#যাতনা_আমার
#সানজিদা_ইসলাম_সূচনা
#পর্ব : ১৯
(কপি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।)
দুইদিন হলো নাভান বাংলাদেশে ফিরেছে। এর মধ্যে নাভানের সাথে নাহিদ মির্জা আর সোহানা। কেউই কোনো কথা বলেনি। নাভান বাড়িতে এসেছে? এ যেন কেউ বিশ্বাস করতে পারে নি। সেদিন রাতে নিধি আর ইশানের কথা কেউ বিশ্বাস করতে পারেনি। নাভান যখন সদর দরজা দিয়ে ভিতরে ঢুকেছিল। সবাই নিরব ভূমিকা পালন করেছিলো। সবার চোখ নাভানের উপর থাকলেও, নাভান তাকিয়ে ছিলো তার মায়ের পানে। অশান্ত চোখ জোড়া, হাজারো আকুতি ভরা দৃষ্টিতে সোহানা মির্জার দিকে তাকিয়ে থাকলেও তিনি সেটা অগ্রাহ্য করে চলে গিয়েছিলেন তার রুমে। বাকি সবার সাথে নাভানের কথা বার্তা ভালোই চলছে। আয়েশা মির্জা সারাদিন খুশিতে নাচতে থাকেন। নাভান মিনি ছাদের একটা বেতের সোফায় বসে আছে। সামনে চা রাখা। দু’হাত এক করে তাতে থুঁতনি রেখে বিষণ্নতা হতাশা মুখে বসে রয়। ইশান নাভানের পাশের সোফায় বসে হঠাৎ। নাভান ঘার ঘুরিয়ে তাকায়।
-” কি ব্যাপার? মন খারাপ? ”
ইশান গম্ভীর মুখে প্রশ্ন করে। নাভান হাসে কিঞ্চিত। মুখ বাকিয়ে বিদ্রুপের হাসি সেটা। সহসাই বলে ওঠে,
-” বুঝতে পারছি না। কি করবো? সবকিছু এবার বেশীই জটিল। মায়ের সাথে আমার কথা বলা৷ অনেক জরুরি। কিন্তু দেখনা, সে আমাকে দেখলেই মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। ”
-” তুমি জানোই, বড়মার অভিমান কতোটা প্রখর। তুমি তার মতামত, কাজকে গুরুত্ব দাওনি। তার উপর, তার খুব ভালোবাসার পছন্দের মেয়ে ইনায়া। যাকে তুমি কঠিন ভাবে ভেঙে ফেলেছো। যেটা তার প্রাপ্য ছিলো না। তার দায় তুমি বড়মার থেকে সরাতে পারবে কি না? জানা নেই। ”
ইনায়ার কথা মাথায় আসতেই নাভান কিছুটা অস্থির হয়। চোখের সামনে ভেসে উঠে বৃষ্টিসিক্ত কোমল রমনী ইনায়ার মুখ। নাভান জোরে নিঃশ্বাস ফেলে।
-” মেয়েটা এখন কোথায়? ”
ইশান হাসে, -” কে? তোমার বউ? ”
নাভানের ভেতরটা ধুক করে উঠে যেন। ‘ বউ ‘ কয়েকবার বিরবির করে জপে নাভান।
-” ইনায়া এখন হলে থাকে। আর তোমার ফ্রেন্ড ফাহাদ করিম হলো ইনায়ার আপন মামাতো ভাই। শুধু ফাহাদ নয় তোমার বেবি অদিতিও ইনায়ার আপন ফুপাতো বোন। ”
নাভান কথাটা শুনে ভ্রু কুঁচকায়। কই ফাহাদ তো তাকে এতোদিন এই বিষয়ে কিছুই বলেনি। নাভান কে ইশান সম্পূর্ণ ঘটনা বলে। নাভান সব শুনে নিশ্চুপ রইলো। শুধু একটা বিষয় মাথায় ঘুরলো। কালকের মেয়েটাই কি ইনায়া। নাভানের তুখোর মস্তিষ্ক যেন এবার কিছু ধরতে পারল। ইনায়ার নাভান কে দেখে হকচকিয়ে যাওয়া, ঘাবড়ানো? সবই তাকে এখন ভাবাচ্ছে।
-” অদিতির কি খবর? শুনলাম তার সাথে ব্রেকআপ করেছ। কারণ কি? ”
ইশানের কথায় ধ্যান ভাঙে নাভানের। বিরক্ত হয়ে বলে,
-” ওর কথা মনে করাস না। মেজাজ বিগড়ে যায়। ”
-” কেন? তুমি তো ওর দিওয়ানা ছিলে। ”
নাভান এবার শুন্য মনে বলে ওঠে,
-” একাকিত্বের জীবনে অনেক নারীর সঙ্গীই হয়েছি। কানাডার কালচারে নিজেকে মানিয়ে নিয়েছিলাম। মায়ের সাথে কিছুটা জেদ ধরেই সেখানে মানিয়ে নেওয়া। অদিতি একটু ডিফরেন্ট ছিল। আমি তার প্রতি আসক্তও হয়েছিলাম প্রচুর। অদিতি কেই আমার লাইফ পার্টনার বানাবো আমি শিওর ছিলাম। কিন্তু? ”
নাভান এবার থামে ইশান এক ধ্যানে তার দিকে তাকিয়ে আছে।
-” কিন্তু এখান থেকে ফিরে যাওয়ার কিছুদিন পর, লিও নামের অদিতির এক ফ্রেন্ড আমাকে কিছু ছবি পাঠায়। ছবি গুলো দেখে লিওর সাথে যোগাযোগ করে আমি যানতে পারি। অদিতি লিওর বেবি কনসিভ করেছিলো। কিন্তু সে আমাকে পাওয়ায় জন্য বাচ্চাটা এবোর্শন করিয়ে নেয়। জাস্ট ভাব। ”
ইশান চোখমুখ কুঁচকে নেয়। কি বিশ্রী মেয়ে অদিতি। ইশান নাভানের দিকে তাকিয়ে হতাশ কন্ঠে বলে,
-” যাই বলো, তোমার ইনায়া কে বিয়ে করে এভাবে চলে যাওয়াটা ঠিক হয় নি। ”
নাভান চুপ হয়ে থাকে। কিছু বলে না আর। বুক চিড়ে দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে আসে।
-” মায়ের সাথে জেদ ধরে সত্যিই আমি একটা পৈশাচিক কাজ করে ফেলেছি। ”
ক্লাস শেষে নিধি ইনায়া কে নিয়ে একটা রেস্টুরেন্টে যায়। সেখানে গিয়ে খাওয়া দাওয়া শেষ করতেই, নিধি তার আর ইশানের বিয়ের খবর ইনায়া কে দেয়। ইনায়া অবাক হয় প্রচুর। ইশানের সাথে নিধি? কিন্তু নিধির চোখমুখ দেখে ইনায়া বোঝে এই বিয়েতে নিধি প্রচন্ড খুশি। কিন্তু ইশান?
-” ভাইয়ার কি মত নিধি? ”
নিধি ইনায়ার প্রশ্ন শুনে থমকায়। মুখটা মলিন করে বলে,
-” তা তো জানিনা। আমিতো আড়ি পেতে সব শুনেছি। বলেছে তোমাদের ডিভোর্স হলে সবাই কে জানাবে। ”
নিধি কথাটা বলে ইনায়ার মুখের দিকে তাকায়। ইনায়া শান্ত স্বরে জবাব দেয়,
-” আমার কাছে ডিভোর্স লেটার এসেছে নিধি। এখন শুধু আমাদের সম্পর্ক একটা সাইনের উপর নির্ভর করছে। ”
নিধি মলিন মুখে বলে,
-” পরশু ভাইয়া এসেছে ভাবি। ”
ইনায়া শুনে কোনো প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে না। সে চুপচাপ বাইরে রাস্তায় তাকিয়ে থাকে। নিধি হতাশ হয়। হঠাৎ ফোন আসায় নিধি উঠে দাঁড়িয়ে বলে,
-” আসছি ভাবি একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ করবো। ”
-” কি কাজ? ”
-” জানতে পারবে। কাজটা শেষ হলে তুমি সহ পুরো এলাকাই জানতে পারবে। ”
কথাটা বলে নিধি হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে যায়। ইনায়া অবাক হয়ে সেও হলের দিকে এগিয়ে যায়। রাস্তায় কিছুক্ষন দাড়ায় ইনায়া। আজ সুর্যের তেজ খুবই প্রখর। ঘামে জবজবে অবস্থা মুখমন্ডল। ইনায়া ওরনা দিয়ে মুখ মুছে সামনে অগ্রসর হয়। হঠাৎ মাথার উপর কেউ ছাতা ধরতে ইনায়া পাশে ফিরে তাকায়। জায়ান মুচকি হেসে তার দিকে তাকিয়ে আছে। ইনায়া একবার আশেপাশে তাকায়। না, আজ গুন্ডাটা ছেলেপেলে নিয়ে আসেনি।
-” করছেন কি মানুষ জন দেখছে। ”
জায়ান ছাতাটা ইনায়ার হাতে মুঠোয় দিয়ে। একটু দুরে দাঁড়িয়ে মিটিমিটি হেসে বলে,
-” প্রহর শেষের আলোয় রাঙা আজ চৈত্রমাস- তোমার চোখে দেখেছি আজ আমার সর্বনাশ। ”
জায়ানের হঠাৎ এমন কথায় ইনায়া চমকায়। হতবিহ্বল হয়ে তার দিকে কয়েক নেনো সেকেন্ড তাকিয়ে মুহূর্তেই হেসে উঠে। জায়ান অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখে সেই মুক্তোঝরানো হাসি। ইনায়া নিজেকে সামলে শান্ত স্বরে বলে ওঠে,
-” শেষ পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথ কেও কপি করলেন? তাও আবার নিজের মতো বানিয়ে? ”
ইনায়া কথাটা বলে থামলো। তারপর মুচকি হেসে আবার বলে উঠল,
-” প্রহর শেষের আলোয় রাঙা সেদিন চৈত্রমাস। তোমার চোখে দেখেছিলাম আমার সর্বনাশ। এমনটা হবে। ”
জায়ান মাথা নিচু করে হেসে উঠে আবার ইনায়ার পানে তাকায়।
-” তা সত্যিই কি তোমার সর্বনাশ দেখতে পেয়েছো? ”
ইনায়া জায়ানের কথার মানে বুঝতে পারে। হাস্যোজ্জ্বল মুখটা এবার রাতের আধারের মতো অন্ধকার করে নেয়। তারপর মিহি কন্ঠে বলে,
-” দেখতে চাইলেও দেখবো না। বুঝতে পারলেও বুঝবো না। আমি আর কিছুই নতুন করে বুঝতে চাই না। ”
কথাটা বলে জায়ানের দিকে দু’পায়ে অগ্রসর হয় ইনায়া। জায়ানের হাতে ছাতা ধরিয়ে সে গন্তব্যের দিকে অগ্রসর হয়। জায়ান কুটিল হেসে পেছন থেকে বলে ওঠে,
-” সামলে রেখো নিজেকে বোকা হরিণী। বাঘ মামা কিন্তু পেছনে ছুটছে। একবার ঘাড় ঘুরিয়ে পিছন তাকালেই, বগলদাবা করে ফেলবো। সো বি কেয়ার ফুল। ”
কথাটা শুনে ইনায়া দাঁড়ায়। কিন্তু পিছনে ফিরে না।
-” আমি সাবধানেই থাকবো। আপনিই নিজেকে সামলে নিয়েন। না হলে পিছলে যাবার ভয় নিয়ে পিছু করতে হবে। ”
-” জায়ান করিম কোনো কাজে ভয় নিয়ে এগোয় না। আর এটাতো মনের ব্যাপার। জোর একটু বেশীই। ”
কথাটা বলে জায়ান পা চালিয়ে চলে যায়। ইনায়া খানিকক্ষণ পরে পিছনে ফিরে। জায়ান কে আর দেখতে পায়না সে। একটা বড়ো নিঃশ্বাস ফেলে ইনায়া সামনে ফিরে হাটতে থাকে। হলে এসে ইনায়া প্রথম গোসল সেরে নেয়। আজ বিকালে মির্জা বাড়িতে যাবে সে। সোহানার সাথে কথা বলতে। সাথে মিজানুল করিম বা ফাহাদও যাবে। ইনায়া যখন চুল শোকাচ্ছিল তখনই তিথি রুমে আসে। পরনে পাতলা সাদা রঙের সুতির শাড়ি। চুল গুলো সুন্দর করে খোপা বাঁধা। হালকা সেজেছেও তিথি। নিশ্চয়ই পার্লার থেকে এসেছে।
-” কি ব্যাপার? আজ ইংলিশ ম্যাম থেকে বাঙালি গিন্নি হয়েছ যে? ”
তিথি মুচকি হেঁসে জবাব দেয়,
-” একজন কে সারপ্রাইজ দিব ভাবছি। তা তুমি কি মাত্র এলে? ক্লাস তো মনে হয় সেই কখনই শেষ হয়েছে। ”
-” আর বলো না। নিধির খপ্পরে পড়েছিলাম। আঁটকে রেখে একটা গুড নিউজ দিল। ”
ইনায়া ক্লান্ত ভঙ্গিতে বলে ওঠে। তিথি ব্যস্ত হাতে নিজের ব্যাগ ঠিক করতে করতে শুধায়,
-” গুড নিউজটা কি? ”
-” তার আর ইশান ভাইয়ের বিয়ে ঠিক হয়েছে। ”
হাসি খুশি বলে ইনায়া। কথাটা শ্রবণ হতেই তিথির ব্যস্ত হাত থেমে যায়। ভেতরটা কেঁপে উঠে তৎক্ষণাৎ। জিজ্ঞাসু চোখে ইনায়ার পানে তাকায় তিথি।
-” বিয়ে? তারা দুজনেই খুশি এতে? ”
-” সত্যিই, মেয়েটা খুব খুশি। আমি ওই বাড়িতে থাকা কালিন তাদের মধ্যে এমন কিছু দেখিনি। বিষয়টা সম্পূর্ন পারিবারিক ভাবে ঠিক করা হয়েছে। ”
তিথি যেন থমকে গেছে। তার মুখে কোনো রা নেই। তরতরিয়ে ঘেমে একাকার হয় তিথি। ইশান তো তাকে কিছু বলেনি? সে জানে তো ব্যাপার টা? আজ তো ইশানের সাথে দেখা করবে তিথি। হন্তদন্ত হয়ে তিথি উঠে দাঁড়ায়। ইনায়া অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে,
-” অল রাইট তিথি? ”
তিথি কোনো জবাব দেয় না। এক প্রকার দৌড়ে রুম থেকে বেরোয়। ইনায়া যেন বোকা বনে রয়। তিথির এভাবে হঠাৎ হকচকিয়ে উঠাটা তাকে ভাবায়। তিথি তার ব্যাগটাও রেখে গেছে। ইনায়া দীর্ঘশ্বাস ফেলে তৈরি হতে থাকে।
নাভান বিকালের দিকে নিজের রুমে শুয়েছিলো। সোহানার সাথে কথা বলতে গিয়েও পারেনি। কি করবে কিছুই বুঝতে পারে না নাভান। সে শোয়া থেকে উঠে দাঁড়িয়ে নিজের বেলকনিতে যায়। সেখানে যেতেই নাভান অবাক হয়। বেলকনিতে প্রচুর ফুলের গাছ লাগানো। কিছু কিছু ফুলের নামও যানে না নাভান। গত দুইদিনে এদিকে আসা হয়নি নাভানের। কে সাজিয়েছে এমন করে? মা নয় তো? হবে, মাই হবে। শুধু বেলকনি নয় পুরো রুমটাই অনেক গুছানো ছিল। নাভানের ছবি দিয়ে পুরো রুমই সাজানো ছিল। নাভান ভাবনা বাদ দিয়ে বাইরে যাবার জন্য তৈরি হয়। ফাহাদের সাথে দেখা করতে হবে আজ। গাড়িতে উঠে ফাহাদের অফিসের দিকে যেতে থাকে নাভান। মাঝখানে গাড়ি জ্যামে পরায় নাভান বিরক্ত হয়। এইদেশের পপুলার সমস্যা এটা। বিশ মিনিট জ্যাম পরে থাকে গাড়ি। নাভান হঠাৎ জানলা দিয়ে বাইরে তাকাতেই উলটো দিকের একটা গাড়িতে ইনায়া কে দেখতে পায়। যে সিটে হেলান দিয়ে চোখ বুঝে রয়েছে। নাভান এক ধ্যান তাকিয়ে থাকে ইনায়ার দিকে। নাভান হঠাৎ লক্ষ্য করে ইনায়ার চোখের কার্নিশ দিয়ে গড়িয়ে অশ্রুধারা বয়ে যাচ্ছে। নাভানের ভিতরটা কেন যেন নড়ে উঠে। সে ভেতর থেকেই চাইতে লাগলো এই মেয়েটা যেন না কাঁদে। যেটা তার দেখতে একটুও ভালো লাগছে না। অনেক্ক্ষণ বাদেই জ্যাম ছুটে। নাভানের নজর এতোক্ষণ ইনায়াতেই নিবদ্ধ ছিল। গাড়ি যেতেই নাভানের হুঁশ আসে। সেও গাড়ি স্টার্ট দিয়ে গন্তব্যের দিকে যেতে থাকে। ফাহাদের কাছে গিয়ে প্রথমেই, ইনায়ার প্রতি যে সন্দেহ হচ্ছে তা ভাঙতে হবে। কেন যানি তার মন বলছে। এটাই সেই ইনায়া।
চলবে……………
#যাতনা_আমার
#সানজিদা_ইসলাম_সূচনা
#পর্ব : ২০
( কপি করা সম্পুর্ন নিষিদ্ধ)
বুকের বা পাশে হাত দিয়ে হতবাক হয়ে বসে রয়েছে ইশান। তিথি তার সামনে বসে রক্ত চোখে তাকিয়ে আছে। সে পারলে এখন তাকে গিলে খেত। অসম্ভব সুন্দরী তিথি যখন শাড়ী পরে রেস্টুরেন্টের দরজা দিয়ে ভিতরে আসে। ইশানের হৃদয় টা সেখানেই থমকে গিয়েছিল। সাদা শাড়ী পরা তিথিকে ইশানের কাছে স্নো হোয়াইট লাগছিলো। ইশানের মুগ্ধতা তখনই শেষ হয় যখন তিথি এগিয়ে এসে তার বুকের বা পাশ টা কামড়ে ধরে। তীব্র ব্যথায় ইশান এক ঝাড়া দিয়ে তিথিকে তার কাছ থেকে সরিয়ে দেয়। তিথি দাঁত কিড়মিড়িয়ে ইশানের সামনের সিটে বসে পরে।
-” এটা কি হলো তিথি? ”
-” সিল মেরে দিয়েছি। যাতে করে তোমার বউ এটা দেখে তোমার থেকে দশ হাত দূরে থাকে। ”
ইশান চমকায়। হতভম্ব হয়ে জিজ্ঞেস করে,
-” বউ মানে? কি বলছো এইসব? ”
তিথি এবার ফুঁসে উঠে গজগজ করে বলতে থাকে,
-” ন্যাকা? কিছুই জানো না? দুইদিন পর তো বউ নিয়ে এসে বলবে, আমি জানিনা কিছুই। ঘুম থেকে উঠে দেখেছি বিয়ে হয়ে গেছে। ”
ইশান এবার একটু রেগে যায়। কখন থেকে আজেবাজে কথা বলে চলেছে তিথি। কিঞ্চিত রাগী গলায় তিথি কে বলে,
-” কি হয়েছে বলবে তো আগে? ”
তিথি এবার আচমকাই কেঁদে উঠে। ইশান এবার পুরোপুরি আশ্চর্য হয়ে সুধায়,
-” কাঁদছ কেনো? ”
-” তোমার নাকি নিধির সাথে বিয়ে? ”
‘ কি ‘ চমকে যায় ইশান। বিরক্ত স্বরে বলে,
-” কি বলছো এইসব? মাথা খারাপ হয়েছে? কোথা থেকে কি শুনেছো? ”
তিথি ইনায়ার সাথে নিধির বলা সকল কথা বলে। সব শুনে ইশান হতভম্ব হয়ে যায়। তার পরিবার তার পিঠ পিছে এতো বড়ো প্লান করেছে? আর নিধি? সে কি করে এটা মেনে নিলো। এটাই বুঝতে পারছে না ইশান। সে তিথির দিকে এগিয়ে যায়।
-” সত্যি বলছি তিথি, আমি কিছুই জানিনা। তুমি কেঁদো না। আমি বাড়ির সবার সাথে এই বিষয়ে কথা বলবো। সাথে তোমার আমার বিষয়েও কথা বলবো। ”
তিথি আদুরে গলায় জিজ্ঞেস করে,
-” সত্যিই বলবে তো? ”
ইশান সহসাই বলে ওঠে, -” অবশ্যই বলবো। ”
তিথি এবার একটু নরমাল হয়। ইশান ভাবে অন্য কথা। এমন বাজে বুদ্ধি নিশ্চয়ই তার গিন্নি সবাই কে দিয়েছে। তার খবর তো সে বাড়িতে গিয়েই নেবে। কিন্তু? বাকি সবাই কি করে তার এই প্রস্তাব মানতে পারে। আর নিধি? ইশান ভাবতেই পারছে না। নিধি কি করে তাকে অন্য কিছু ভাবতে পারে? কিছুতেই মাথায় ঢুকছে না ইশানের।
নাভান ফাহাদের অফিসে এসেছে অনেক্ক্ষণ হলো। দুজন মিলে অনেক গল্প জুড়ে দিয়েছে। কত-শত কথা দু’জন জমিয়ে রেখেছিল। এতোকিছুর মধ্যে ইনায়ার কথা একবারের জন্যও জিজ্ঞেস করতে পারেনি নাভান। কিছুক্ষণ সময় যেতেই সেখানে জায়ান আসে। নাভান কে দেখে চোখমুখ শক্ত করে ফাহাদের পাশে বসে।
-” মিটিং দু-ঘন্টা পর দিয়েছ। কোনো সমস্যা? ”
জায়ান গম্ভীর স্বরে বলে। ফাহাদ হালকা হেঁসে জায়ান কে বলে ওঠে,
-” আর বলিস না। এতোদিন পর নাভান কে পেলাম। তাই একটু সময় নিচ্ছি। ”
নাভান জায়ানের দিকে তাকায়। জায়ানের মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে তার প্রচুর বিরক্ত লাগছে। নাভান আলতো হেঁসে ফাহাদ কে বলে ওঠে,
-” আজ তাহলে উঠি। তোর গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে মনে হয়। ”
-” না কি বলিস? এতোটাও নয়। তোর সাথে পরিচয় করিয়ে দেই, আমার ছোট ভাই। ”
নাভান হাসিমুখে জায়ানের দিকে হাত বাড়ায়। জায়ানের অভিব্যক্তিটা দেখার মতো ছিল। সে তার মুখ আরো গম্ভীর করে নাভানের বাড়ানো হাতে হাত মেলায়।
-” আমি নাভান শাহরিয়ার মির্জা। তোমার ভাইয়ের খুব ভালো বন্ধু। ”
-” আর আমি আপনার খুব ভালো প্রতিদ্বন্দ্বী। ”
এমন বিস্ফোরণ মন্তব্য করে জায়ান রুমের বাইরে চলে যায়। ফাহাদের জায়ানের কথা শুনে কাশি উঠে যায়। এই ছেলের যা মুখে আসে তাই বলে। নাভান জায়ানের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রয়। অতিরিক্ত বুদ্ধিমত্তা সম্পূর্ণ নাভানের মাথায় বিষয়টা ধরে বসে। সে ফাহাদের দিকে প্রশ্নবিদ্ধ মুখে তাকায়। ফাহাদ হাল্কা হেঁসে বলে ওঠে,
-” ফাজিল তো ছেলেটা, প্রচুর ফাজিল। এমন কথাই বলে। তুই কিছু মনে নিস না। ”
নাভান কিছু বলে না। ক্ষানিকটা মুখ মলিন করে ফাহাদ কে সুধায়,
-” তোকে একটা কথা জিজ্ঞেস করবো ভাবছিলাম। ”
ফাহাদ নাভানের দিকে তাকিয়ে থাকে। নাভান নিজেকে কিছুটা ধাতস্থ করে জিজ্ঞেস করে ,
-” ইনায়া কি তোর কাজিন? ”
ফাহাদ কথাটা শুনে চমকায়। ইনায়ার কথা নাভান জিজ্ঞেস করছে? সে কি ভুল শুনছে? মাথা ঠিক আছে তো নাভানের? ভাবছে ফাহাদ।
-” হুম, ফুপাতো বোন আমার। ফুপির সাথে আমাদের অনেক বছর ধরেই সম্পর্ক ভাল ছিল না।
তাদের মৃত্যু, ইনায়ার সাথে প্রথম দেখায় সব বুঝতে পেরেছিলাম। এমন মিষ্টি মেয়ের সাথে এমন হবে, তা মানতে পারিনি। তোর উপর রাগ হয়েছিল প্রচন্ড। তারপর ভাবলাম, জোর করে কোনোদিন তোরা সুখী হতে পারবি না। এরচেয়ে বিচ্ছেদই ভালো। ”
নাভান কে প্রচুর অস্থির দেখায়। ফাহাদের কথার প্রেক্ষিতে কিছুই বলতে পারে না। শুধু জিভ দিয়ে নিচের ঠোঁট ভিজিয়ে মিনমিন কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,
-” তুই কি ইনায়ার কোনো ছবি বা এড্রেস আমাকে দিতে পারবি? ”
ফাহাদ হতবাক হয়ে নাভানের দিকে তাকায়। একের পর এক আশ্চর্য হচ্ছে ফাহাদ। ইনায়ার প্রতি নাভানের এতো কিউরিওসিটি, ফাহাদ কে ভাবাচ্ছে। ফাহাদের তাকানো অস্থির হয় নাভান। সে কাতর কন্ঠে দুইদিন আগের ও আজকের বিষয় গুলো ফাহাদের সাথে সেয়ার করে। সব শুনে ফাহাদ নিশ্চিত হয় যে নাভান ইনায়াকেই দেখেছে। ফাহাদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে কিছু বলবে, তার আগেই রণমুর্তি ধারন করে জায়ান আবার রুমে ঢুকে। হাতের অ্যাপেল ব্র্যান্ডের মোবাইলটা ফাহাদের দিকে ছুড়ে মেরে বাজখাঁই গলায় বলে ওঠে,
-” পনেরো দিনও হয়নি ব্রেকআপ হয়েছে। তার ভিতরেই আবার নতুন গার্লফ্রেন্ড নিয়ে জনগণের সম্মুখে ডেট করছিস? তর কি একটুও বুদ্ধি নেই? ”
জায়ানের কথায় ফাহাদ চমকায়। ভ্রু কুঁচকে কঠিন স্বরে জিজ্ঞেস করে,
-” কি বলছিস এইসব? জানি আমি একটু বেশীই রিলেশন করেছি। তাই বলে ওপেন পাবলিকে গার্লফ্রেন্ড নিয়ে প্রেম করবো? তুই আমাকে এতো লেইম কি করে ভাবছিস? তাও আবার ”
-” নিজেই দেখ। ”
ফাহাদ ফোনটা হাতে নিয়ে ওপেন করতেই, চোখ কপালে। তিরিক্ষ দৃষ্টিতে ফোনের দিকে তাকায় ফাহাদ। তারপর চিৎকার দিয়ে বলে ওঠে,
-” হোয়াট ননসেন্স? এইসব কি? ”
-” সেটা তুই ভালো বলতে পারবি। ”
গমগমে গলায় বলল জায়ান। ফাহাদ শব্দ করে ফোনটা টেবিলে রাখে। নাভান ফোনটা হাতে নেয়।
” ব্রেকিং নিউজ : আবারো প্রেমের সম্পর্কে জড়ালেন মেয়র ফাহাদ করিম। গোপন সুত্রে জানা গেছে বিরোধী দলের লোক খলিল তালুকদারের ভাইয়ের মেয়ের সাথে ডিপ রিলেশনে জড়িয়েছে ফাহাদ করিম। খলিল তালুকদারের বড় ভাই আসাদ তালুকদার। তার স্ত্রী দিয়া সাহা, তাদের মেয়েই তিলক। ” নিউজের সাথে ফাহাদ আর তিলকের রেস্টুরেন্টে বসা দুইটা ছবি। নাভান ভ্রু কুঁচকে ফাহাদ কে জিজ্ঞেস করে,
-” এটা তো আমাদের ফ্রেন্ড তিলক। সত্যিই তার সাথে রিলেশনে আছিস? তাও আবার বিরোধী দলের মেয়ে? ”
জায়ান অগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ফাহাদের দিকে। ফাহাদ মাথায় দুই হাত দিয়ে চেপে ধরে আছে। সেদিন একটা জরুরি কাজ নিয়ে আলাপ করছিল তারা। তিলক মুলত ফাহাদের কাছে একটা বিষয়ে হেল্প চেয়েছিল। সেটা নিয়েই অনেক্ক্ষণ আলাপ করেছিল। কে কখন কাজটা করেছে মাথায় ঢুকছে না ফাহাদের। ফোনটা আবার নিয়ে ভালো করে ছবি দুটো দেখে ফাহাদ।
-” আই নো ভাই তুই কি করেছিস। কিন্তু পার্টির লোকজন খুব ক্ষেপেছে। তারা বিষয় টা হালকা ভাবে নিচ্ছে না। তারা ভাবছে তুই ডাবল টাইমিং করছিস। সামনেই ইলেকশন। এখন যদি নিজেদের লোকজন বিপক্ষে চলে যায়। আমাদের আসন ছাড়তে হবে। ”
জায়ান রুষ্ট কন্ঠে বলে। ফাহাদ কঠিন দৃষ্টিতে ছবি গুলো পরক্ষ করে। ছবি গুলো রেস্টুরেন্টে প্রথম সারির টেবিল থেকে তুলা হয়েছে। ফাহাদের হঠাৎ করেই তার সামনের টেবিলে বসা নিধির কথা মনে পড়লো। নিধির তাকে দেখেই ব্যাগে হকচকিয়ে কিছু লুকানো। তাকে দেখে হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে যাওয়া সবই এখন মস্তিষ্কে হানা দেয় ফাহাদের। দপ করে চোখ গুলো জ্বলে উঠে ফাহাদের। সে নিশ্চিত, এই কাজ নিধির ধারায় হয়েছে। কিন্তু বোকা নিধি কি জানে? এই সামান্য মজাতে ফাহাদের কতোবড় সমস্যা সে ক্রিয়েট করেছে? বিপক্ষের লোক গুলোও এটাকে মই বানিয়ে উপরে উঠার চেষ্টা করবে নিশ্চয়ই। সমস্যা টা যদি ভালোই ভালোই ফাহাদ হ্যান্ডেল না করতে পারে। তাহলে, তার পদ ত্যাগ করতে হবে। রাগে ফোনটা দেয়ালে ছুড়ে মারে ফাহাদ। কিড়মিড়িয়ে জায়ানের দিকে তাকিয়ে রাগান্বিত হয়ে বলে ওঠে,
-” পাখি বড্ড উড়তে শিখেছে। তার ডানা গুলো এবার কাটতেই হবে। তুই কিন্তু আমাকে কোনো বাঁধা
দিবি না। ”
জায়ান বাজখাঁই গলায় বলে,
-” যা বুঝেছিস তা এক্সপ্লেইন কর। ”
ফাহাদ সেদিন কার কথা সব নাভান আর জায়ান কে বলে। সব শুনে তাদের মনও নিধির দিকেই সন্দেহর তীর ছোড়ে। জায়ানের প্রচন্ড রাগ হচ্ছে। লোকে ঠিকই বলে। মেয়েদের বুদ্ধি হাঁটুর নিচে। এদের রাগ আর তর্ক দিয়ে পুরুষদের উপরে থাকতে পারলেই চলে। আগেপাছে কি হবে না হবে, তা দেখার বা বোঝার সময় তাদের নেই। কিন্তু নাভানের মনে চলচে অন্য বিষয়। সে কিছুটা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে,
-” নিধি কেনো তোর সাথে এমন করবে? কিসের শত্রুতা তোদের? ”
এ যাত্রায় ফাহাদ একটু দমে। তার মুখের আদল কিঞ্চিৎ পরিমাণ দমিয়ে রাখে। কি জবাব দেবে নাভান কে? যে তোর বাচ্চা বোনের সাথে অতিরিক্ত ফ্লার্ট করার ফল এটা। জায়ান বিরক্তিতে চোখমুখ কুঁচকায়। জায়ানের আগে থেকেই তাদের সকল বিষয় জানা। আগে থেকেই ফাহাদ কে সাবধান করেছিল জায়ান। কিন্তু ফাহাদ শুনলে তো? একযুগ ছোট বাচ্চা মেয়ের সাথে লাগাটা মনে হয় ফাহাদের কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখন নাভান কে কি বলবে ফাহাদ। অনেক অসস্থি লাগছে তার। তবুও ফাহাদ ভেতরে সাহস সঞ্চয় করে নাভানের দিকে তাকিয়ে করুন তবুও শক্ত গলায় বলে ওঠে,
-” আই লাভ হার! এক সময় তাকে চেয়েছিলাম আমি। এইটুকুর জন্যেই আমি অপরাধী। এখন যদি সে এই সামান্য বিষয় নিয়ে আমার সাথে আরো লাগতে আসে? তাহলে আমি তার প্রতি আমার পাপের বোঝা আরো বাড়িয়ে নেবো। তখন আমাকে তোরা কেউ আটকাতে পারবি না। ”
বিস্ফোরণ মন্তব্য করে ফাহাদ উঠে চলে যায়। তার এমন কথায় নাভানের মুখ গম্ভীর হয়ে যায়। কিসের মধ্যে কি? ফাহাদ নিধিকে ভালোবাসে? এটা যেন তার মাথায় ঢুকছেনা। আর যাইহোক, নিধি যে ফাহাদ কে মানবে না। এটা গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারে নাভান। কারণ, অনেক আগেই নিধি নাভানের কাছে নিজের মনের মানুষের কথা বলে দিয়েছে। ফাহাদ কে তো রিজেক্ট করবেই। ভাবছে নাভান। বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে জায়ানের দিকে এগোই নাভান। এদিকে জায়ান মনেমনে ভাইকে বাহবা দিচ্ছে। তার ভাই তাহলে রিয়াল ভালোবাসা নিয়ে কনফিউজড নয়। এখন তাকে রাজনৈতিক দিক সামলাতে হবে। এমনিতে শান্ত ফাহাদ রাগলে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। জায়ান চলে যেতে নিলেই নাভান পিছন ডাকে। জায়ান সোজা হয়ে নাভানের সামনে দাঁড়ায়। ছয় ফুট লম্বা দুইজন সুগঠিত বলিষ্ঠ দেহের পুরুষ। দু’জনেই অসম্ভব সুন্দরের অধিকারী। একজন অন্যজনের থেকে বয়সে বড় হলেও তাদের বডি স্টাইল একি রকম নিখুঁত। জায়ান তিক্ত বিষাক্ত চোখে নাভানের দিকে তাকিয়ে আছে। নাভানের অভিজ্ঞ মস্তিষ্ক সেটা বুঝেও না বুঝার প্রয়াস চালায়। এখন এই ছেলের সাথে তার কথা বাড়ানোর ইচ্ছে নেই। দীর্ঘশ্বাস ফেলে নাভান শান্ত স্বরে বলে,
-” ফাহাদের মাথা এখন গরম আছে। নিধির সাথে আমি কথা বলবো। তুমি প্লিজ ফাহাদ কে বুঝিয়ে বলো। নিধি এখনো অবুঝ। আমি দেখছি বিষয় টা। তোমরা মিডিয়া ডেকে মিট আপের ব্যবস্থা করলে, আমি নিধিকে ঠিক নিয়ে আসবো। ”
জায়ান মাথা নাড়ায়। নাভান ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ফেলে সামনের দিকে এগুতেই জায়ান ঘাড় বাঁকিয়ে বলে,
-” লড়াই তাহলে লেবেলে লেবেলেই হবে? ভালো খুব ভালো। আমার আবার প্রতিদ্বন্দ্বী মনের মতো না হলে, প্রতিযোগিতায় নামতে ভালো লাগে না। ”
নাভান এবার পিছু ফিরে জায়ানের দিকে তাকায়। মুচকি হেঁসে, মুখ গম্ভীর তবুও হাসি নিয়ে বলে,
-” লড়াই করতে হলে আগে তার মূলগ্রন্থ পাঠের বিদ্যা অর্জন করতে হয়। তা নাহলে সে মুর্খ প্রতিযোগি। আমি সেই মুর্খের কাতারে পরিনা। নদীর কুল কিনার না মেপে আমি অন্তত নদী সাঁতরে পার হবার কথা মনেও আনবো না। ”
জায়ান দাঁত বের করে হাসে। তারপর একটু রসিকতা ছড়িয়ে শান্ত স্বরে বলে,
-” বেস্ট অফ লাক। আপনার যাত্রা শুভ হোক। ”
দুজনেই দুজনের দিকে শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। একজন জানায় অন্যজন অজানায় তাদের সামনের দিনগুলোর জন্য প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য মনোবল শক্ত করে।
ইনায়া আর মিজানুল করিম মির্জা বাড়িতে এসেছে অনেক্ক্ষণ হবে। মিজানুল করিম ডিভোর্স পেপার নাহিদ মির্জা ও সোহানার কাছে দিয়েছে। উনি বলেছেন সকল কন্ডিশন নাভান কে দেখিয়ে তার থেকে সাইন নিয়ে নিতে। তারপর ইনায়া সাইন করে দিবে। আজকে ইনায়া আর সোহানার মুখ খুব শান্ত। তাদের মুখ দেখে বোঝার উপায় নেই ভিতরে কি চলছে। নাহিদ মির্জা হতাশ হয়ে মাথা নিচু করে নেয়। বাড়ির সবারও ইনায়ার জন্য ভেতর নড়ে ওঠেছে আজ। আয়েশা আর নিপা নির্বিকার। সবচেয়ে বেশি কষ্ট নিধি পাচ্ছে। তার এই মিষ্টি ভাবিটা আর ভাইয়ের বউ থাকবে না। কি হতো ভাই ভাবি কে মেনে নিলে? নিধির অবুঝ মাথায় এই প্রশ্নটাই বার বার ঘুরতে থাকে। নওয়াজ মির্জা এবার নাহিদ মির্জা কে ডিঙ্গিয়ে বলে উঠলো,
-” আজকে বোধ হয় তা আর সম্ভব হবে না। নাভান বাইরে আছে। ও এলে আমরা পরিবারের সবাই মিলে দেখবো বিষয় টা। ”
ইনায়ার বুক টা দুমড়ে মুচড়ে উঠলো যেন। মনকে তো শক্ত করেছিল সে। কিন্তু পরিস্থিতির সামনে আসতেই ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যাচ্ছে। ইনায়া নিজেকে আরো কঠিন করলো। নওয়াজ মির্জা তখন খানিকক্ষণ চুপ থেকে আবার বলে ওঠে,
-” দেনমোহরের হিসাবটা বোধ হয় এখন করে নিলেই ভালো হয়। পরে নাহয় এমাউন্ট ইনায়ার কাছে পাঠিয়ে দিবো। ”
এ যাত্রায় ইনায়া মুখ খুলে। সে সামনের সবার দিকে তাকিয়ে ম্লান হেঁসে বলে,
-” যেখানে আমাদের বিবাহিত জীবনে নেই কেউ কাউকে জানাশোনা, না কাউকে হয়েছে ভালো করে দেখা। সেখানে, দেনমোহরের হিসেবটা যেন বড়োই অদ্ভুত। আমরা দুজনেই দুজনের প্রতি কোনো অধিকার দেখাইনি। সেখানে দেনমোহর আর কি? এটা আমি চাইবো না। দেনমোহর তো সংসার জীবনে স্বামীর কাছে স্ত্রীর প্রাপ্য অধিকার। আমাদের তো কোনোদিন সংসারই হয়নি। দেনমোহর দাবি আমি রাখবো না। এটা বাদ দিন। ”
পিনপিনে নিরবতা চলছে মির্জা বাড়ির বিশাল বড়ো হলরুমটায়। ইনায়ার কথার পরে কেউ আর কথা বলে না। শুধু সোহানা নির্বিকার শান্ত চোখে ইনায়ার দিকে তাকিয়ে থাকে। মিজানুল করিম একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ইনায়া কে ব’লে,
-” তাহলে এইরকথাই থাক। উঠো, আমাদের এবার বেরোতে হবে। ”
ইনায়া সম্মতি জানায়। মিজানুল করিম সবার থেকে বিদায় নিয়ে আগে বেরিয়ে পরে। ইনায়া এবার সোহানার দিকে এগুতেই। তিনি তাকে জড়িয়ে ধরে শান্ত গলায় বলে,
-” ক্ষমা করে দিস মা। ক্ষমা করে দিস। ”
ইনায়া ম্লান হেঁসে বাড়ির সবার উদ্দেশ্যে বলে,
-” তোমরা কেউই আমার কাছে গ্লিটি ফিল করবেনা। যা হয়েছে তা আমার নিয়তি ছিল। ”
আয়েশা মির্জা এবার ইনায়ার সামনে এসে ভাঙা গলায় বলল,
-” তোর সাথে অনেক খারাপ ব্যবহার করেছি। আমি মন থেকে এমনটা করতে চাইনি। সবকিছু ভুলে যাস। দেখবি, তুই অনেক সুখী হবি জীবনে। ”
ইনায়া কিছু বলে না দীর্ঘশ্বাস ফেলে সামনে হাটে। যেখানে, জীবনটা তার যাতনার কালো রাতের আধারে ডুবে রয়েছে। সেখানে, সুখের সূর্য উঠবে কি? নিজের মনকেই প্রশ্ন করে কোনো উত্তর পায়না ইনায়া। গাড়িতে উঠে বসতেই সেটি ধিরে ধিরে মির্জা বাড়ির মূল ফটকের দিকে এগোয়। মূল ফটক থেকে গাড়ি বের হতেই, আরও একটা গাড়ি গেইট পেড়িয়ে মির্জা বাড়ির দিকে আস্তে করে ঢুকে। দুই প্রান্তের দুই গাড়িতে বসা দুটি ভিন্ন মানুষ চমকে উঠে গাড়ির জানলা ভেদ করে সামনে তাকায়। মিল হয় দুই জোড়া চোখের। এক জোড়া চোখের ভেজা নেত্রপল্লব শান্ত নির্বিকার। তো অন্য জন্য অবাক বিস্ময় ভরা চাহনি। যেনো এটা হবার ছিল না। ইনায়াদের গাড়ি বামে ঘুরিয়ে দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলছে। পিছে ফেলে যাচ্ছে অবাকের চুড়ান্ত সীমায় থাকা নাভান শাহরিয়ারকে। যে এখন নিস্প্রভ হয়ে তাকিয়ে আছে ইনায়াদের গাড়ির যাওয়ার দিকে। সব সংশয় সন্দেহ দূর হলো নাভানের। সে যেটা ধারনা করেছিল সেটাই ঠিক। তবে কি প্রতিযোগীতায় নামার সময় এতো জলদিই এসে গেছে?
চলবে………….