকে ন্যায্য বিচার করে দেয়নি। না না, এই অপবাদ নিয়ে আমি এমপির আসন ছাড়ছি না। নাম বল একবার। পুরো গুষ্ঠি তুলে নিয়ে আসব। ”
আমার একটা মানসম্মান আছে নাকি?
জায়ান একবার ফাহাদের দিকে তাকিয়ে সামনে দৃষ্টিবদ্ধ করে। হালকা হেসে, তারপর কটুক্তি স্বরে বিদ্রুপের সহিত বলে,
-” তার আগে লোকে এটা বলবে যে মেয়র ফাহাদ করিম নিজের মন ভাঙারই বিচার করতে পারেনি। সে ভাইয়ের টা আবার কি দেখবে? ”
ফাহাদ এবার চটে গেল। সে কন্ঠে তেজ এনে চিবিয়ে চিবিয়ে বলে ওঠে,
-” সেটা তোর জন্যই আমি করতে পারিনি। নাহলে দেশবাসী জানতো ফাহাদ করিমের মন ভাঙার শাস্তি কি হতে পারে। আর তুই আমাকে কথায় কথায় খোঁচা মারিস। যা তোকে আর কোনো হেল্প করছিনা। মিটিং এর সময় হয়েছে চললাম আমি। ”
ফাহাদ রেগে গিয়ে চলে যায়৷ জায়ান তার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে হেঁসে ওঠে। তারপর জোর গলায় বলে উঠে,
-” জায়ানের জন্য সে নিজেই যথেষ্ট ভাই। ”
-” তুমি এভাবে দাঁড়িয়ে আছো কেনো? কোন রুম? কোন ডিপার্টমেন্ট? ”
হঠাৎ একটা মেয়েলি গলার আওয়াজ শুনে সামনে তাকায় ইনায়া। তার থেকে বছর দুই বড় হবে। একটা সুন্দর মেয়ে দাড়িয়ে আছে। ইনায়া একবার রুমের দিকে তাকিয়ে মাথা উপর নিচ করে।
-” ডিপার্টমেন্ট অফ পলিটিক্স। আমি ইনায়া। ”
-” আমি শ্রুতি। তোমাদের ডিপার্টমেন্টেরই স্টুডেন্ট।আমার সাথে এসো তুমি ।”
মেয়েটি যেন তার সকল প্রশ্নের জবাব পায়। সে ইনায়ার হাত ধরে তার রুমে নিয়ে যায়। সেখানে আরও দুজন ছিল। তাদের সাথে ইনায়াকে বসতে বলে ফোন নিয়ে বাইরে যায়। তারপর কাউকে ফোন ঢুকিয়ে রিসিভ হতেই বলে,
-” জায়ান স্যার আপনি যেমন ধারনা করেছিলেন তাই হয়েছে। ওরা ইনায়া কে বের করে দিয়েছে রুম থেকে। ”
অপরপাশে থাকা জায়ান যেন ভিষণ চটে গেল। সে শ্রুতিকে সর্বদাই রেখেছে তিথির আপডেট দিতে। বাজে ফ্রেন্ডদের সাথে মিশে ব্যবহার পুরোই বিগরে গেছে। তাই বুদ্ধি করেই দু’ভাই ইনায়ার সাথে তাকে রাখতে চেয়েছিল। কিন্তু তিথি যে এতোটা রুড বিহেব করবে ইনায়ার সাথে সে এটা ভাবেনি। জায়ান এবার শ্রুতি কে কঠিন স্বরে বলে,
-” তুমি ইনায়ার সাথে থেকো। আর সকল আপডেট দিও আমাকে। কালকে তিথির সাথে কথা হচ্ছে। ”
বলে ফোন রেখে দেয় জায়ান। পার্টি অফিসের একটা ঝামেলার গুরুত্বপূর্ণ মিটিং করছিল জায়ান। শ্রুতির ফোন আসায় সে মিটিং ছেড়ে বারান্দায় এসে কথা বলছিল। আচমকা তিথির উপর তার প্রচুর রাগ হয়। ইনায়ার সাথে তিথি এমন করবে সেটা তার মাথাতেও আসেনি। এতো রুড কবে হল তার বোন? কাল মুলাকাত করবে সে।
এদিকে প্রায় এগারো টার পর দরজা খুলে তিথি। তার ফ্রেন্ড গুলো যেতেই আশেপাশে তাকিয়ে ইনায়া কে খুঁজে। কই গেল মেয়েটা? আবার কিছু হলোনা তো? সে এবার বিরক্ত হয়ে রুমে গিয়ে শুয়ে পরে। নিজের প্রতি রাগ হচ্ছে। ভাইয়ের রাগ ইনায়ার উপর না ঝাড়লেও পারত। কিন্তু কি করবে? ফ্রেন্ডশিপের থেকে বড় কিছুই নয় এটা তার ধারনা। অনেক্ক্ষণ গল্প করে রুমে আসে ইনায়া। দরজা টা ভিড়ানো ছিল। ড্রিম লাইটের আলো মিটমিট করে জলছিল। ইনায়া টেবিল থেকে ফোন নিয়ে ফ্লাশ অন করে। বিছানায় যেতেই দেখতে পায় সেটা ভিজানো। ইনায়া ঢেড় বুঝে এটা তিথি আর তার ফ্রেন্ড’দের কাজ। ইনায়া ব্যাগ থেকে একটা কাথা বের করে,মেঝেতে বিছিয়ে শুয়ে পরে। আজ রাতে তার ঘুম আসবেনা। চোখ দিয়ে শুধু নোনাজল গড়িয়ে পড়ছে। এতো লাঞ্ছিত কেন তার জীবন টা? একটুকরো সুখও তো তার ভাগ্যে নেই। ইনায়ার ভাবনার মাঝেই তার ফোন বেজে উঠে। সে হাতে ফোন নিতে দেখতে পায় অপরিচিত নাম্বার থেকে কল আসছে। ইনায়া ফোনটা রিসিভ করে কানে নেয়। কিন্তু অপর পাশ থেকে কোন রেসপন্স পায় না। সে কান্নারত গলায় ধিরে ধিরে জিজ্ঞেস করে,
-” কে বলছেন? ”
অপর পাশের ব্যাক্তির নিঃশ্বাসের শব্দ শুনছে ইনায়া। সে অনেক বার বার জিজ্ঞেস করলেও। কিন্তু ওই ব্যাক্তি নিরুত্তর থাকে। ইনায়া এবার ফোন কাটতে গেলেই, কেউ বলে ওঠে,
-” নিজের চোখের পানির মর্ম যে বোঝেনা। সে-তো পদে পদে লাঞ্ছিত হবেই। আগে নিজের মনকে শক্ত করো, আর কাঁদবে না তুমি। তখন দেখবে, জীবন টা তোমার জন্য সহজ হয়ে যাবে। জীবনে মনের শক্তিটা দৃঢ় রাখতে হবে। বুঝলে বোকা হরিণী? ”
ইনায়া প্রথমে কথা গুলো শুনে অবাক হয়েছিল। কিন্তু লাস্টের কথাটা শুনে ভ্রু কুঁচকে যায় তার। নাক টেনে মিনমিনে গলায় বলে ওঠে,
-” বোন ঘড় থেকে বের করে দিচ্ছে। আর ভাই মাঝরাতে জ্ঞান দিচ্ছে। বলি আপনার কাছে খবরটা কে দিয়েছে? নিশ্চয়ই তিথি হবে। যেখানে সেখানে গুন্ডামী করা ভাল নয়। আপনার জন্য আমার সমস্যা হলো। ”
জায়ান এবার হেঁসে উঠল। মুখের হাসি বজায় রেখে অকপটে জানতে চাইল,
-” আমার কন্ঠ শুনেই চিনে ফেললে? তা আমার প্রেমে পড়ে গেলে নাকি? ”
-” একদম না, আপনিই আমাকে বোকা হরিণি ডাকেন। তাতেই অনুমান করেছি।
হুট পটিয়ে বলে ওঠে ইনায়া। জায়ান সামন্য গম্ভীর হয়ে জিজ্ঞেস করে,
-” তাই? এতোটা খেয়াল করো আমাকে? ব্যাপার কি? ”
ইনায়া এবার চটে যায়। মাঝরাতে কল দিয়ে তার সাথে ফাজলামো করা হচ্ছে? না এই গুন্ডার পাল্লায় আর পড়া যাবেনা। ইনায়া ফিসফিসিয়ে বলে ওঠে,
-” অন্যের বউ কে কল মাঝরাতে কল দিয়ে বিরক্ত করা, নিশ্চয়ই আপনার রাজনীতিতে পড়েনা গুন্ডা সাহেব। প্লিজ ফোনটা রেখে দিন। ”
জায়ান রেগে গিয়ে কিছু বলতে যাবে তার আগেই, ইনায়া ফোন কেটে দেয়। জায়ান কান থেকে ফোন সড়িয়ে সামনে আনে। এই পিচ্চি মেয়ে তাকে যা নয় তাই বলছে? ফোনে হঠাৎ ইনায়ার মেসেজ দেখে জায়ান।
-” অন্যের বউ কে আর কখনো ফোন দিবেন না মিঃ সন্ত্রাসী। আপনাকে তা শোভা পায়না। ”
জায়ান বিরবির করে বার কয়েক পড়লো লেখাটি। তারপর কুটিল হেসে বলে ওঠে, “অন্যের বউ”
চলবে……..…………….
#যাতনা_আমার
#সানজিদা_ইসলাস_সূচনা
#পর্ব: ১৪
( কপি করা সম্পুর্ন নিষিদ্ধ।)
খুব ভোরে উঠে ইনায়া নিধির সাথে একটা ক্যাফেতে এসেছে। নিধিই বলেছিল তাকে সকালে বের হতে। ভোরের সকাল চারদিকে কুয়াশা। বাইরে না গেলে বোঝাই মুশকিল এখনো শীতের রেষ রয়েছে। ইনায়া কালো একটা থ্রি পিস পরেছে। উপরে সাদা রঙের পাতলা চাদর। সময়টা ফেব্রুয়ারীর মাঝামাঝি। কালকের বিষয়ে ইনায়া নিধিকে কিছুই বলেনি। সে নিজেই দেখবে বিষয়টা। ধোঁয়া উঠা গরম চা নিয়ে দুজনেই বসে আছে। ইনায়া ভারী মন নিয়ে নিধির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে,
-” হঠাৎ আজকে এতো জলদি বেরোতে বললে? কোনো সমস্যা নিধি? ”
নিধি ডানে বায়ে মাথা নাড়িয়ে গম্ভীর মুখে বলে,
-” নতুন করে আর কি সমস্যা হবে বলো? কাল শুনলাম বাবা আর তোমার মামা, তোমাদের ডিভোর্সের জন্য আপিল করেছে। আর মিঃ মেয়র বলেছেন তোমাকে নিয়ে তাদের বাসায় যেতে। ”
ইনায়ার ভ্রু কুঁচকে যায়।
-” মেয়র মানে ফাহাদ ভাইয়া? ”
নিধি মাথা ঝাকিয়ে উঠে। ইনায়া অকপটে জানতে চায়,
-” তোমার সাথে তার আগে থেকেই পরিচয় ছিল? ”
নিধি এবার সোজা হয়ে বসল। মুখটা একটু গম্ভীর করে শান্ত স্বরে বলে উঠল,
-” তোমাকে একটা কথা বলা হয়নি। মেয়র আর ভাই দুজন বেস্ট ফ্রেন্ড। এফবিতে মাঝে মধ্যে তার সাথে কথা হতো। একটা বিষয় নিয়ে তাকে আমি বছর দুএক আগে ব্লক করে ছিলাম। হঠাৎ কোথা থেকে নাম্বার পেয়ে কল দিল। ”
ইনায়া অবাক হয় ফাহাদ তাকে এমন কিছু বলেনি। সে মাথা নাড়িয়ে কিছু বলতে যাবে। তার আগেই ইনায়ার চোখ পরে মাত্র ক্যাফেতে ঢোকা জায়ানের দিকে। তার নজর ইনায়ার দিকেই স্থির। কালো রঙের পাঞ্জাবিটা জায়ানের ফর্সা শরীরে এটে আছে। চুল গুলো আজ কিছুটা উসকোখুসকো হয়ে আছে। পাঞ্জাবির হাতাটা গুটিয়ে জায়ান ইনায়ার পাশের সিটে বসে পরে। অতঃপর ইনায়ার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেঁসে বলে ওঠে,
-” ওয়াও, আজ তো সন্ত্রাসীর সাথে ড্রেস কোড মিলিয়ে পরেছ। এই তুমি আমার পেছনে স্পাই লাগাওনি তো আবার? ”
ইনায়া হকচকিয়ে যায় জায়ানের কথায়। এই ছেলে তো দারুণ ধরি বাজ। সে ক্ষিপ্ত গলায় গটগট করে বলে,
-” স্পাই তো মনে হয় আমার পেছনে আপনি লাগিয়েছেন। আর এখন ঢং করছেন? আপনার মতিগতি আমার ভালো ঠেকছে না। চল নিধি আমি চলে যাব। ”
বলেই ইনায়া নিধির হাত ধরে উঠে যায়। জায়ান এবার মুখে বিরক্ত ভাব ফুটিয়ে তোলে। এই মেয়ে তাকে শান্ত থাকতে দেবেনা। জায়ান ইনায়ার হাত ধরে ধপ করে চেয়ারে বসিয়ে দিল। আর নিধির দিকে তাকিয়ে হেঁসে বলে ওঠে,
-” বাইরে আমার গাড়ি আর ড্রাইভার দাঁড়ানো আছে। চুপচাপ গাড়িতে গিয়ে উঠে বসো। ”
-” আর ভাবি? ”
নিধির দিকে জায়ান চোখ পাকিয়ে চায়। নিধি আর কিছু বলতে পারে না। এই লোক হঠাৎ করেই তার ফেস চেন্জ করে ফেলেছে। নিধি সুড়সুড় করে বাইরে চলে যায়। ইনায়া এবার জায়ানের হাত ছাড়িয়ে বলে,
-” কি চাই আপনার? ”
জায়ান ইনায়ার দিকে গরম চোখে তাকায়। লম্বা নাকের পাতি গুলো ফুলেফেঁপে উঠছে। মুখটা রক্তিম হয় নিমিষেই। ইনায়া এবার চুপসে যায়।
-” ইউ নো হোয়াট! হো আই এম? আমাকে ইগনোর করাটা মোটেও ভাল হবে না তোমার জন্য। চুপচাপ বসো এখানে। ”
ইনায়া ভয় পেয়ে চুপচাপ বসে থাকে। জায়ান এবার নিজেকে ধাতস্থ করলো। গলার আওয়াজ কিছুটা নিচু করে বলে,
-” দেখো তিথির ব্যবহারের জন্য আমি দুঃখিত। ও যে এই রকম করবে আমার ধারনার বাইরে ছিল। ”
-” ধারনা কেন করতে পারেন নি? ও তো আপনারই ফুল কপি। ”
ইনায়া গলা উঁচিয়ে বলে উঠে। জায়ান বাঁকা চোখে তার দিকে তাকায়। ইনায়া আবার মাথা নুইয়ে নেয়।
-” তাই? তা আমাকে এতো উগ্র মনে হওয়ার কারণ কি? জানতে পারি? ”
ইনায়া এবার সহসা মাথা নাড়িয়ে গটগট করে বলে ওঠে,
-” রাজনীতি! রাজনৈতিক কর্মকান্ডে জড়িত সকল মানুষকেই আমার উগ্র মনে হয়। কি পায় রাজনীতিতে। যেখানে, একটু ভুল হলেই নিজের লোকদেরও খুন করতে হাত কাপে না। ক্ষমতার লোভে পরে সবাই সিংহ হয়ে যায়। আর সাধারণ ক্ষমতাহীন মানুষকে নিরীহ হরিণ মনে করে তারা। বাবা আমার আর মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে রাজনীতি থেকে সড়ে এসেছিলেন। এখানে সাধু হয়ে কেউ থাকতে পারে না ক্ষমতার লোভে পরবেই। যেমন আপনি আর আপনার বোন। পাওয়ার দেখিয়েছেন আমার সাথে। ”
জায়ান পায়ের উপর পা তুলে সটান হয়ে বসে ছিল। সে মনোযোগ দিয়ে ইনায়ার কথা শুনছিল। সে ইনায়ার দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ায়। তন্মধ্যে একজন ওয়েটার কিছু খাবার নিয়ে আসে পাস্তা, নুডলস, স্যুপ। ইনায়া ভ্রু কুঁচকে তাকায় সেদিকে।
-” নাও ফিনিশ করো। একটা বাটিও যেন ভরা না থাকে। ”
জায়ান ইনায়ার দিকে তাকিয়ে গম্ভীর মুখে বলে ওঠে। ইনায়া কিছুটা বিরক্তি নিয়ে বলে,
-” আপনাকে কে বলেছে আমি এখন খাব? আর এত সকালে আমার খাওয়ার অভ্যাস নেই। ”
-” আমি তোমার অজুহাত শুনতে চাইনি খেতে বলেছি। চুপচাপ খেয়ে আমার সাথে চলো। ”
ইনায়া রেগে যায় জায়ানের কথা শুনে। জায়ান গম্ভীর তবুও শান্ত চোখে তাকিয়ে আছে তার দিকে। ইনায়া মুখটা বিকৃতি করে,
-” আপনার সাথে যাব মানে? এই আপনি আমার কে? তার উপর আবার অধিকার দেখাচ্ছেন। ফাউল লোক একটা। ”
জায়ান এবার ইনায়ার দিকে তাকিয়ে ভয়ংকর একটা কাজ করে। টেবিলের উপর থেকে কাচের গ্লাসটা নিয়ে মুহূর্তেই ভেঙে ফেলে। তারপর ইনায়ার দিকে সেটা ধরে। ইনায়ার তো জান যায় যায় অবস্থা। সে তো ভুলেই গেছিল, যে একজন সন্ত্রাসীর সামনে বসে আছে। ভাঙা গ্লাসের দিকে তাকিয়ে হালকা একটা ডুক গিলে ইনায়া। জায়ান রক্তিম চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে।
– ” যদি আর একটা কথা বলো তাহলে? আমি আমার নিজের হাত কেটে ফেলবো। আর মিথ্যা মামলায় অভিযুক্ত আসামি বানাবো তোমাকে। বলবো, তুমি বিরোধী দলের লোক। আমাকে মারতে এসেছ। ”
ইনায়া চোখবড় করে জায়ানের দিকে তাকায়। বিষ্ময়কর দৃষ্টি দিয়ে তাকিয়ে অকপটে জিজ্ঞেস করে,
-” ফাজলামি করছেন? বললেই হলো? এমন হাস্যকর কথা লোকে শুনলে হাসবে। পাগল নাকি আপনি? ”
-” ফাজলামি ও করছি না কথাও হাস্যকর না। আর আমি পাগলও না। এখন যদি আমাকে একটা পিঁপড়ে ও কামড় দেয়। তার দায় আমি তোমার উপর দিয়ে, তোমাকে জেলে ভরতে পারব। কারণ তুমিই বলেছ আমার রাজনৈতিক পাওয়ায় আছে। আমি যেমনটা বলবো তেমনটিই করতে পারব। বিকজ মাই পাওয়ার। এখন চুপচাপ খাও নাহলে, সারাজীবন জেলের ভাত খেতে হবে। ”
ইনায়া জায়ান কে আর ঘাঁটল না। এইসব রাজনৈতিক কৌশল অবলম্বন করা মানুষ গুলো বড়ই বিপদজনক হয়৷ দেখা যাবে সত্যিই তাকে জেলে ঢুকিয়ে দিয়েছে। ইনায়া চুপচাপ নুডলস খেতে থাকে। জায়ান গম্ভীর চোখে ইনায়ার দিকে তাকিয়ে আড়ালে হেসে উঠে।
এদিকে নিধি বাইরে এসে দেখে গাড়ির সামনে সাদা রঙের পাঞ্জাবি পরিহিত ফাহাদ দাঁড়িয়ে রয়েছে। সাথে তার একগাদা ছেলেপুলে। জায়ান তো বলেছে ড্রাইভার আছে দাঁড়িয়ে। নিধি নাক ফুলিয়ে সামনে যায়। ফাহাদ তার দিকে তাকিয়ে হাসি দিয়ে বলে,
-” হেই, বেবি গার্ল লং টাইম নো সী? ”
-” লজ্জা করে না চৌত্রিশ বছরের এক মধ্যবয়সী লোক হয়ে একটা বাচ্চা মেয়েকে বেবি বলছেন? ”
ফাহাদের মুখটা চুপসে যায় তৎক্ষনাৎ। বয়স নিয়ে খোটা? আশেপাশে ছেলেদের দিকে একবার তাকায়। তার মুখটাকে গম্ভীর থেকে গম্ভীর করে ভরাট গলায় বলে ওঠে,
-” তোমার আমাকে বুড়ো মনে হয়? ”
-” তা নয়তো কি? আপনি কি নিজেকে ইয়াং মনে করেন? আপনার থেকে তো আপনার ছেলেপুলে গুলো যথেষ্ট স্মার্ট আছে। ”
অপমানে মুখ থমথমে হয়ে যায় ফাহাদের। তার চামচার সামনেই তাকে সাবান ছাড়া ধুয়ে দিল এই মেয়ে। নিধি কি জানে না? তার মতো এমন হ্যান্ডসাম ছেলে এই এলাকা তে নেই। ছেলে গুলো এক সঙ্গে হেসে উঠে। ফাহাদ সব গুলোকে একটা রাম ধমক দিয়ে নিধির দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকায়।
-” এই বজ্জাত মেয়ে আগে ছোট ছিলে, তাই ভাবতাম বোঝনা মানুষের সাথে কি ভাবে ব্যবহার করতে হয়। কিন্তু তুমি তো ঠিক আগের মতোই আছো। ”
-” আসলে কি? যে যেমন তার সাথে আমি এমন ব্যবহারই করি। ”
ফাহাদের কথার প্রেক্ষিতে বলে ওঠে নিধি। ফাহাদ বিষ্ময়কর দৃষ্টি দিয়ে নিধির দিকে তাকিয়ে থাকে। এই মেয়ে একটুও বদলায় নি। দুনিয়ার সবার সামনে ছোট দুধের শিশু আর তার সামনে এলেই সাপের মতো ফোঁসফোঁস করতে থাকে। কি দোষ তার? ফাহাদ করিম কে অপমান? এর হিসেব সে নেবেই।
-” গাড়ির দরজাটা খুলেন। ”
-” কেন? আমি কি তোমার চাকর? ”
নাকমুখ ফুলিয়ে বলে ওঠে ফাহাদ। নিধি গাড়ির উপর এক হাত আর কমোড়ে এক হাত দিয়ে মুচকি হেসে বলে,
-” জায়ান ভাই বলেছে বাইরে তার গাড়ি আর ড্রাইভার দাঁড়ানো আছে। গাড়ির সামনে তো আপনি আছেন। ভাবলাম আপনিই ড্রাইভার হবেন। ”
অপমানে মুখ থমথমে হয়ে যায় ফাহাদের। তার দলের লোকগুলো তার অগোচরে মিটিমিটি হাসছে। না এই পুচকে মেয়ে তাকে?ফাহাদ করিম কে এতো কথা শুনাল? এ ভারি অন্যায়। আর জায়ান? ওকে ফাহাদ পরে দেখে নিবে।
-” বেশী বাড়ছো না মেয়ে? খবরদার মেয়রের সাথে মুখ সংযত করে কথা বলো। না হলে আইনের আওতায় আনবো তোমাকে। ”
নিধি এবার বাঁকা হেঁসে গাড়ির দরজা খুলে ভেতরে বসে। একটু উঁকি দিয়ে মেকি হেঁসে বলে ওঠে,
-” তা মেয়র সাহেব এবার নাকি প্রেমে ছ্যাঁকা খেয়েছেন? ভেরি সেড! তা তাকে আইনের আওতায় আনতে পারেন নি? আহারে! এমন হলে প্রেম থাক বিয়ের জন্য মেয়েই পাবেন না আপনি। ”
বলেই গাড়ির দরজা লাগিয়ে দেয় নিধি। ফাহাদের রাগ এখন আকাশচুম্বী। এতোগুলা লোকের সামনে অপমান? ফাহাদ এবার ড্রাইভিং সীটের দরজা খুলে বসে পরে। বিকট শব্দে দরজা লাগিয়ে গাড়ি স্টার্ট দিতেই, নিধি তেতে উঠে।
-” আপনি গাড়ি স্টার্ট দিচ্ছেন কেনো? পাগল হয়েছেন? ভাবি ক্যাফেতে আছে। নামান এক্ষুনি আমাকে। ”
-” কেনো আমিতো ড্রাইভার গাড়ি তো চালাবোই। আর আপনার জায়ান ভাই বলেনি এই ড্রাইভার দিকদিগন্ত না বুঝেই গাড়ি চালায়। ”
-” দেখুন খারাপ হয়ে যাচ্ছে কিন্তু। কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন আমাকে? ”
চিৎকার দিয়ে উঠে নিধি। ফাহাদ পিছনে ফিরে নিধির দিকে তাকিয়ে শয়তানি হাসি দিয়ে বলে ওঠে,
-” কাজি অফিসে! আমি যখন আর কোনো মেয়েই পাবো না। ভাবলাম তোমাকেই বিয়ে করে নেই। কি বলো? ”
-” জানে মেরে দিবো আপনাকে আমি। ”
ফাহাদ সামনে তাকিয়ে ড্রাইভিং মনোযোগ দেয়। পিছনে থেকে নিধি চিৎকার করছে। ফাহাদ সামনে থেকে মুচকি মুচকি হাসছে। নিধিকে জ্বালিয়ে তার ভালোই লাগছে। অন্যদিকে ইনায়ার খাবার শেষ হতেই, তাকে নিয়ে ক্যাফের বাইরে আসে জায়ান। এসেই দেখতে পায় দলের লোক গুলো জিপে বসে বসে সিগারেট টানছে। ইনায়া ওদের দেখে মুখ বাকায়। যেখানে দলনেতাই এমন, তার চেলারা তা বজায় রাখবেই। জায়ান কে দেখে সবগুলো ছেলে নেমে দাঁড়ায়।
-” কিরে ভাই কই? গাড়ি কই? ”
হ্যাংলা পাতলা দেখতে একটা ছেলে এসে জায়ানের কাছে তটস্থ স্বরে বলে,
-” গাড়ি আর ওই মেয়েটারে নিয়া তো চলে গেছে। ”
-” কিইহহ ”
ইনায়া পাশ থেকে চিৎকার দিয়ে বলে ওঠে। ফাহাদ নিধি কে নিয়ে কই যাবে? জায়ান বিরক্ত হয়ে ইনায়ার দিকে তাকায়। এইটুকু কথা শুনেই তার রিয়াকশন দেখার মতো হয়েছে। জায়ান ফাহাদের ফোনে কল করলেও ফোন রিসিভ হয় না। জায়ান রেগে যায় ফাহাদের উপর।
-” কি একটা অবস্থা আমি অফিসে যাব কি করে? ”
-” ভাই খবর দিছি। গাড়ি মনে হয় একটু পরেই চলে আসবো। ”
বলে উঠে একজন। জায়ান ছেলে গুলো কে যেতে বলে। সব-কয়টা জিপে চরে পার্টি অফিসের দিকে যায়। ইনায়া এবার ক্ষিপ্ত গলায় গটগট করে জিজ্ঞেস করে,
-” আশ্চর্য তো? কই নিয়ে যাবে ফাহাদ ভাই নিধি কে? ”
-” আমি কি করে বলবো? তুমি যেখানে ছিলে আমি সেখানেই ছিলাম। এতো প্রশ্ন না করে চলো আমার সাথে। ”
দাঁতে দাঁত পিষে জবাব দেয় জায়ান। ইনায়া সাদা চাদরটা ভালো মতো গায়ে জড়িয়ে সামনে হাঁটা শুরু করে। জায়ানের রাগে কপালের রগ ফুলে উঠে। ক্ষিপ্র গতিতে এগিয়ে গিয়ে ইনায়ার সামনে দাঁড়ায় জায়ান।
-” লিসেন! আমি এক কথা বারবার বলতে পছন্দ করি না। তুমি আমাকে ইগনোর করছো। এক্ষুনি আমার সাথে চলো। ”
-” আপনিও শুনুন! আমি আপনার সাথে কোথাও যাচ্ছি না। আমি এখন ক্যাম্পাসে যাব। আর আপনার ভাইকে বলুন নিধিকে নিয়ে আসতে। ”
জায়ান পাঞ্জাবির হাতা গুটিয়ে ডানে-বামে তাকায়। তারপর ইনায়ার চোখের দিকে তাকিয়ে নিচু স্বরে বলে ওঠে,
-” তুমি যদি কথা না শুনো তাহলে? তোমাকে কোলে তুলে নেব কিন্তু। ”
-” খাটাশ একটা! আমি ভুলেও যাব না। ”
জায়ান এবার নিচু হাতেই ইনায়া আসনে ভেঙে রাস্তার মধ্যে বসে পরে। জায়ান বিষ্ময়কর দৃষ্টি দিয়ে ইনায়ার দিকে তাকায়। এটা কেমন বাচ্চামো স্বভাব?
-” আপনি যদি আবার আমার সাথে এমন করেন? তাহলে আমি রাস্তায় শুয়ে যাব। ”
জায়ান এবার বিস্ময়ের সাথে রাগেও প্রচুর।
-” বেয়াদব মেয়ে ওঠো বলছি। না হলে থাপ্পড় মারবো একটা। সিনক্রিয়েট করো না ইনায়া। ”
-” সিনক্রিয়েট আমি না আপনি করছেন। যেতে দেন আমাকে। ”
জায়ান এবার আকাশচুম্বী রাগ নিয়ে মেনে নেয় ইনায়ার কথা। ইনায়া বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে কাপড় ঝেড়ে সামনে হাটে। জায়ান পিছন থেকে বলে,
-” যতোক্ষণ না ক্যাম্পাসে ঢুকছো, আমি তোমার পিছন পিছন আসবো। ”
ইনায়া কিছুই বলেনা। সে দ্রুত সম্ভব পা চালায়। সকাল হয়ার দরুন রাস্তায় লোকের আনাগোনাও কম। জায়ান ইনায়ার দুহাত পিছনে পকেটে হাত দিয়ে হাঁটছে। কেউই কোনো কথা বলেনি একবারের জন্যেও। কিছু দুর একটা গলির মাঝখানে যেতেই হঠাৎ একটা গুলির শব্দে ইনায়া কানে ধরে বসে পরে। কয়েক সেকেন্ড বাদে ইনায়া উঠে দাড়িয়ে চট জলদি পেছনে ফিরতেই থমকে যায়। জায়ান হাঁটু গেড়ে বসে আছে। রক্তে ফোয়ারা হয়ে গেছে তার ডান কাধের একটু নিচের দিক। জায়ান জায়গা টা চেপে ধরার চেষ্টা করে, রক্তিম চোখে আশে পাশে তাকাচ্ছে। ইনায়া কিছুক্ষণ ভয় পেয়ে থাকলেও আচমকা পা সচল হয় তার। সে জায়ানের পাশে হাঁটু গেড়ে বসে।
-” আপনি ঠিক আছেন তো? কি ভাবে হলো এটা? কে করলো এটা ?
ইনায়ার এতো গুলো প্রশ্নে জায়ান রক্তিম চোখে তার দিকে তাকায়। ইনায়া আতকে উঠে প্রায়। জায়ানের সুন্দর মুখশ্রী টুকটুকে লাল হয়ে আছে। কষ্টের ছাপ স্পষ্ট। ইনায়া গায়ের চাদরটা দিয়ে জায়ানে কাধের দিকটা বেধে দেয়। প্রচুর রক্ত ক্ষরণ হচ্ছে। ইনায়া আশে তাকিয়ে কোনো যানবাহন আর লোক দেখতে পায় না। যাও দু’একটা রিকশা আসলেও তারা জায়ানের অবস্থা দেখে চলে যাচ্ছে। জায়ান চেষ্টা করে সোজা হয়ে বসে। পকেট থেকে ফোন বের করে ফাহাদ কে কল করে। কিন্তু এবারও ফোন রিসিভ করেনা। কয়েকবার দেবার পর একই ঘটনা। জায়ান এবার রেগে গিয়ে ভয়ংকর রকম একটা বিশ্রী গালি দিয়ে বসলো। ইনায়ার কান ঝা ঝা করে উঠলো। অন্য সময় হলে সে জায়ানকে কথা শুনাত। কিন্তু এখন পরিস্থিতি অন্যরকম। হঠাৎ জায়ান ইনায়ার হাত ধরে রাস্তায় শুয়ে পরে। তাদের উপর দিয়েই একটা গুলি গিয়ে পাশের দোকানের দেয়ালে লাগে। জায়ান গুলি যেদিকে ছোড়া হয়েছে সেদিকে তাকায়। দেখতে পায় সেখানে প্রচুর ঝোপঝাড়।
-” শালা, সামনা সামনি গুলি চালাবার সাহস থাকে না। আবার রিভলবার হাতে নেস। ”
জোরে বলে কোমড় থেকে বা হাতে রিভলবার বের কর জায়ান। ইনায়া তা দেখে ভ্রুকুটি কুঞ্চন করে,
-” আপনি এই অবস্থায় গোলাগুলি করবেন। আপনি মানুষও বটে। ভাঙবেন তবুও মচকাবেন না। ”
-” মরতে চাও?
-” কি বলেন? মরতে চাইবো কেন?”
-” তাহলে, আমাকে উঠতে সাহায্য করো। এখান থেকে সরতে হবে। নাহলে দুজনেই মারা পরবো। ”
ইনায়া জায়ান কে উঠতে সহায্য করে। জায়ান এখোনো শক্ত আছে অনেকটা ইনায়া ভাবছে। সে হলেতো এতক্ষণে অক্কা পেত। একটা দোকানের পেছনে বসায় জায়ান কে ইনায়া। জায়ান নিজের দলের একজন কে ফোন দেয়। রিসিভ হতেই ক্লান্ত ভঙ্গিতে বলে ওঠে,
-” খলিলের লোক গুলি চালায়ছে। জলদি বাজারের গলিতে চলে আয়। এক্ষুনি। ”
কথাটা বলতেই হাত থেকে ফোনটা ঢলে পরে জায়ানের পুরো শরীর অবস হয়ে আসছে প্রায়। ইনায়া ব্যাগ থেকে পানির বোতল বের করে জায়ানের মাথায় ঢালে।
চলবে…………