#যাতনা_আমার
#সানজিদা_ইসলাম_সূচনা
#পর্ব: ৩৩ (ক)
মির্জা বাড়ির সবাই এখন করিম ভিলায় আছে। সকলের মুখ থমথমে অবস্থায়। মিনারা বেগম গতকাল থেকে ফাহাদের সাথে একটা কথাও বলেননি। তিনিও বেশ শান্তই আছেন আপাতত। সকাল বেলায় ফাহাদ নতুন ফার্নিচার এনে, রুমে লোকজন দিয়ে সেটা করাচ্ছিলো। মিজানুল করিম ছেলের রুমের হাল দেখে উচ্চ স্বরে হেঁসে ছিলেন। বুঝিয়েছেন ফাহাদ কে, বিয়ে করে এবার বোঝ মজা। ফাহাদ খালি গায়েই এতক্ষণ লোকজনের সাথে সবকিছু ঠিকঠাক করতেই মির্জা বাড়ির লোকেরা আসেন বাড়িতে। নিধি মাকে দেখেই তার কোল জড়িয়ে শুয়ে পরে। এক্ষনো একই অবস্থায় আছে। ফাহাদ এখনো খালি গায়ে দিব্যি তাদের সামনে বসে আছে। কারণ সে শরীরে কিছু জড়ানো সময় পায়নি। নাহিদ মির্জা এসেই নিধি নিয়ে যাওয়ার কথা তুলেছেন। ফাহাদও এক কথায় সেটা নাকচ করে দিয়েছে। এই নিয়ে কিছু কথা কাটাকাটি হয়েছে দুই পরিবারের মধ্যে। মিজানুল করিম নওয়াজ মির্জা আর নাহিদ মির্জাকে বোঝানোর স্বরূপ বলে উঠলো,
-” দেখুন ভাই, বিয়ে টা তো ছেলে খেলা নয়। যেভাবেই হোক বিয়ে টা তো হয়েছে। সেটা আমাদের মানতে হবে। ঝগড়া বিবাদ করে সমস্যা বাড়িয়ে লাভ নেই আর কোনো। ”
নাহিদ মির্জা মিজানুল করিমের কথায় মাথা ঝুকালেন কিছুটা। তারপর গম্ভীর গলায় বলে ওঠেন,
-” তা ঠিক, কিন্তু এখন নিধির মনের যা অবস্থা সে নিজেকে এখনো ভালো করে ট্রমা থেকে বের করতে পারেনি। এই অবস্থায় এমন পরিস্থিতিতে নিজেকে মানিয়ে নেওয়া নিধির জন্য খুব একটা ভালো হবেনা বলে আমি মনে করছি। নিধি যেহেতু চাইছে, ও যাক আমার সাথে। বাকিটা সে সুস্থ মাথায় ভেবে দেখবে। ফাহাদের সাথে সংসার করবে কি না। ”
নাহিদ মির্জার কথা শেষ হতেই, ফাহাদ ক্ষ্যাপা ষাঁড়ের ন্যায় হয়ে বলল,
-” আমি নিধিকে যেতে দিচ্ছি না কোথাও। সে চাইলেও না। ”
সোহানা মির্জা এতক্ষণ চুপ থেকে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ফাহাদের দিকে তাকায়। শান্ত গলায় তাকে বলে ওঠে,
-” আমাদের মেয়ে যেহেতু যেতে চাইছে, তাতে তুমি বাঁধা দিতে পারো না। জোর করে কিছুই হয় না। তুমি নিধিকে জোর করে মিথ্যা বলে বিয়ে করেছো সেটা উচিত হয়নি। গার্ডিয়ান হিসেবে এখন আমরা যা চাইবো তাই হবে। ”
ফাহাদের পাশে বসা আয়েশা মির্জা বসে বসে পান চিবুচ্ছেন। তার এই বাড়িতে এসে মত ঘুরে গেছে। তিনি এখন জোর করে হলেও নিধিকে এই বাড়িতে রেখে যাবেন। মনে মনে সেটাই আঁটছেন। ফাহাদ সোহানা মির্জার কথায় নাখোশ হয়ে বলল,
-” আইন অনুযায়ী আর ধর্ম মতে নিধির গার্ডিয়ান এখন আমি। ওর আমার কথ অনুযায়ী চলতে হবে। সেটাতে আপনারা বাধা দিতে পারবেন না। ”
-” আমি থাকবো না আপনার সাথে। বাড়িতে গিয়েই আপনাকে ডিভোর্স দিবো আমি। ”
হঠাৎ করেই মুখ উঠিয়ে বলে ওঠে নিধি। ফাহাদ ভ্রু কুঁচকে নিধির দিকে তাকালো। ডিভোর্স দেবে মানে কি? না তার বউকে আর মির্জা বাড়ির সংস্পর্শে রাখা যাবেনা। গলার জোর অনেক বেরে গিয়েছে। ফাহাদ কিড়মিড়িয়ে কিছু বলতে যাবেন। তার আগেই আয়েশা মির্জা খেঁকিয়ে উঠেন।
-‘ চুপ করো তোমরা সবাই। আমি এখানে আছি না,তো কি? নাহিদ, নওয়াজ আমি ভাবছি নিধিকে আমরা নেবো না। বিয়ে তো একবারি হয়। সম্পর্ক টা কে একটা সুযোগ দেই আমরা। ”
মিজানুল করিম হ্যাঁ মিলালেন উনার সাথে। ফাহাদ খুশি হলো অনেক। দাদি তার কাজ সহজ করে দিবে মনে হয়। নিধির মাথায় যেনো বাঁশ পরলো। দাদি কি বলছে এইসব? সোহানা মির্জাও অবাক হলেন। আয়েশা মির্জা হঠাৎ মত ঘুড়ালেন কেন?
-” দাদি কি বলছো এইসব?
-” মা আপনার মাথা ঠিক আছে তো? ”
আয়েশা মির্জা সোহানা আর নিধির কথায় কোনো গুরুত্ব দিলেন না। ছেলেদের দিকে তাকিয়ে আবার বলে উঠলো,
-” শুনেছিস কি বলেছি? এই নিয়ে আর কোনো কথা শুনতে চাইছি না। ”
নাহিদ মির্জা আর নওয়াজ মির্জা একে অপরের দিকে তাকালেন। আয়েশা মির্জার মতিগতি হঠাৎ করেই চেঞ্জ হয়ে যায়। নওয়াজ মির্জা শান্ত গলায় বলেন,
-” মা এখানে নিধির মতের গুরুত্ব বেশী। ও যেটা চায় সেটাই হওয়া উচিত। ”
-” রাখ তার মত চাওয়া। সে তো জানেই না তার ভালো কোনটায়। ”
এতোক্ষণ নিরব ভুমিকা পালন করা নিপা এবার মুখ খুললো। তিনি ভ্রু কুঁচকে আয়েশা মির্জাকে জিজ্ঞেস করে উঠে,
-” মা আপনিই তো চাইছিলেন না নিধি এখানে থাকুক। আর এখানে এসেই মত পাল্টে ফেললেন? ”
আয়েশা মির্জা মুখ ভেঙালেন। কথার কোনো উত্তর না দিয়ে তার পাশে বসা ফাহাদের দিকে তাকালেন। এদিকে পরিবেশ ঠান্ডা করে দিয়েছেন আয়েশা মির্জা। নিধি মায়ের আঁচল ধরে বারবার বলছে তাকে নিয়ে যেতে। ফাহাদ আয়েশা মির্জার গাল ধরে ফিসফিস করে বলে ওঠে,
-” ধন্যবাদ দাদী, আমার বউ কে দিয়ে যাবার জন্য। ”
আয়েশা মির্জা হাসলেন কিছুটা। অতঃপর ফাহাদের দিকে তাকিয়ে এবার ভ্রু কুঁচকালেন। গম্ভীর কন্ঠে আস্তে করে জিজ্ঞেস করলেন,
-” তা নাত জামাই? তোমার কাপড় কই? এমন খালি গায়ে ঘুরছো কিসের জন্য? ”
-” বেশ আছে দাদী, কি আর বলবো। কালকে থেকে তো আপনার নাতনি আমাকে কাপড় পরতেই দিচ্ছে না। আর এখন আপনাদের দেখে ঢং করছে। ”
আয়েশা মির্জা অবাকের ভঙ্গিতে বলে ওঠেন,
-” সত্যি? ”
ফাহাদ হাসিমুখে মাথা নাড়ায়। এখন তো আর আয়েশা মির্জা নিধিকে আরো আগে নিবেনা। স্বামীর সাথে এখন থাকাটাই তার জন্য উত্তম। নিধির ফাহাদের এমন মিথ্যা কথায় হা হয়ে গেল। রাগি দৃষ্টিতে ফাহাদের পানে তাকায় সে। হঠাৎ করেই ফাহাদের ফোনে জয়ানের কল আসে। ফাহাদ ফোন রিসিভ করে ভ্রু কুঁচকে ফেলে খানিকটা। তারপর হন্তদন্ত হয়ে উপরে গিয়ে গায়ে শার্ট জড়িয়ে আসে। মিনারা বেগম ছেলের এমন তাড়াহুড়ো দেখে এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করেন,
-” কোথায় যাচ্ছিস? কোনো সমস্যা? জায়ান ঠিক আছে তো? ”
-” জায়ান ঠিক আছে মা। ইনায়া কিডন্যাপ হয়েছে আমি আসছি। ”
এইবলে ফাহাদ হন্তদন্ত হয়ে বাড়ির সবাই যায়। পরিস্থিতি এখন অন্যদিকে। বাড়ির সবাই অবাক হয়ে আছে। ইনায়া কে কিডন্যাপ করলো কারা। হঠাৎ করেই সবার মনে ইনায়ার জন্য ভয় শুরু করে দেয়। নিধির মতোই ইনায়ার হাল হবে নাতো? সোহানা মির্জা আতংকিত মুখ নিয়ে নাহিদ মির্জার দিকে তাকালো। উনাকেও বেশ চিন্তিত লাগছে। মিজানুল করিম প্রথমে একটু ঘাবড়ে গেলেও এখন কিছুটা নিজের মনকে স্বস্তি দিচ্ছেন এই ভেবে, যে জায়ান ইনায়ার কিছুই হতে দেবে না। আয়েশা মির্জা এবার ভ্রু কুঁচকে বললেন,
-” ছেলে দুটো ওখানেই যায়নি তো? সকালে কিসের জানি পুলিশ ইনফর্ম করার কথা বলছিলো। ”
নওয়াজ মির্জা কথাটাকে উড়িয়ে দেন। তিনি শান্ত গলায় মায়ের পানে তাকিয়ে বলে ওঠেন,
-” তেমনটা হবেনা মা, ইশান আর নাভান এই বিষয়ে জানলে আমাদের বলতো ঠিকই। ”
কেউ কোনো উত্তর দিলোনা। সামনের পরিস্থিতির জন্য শুধু সবাই ইনায়ার জন্য দোয়া করতে লাগলো। বাবা-মা হারা মেয়েটার সাথে যেন কোনো ভুল কিছু না হয়। সোহানা মির্জা নিধিকে বুকে নিয়ে ইনায়ার জন্য কাঁদতে লাগলেন। তিনি ইনায়ার বাবা মাকে দেওয়া কথাটা রাখতে পারেননি। মিনারা বেগম মিজানুল করিম কে তাগিদ দিলেন জায়ান কে কল করার জন্য। মিজানুল করিম তাই করলেন। কিন্তু ফোন তুলেনি জায়ান।
-” না জানি আমার ছেলে দুটো আবার কোন বিপদে পা দেয়। আমার কি ভাগ্য? দুই ছেলে এতো মহান নেতা হতে গিয়ে নিজেদের জীবন শেষ করে দিচ্ছে। একজনের বউ ধর্ষিতা আর অন্য জন বিয়ে করবে ডিভোর্সি। এই দিন দেখার জন্য ছেলেদের মানুষ করেছিলাম? ”
মিনারা বেগমের কথায় সবাই আশ্চর্য বনে গেলো। এ নয় যে নিধিকে ধর্ষিতা বলেছে। আশ্চর্য হয়েছে ডিভোর্সির কথা শুনে। সোহানা মির্জা মিনারা বেগম কে জিজ্ঞেস করে উঠে,
-” মানে? কার কথা বলছেন আপনি? ”
মিজানুল করিম মিনারা বেগমকে চুপ করতে বলছেন। তারপরও মিনারা থামেন না। তিনি কিছুটা রাগ নিয়ে বলে উঠেন,
-” আপনাদের ডিভোর্সি বউ ইনায়া। যাকে এখন আমার ছেলে বিয়ে করতে চাইছে। তাই বলছি সারাদেশের সমাজ সেবা আমার ছেলেরা নিয়ে রেখেছে। ”
কেউ আর কোনো কথা বলার ভাষা পেলো না। চুপচাপ হয়ে গেলো যেন সবকিছু। নিধিও অবাকের পর্যায়ে। এইজন্যই কি জায়ান ইনায়ার প্রতি এতো আগ্রহ প্রকাশ করছে? উত্তর মেলে না কোথাও। সব যেন ইনায়ার ফিরে আসায় রেয়েছে।
,
,
,
,
পুরান ঢাকার ইনায়াদের বাড়ির সামনে দাড়িয়ে আছে নাভান। তখন অদিতি তাকে ফোনে ইনায়ার ভিডিও দিয়ে এখানে আসতে বলেছিল। নাভান তৎক্ষনাৎ শুধু ইশান কে এই ব্যাপারে জানিয়ে পুলিশ আনতে পাঠিয়ে দেয়। ফাহাদ কে মেসেজ করে দেয় সবটা। অদিতি নাভান সতর্ক করেছিল। যেন কেউ কিছু যানতে না পারে। কিন্তু নাভান রিস্ক নিলোয় একটু। নাভান বাড়িতে ঢুকবে সেই মুহূর্তে দুজন লোক নাভানের মুখে রূমাল চেপে ধরে। নাভান বুঝে গিয়ে অনেক ছোটার চেষ্টা করে ওই লোক গুলোর থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নেয়। কিন্তু শেষ রক্ষা আর হয় না। তীব্র ঝাঝে আস্তে আস্তে চোখ বন্ধ হয়ে আসে নাভানের। শরীরের ভর ছেড়ে দেয় মাটিতে। সময় অতিবাহিত হয় ঘন্টার পর ঘন্টায়। নাভান নিভু নিভু চোখে আস্তে আস্তে করে তাকায়। মাথাটা প্রচন্ড ঝিমিয়ে রয়েছে তার। একটা বিছানায় শোয়া নাভান। হঠাৎ করে ইনায়ার কথা মাথায় আসতেই নাভান বিছানা থেকে উঠে বসে। বহু কষ্টে দাড়িয়েও তাল পাচ্ছে না নাভান। এটা কোন জায়গা তার মাথায় ধরছে না। রুমটা বাইরে থেকে লাগানো। নাভান রুমের মধ্যে থাকা গ্লাসের পানি দিয়ে মুখে ভেজালো। তখনই ওয়াশরুমের দরজা খুলার শব্দ পেলো নাভান। পিছন ফিরতে রাগে কিড়মিড়িয়ে উঠে নাভান। তার পিছনে অদিতি দাঁড়ানো। খোলামেলা লাল একটা নাইটি পড়ে অর্ধনগ্ন অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে অদিতি। ঠোঁটে তা আবেদনময়ি হাসি লেগে আছে। নাভানের রাগ হলো ভিষণ। সে প্রচন্ড রেগে জিজ্ঞেস করে,
-” হচ্ছে টা কি? কি চাইছো তুমি? ইনায়া কোথায়? ”
অদিতির মুখের হাসি আরো চওড়া হলো। সে লাস্যময়ী ভঙ্গি করে নাভানের সামনে আসে। দু’হাতে নাভানের গলা জড়িয়ে লো ভয়েজে বলে ওঠে,
-” প্লিজ নাভান, আমাদের এই মিষ্টি সময়ে ইনায়া কে কেন মনে করছো? এনজয় দিস নাইট! ”
নাভানের রাগের মাত্রা ছাড়ালো। হঠাৎ করেই অদিতির গলা চেপে ধরে সে। তারপর হিসহিসিয়ে বলে ওঠে,
-” আমার হাতে মারার এতো সখ হয়েছে তোর? যে এখানে চলে এসেছিস। নিধির সাথে যা করেছিস, তার জন্য তো তোকে আমি জানে মেরে ফেলবো। ”
অনেক জোরে গলা চেপে ধরায় অদিতির দম বন্ধ হয়ে আসছে প্রায় তবুও ঠোঁটের হাসি বজায় রেখে আস্তে করে বলে উঠে,
-” আজ এই প্রথম বার এমন হলো যে তুমি আমাকে এরূপ অবস্থায় দেখে প্রসংশা করোনি? সব ওই ইনায়ার জন্য হয়েছে। আমার বেড পারফরমেন্স কি এতোটাই খারাপ ছিলো নাভান? যে ওই সামান্য মেয়ের জন্য তুমি আমাকে ছেড়ে দিয়েছো?
নাভানের হাত আরো দৃঢ় করে। অদিতি এবার দম বন্ধ হয়ে যাবার পালা। বহু কষ্টে বলে ওঠে,
-” ইনায়া কে দেখতে চাইবে না বেইবি? ”
নাভান ফট করে হাতের বাধন আলগা করে। অধৈর্য হয়ে জিজ্ঞেস করে,
-” ইনায়া কই? কি করেছিস ওর সাথে? ”
অদিতি গলায় ধরে কাশতে থাকে। কিছুক্ষণ পরে নিজেকে সামাল দেয় সে। তারপর উপরের নাইটি টা গায়ে লাগিয়ে রুম থেকে বেড়িয়ে যায়। নাভান অদিতির পিছু করে একটা রুমে যেতেই থমকে যায়। অদিতির দিকে নাভান রক্ত চোখে তাকিয়ে ইনায়ার কাছে যায়। মেঝেতে পরে আছে ইনায়া। নাভান ইনায়া কে দেখে আঁতকে উঠল। পুরো শরীরে চাবুকের মার। গালে পাঁচ আঙুলের ছাপ স্পষ্ট। ঠোঁট কেটে রক্ত পরছে। ইনায়ার পুরো শরীরেই মার। নাভান কোথায় ধরবে কি করবে বুঝতে পারলো না। চোখের কার্নিশ দিয়ে এক ফোটা পানি বের হবার আগেই সেটা মুছে নেয় নাভান। নাভান ভাবে সব তার নিজের জন্য হয়েছে। তার পাপের শাস্তি সবাই কেনো পাচ্ছে? কেউ ভুল করে তো মাফ পায়। কিন্তু নাভান বড় পাপ করেছে। সেটার মাফ হলেও, তার দহন সারাজীবন বইতে হবে। তার পাপের জন্য নিজের বোন, পুরো পরিবার শেষ হয়েছে। আবার এখন ইনায়া। নাভানের চোখ পানিতে ভড়ে গেছে কিন্তু সেটা সে শত চেষ্টা করেও ধরে রাখতে পারেনি। গাল বেয়ে ইনায়ার চোখের উপর পরতেই, ইনায়া মৃদু নড়ে উঠে। হালকা ভাবে পাপড়ি ঝাপায় সে। নাভান কে দেখে বেশ অবাক হলো ইনায়া৷ নড়তে গিয়েও পুরো শরীর ব্যাথায় কেঁপে ওঠে তার। ঠোঁট উলটে দেয় ইনায়া। নাভানের জানটা যেন বের হয়ে যায়। ইনায়ার গালে আলতো হাত রেখে মৃদু স্বরে জিজ্ঞেস করে,
-” এখন কেমন লাগছে? নিশ্চয়ই খুব কষ্ট হচ্ছে? ”
ইনায়া কোনো উত্তর দিলো না। চুপটি করে রইলো। নাভান আলতো হাতে ইনায়া কে উঠালো। তারপর অদিতির ভয়ংকর চোখে তাকিয়ে বলে ওঠে,
-” আর কতো নিচে নামবে তুমি? লজ্জা করে না তোমার? ”
অদিতি হাসে। তারপর আফসোস নিয়ে বলে উঠে,
-” এই মেয়ের নামও তো শুনতে চাইতে না। আর এখন? আর তোমাতে পাওয়ার জন্য আরো নিচে নামতে পারবো আমি। আমাকে কেন ঠকালে নাভান? ”
-” আমার জীবনের ওই একটা বড়ো পাপ যে হিরে রেখে তোমার মতো সিলভার স্কিন আমি বেছে নিয়েছিলাম। মায়ের শত বাধা না মেনে তোমাকে আমি লাইফে জায়গায় দিয়েছিলাম শুধু একটা কারণে। তা হলো, আমার মনে হয়েছিল তুমি আমি পারফেক্ট ম্যাচ। তার জন্য বিয়ে করেও তার মুখ না দেখে তোমার কাছে চলে গিয়েছিলাম। তোমার অতিত নিয়ে আমার কোনো মাথা ব্যাথা ছিলোনা। কিন্তু তুমি? আমাকে পাবার জন্য নিজের বাচ্চাটা মেরে দিলে? কত জঘন্য তুমি? ”
অদিতি নাভানের কথায় হেসে উঠে। অতপর শান্ত গলায় বলে,
-” তাতেও তোমার মন গললো না নাভান। তাতেও তোমার সব পেয়ে পেলাম না। ”
অদিতি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কাউকে ডাকলো। অতঃপর সেখানে পরপর বলিষ্ঠ দেহের আটজন ছেলে এসে ঢুকে। একজন অদিতির হাতে দুইটা ফাইল ধরিয়ে দেয়। অদিতি নাভানের সামনে এসে হাঁটু গেড়ে বসে তারপর ফাইলগুলো দেখিয়ে বলে,
-” এখানে বিয়ের রেজিস্ট্রি পেপার। আর এটা তোমার সমস্ত সম্পত্তির দলিল, যা তুমি এখন আমাকে বিয়ে করার সময় লিখে দেবে। ”
ইনায়া এতোক্ষণ সবকিছু শুনেছিল। সে ক্লান্ত চোখে তাকায়। নাভান ইনায়া কে চোখে একবার তাকিয়ে অদিতি কে বলে উঠে,
-” আমি তা কেনো করবো? ”
অদিতি ঠোঁট বাঁকিয়ে হেসে উঠে। ইনায়ার দিকে একবার তাকিয়ে, আটজন ছেলেকে দেখিয়ে ফিসফিস করে বলে ওঠে,
-” তুমি কি চাও, ওর অবস্থা নিধির মতো হোক? ”
ইনায়ার গা গুলিয়ে আসে। সে নাভানের দিকে আরো এগিয়ে বসে। মনে মনে শুধু একজনের নাম জপতে থাকে। নাভান এবার ভয়ংকর ভাব রেগে বলে ওঠে,
-” আরকতো নিচে নামবি তুই? ”
-” যতক্ষণ না তোমাকে পাচ্ছি। আর এটা মনেও নিওনা, কেউ তোমাদের বাচাতে আসবে? আমি জানতাম নাভান, তুমি পুলিশ ইনফর্ম করবে। তাইতো ভুল এড্রেস দিলাম তোমাকে। তাড়াতাড়ি পেপার গুলোতে সাইন করে দাও। তুমি তা করলেই ইনায়া সেভ থাকবে। ”
বলেই নাভান কে একটা চোখ টিপ দিয়ে উঠে যায় অদিতি। চারদিকে মাগরিবের আজানের ধ্বনি বেজে ওঠে। নাভান যেন পরিস্থিতির বাইরে চলে যাচ্ছে। কি করবে এখন?
,
চলবে…………….
#যাতনা_আমার
#সানজিদা_ইসলাম_সূচনা
#পর্ব: ৩৩ (খ)
বাবা-মায়ের কবর জিয়ারত করে ইনায়া রাস্তার পাশে এসেছিল গাড়ির জন্য। কিন্তু কিছু বুঝে উঠার আগেই একটা গাড়ি তার সামনে ব্রেক কষে। জোর করে ইনায়া কে তারা নিয়ে আসে এই বাড়িতে। অদিতি কে দেখে ইনায়া অবাক হয়েছিলো প্রথমে। তাকে কেন এখানে এনেছে? তা জানতে চাইলেই অদিতি তাকে চাবুক দিয়ে মারতে শুরু করে। ইনায়ার আর্তনাদ সে রুমের প্রত্যেকটা ইট বালুও যেন সাক্ষী হয়ে রয়েছে। একসময় ইনায়া নিশ্চুপ বনে যায়। তখন থামে অদিতি। অন্ধকারে মৃদু মৃদু হলুদ আলোয় নাভান ইনায়ার রক্তাক্ত মুখের দিকে তাকালো। অতঃপর সিংহিনীর মতো সামনে বসে থাকা অদিতির দিকে লক্ষ্য করে। যে একগাল হেসে তার দিকে তাকিয়ে আছে। নাভান একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করে উঠে,
-” আমি তোমাকে বিশ্বাস করবো কি করে? যে তুমি ইনায়ার কিছু হতে দিবে না? ”
অদিতি চমৎকার হাসলো। তারপর সুরেলা গলায় শান্ত স্বরে বলে উঠলো,
-” তুমি সাইন করলেই ইনায়া সুস্থ থাকবে। না হলে আমি কথা রাখবো না। ”
নাভান রাজি হলো সাইন করার জন্য। অদিতি যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেয়েছে। সে উঠে গেলো নাভানের উদ্দেশ্যে ফাইল দিবে বলে। ইনায়া কষ্ট করে ফিসফিস কন্ঠে বলে উঠে,
-” আপনি কি পাগল হয়েছেন? এটা কেন হতে দিচ্ছেন? ”
নাভান উত্তর দিলো না। উঠে দাড়িয়ে অদিতির হাত থেকে ফাইল টা নেয়৷ অদিতি তার সামনেই দাঁড়ানো। আচমকাই নাভান হাতের ফাইল দিয়ে অদিতির মুখে মেরে দেয়। অদিতি হতভম্ব হয়ে মুখে ধরে বসে পরে। রুমে থাকা বাকি ছেলে গুলো নাভানের দিকে এগিয়ে আসতেই নাভান তার সামনে পরে থাকা হকিস্টিক দিয়ে সবগুলোকে পেটাতে থাকে। মেন পয়েন্ট তাক করে মার গুলোতে ছেলে গুলো সহজেই কাত হয়ে পরে রয়েছে। নাভান গিয়ে ইনায়া কে দাঁড় করায়। ইনায়া এই পাঁচ মিনিটের ভেতরে ঘটে যাওয়া ঘটনায় অবাক হয়ে গেছে। নাভান ইনায়া কে নিয়ে রুমের বাইরে এসে দরজা লক করে দেয়। ইনায়া আর নাভান দুজনেই অবাক হলো। জায়গাটা তাদের কারোই চেনা নয়। হঠাৎ বাইরে থেকে প্রচুর শোরগোলের আওয়াজ পুলিশের সাইরেন কানে আসে। আর এদিক দিয়ে রুমের ভেতরের ছেলে গুলোও দরজায় জোরে জোরে ধাক্কা দিচ্ছে। নাভান ইনায়া কে নিয়ে সিড়ি বেয়ে নিচে নেমে আসে। তখনই ইনায়ার চোখ যায় জায়ানের পানে। যে কয়েকটা ছেলেকে পিটিয়ে এদিকেই আসছে। নাভান অবাক হলো এই ভেবে। অদিতি এতোগুলো লোক হায়ার করলো কি করে? বাংলাদেশে ওর চেনা জানা কতদূর? নাভানের ভাবনারা গত হয় জায়ানের আগমনে। জায়ান এক ধ্যানে ইনায়ার দিকে তাকিয়ে আছে। তার মুখের অভিব্যক্তি বোঝা গেলো। ইনায়ার কান্নারা যেন বাঁধ ভেঙে আসে৷ জায়ার আলতো হাতে ইনায়া কে জড়িয়ে ধরে ফিসফিস গলায় জিজ্ঞেস করে,
-” বড্ড দেরি করে ফেলেছি কি হরিণী? কে করছে এমনটা? ”
ইনায়া কথা বলে না জায়ানের বুকে মিশে ফোপাঁতে থাকে। আচমকা জায়ানের কপালের রগ ফুলে ফেঁপে উঠছে। চোখ গুলো জ্বলজ্বল করে উঠে। ইনায়া কে পাজো কোলে নিয়ে উপরে উঠে যায়। নাভানের দিকে পিছু ফিরে শান্ত এবং গম্ভীর গলায় বলে,
-” সবকটাকে তুলে পুলিশের হেফাজতে রাখো। এদের ব্যবস্থা আমি করছি। ”
নাভান আর কিছু বলতে পারে না। মলিন মুখে তাকিয়ে থাকে শুধু সেই দিকে৷ জায়ান উপরে এসে ইনায়াকে সোফায় বসায়। তারপর জিজ্ঞেস করে কোথা থেকে কি হয়েছে। ইনায়া ও বাধ্য মেয়ের মতো সব খুলে বলে। জায়ান রুমটার দিকে তাকায়। ইনায়াকে এখানে বসে থাকতে বলে সে রুমটার দিকে এগিয়ে যায়। ইনায়া জায়ান কে বারণ করতে গিয়েও করে না। তার কথা কি এই জায়ান করিম শুনবে? জায়ান রুমে ঢুকতেই আট টা ছেলে আর অদিতিকে দেখতে পায়। ছেলে গুলোকে দেখে বাঁকা হাসে জায়ান। অতঃপর বিরবির করে বলে,’ নেড়ি কুত্তার পাল ‘ তারপর ভয়ংকর চোখে অদিতির দিকে তাকায়। এমন সুদর্শন ভয়ংকর রুপের ছেলে দেখে অদিতি একটু ভয় পেল। জায়ান কে দেখে ছেলে গুলো কাঁপা-কাঁপি শুরু করে দিয়েছে। একটা ভয়ে ভয়ে বলে উঠে,
-” ভাই আপনে? মাফ কইরা দেন। এরা যে আপনার লোক বুঝিনাই। মাফ কইরা দেন। ”
জায়ান বাঁকা হাসে। অতঃপর ঠোঁট বাকিয়ে বলে,
-” মাফ করে দিবো? ঠিকাছে যা মাফ করলাম। তবে একটা ডিল বদল হয়ে যাক? ”
ছেলেগুলো জায়ানের কথার মানে বুঝতে পেরেছে বোধহয়। তারা সব কটাই মাথা নাড়ায়। জায়ান অদিতির দিকে একবার বাঁকা হেসে রুম থেকে বেড়িয়ে যায়। অতঃপর বড়ো একটা তালা ঝুলায় সেখানে। ইনায়ার কাছে এসে আলতো হাতে তাকে কোলে তুলে নেয়। ইনাযা ভ্রু কুচকে জিজ্ঞেস করে উঠে,
-” এটা কি হলো? ”
-” তোমার এতো কিছু জানতে হবে না। ”
জায়ানের কথায় ইনায়া আর কোনো কিছু বললো না। চুপচাপ হয়ে জায়ানের বুকে মিশে রইলো। হটাৎ করে ইনায়ার কানে আসে অদিতির চিৎকার। সে চোখছোট করে জায়ানের দিকে তাকালো। জায়ান তা লক্ষ্য করলো না। ইনায়াকে নিয়ে বাইরে চলে আসে৷ ইনায়া দেখে সেখানে ফাহাদ, ইশান, নাভান কে, আরো অনেক পুলিশ। সে একটু নড়তেই জায়ান আরো জোরে ধরে। ফাহাদ ইশান এগিয়ে এসে ইনায়ার কন্ডিশন জানতে চায়। জায়ান ইনায়াকে গাড়িতে বসিয়ে ফাহাদের দিকে তাকায়,
-” বাকি কালপিট গুলোর ব্যবস্থা আমি করবো। তারপর নিজ হাতে পুলিশের কাছে দিয়ে আসবো। অদিতির সাথে আরো কেউ আছে। সেটা বের করতে হবে। এদিক টা তুমি সামলে নাও। আমি ইনায়াকে নিয়ে হসপিটালে যাচ্ছি। আর ওর স্টেটমেন্ট নেওয়ার দরকার নেই। ”
ফাহাদ সায় জানালো। তারপর বিশাল বড়ো এই দু’তালা ভাঙা বাড়িটা দেখলো। এটা শহর থেকে বেশ কিছুটা দুরে। অদিতি একা একা এই বাংলাদেশে এমন নির্জন বাড়ি কি করে খুজে পেলো? তা তাদের কারোর মাথায় ঢুকছে না। ওর সাথে কার হাত থাকতে পারে? ক্ষণেক্ষণে অদিতির চিৎকারের আওয়াজ ভেসে আসছে। নাভান ইশান হতভম্ব হলো। ইশান আশ্চর্য দৃষ্টিতে ফাহাদের দিকে তাকিয়ে বললো,
-” এটা কি ঠিক হচ্ছে? ”
ফাহাদ হাসে, জায়ান বাঁকা চোখে তাকিয়ে ইশানকে ফিসফিস করে বলে ওঠে,
-” ওদের মতো মেয়েরা এইসবই বেশি খোঁজে। চিন্তা করো না জানে মরবে না। শুধু একটু বেশি সামাল দিতে হবে। ”
ইশানের এই কথা শুনে কান ঝা ঝা করে উঠলো। ফাহাদ পুলিশের সাথে গেলো কথা বলতে। জায়ান নিজের লোকদের বললো বাড়িটা পাহারা দিতে। যাতে করে একজনও পালাতে না পারে। তারপর জায়ান চুপচাপ গাড়িতে গিয়ে উঠে বসে। ইনায়ার দিকে একপলক তাকালো। তারপর গাড়ি স্টার্ট দিলো হসপিটালের উদ্দেশ্যে। আর নাভানের চোখ পড়ে থাকলো সেই গাড়ির শেষ দৃষ্টি পর্যন্ত।
,
,
,
,
রাত বারোটা বেজে ঘড়ির কাটা এখন চল্লিশের ঘরে। নিধি একা-একা ফাহাদের রুমের বারান্দায় বসে আছে। কিছুই ভালো লাগছে না তার। ইনায়ার জন্য বড্ড দুশ্চিন্তা হচ্ছে তার। নিধি বড়ো একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে রুম থেকে বেড়িয়ে নিচে নেমে আসে। কাল থেকে এখনো না খাওয়া সে। সারাদিন মিনারা বেগম একবারও নিধির খোঁজ করেননি। নিধি নেমে এসে এদিক সেদিক তাকায়। তাদের বাড়ির থেকেও বিশাল বড়ো করিম ভিলা। সবদিকেই যেন আভিজাত্য ফুটে রয়েছে। বাড়ির মেঝে থেকে আসবাবপত্র সব সোনালী রঙের আভায় ফুটে রয়েছে। নিধি আলতো পায়ে হলরুমে আসে। এসেই কিছুটা অবাক হয়। মিজানুল করিম আর মিনারা বেগম আর তিথি সোফায় বসে রয়েছেন। হয়তো ছেলেদের জন্য? মিজানুল করিম নিধিকে দেখতে পেয়ে কাছে ডাকে। নিধি আলতো পায়ে হেঁটে তাদের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। তিথি নিধিকে বসতে বলে তার পাশে। মিনারা বেগম একপর্যায়ে খেঁকিয়ে উঠলেন,
-” এতো রাত অবধি জেগে আছো কেনো? ”
নিধি শান্ত গলায় বলে ওঠে,
-” আমার খিদে পেয়েছে প্রচন্ড। ”
মিজানুল করিম আর মিনারা বেগম দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল কিছুটা। ছেলেদের টেনশনে পরে নিধির কথা ভুলে আছেন। মিজানুল করিম মিনারা বেগমকে গম্ভীর গলায় বললেন,
-” এতোক্ষণ পর্যন্ত খায়নি মেয়েটা। খেয়াল রাখবেনা তুমি? ”
-” বালাইষাট, ও কি কচি খুকি? খিদে পেল কি আমাকে খাইয়ে দিতে হবে? ”
তিথি মায়ের কথায় অবাক হলো প্রচুর। এটা কেমন কথা। তিথি সন্ধ্যার দিকে হোস্টেল থেকে ফিরে এসেছে। সেও নিধিকে ডিস্টার্ব করবে না বলে উপরে যায়নি। তিথি বিরক্ত হয়ে মা কে বলে উঠে,
-” আশ্চর্য, মেয়েটা বাড়িতে নতুন। ও কি সব চেনে? জলদি যাও। ”
– ” তোমার থেকে এমন ছেলে মানুষি আসা করিনি মিনারা। ”
কথাটা বলে নিধির কাছে এসে মিজানুল করিম দাঁড়ালেন। মিনারা বেগম উঠে গেলেন খাবার বাড়তে। মিজানুল করিম হাসিমুখে বলে উঠেন,
-” চলো একসাথে খাওয়া যাবে।
নিধি মাথা ঝাকিয়ে তাদের সাথে ডাইনিং রুমে গেলো। খাবারের শেষ পর্যায়ে ফাহাদ বাড়িতে আসে। ঘড়ির কাটা তখন একটা বিশ। কলিং বেলের শব্দে মিনারা বেগম জলদি গিয়ে দরজা খুলেন। ফাহাদ কে একা দেখতে পেয়ে জায়ানের কথা জিজ্ঞেস করতেই ফাহাদ বলে ওঠে, জায়ান সকালে আসবে। মিজানুল করিম বার কয়েকবার ইনায়ার কথা জিজ্ঞেস করেছেন। কে কারা কিডন্যাপ করেছে সে বিষয় আপাতত চেপে গেলো ফাহাদ। হাতমুখ ধুয়ে কয়েক লোকমা মুখে দিয়ে উপরে চলে গেলো। মিনারা বেগম আর মিজানুল করিম এবার কিছুটা শান্ত হতে পেরেছেন। দুজনেই এবার চলে গেলো। তিথিও তাই করলো। নিধি নিচে কতক্ষণ পায়চারি করে রুমে চলে আসে। আসতেই ফাহাদ তার কোমড়ে জড়িয়ে ধরে বিছানায় শুয়ে পরে। নিধি ছুটতে গেলেও পারে না। ফাহাদ এবার নিধির বুকে মাথা রেখে লো ভয়েজে বলে ওঠে,
-” মাথাটা টিপে দাও। ”
ফাহাদ মাত্র সাওয়ার সেরেছে। মাথার চুল মোছা হয়নি। যার দরুন নিধি অনেকটাই ভিজে যাচ্ছে। সে খেঁকিয়ে বলে ওঠে,
-” কি করছেন কি? আমাকে ভিজিয়ে দিচ্ছেন তো। ”
ফাহাদ বুক থে মাথা উঠিয়ে নিধির পানে তাকায়। চোখ দুটি তার খুবই শান্ত। ফাহাদ নিধির কপালে ছোট্ট একটা চুমু দিয়ে লো ভয়েজে ব’লে,
-” আমার চেরি ফুল , আই লাভ ইউ! আমি তোমাকে ভিষণ রকমের কাছে চাই। ”
নিধি হেসে উঠলো তৎক্ষনাৎ। চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পরলো। কাপা গলায় জিজ্ঞেস করলো,
-” আমার মতো নষ্ট ফুলকে জীবনে এনে, জীবনটা নষ্ট করলেন কেন মেয়র সাহেব? নষ্ট ফুলের তো কোনো সুবাস নেই। আপনার জীবন টাও নষ্ট করে দিবে। ”
ফাহাদ চমৎকার হাসলো। অতঃপর ফিসফিস করে বলে ওঠলো,
-” তুমি নামক সুবাসিত ফুলের সংস্পর্শে আমি হাজারবার নষ্ট হতে রাজি। তুমি আমার আধার জীবনটা রঙিন করে দিয়েছ নিধি। যেখানে শুধু আমার সুখ দেখতে পাচ্ছি আমি।তোমার দুঃখ কষ্ট সব চোখের জলে ধুয়ে যাক। সবটুকু যাতনা শুধু আমার হয়ে থাক। শুধু আমার হয়ে থাক। ”
নিধি আচকা ফাহাদকে সড়িয়ে উলটো পাশে শুয়ে পরে। তারপর বিরবির করে বলে ওঠে,
-” আমার যাতনা আমারই থাক। তা আপনি পুহাতে আসবেন না মেয়ের সাহেব। দগ্ধ হয়ে যাবেন। ”
,
,
,
,
হাসপাতালের ইমার্জেন্সি বিভাগে এডমিট করা হযেছিলো ইনায়া কে। ইনায়ার সারা শরীরেই প্রচন্ড ব্যথা। এতো রাতে মহিলা ডাক্তারও জোগাতে জায়ানের বেগ পেতে হয়েছে। ডাক্তার তো প্রথমে ইনায়াকে দেখে আঁতকে উঠে ছিলেন। ফর্সা চামড়ায় মারের দাগ গুলো জ্বলজ্বল করছিল। ইনজেকশন মলমে ইনায়ার ব্যথা শেষ রাতের দিকে একটু কমে এসেছিল। জায়ান বাকি রাত তার শিয়রেই বসা। ৪:৩০ মিনিট, ইনায়ার চোখ কিছুটা লেগে এসেছিল। হঠাৎ করেই ঘুম ভাঙতে পাশে লক্ষ্য করে জায়ান কে। যে এখন ঘুমে ঢুলেছে মাত্র। ইনায়া আর তাকে ডাক দিলো না। সাবধানে বেড থেকে নেমে ওয়াশরুমে যায় সে। হসপিটালের পোশাকে আছে এখন ইনায়া। ওয়াশরুমের মিররে নিজেকে দেখে ঘাবড়ায় ইনায়া। সব রাগ অদিতি তার উপর ঝেড়েছ। শুধু কি ভালোবাসার জন্য মানুষ এমন জঘন্য হতে পারে? ইনায়া বেরিয়ে এসে জানালার পাশে এসে দাঁড়ায়। কনকনে ঠান্ডা বাতাস আসছে। ইনায়ার হঠাৎ মনে পড়ে নাভানের একটা কথা। কেউ কি করে নিজের সন্তান কে মারতে পারে? তাও অন্য একটা পুরুষের জন্য? কিভাবে? ভেবে কুল পায় না ইনায়া। নাভানের প্রতি তার ভালোবাসা ছিলো তিন কবুলের জোরে। তিন কবুল বলার পরই তার প্রতি অধিকার ভালোবাসা যেন সবই একেবারে চলে এসেছিল। যা ছিল প্রচুর গভীর। কিন্তু একটা নাড়ী কতদিন পারে নিজের মানুষটির সাথে অন্য মেয়ের ঘনিষ্ঠ হওয়ার মুহূর্ত? একবার, দুবার,? সেখানে ইনায়া নয় নয়টি মাস তা দেখে এসেছে। যেখানে সে নিজের মুখটা স্বামীকে তখন দেখাতে পারেনি সেখানে অধিকার শব্দটা বেমানান হয়েগেছিল। হয়ত নাভানের তার কথা একটুও মনে পরেনি। তাই, অন্য মেয়ের সঙ্গে রাত্রি যাপনে তার বিবাহিত জীবনের নয়টি মাস পার করতে পেরেছে। আর তাদের প্রতিটি মুহূর্তের সাক্ষী ছিলো বোধহয় ইনায়া। সে রাতের আধারে মোবাইল বুকে জড়িয়ে শুধু কেঁদেই গেছিল। স্ত্রী হিসেবে নিজের আত্মসম্মান ছিলে কই তার। চোখের সামনে ভালোবাসার চাদর সরে যখন সত্য বেড়িয়ে এলো, তখনই সে আত্মসম্মানের মহিতে বাধ্যমূলক ভালোবাসা, সংসার ছেড়ে ছিল। যে সংসার ছিল তার একারই নয়টি মাসের স্মৃতি। সাথে স্বামীর ছবি আর নাম। শুধু এতোটুকুই। শুধু সম্পর্কের বেড়াজালে বাধা ছিলো সে। আচমকা দুটি পুরুষালী হাত পেছন থেকে ইনায়ার কোমড় জড়িয়ে ধরে। ইনায়ার পিঠ ছুয় তার প্রশস্ত বুকে। কাধে কারো মুখ, আর ঘাড়ে নিঃশ্বাসের বারি লাগলেও ইনায়া হেলে না। দীর্ঘশ্বাস ফেলে শুধু তাকিয়ে থাকে আকাশের ওই রাতের শেষ চাদের দিকে। জায়ান হালকা স্বরে জিজ্ঞেস করে উঠে,
-” ডাকলে না আমাকে? একা একা কেনো উঠতে গেলে? যদি পরে যেতে? ”
ইনায়া ম্লান হাসলো, মৃদু স্বরে বলে উঠলো,
-” একা একা হাটলেই জীবনের আসল মানে বোঝা যায়। পরে গিয়েও নিজেকে উঠে দাঁড় করাতে হয়। আপনি কি তা বুঝবেন? ”
জায়ান শব্দ করে হেসে উঠে। ইনায়া কে ঘুড়িয়ে তার দিকে ফেরায়। হাত দিয়ে মুখে আসা চুল গুলো কানের পিছনে গুঁজে দেয়। ইনায়া শান্ত চোখে জায়ানের চোখের দিকে তাকালো। শান্ত গম্ভীর চোখ জোড়া অজস্র মায়া নিয়ে ইনায়ার পানে তাকিয়ে আছে।
-” আপনার চোখ জোড়া গভীর সমুদ্রের ন্যায়। তাকাতে বড্ড ভয় হয় আমার। ”
-” সমুদ্রে তলিয়ে যাবার ভয় আছে তোমার? বিশ্বাস করো ডুবতে দিবোনা। ”
-” সে আছে। কিন্তু বিশ্বাস করতে বড্ড ভয় হয়। ”
জায়ান কোনো উত্তর দিলো না। ইনায়া চোখ বন্ধ করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। জায়ান মুখ বাড়িয়ে ইনায়ার চোখের উপর ফু দেয়। ইনায়ার চোখের পাপড়ি গুলো সহজেই নড়ে উঠে যেন। জায়ান ইনায়া কাঁপতে থাকা ঠোঁট জোড়ায় নিজের বৃদ্ধা আঙুল দিয়ে চেপে ধরে। অতঃপর নিজের ওষ্ঠদ্বয় সেই আঙুলের উপর রাখে। একজনের নিঃশ্বাস আরেকজনের মুখে আছড়ে পরছে। শেষরাত মৃদু হাওয়া দুজন প্রাপ্ত বয়সী নরনাড়ীর ভেতরের অনুভুতি গুলো জ্বলজ্বল করছে। জায়ান ফিসফিস করে বলে ওঠে,
-” আমি কবে তোমায় বৈধ ভাবে ছুঁয়ে দেবো হরিণী? জানো কি? ”
ইনায়া চোখমেলে তাকালো। জায়ানের বন্ধ চোখজোড়ার দিকে তাকিয়ে ফিসফিস স্বরে বললো,
-” শীগ্রই, খুব শীগ্রই! “,
চলবে……………..