#যাতনা_আমার
#সানজিদা_ইসলাম_সূচনা
#পর্ব : ৩৯
নভেম্বরের শেষ দিকের সময়। হেমন্তকালকে বিদায় জানিয়ে বাংলা বর্ষপঞ্জিকায় যুক্ত হয়েছে শীতকালের পৌষ মাস। কনকনে ঠান্ডা কুয়াশার চাদরে মুড়ানো আজকের সকাল পুরোটা শহর জুড়ে। অবশ্য তা ঠাওর করতে পারবে না মফস্বল শহরের বাসকৃত লোকজন। একতলা দুতালা এক সাথে হাড্ডাহাড্ডি ভাবে দাঁড়িয়ে থাকা বিল্ডিংয়ের মানুষ গুলো প্রকৃত শীতের আমেজ খুব কম পায়। বড়ো বড়ো দাড় করানো সেই অট্টালিকা গুলো শুষে নেয় যেন শীত শীত আমেজ। তার সাথে এই আলসে শহরে বাঙালি শীত মানে মাঘের শেষ পনের কে উপলব্ধি করে শুধু। কারণ আজ তাদের জীবন চারদেয়ালের রুম আর ফোন, ইন্টারনেট এতেই বিশ্ব জয় করে নেয় তারা। সকাল আটটা, কম্ফোর্টের নিচে আরামদায়ক উষ্ণতা অনুভবের তীব্রতায় আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে দুজন দম্পতি। গভীর নিদ্রায় তারা। তাদের এই আরামদায়ক মোমেন্ট নষ্ট করে বেজে উঠলো এলার্ম ঘড়ি। তন্দ্রাছন্ন হলো কিছুটা দু’জনের। ভ্রু জোড়া কুঞ্চিত হয়। পিলপিল করে চোখ খোলে নিধি। ভালো করে ঘুমটা ভেঙে আসতেই চোখ রাখে পাশে শোয়া ফাহাদে পানে। চোখমুখ কুঁচকে রয়েছে তার। নিধি আড়মোড়া ভেঙে উঠতে গেলেই পারেনা সেটা। কারণ তাকে দৃঢ় কঠিন বাঁধনে রেখেছে ফাহাদ। নিধি কিছুটা উপুড় হয়ে ফাহাদ কে ডাকলো,
-” ফাহাদ শুনছেন? ছাড়ুন আমাকে। বেলা দশটা গড়ালো বলে। নিচে গিয়ে ব্রেকফাস্ট তৈরি করতে হবে তো না-কি? ”
কিন্তু না। এই কথা বলার পরে ফাহাদ তাকে আরো জড়িয়ে ধরে তার চওড়া বক্ষ পাঁজরে। নিধি বিরক্ত হলো খুব। এটা যেন নিত্যকার ঘটনা হয়ে উঠেছে। তীব্র রাগ নিয়ে মাথা উঠিয়ে ফাহাদের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে নিধি। নাহ, তার কোনো হেলদোল নেই। নিধি এবার রেগে গিয়ে ফাহাদের কোমড়ের কাছে সুড়সুড়ি দিতেই তড়াক করে নিধিকে ছেড়ে দিয়ে একহাত দূরে স্বরে যায় ফাহাদ। বিশ্ব জয় করার মতো হেসে উঠে নিধি। ফাহাদের তন্দ্রাঘোর কাটলো। ভালো করে বিষয় টা বুঝে উঠতে একটু সময় লাগলেও, পরে ফাহাদ খেপে ফুঁসে ওঠে। আচমকা নিধির হাত টেনে তার নিচে ফেলে গলায় মুখ গুঁজে শুয়ে পরে ফাহাদ। নিধি যেন এবার মহা বিপদে পড়েছে। ক্ষ্যাপা ষাঁড় খেপেছে। নিধি দুবার ফাহাদের কাধঁ ঝাঁকাতেই মুখ তুললো সে।
-” নট ফেয়ার বউ, তোমার এই কাজটা যে আমার পছন্দ নয় জানোনা? ”
-” তো কি করবো বলেন? গত তিন বছরেও তো আপনি শুধরোচ্ছেন না। সকাল সকাল আমাকে যন্ত্রণা না দিলে হয় না? আমাকে ছাড়ুন, ব্রেকফাস্ট তৈরি করতে হবে। ”
নিধি চিড়বিড় করে কথা গুলো খই ফোটানোর মতো বলে উঠে। ফাহাদ নাক ফোলায়। মুখটা গম্ভীর করে তৎক্ষনাৎ।
-” তাই? করিম ভিলায় স্টাফের অভাব নেই বউ। তারা নিশ্চয়ই বসে থাকবে না। আর রইলো যন্ত্রনার কথা? সারারাত তুমি আমাকে যে ধরনের প্যারা দাও, এটা ধরলে সকাল তো কিছুই না। ”
কথাটা বলে ওষ্ঠদ্বয় নির্বিঘ্নে এগিয়ে দেখালো ফাহাদ। সুক্ষ্ম খোঁচা টা কোন দিক দিয়ে দিয়েছে তা মস্তিষ্কে ফুটে উঠেলো তাড়াক করে। লজ্জায় মুখ লাল হলো নিধির। তবুও দমলো না সে।
-” সত্যিই? আপনি প্রতি দিন আমাকে নয়টা পর্যন্ত আপনার কাছে জোরজবরদস্তি করে ধরে রাখেন। আমি ফ্রেশ হয়ে নিচে নামতে নামতে আপনি এসে হাজির হন। আর বাবার সাথে ঝগড়া করতে করতে না খেয়ে অফিসে যান। তার কারণ হলো আপনি আমার হাতের খাবার ছাড়া আজকাল সেফদের বানানো কিছুই খাননা। আমি যেহেতু লেট করে উঠি আপনি ব্রেকফাস্ট করেন না। আর আপনি যাবার পরে মায়ের মুখে আমার এইসব বাণী শুনতে শুনতে দুপুর গড়ায়। তিন বছর ধরে এটাই হয়ে আসছে। ”
এক দমে কথা গুলো বলে থামে নিধি। বড় নিঃশ্বাস ফেলে সে। ফাহাদ তার কথার বিপরীতে টানটান হয়ে বলে উঠে,
-” তা তো বলবেই। স্বামীর জন্য সামান্য নাস্তাটা সময় সাপেক্ষে রেডি করতে পারোনা তুমি। কথা তো শুনতেই হবে। ”
নিধি যেন কপাল চাপড়ায়। কই যাবে সে? এ লোক ধড়িবাজ একটা। নিজেই তো তাকে সে সুযোগ দেয়না। আবার নাস্তার টেবিলে ঠিক অভিযোগ তুলে দেয় নির্বিঘ্নে।
-” তাহলে এখন আমাকে ছাড়ুন। আপনার সেবা করতে হবে যে। অফিসে যেতে হবে আপনার। নাহলে ফের বাবার সাথে ঝগড়া করতে হবে। ”
-” মন চায়ছে না। আর একটু থাকো প্লিজ। ”
কথাটা বলে নিধির গলায় ফের মুখ গুঁজে শুয়ে রইলো ফাহাদ। নিধি দীর্ঘশ্বাস ফেলে। বলে কোনো কাজ হবে না আর। পেড়িয়েছে প্রায় তিন বছর। একই স্বভাব ফাহাদের। এই লোকটাকে কোনো কথাই শুনাতে পারেনা সে। নিধি ফাহাদের নিকট থেকে চোখ সরিয়ে স্থির করে। কুয়াশায় নিরবিচ্ছিন্ন সকালের একটু খানি একফালি রোদের দিকে। যা উইন্ডোর কাচ ভেদ করে আছরে পরেছে। ফাহাদ নিধির সুখের ঘরে। নিধি ফাহাদের মথায় হাত বোলায়। এই লোকটা তার অন্ধকার জীবনের একফালি চাঁদের আলো। সে জীবনে না আসলে হয়তো পুরো জীবন অন্ধকারেই নিমজ্জিত থাকতো। তার জীবনে সবচেয়ে বড়ো উপহার হলো ফাহাদ।
,
,
,
,
,
অটোয়া শহরে শীতের আবির্ভাব হয়েছে কয়েকদিন যাবত। গা হিম করা ঠান্ডা বাতাস এতোদিন থাকলেও, আজ যুক্ত হয়েছে তুষারপাত। সাদা সাদা পেজো তুলোর মতো কুঁচি কুঁচি বরফ গুলো আঁচড়ে পরছে ঘরবাড়ি বিস্তর পান্তর জুড়ে। মুক্তঝড়ার মতো শুভ্র সাদা তুষার কনা গুলো ঠাই নিচ্ছে ঘড় জমিনে। সকাল থেকেই নিজেদের অপরুপ চিত্র দেখিয়ে চলছে শহর জুড়ে। বছরের প্রথম স্নো ফল সবাই উৎসাহের সহিত উপভোগ করছে যেন। হাইওয়ে রাস্তা, দু’একটা গাড়ি এখনো চলমান। এরমধ্যে একটা কালো বিএমডব্লিউ। এই নিষিদ্ধ তুষারপাত কম হওয়ায় এখনো এগিয়ে যাচ্ছে নিজের গতিপথ অনুসার করে। রাস্তায় তুষারের মিছিল বাড়ছে তড়িৎ গতিতে। এরইমধ্যেই নিজের কাঙ্ক্ষিত জায়গায় এসে থামে থামে বিএমডব্লিউটি। এরই মাঝে পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে সেখানে থামে আরও একটি গাড়ি। এরথেকে বেড়িয়ে আসে অভার লং কোর্ট ও গলায় মাফলার এবং মাথায় টুপি পরহিত লিও। ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল সে গাড়িটির দিকে। গাড়ির কাচ ভেদ করে সামনের মালিককে দেখে হেসে উঠেলো লিও।
-” বছরের প্রথম স্নো ফলের উৎসবে তোমাকে স্বাগতম এনএসএম। বাট, তুমি গাড়ি থেকে নামছো না কেন? বাই দ্য ওয়ে, তুমি কি চাইছো আমি তোমাকে ফুল দিয়ে বরণ করে ভিতরে নিয়ে যাবো? তাহলে স্যরি, আমি তা অ্যারেঞ্জম্যান্ট করতে পারিনি। আমার কাছে এখন এসবের সময় নেই। ”
ভেতরের মানুষটা ক্রূর হাসলো। সাইড থেকে কোর্ট টা গায়ে জড়িয়ে গাড়ি থেকে নেমে আসে সে। অতঃপর গম্ভীর দৃষ্টিপাত করে সামনে দাঁড়ানো লিওর দিকে। অতঃপর মুখ বাকিয়ে গমগমে আওয়াজে বলে,
-” এসব নমনীয়তা সঞ্চালিত শুধু তোমার ওয়াইফ জিসা পর্যন্ত রাখো লিও। আমাকে এসব দেখিয়ো না। ফের, লোকে আমাদের গে উপাধি দিয়ে দিবে নির্ঘাত। ”
লিও হাসলো চোখ বন্ধ করে। মজা নিয়ে বলে উঠলো,
-” সো হোয়াট? লোকে করুক এসব মজা। আমরা কেন কান দিবো এইসবে? একটু তো নমনীয়তা ভাব দেখাতেই পারি। বিকজ, আই এম ইয়োর বিজনেস পার্টনার। ”
কথাটা বলে কিছুক্ষণ পরে চোখ মেলে সামনে কাউকে পায়না লিও। ফুস করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে যেতে-যেতে বলে ওঠে,
-” ওহ্, কাম অন নাভান। রাগ করলে নাকি? আমি তো মজা করছিলাম। ”
অটোয়া শহরের বেশ নামীদামি বিজনেস ক্লাসিক ব্লু ফেইরি হোটেল এন্ড রেস্টুরেন্টে এটা। অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারে এই রেস্তোরাঁটির কারুকাজ। এখানে বেশির ভাগ বিজনেসম্যানদের মিটিং করার ফেবারিট জোন। নাভান আর লিও ভিতরে গিয়ে তাদের বাকি ক্লাইন্টদের সাথে মিটিংয়ে ব্যাস্ত হয়ে পরে। একটা জরুরি তলবে সবাই একত্রে হাজির হয়েছে আজকের এই তুষার ভরা দিনেও। লিও দুবছর ধরে নাভানের কোম্পানীর সাথে কাজ করছে। অতি গুরুত্বপূর্ণ মিটিং সেটা৷ সময় গড়ায় মধ্যাহ্ন দুপুরে। মিটিং শেষে গম্ভীর মুখে বসে আছে নাভান, সাফরান আর লিও। অত্যাধিক গম্ভীর হয়ে আছে তিনজনেরই মুখ। ক্ষানিকটা সময় পার হইতে নাভান চিড়বিড় করে রেগে বলে ওঠে,
-” কতোটা গুরুত্বপূর্ণ ডিল ছিলো সেটা। ডিল সাকসেসফুলি পার করার পরেও ক্যান্সেল করতে পারে কি করে? ”
লিও আর সাফরান একে অপরের দিকে তাকালো। তপ্ত মুখের নাভান কে নেভানোর ব্যবস্থা তাদের নেই। সাফরান বিরস গলায় বলে উঠলো,
-” অদিতি, ও আমাদের থেকে ভালো এমাউন্টও অফার করেছে তাদের। ”
নাভানের চোখ সচল হলো। লস, সব জায়গায় লস দিয়ে রেখেছে এই মেয়ে। মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষ গুলো জ্বলজ্বল করে উঠে গেলো তৎক্ষনাৎ। নাভানের ভয়ংকর ভাবগাম্ভীর্যের সঙ্গে পাল্লা দিতে চাইলো না সাফরান। কফির কথা বলে তড়িঘড়ি করে উঠে চলে যায় সে। নাভান গম্ভীর মুখে বলে,
-” আর কতো ওকে চান্স দেবো লিও? সেই থেকে আমাদের পেছনে পরে আছে ওই বিচ টা। ”
-” তু্মি জানো না নাভান, ওর হাত কতোবড়? বড় বড় আন্ডারগ্রাউন্ড মাফিয়াদের হাতে নিয়ে চলে। বিকজ, তাদের বেবিগার্ল বলে কথা। ”
-” ও আর কতো নিচে নামতে পারবে লিও? আর কতো?
লিও কতোক্ষণব্যাপী হতে নিশ্চুপ থেকে আচমকা বলে উঠলো,
-” লাস্ট মান্থ ওর সাথে হঠাৎ করেই দেখা হয়েছিলো। তোমার কথা জিজ্ঞেস করেও বলে উঠেছিলো, বাংলাদেশের সাথে তার ঢের হিসেবনিকেশ বাকি আছে। সে সব কমপ্লিট না করে তোমাকে মুখ দেখাবেনা। ”
নাভান দাঁতের ফাকে গর্জন তুলে ফিসফিস করে বলে ওঠে,
-” রিডিকিউলাস, ওর মতো মেয়েকে আমি মৃত্যুর আগে দেখতে চাইনা। ”
নাভান দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। চোখ রাখলো বাইরে কাচ ভেদ করে শুভ্র নির্মল সাদা তুষার কুচির দিকে। হতাশায় ভেতরটা হাহাকার দিয়ে উঠলো তার। অদিতির সাথে বাংলাদেশেই তার শেষ দেখা হয়েছিল। গত তিন বছরে আর তাদের দেখা হয়নি। অদিতি আড়ালে থেকেই তার উপর নজর রাখছে যেন প্রতিনিয়ত। কারণ এখন তার শত্রু নজর অন্য দিকে। আচমকা ইনায়ার চেহারাটা চোখের দৃশ্যপটে ভেসে উঠলো যেন। হ্রদ গহীনের কোণে আলোড়ন তৈরি করে মুহূর্তে। সদা বিরাজমান প্রশ্ন মনের কোনে ঘন্টা বাজিয়ে তুলে নির্বিঘ্নে। ইনায়া ভালো আছে তো? অপরপক্ষের সত্তা কুটিল হেসে বলে উঠে,
-” সে তো আছেই বেশ। কারণ তাকে ভালো রাখার মানুষটাই এমন। ”
নাভানের হতাশা ব্যক্ত করা মুখটা দেখে লিও ভাবলো। কিছু কিছু মানুষের জীবনে সুযোগ একবারই আসে। তা হাত ছাড়া করলে আর পাওয়া যায় না সেই সুযোগ। লিও দীর্ঘশ্বাস ফেলে নাভানের দৃষ্টিতে চোখ রাখে। অনেক অস্থিরতা মনস্তাপ জুড়িয়ে আছে সেটাতে। হয়তো ইনায়ার কথা মনে পরেছে। এমনটা প্রায় হয়ে আসছে। আচমকা নাভান জিজ্ঞেস করে উঠলো,
-” জিসা কেমন আছে? চেক-আপ করা হচ্ছে তো ঠিক মতো? ”
-” এইতো ভালোই আছে। শুধু নতুন জনের আগমনের অপেক্ষায়। ”
,
,
,
,
,
ব্যস্ত রাস্তা, ব্যস্ত মানুষ জন আর ব্যস্ত শহর। জীবিকা নির্বাহের আপ্রাণ চেষ্টায় ব্যস্ত জনগণ। নিজেদের মতো চলে ফিরছে তারা। এ শহরের প্রতিটি সাধারণ মানুষ বেঁচে থাকার তাগিদে প্রতিটি দিন নিজেদের একই পদ্ধতিতে জীবনকে নিয়ে চলছেন। যার যার মতোই ছুটছেন দুরন্তপনার সহিত। দুপুরের সময়, কোচিং সেন্টারের বাইরে কারো জন্য অপেক্ষাকৃত ইনায়া। শরীরে সি গ্রীন কালারের একটা সেলোয়ার স্যুট। দুধে আলতা গায়ে রঙটা যেন বেশ মানিয়েছে। ভ্রুকুটি কুঞ্চিত করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলো সামনে। পাশেই বিশাল বড়ো সাইনবোর্ড ‘ প্রজ্ঞা কোচিং সেন্টার ‘। পাশ কেটে কতো স্টুডেন্ট সালাম জানিয়ে বিদায় নিচ্ছে। ইনায়ার সেদিকে খেয়াল নেই। বিরক্ত হয়ে কিছুক্ষণ ওয়েট করলো রিকশার জন্য। কিন্তু আশ্চর্য, এতোক্ষন সে রিকশা ফিরিয়ে দিলেও এখন আর কোনো রিকশাই পাচ্ছে না। আজ প্রচুর রাগ হলো ইনায়ার। পাশেই হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসলো রায়া। তারপর ইনায়ার গম্ভীর মুখের দিকে চেয়ে বলে উঠে,
-” ফাইনালি কোচিং থেকে এক সপ্তাহের ব্রেক নিতে পারবো। আমি খুব এক্সাইটেড, আর তুই মুখ টাকে এমন ভোতা করে কেন রেখেছিস? ”
ইনায়া উওর দিলো না। মনটা খারাপ করে সামনে তাকিয়ে। রায়া হয়তো বুঝলো। মুখ বাকিয়ে ফোন বের করে ইনায়ার দিকে এগিয়ে দেয়,
-” তোমার নেতা সম্মেলনে। এখানে মুখভার করে রাখলে কি হবে? ”
ইনায়া এবার কথা ঘুরালো,
-” সানিয়ার বেবি কে দেখতে যাবি? ”
-” আজ না, কালকে চল। ”
ইনায়া সম্মতি জানালো। তারপর দুজনেই একটা রিকশায় করে চলে যায়। যাত্রা পথে ইনায়া একটা জায়গায় নেমে পরে। রায়া হাসলো, কিছু কথা বলে সে একাই ফ্লাটের দিকে গেলো। সানিয়ার বিয়ে হয়েছে দুই বছর। সে এখন এক বাচ্চার মা। ইনায়া আর রায়া এখন অন্য জায়গায় এক সাথে থাকে। দেখতে দেখতে তাদের কোচিং সেন্টারটা অনেক বড়ো করেছে তারা। ইনায়া অনার্স শেষ করেছে। ছোট বড়ো বাচ্চাদের সাথে তাদের সময়,ভালোই কাটে। রায়া ও সে মোটামুটি খুব ভালো বন্ধু হয়েগেছে এতোদিনে। এই শহরে মাথা উচু করে দাঁড়াবার শক্তি এখন ইনায়ার বেশ আছে। শীতের দিন হলেও দুপুরের খুব প্রখর রোদে হেটে ইনায়ার অবস্থা নাজেহাল। ইনায়া সাইড ব্যাগ থেকে রুমাল বের করে মুখটা মুছে নেয়। রাস্তার পাশেই বিশাল বড়ো মাঠ। প্রচুরসংখ্যক লোকজনের ভিড় সেখানে। মাইকে তীব্র কন্ঠের ভাষণ। রাস্তায় পার্ক করা অনেক গুলো গাড়ি। মাঝখানের কালো গাড়িটা দেখে তৎক্ষনাৎ মুখ বাকালো সে। মাঠের চারদিকে বড়ো দেওয়াল টানা। অপর পাশে বসার জায়গা আছে সেখানে। ইনায়া দোকান থেকে কোমল পানীয় কিনে খেতে শুরু করলো। দোকানী হয়তো এমন দিনে এইসব কেনায় তাকে পাগল বলে আখ্যায়িত করেছে মনে মনে। তাতে ইনায়ার কি? সাময়িক কোলাহলের পরে কানে বেজে উঠে সেই চিরাচরিত কন্ঠস্বর। ইনায়া থমকালো কিছুক্ষণ। মুগ্ধ হয়ে শুনলো তার পৌরসভার বর্তমান মেয়রের বলা কথা গুলো। মাদকাসক্ত হয়ে তার কথা গুলো যেন সর্বদাই ইনায়ার নিকট ঠেকে। এ এক কঠিন রোগের রোগীতে আক্রান্ত হয়ে যাচ্ছে দিনকে দিন। যা থেকে সে চাইলেও বের হতে পারবে না। কই? আগে তো এমন লাগতো না। ভালো লাগাটা প্রখর বিদ্রূপাত্মক হয়ে আছে আজকাল। ইনায়া মৃদু হেসে উঠে আনমনে। অতঃপর বিরবির করে বলে ওঠে,
-” সে কি জানে? হয়েছি দগ্ধ, তার প্রেম দহনে? ”
ইনায়া হাসি আরো প্রসারিত হয়েছে। আজকাল জীবন টা বড্ড ভালো লাগে তার কাছে। আগে তো এমন ছিলো না। আচানক ইনায়ার মুখে আধার নেমে আসে। এই ভালো লাগা গুলো যে তার ভাবতেও মানা। মনের ভেতর বড্ড ভয় জেঁকে বসে। কারণ প্রথমই হারিয়ে মুখ থুবড়ে মাটিতে পড়েছিল সে। এখন হারাবার ভয়ে তটস্থ ভঙ্গিতে ৪ বছর পূর্বের স্মৃতি হানা দেয় তার মস্তিষ্কে। গাড়ির সাইরেন বেজে উঠায় ধ্যান ভেঙে যায় ইনায়ার। শাঁইশাঁই করে চলে যাচ্ছে পার্কিং করা একের পর এক গাড়ি গুলো। ইনায়ার চোখ থাকে নতুন মার্সিডিজ গাড়িটির দিকে। তার কালো কাচ ভেদ করে কাউকে খোঁজার প্রয়াস চালায়। কিন্তু হয়ে উঠেনা আর। লোকটা কি চলে গেলো? সময় গড়ালো আছরের দিকে। আস্তে আস্তে ভরাট সমাগম শূন্য হয়ে যায়। ইনায়া মলিন মুখে অন্য দিকে তাকিয়ে উঠে যাওয়ার জন্য উদ্যোগ নিতেই পাশ থেকে একটা কর্কশ গলার ধমক শুনতে পায় সে।
-” যাচ্ছো কেনো? আরো কিছুক্ষণ থাকো। সন্ধ্যা হবার পরেই একেবারে চলে যেও। ”
ইনায়া এবার ভীতু চোখে পাশে তাকায়। কালো পাঞ্জাবি পরা মুখে মাক্স লাগানো জায়ান কে দেখে চমকালো না একটুও। চোখ দুটি সচল হলো তার। রাগের বহিঃপ্রকাশ ঘটালো মুখমন্ডলে। জায়ান ধীর গতিতে ইনায়ার সামনে দাড়িয়ে লো ভয়েজে বলে ওঠে,
-” আমার বোকা হরিণী। এ-তো কেন যাতনা দাও আমাকে? ”
-” আর আপনি যে আমাকে জালিয়ে দিচ্ছেন। তার বেলায় কি? ”
জায়ান হাসলো, বুঝলো ইনায়ার রাগ হয়েছে বেশ। এদিকটায় আপাতত শুনশান হয়ে আছে। জায়ান আচমকা জরিয়ে ধরে ইনায়া কে। ইনায়া কিছুটা চমকে উঠে। সে স্থির হয়ে দাড়িয়ে থেকে অভিযোগের স্বরে বলে উঠে,
-” গত এক সপ্তাহে ফোন ব্যতীত সামনাসামনি আমাদের কোনো কথা হয়েছে জায়ান? গতকালকেই তো বললেন আজকে পুরো বিকেলটা আমার জন্য বুকিং করেছেন। আর রাত পেরোতেই ভুলে গেলেন? ”
জায়ান দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলতে শুরু করলো,
-” আচমকা হয়ে গেছে আজকের সম্মেলন। তোমাকে অনেক ফোন দিয়েছি। কিন্তু সেটা বোধহয় তোমার দৃষ্টিগোচর হয়নি। এখানে তোমাকে দেখে জাস্ট ডিসট্রাক্টেড হয়ে গেছি। হ্যাই? ”
ইনায়া মুখ তুলে জায়ানের দিকে তাকালো। জায়ান অতি আদুরে ভঙ্গিতে বলে ওঠে,
-” আমার লাইফটা অনেক রিস্কি। এরজন্যই বলেছি, আমার কাজের আশে পাশেও থেকো না। কারো নজর হয়ে গেলে কিন্তু পিঞ্জিরার বন্দী পাখি হয়ে থাকতে হবে। তখন কিন্তু এখনকার মতো মুক্ত পাখি হয়ে ঘুরতে পারবেনা। ”
-” তাহলে ছেড়ে দিন না এই রাজনীতি জনসংযোগ। আমরা আমাদের মতো বেচে থাকবো। ”
ইনায়ার কথায় জায়ান ভ্রুকুটি কুঞ্চিত করে তাকালো তার দিকে। অতঃপর শান্ত গলায় বলে ওঠে,
-” রাজনীতি তো আমার রক্তে মেশানো। তা কি করে ছাড়বো? ”
-” কেনো ফাহাদ ভাইতো নিধির এক কথায় রাজনীতি থেকে সরে এসেছেন। আপনি কেনো পারবেন না? এই আপনার আমার প্রতি ভালোবাসা? সব ঢংয়ের কথা। ”
আচমকা জায়ান কে সড়িয়ে দিয়ে ইনায়া উলটো হাটা দেয়। জায়ান হতভম্ব হলো কিছুক্ষণের জন্য। বিষয় টা বুঝে আসতেই ইনায়ার দিকে এগিয়ে যায়। গোধূলির শেষ বিকেল। গোধূলির আলোমাখা আকাশপটের উপরে-সেইটুকুই রঙিন আলো জানান দিচ্ছে। সামনে ঘনিয়ে আসছে শীতের কুয়াশাময় সন্ধ্যা। ঠান্ডাও লাগছে ঢের। সময় মাত্র কিছুক্ষণ। এই লালচে আলোমাখা শেষ গোধূলির রাস্তা ধরে ইনায়া মুখ ফুলিয়ে হেঁটে চলছে। পিছনে জায়ান আসছে। ইনায়া পিছু ফিরে শাসানো ভঙ্গিতে বলে ওঠে,
-” খবরদার নেতা সাহেব। পিছু আসলে কিন্তু জনগণের মার খাওয়াবো। ”
জায়ান চমৎকার হাসলো। বুক ফুলিয়ে বলতে শুরু করে,
-” পাবলিক তার নেতাকে মারার সাহস সহজে রাখে না হরিণী। ”
ইনায়া কিছু বললো না। জায়ান ইনায়ার হাত এবার জোর করে ধরে নিয়ে যেতে লাগলো। ইনায়া আর রাগ দেখালো না। গাড়ির কাছে আসতেই ইনায়াকে খুব জোরে জড়িয়ে ধরে জায়ান। নিজের বক্ষপিঞ্জরে ইনায়াকে চেপে ধরে ফিসফিস করে বলে ওঠে,
-” আমার ভালোবাসার পরিমাণ যে কতোটুকু, তা তুমি মাপকাঠি দিয়ে পরিমাপ করতে পারবেনা হরিণী?
ইনায়া দীর্ঘশ্বাস ফেলে। যা জায়ানের হ্রদ গহীনে ঝড়োমেঘ ডেকে তুলে তৎক্ষনাৎ। জায়ানের কন্ঠ গম্ভীর হয়। গরম অস্থির তোলপাড় গলায় বলে ওঠে,
-” দ্বিতীয় বার আমার ভালোবাসাকে আঙুল তুলে কথা বললে সেটা আমি মেনে নেবো না। ”
,
চলবে………….
#যাতনা_আমার
#সানজিদা_ইসলাম_সূচনা
#পর্ব : ৪০
নিধির বারান্দার সাথে লাগোয়া শিউলি ফুলের গাছটা এখন আর সেখানে হেলে নেই। ঝড়ের কবলে পরে ভেঙে গেছিলো কয়েক মাস আগে। তারপর লোক দিয়ে গুড়ি পর্যন্ত কাটিয়ে ফেলেছিলেন সোহানা মির্জা। গুড়ি থেকে নতুন পাতা গজিয়েছে নতুন ডাল মেলেছে। সোহানা মির্জা গাছে পানি দিতে দিতে শিউলি গাছটা পরক্ষ করলেন। মেয়ের কথা হঠাৎ করেই মনে হয়ে গেলো তার। সকালের স্নিগ্ধ ঠান্ডা বাতাসের সাথে ভেতর থেকে গভীর নিঃশ্বাস বেরিয়ে আসে সোহানা মির্জার। নিধি সংসারী হয়েছে, ছেলেটাও বিদেশে, কিছু টা মন খারাপ নিয়েই কেটে যাচ্ছে নাহিদ মির্জা আর সোহানার দিন। শরীরে চাদরটা ভালো করে জরিয়ে বিষন্ন ভগ্নহৃদয় নিয়ে সোহানা মির্জা বাড়ির দিকে গেলেন। নাহিদ মির্জা গত এক বছর যাবত অফিসের ঝামেলায় নিজেকে আর জড়ান না। আজকাল শরীর ও ভালো থাকে না। সোহানা মির্জা হন্তদন্ত পায়ে রুমে ঢুকলেন। নাহিদ মির্জার ঘুম ভেঙে গেছে। ইশানের সাথে অফিসের বিষয়ে কথা বলছেন তিনি। সোহানা মির্জা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে রান্না ঘরে ছুটলেন। নিপা আর নওয়াজ মির্জা ওমরাহ করতে গিয়েছেন আজ সাতদিন। সোহানা মির্জা নিয়ম মাফিক নিচে আয়েশা মির্জার রুমের দিকে চোখ বোলালেন। রান্না ঘরে শব্দ হতেই আবারো ছুট লাগালেন তিনি। কোমরে আচল গুজে রান্নায় ব্যস্ত তিথি। সোহানাও হাত বাটলেন তাতে। কাজের এক ফাঁকে সোহানা শান্ত গলায় শুধালো,
-” আজ একবার যাবো ও বাড়ি। তুমি যাবে আমার সাথে? ”
তিথি জিজ্ঞাসা দৃষ্টিতে তাকালো সোহানা মির্জার দিকে। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে সোহানা বিরস গলায় বলে উঠলো,
-” নিধির জন্য মনটা কেমন করছে। সেই কবে একবার দেখা হলো। ”
তিথি ইশারায় সম্মতি প্রকাশ করে। সোহানা স্মিথ হেসে উঠেন। তিথির মাথায় হাত বুলিয়ে কাজে মনোনিবেশ করলেন। খাবার টেবিলে নাহিদ মির্জা আর ইশান শুধু কাজের কথায় ব্যস্ত ছিলেন। কি এক অফিসের ঝামেলা। সোহানা মির্জা আর তিথি নিজেদের মতো ছিলেন। কোনোরূপ কথা হয়নি তাদের মধ্যে আর।
আজকে রোদেরা লুকোচুরি করছে যেন। একবার দেখা দিয়ে মূহুর্তেই পালিয়ে যাচ্ছে। তিথি যেন বিরক্ত হলো তাতে। ছাদে শুকোতে দেওয়া কাপড় গুলোর দিকে একবার তাকিয়ে সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। ওয়াশিংমেশিনে দিয়ে আজকে সারাদিন কাপড় ধুইয়ে মেলে দিয়েছে। কিন্তু রোদের দেখা কই। বিকালের দিকে বাড়িতে যেতে হবে। ফিরতে ফিরতে রাত হবে। তিথি শব্দ করে নিঃশ্বাস মাটিতে ফেলে পিছনে ভিড়তেই চমকে উঠলো। আচমকা দৃষ্টি ফেললো পিছনে। ইশান হাসি মুখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। তিথির মুখটাও মৃদু মেলে উঠে। ইশান আলতো হাতে তিথিকে জড়িয়ে ধরে।
-” এই দুপুর বেলায় একা একা ছাদে কি করছো? জানো? দাদি বলতো, ভর দুপুর আর রাত করে ছাদে গেলে পেত্নী ভর করতে পারে। বুঝলে? ”
ইশানের কথাটা শেষ হতেই দুজনেই হেসে উঠে। আচমকা মনটাও খারাপ হয়ে গেলো দুজনের। ইশান মুখ মলিন করেই বলে ওঠে,
-” জানো? তোমার আমার বিয়ে নিয়ে যতোটা না খুশি ছিলাম, তার চেয়ে বেশি ভয় ছিলো দাদীর কথা ভেবে। তার সাথে তোমার লেগে যেতে দৈনিক তিনবার। ”
তিথি কিছুই বললো না। চোখ দিয়ে অশ্রু টলটল করছিল। আয়েশা মির্জার কথা মনে হলে এখনো তার হৃদয় থমকে যায়। ইশান টপিক চেঞ্জ করে। মৃদুভাবে ডেকে বলে,
-” আজও কি আমার সাথে কথা বলবে না? কতোদিন তোমার কন্ঠ শোনার জন্য আমার ভেতরটা হাহাকার করছে, তা কি তুমি জানো। ”
তিথি আচমকাই ইশানের বুকে মাথা দিয়ে কেঁদে উঠে। ইশান যেন আবারো ব্যর্থ হলো। ব্যর্থ হৃদয় নিয়ে তিথির চিৎকারের প্রতিটি শব্দ মনোযোগ ভাবে শুনতে লাগলো। তিথি চিৎকার করলেও সে নির্বিকার। যা সম্ভব নয়, তা কেন আবদার করে ইশান? সে কি জানে না? তিথির সেই বিদ্বেষ জাগরিত রাতের মুহূর্ত তাকে খুব কঠিন করে পোড়ায়। সে কি বোঝেনা? ইশান দু’হাতে তিথির মুখ তুলে ললাটে দীর্ঘ চুমু টেনে তার চোখের দিকে গভীর দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। তিথি অনেক চেষ্টা করলো স্পষ্ট করে ইশানের নামটি মুখে নিতে। কিন্তু পারলো না। এ যে হবার নয় আর। ইশান মৃদু হেসে নিজের ওষ্ঠ জোড়া ছোঁয়ায় তিথির ওষ্ঠদ্বয়ের সাথে। অতঃপর বিরবির করে বলে ওঠে,
-” তুমি বাকি জীবন এইভাবেই আমার নাম মুখে নিও। এই নিশ্চুপ তুমিটা কে আমার একটুও ভালো লাগে না। একটুও না। ”
যাতনায় বিদীর্ণ হওয়া তিথি যেন একটু শান্ত হয়। এই মানুষটা কে ভালোবেসে কোনো ভুল করেনি সে। নিজেকে খুব ভাগ্যবতী মনে হয় তার। ইশান তাকে তার চেয়েও বেশি ভালোবাসে। তা যেন এখনো, কথায় কাজে বুঝিয়ে দেয় প্রতিনিয়ত। সেদিনের দূর্ঘটনায় তিথির জীবনে বড়ো প্রভাব ফেলেছিলো। গাড়িটা জোরে ব্রেক করায় পিছন থেকে সামনে অনেক জোরে এগিয়ে এসেছিলো তিথি। দাঁতে দাঁত প্রচুর জোরে লাগায় তিথির জিহ্বা উপরের কিছুটা কেটে গিয়েছিলো। তাতে তিথির কথা অনেকটাই অস্পষ্ট হয়েছে। নিজের এমন পরবর্তনে কথা বলাই কমিয়ে দিয়েছে তিথি। নিজের মধ্যে মানসিক চাপের খুব বাজে প্রভাব ফেলেছে সে। ইশান সর্বদা চেষ্টা করে তিথিকে হাসি খুশি রাখার। ইশান নিধি কে এবার পাজো কোলে তুলে নিলো। তিথি এবার অস্পষ্ট স্বরে জিজ্ঞেস করে,
-” কোলে কেনো নিলেন? ”
-” আমি খুব টায়ার্ড বউ। একটু বিশ্রাম নিতে হবে। ”
তিথি ভ্রু কুঁচকে তাকালো ইশানের দিকে। যার অর্থ হলো, আপনি বিশ্রাম নিন। আমাকে কেনো টানছেন? ইশান যেন তার কথার মানে বুঝলো। সে সিড়ি দিয়ে নিচে নামতে নামতে মুচকি হেসে বলে উঠে,
-” তোমাকে লাগবে আমার। তোমাকে। কোলবালিশ হিসেবে ও তোমাকে এখন পাশে লাগবে আমার। ”
,
,
,
মানুষের ভিড়, কোলাহল, যানজটের হর্ন সব মিলিয়ে উত্তাল পরিস্থিতি। ইনায়া বাস স্টপে দাঁড়িয়ে আছে। বাস আসার নাম গন্ধ নেই কোনো। চারদিকে প্রচুর ধূলো বালি। শীতের দিনে রাস্তা ঘাটে এই একটা সমস্যা। ইনায়ার মুখে কিছুটা রাগের আদল। প্রচন্ড বিরক্তও বটে। হাতে লাগানো রোল এক্সের ঘড়িটির দিকে তাকিয়ে সময় পরক্ষ করলো সে। বেলা এগারো টা পেরিয়ে গেছে। আজ রায়া আর সে সানিয়ার বাসায় যাবার জন্য বেড়িয়ে ছিলো। পথে জায়ানের কল আসে। শীগ্রই করিম ভিলায় তাকে আসতে বলে। ইনায়া অবাক হলো, রাগও হলো কিছুটা। আচানক বাড়িতে ডাকার মানে কি? রায়া উদাস মনে একটু ঘুরে ফ্লাটে ফিরে গেলো। ইনায়াও এবার জায়ানের উপর রাগে কিছুটা। মুখ ফুলিয়ে পাশে তাকাতেই বাস স্টপের পিলারের দেয়ালে জায়ানের ছবির পোস্টার দেখে ইনায়া। কোনো মহা সম্মেলনের আয়োজন করা হয়েছে হয় তো। ইনায়া বড়ো নিঃশ্বাস ফেলে। বাস আসাতে তড়িঘড়ি করে বাসে উঠে ইনায়া। গাড়ির দরজার সাথে জানলার পাশের সিটে বসে ইনায়া। কিছুক্ষণ পরেই বাস চলতে শুরু করলো। ইনায়া সীটে হেলান দিয়ে কোলে ব্যাগ রেখে তাতে হাত বসে থাকে। আচমকা চোখ যায় হাতের অনামিকা আঙ্গুলে জ্বলজ্বল করা স্বর্নের ডায়মন্ড খচিত রিং টার দিকে। মুখে হাসির রেখা ফুটে উঠে ইনায়ার। মনে পরে দু বছর আগের সেই দিনটির কথা। যেদিন এই রিং পড়িয়ে জায়ান ওকে বাগদত্তায় স্বীকৃতি দিয়েছিল। মুটামুটি ঘটা করেই তাদের বাগদান অনুষ্ঠান সম্পূর্ণ হয়েছিল। ইনায়ার স্বপ্ন চারণের ফাঁকেই কাঙ্ক্ষিত জায়গায় অগ্রসর হতে থাকে তার যাত্রা বাহক।
করিম ভিলা আজ কিছুটা সাজ সাজ রব। চারদিকে রমরমা ঝলকানো পরিবেশ। খাবারদাবার গুলোতে এলাহী কান্ড। সকাল থেকেই ব্যস্ত হাতে সবকিছু সামাল দিচ্ছে নিধি। সাথে মিনারা বেগমও রয়েছেন। দুই শাশুড়ী বউমার আজ কোনো অবসর নেই। মিনারা বেগম রান্নার এদিক টা নিধির কাছে বুঝিয়ে দিয়ে মিজানুল করিমের কাছে গেলেন। মিজানুল করিম আর ফাহাদ হলরুমে এক সাথে বসে আছেন। মিনারা তাগিদ দিলো তাদের দুজনকেই,
-” আপনি কি এখনো ও বাড়িতে জানাননি কিছু? আর ফাহাদ তোর প্রাক্তন লোকদের কল করে দেখ কোথায় আছে। ”
ফাহাদ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ল্যাপটপ রেখে, ফোন লাগায় জায়ানের কাছে। মিজানুল করিম এতোক্ষণ গভীর ভাবনায় মগ্ন ছিলেন। মিনারার কথায় যেন হুঁশে এলেন মিজানুল করিম। স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে গম্ভীর মুখে বলে উঠলেন,
-” নাহিদ মির্জা জানিয়েছেন যেটা ভালো হয় সেটাই করতে। তিথিরা আসবে একটু পরেই। ”
-” তাহলে তো হলোই। আপনি মুখ ভার করে কেন আছেন? ”
মিজানুল করিম হতাশার সুরে বলে উঠলেন,
-” ফাহাদ এইসব থেকে সরে এসেছে তাতে খুব খুশি হয়েছিলাম। কিন্তু আবারও জায়ানের এইসবে জড়িয়ে যাওয়া খুব চিন্তায় রাখে আমাকে। ফাহাদ কে দেখার জন্য জায়ান ছিলো। কিন্তু ওর জন্য কে আছে? ”
-” তিন বছরে চারবার হামলা হয়েছে। এতেও ছেলের চোখ খুলে না। কি আর করার। ”
ফাহাদ ফোনে কথা শেষ করে বাবা-মায়ের উদ্দেশ্যে বলতে গিয়েও বলে না। তাদের এই তিন বছরে অনেক কথা বলেও বোঝাত পারেনি ফাহাদ। তখনই বাড়িতে প্রবেশ করে ইনায়া। তাকে দেখে সবাই অমায়িক হাসলো। মিনারা বেগম নিধিকে হাঁক ছেড়ে ডাকলেন। হন্তদন্ত হয়ে নিধি ছুটে আসলো। ইনায়া এদের ব্যস্ততা দেখে অবাক হলো কিছুটা। বাড়িতে এমন সাজ সাজ রব দেখে ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে,
-” আজকে ফাংশন আছে কোনো? ”
নিধি উওরে মুচকি হেসে ইনায়ার হাত ধরে উপরে নিয়ে যেতে থাকে। মিনারা বেগম পেছন থেকে বলে উঠে,
-” তারাতাড়ি করো যেন। তারা একটু পরেই চলে আসবে। ”
কে আসবে? কিসের আয়োজন? তা ইনায়ার বোধগম্য হলোনা। নিধি ইনায়া কে কালো রঙের পাথরের কাজের একটা ভারি চুরিদার পরতে বলে।
ইনায়ার অবাকের মাত্রা আরো চওড়া হলো যখন একটু পর ফাহাদ আর মিজানুল করিম তার কাছে একটা প্রস্তাব রেখে বসে। ইনায়া শীতের মধ্যেও ঘেমে ন্যায় একাকার অবস্থা। কি বলবে উওরে বুঝে উঠতে পারছে না। অযাচিত ভাবে ঠোঁট নাড়িয়ে কোনোরকম শব্দ করে তাদের উদ্দেশ্যে বলে উঠলো,
-” আজ? এই মুহূর্তে? একটু বেশিই তাড়াতাড়ি হয়ে গেলো না? ”
মিনারা বেগম আর মিজানুল করিম একে ওপরে দিকে তাকালেন।
-” বিয়েটা দুবছর আগেই হলে ভালো হতো ইনায়া। তোমার অমতের জন্য জায়ান আমাদের নিষেধ করেছিল তখন। ”
মিনারা বেগমের কথায় ইনায়া রা করলো না। মিজানুল করিম বাধ সেধে বলে উঠলো,
-” থাক ইনায়া যেহেতু চাইছে না, তখন জোর করে কি লাভ? তার চেয়ে ভালো হ…………”
ফাহাদ ইশারায় মিজানুল করিম কে চুপ থাকতে বলে। মিজানুল করিমের মুখের কথা মুখেই থেকে যায়। ফাহাদ ইনায়াকে সময় নিয়ে বলে উঠে,
-” তোমার জীবনে সাকসেসফুল হওয়ায়া জায়ানের মূল উদ্দেশ্য ছিলো। এখন আর কি বাকি আছে ইনায়া? জীবনের রঙিন ধাপে যাওয়া ছাড়া? আজ আকদটা হয়ে যাক। সামনে বড়ো করে রিসেপশন করা হবে। জানোই তো, ওর পেছনে শত্রুরা হুমড়ি খেয়ে পরে আছে। সে আগে থেকেই। এখন তো ওর ক্ষমতা অন্যরকম। ”
ইনায়া মাথা ঝাকালো। করিম ভিলার সবাই আজ আটঘাট বেঁধে নেমেছে। আজকেই জায়ান আর ইনায়ার আকদ সম্পূর্ণ করতে চাইছেন। আচমকা আজ হঠাৎ করেই এমন সম্পর্কে বেঁধে যাবে। তাই একটু ঘাবড়ে গেলো ইনায়া। জীবনের প্রথম ঘাত পার করে এই সুখের রাস্তায় হাঁটতে যাবার আগেই ভয়ে মুখ শুকিয়ে যায় তার। ইনায়া নিজেকে ধাতস্থ করে মিনমিন করে বলে ওঠে,
-” আসলে হঠাৎ এমন সিদ্ধান্তে আমি ঘাবড়ে গিয়েছি। মনের প্রস্তুতিরও একটা ব্যাপার ছিলো। সমস্যা নেই, আমি রাজি। ”
সবাই যেন তৃপ্তির নিঃশ্বাস ফেললো। মিজানুল করিম মিনারা বেগমের সাথে কথা বলতে বলতে বেড়িয়ে গেলেন। ফাহাদ এবার চমৎকার হেসে বলে উঠলো,
-” মেয়র সাহেব কিন্তু ভয়ের চোটে আপনার সামনে আসছেন না। মূলত, আমারাই হুট করে এই ডিসিশন নিয়ে জায়ান কে জানিয়েছিলাম। আর কতো? তারও তো বয়স হয়েছে। জীবনের দ্বিতীয় পর্বে যাওয়া খুব জরুরি। ”
ইনায়া মনেমনে হাসলে। পাজি নেতা তাকে ভয় পায়? হু্হ, সব ঢংয়ের কথা। কিন্তু মুখে প্রকাশ করলো না সে। ফাহাদ নিধিকে বলে গেলো ইনায়াকে সাহায্য করতে। এতোক্ষণে কালো চুড়িদার দেখে ভ্রু কুঁচকালো। নিধি উচ্চ স্বরে হেসে বলে ওঠে,
-” ভাইয়া নিজে গিয়ে কিনেছে তোমার জন্য। তার নাকি খুব শখ তোমাকে তার রাজ্যের ব্লাক কুইন বানাবে। ”
ইনায়া কপাল চাপড়ায়। এই লোক শুধরাবে বলে হয় না। দীর্ঘ দু’ঘন্টা সময় নিয়ে ইনায়াকে রেডি করে নিধি। সবশেষে নিজেই মুগ্ধ হয়ে বলে উঠে,
-” মাশাআল্লাহ, খুব সুন্দর লাগছে তোমাকে। ছেলে হলে নির্ঘাত তোমাকে নিয়ে পালাতাম। ”
দুজনেই হেঁসে উঠলো। নিধি তড়িঘড়ি করে নিচে নেমে যায়। বিয়েতে পার্টির কিছু বিশ্বস্ত লোককে ডেকেছে ফাহাদ। তারা এসে গেছে সেই কখন। খাবারদাবারের পার্ট চুকিয়ে বিয়ে পরানোর কাজ সম্পূর্ণ করতে চাইছেন মিজানুল করিম। স্টাফদের সবাইকে খাবার রেডি করার কথা বলে, তিনি গেলেন জায়ানের খোঁজ করতে। নেতা সাহেবের আসার সময় হয়েছে। মিনারা বেগম জায়ানের সব কাপড় গুছিয়ে রাখছেন। তিনি জায়ানের মতের বিরুদ্ধে যাননি। ছেলের পছন্দ কেই মেনে নিয়েছেন। তিথি ইশান এসেছে। সোহানা মির্জা শেষ দিকে আর আসেননি। ইনায়া চুপচাপ বসে আছে। মিনারা বেগম তাকে ডায়মন্ডের একটা নেকলেস পড়িয়ে দিয়েছেন। কালো পাথরের ভাড়ি লং চুড়িদার আর চকচকে ডায়মন্ডে ইনায়াকে অপ্সরার ন্যায় লাগছে। চুল গুলো বাঁধন ছাড়ার মতোই কোমর পর্যন্ত বিছিয়ে আছে। দোপাট্টা মাথায় ভালো করে টেনে দিয়ে ইনায়া দরজার দিকে লক্ষ্য করে। নিধি আর তিথি এগিয়ে এসে ঝটপট বলতে শুরু করে,
-” এক্ষুনি বিয়ে হবে। কাজি আর রেজিস্ট্রার আসছে। তৈরি হয়ে নাও। ”
ইনায়া চমকালো। ঘেমে ন্যায় একাকার অবস্থা হয়ে যাচ্ছে। শীতের মধ্যে ইনায়ার এমন অবস্থা দেখে নিধি আর তিথি দৃষ্টি মেলালো একবার। জীবনের এমন পরিক্ষা ইনায়া পার করে এসেছে একবার। তখন যেটা খুশির ছিলো, এখন সেটা ভালো লাগা ভয় দুটোই কাজ করছে। কিছুক্ষণ পরেই ফাহাদ ইশান মিজানুল করিম সহ কয়েকজন লোক আসলো। ইনায়া ঠোঁট কামড়ে নিজের অস্থিরতা কমায়। প্রথমেই সাইন করে রেজিস্ট্রার কমপ্লিট করে। নিচে বসে সম্পূর্ণ কাগজ তারা ঠিকঠাক করেই নিয়ে এসেছিলো। কাজি বিয়ে পড়ানো শুরু করে। ইনায়া কে কবুল বলতে বললে সে কিছুটা সময় নিয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় কবুল বলে দেয়। সম্পূর্ণ অস্থিরতা ইনায়াকে আচানক ঘিরে ধরে আছে যেন। জীবনের হঠাৎ হঠাৎ এমন মোড় বদল তাকে বিভ্রান্ত করে তুলেছিল প্রথম থেকেই। লোকজন চলে যাওয়ার পর। নিধি ইনায়ার কাধে ধরে হালকা স্বরে জিজ্ঞেস করে,
-” তু্মি খুব ভিষণ ভাবে কাপছো। ”
ইনায়া মুখ মলিন করলো। বিরবির করে বলে উঠলো,
-” ভিষণ অস্থিরতা অনুভব করছি। না জানি কি হয় পরে? ”
,
,
,
,
,
রাত হয়েছে অনেকটা। আজকেও হালকা তুষার পড়া অব্যাহত রয়েছে। ফায়ারপ্লেসের আগুনে খানিক সময় শরীরটা উষ্ণতা অনুভব করলেও, আচমকা নাভানের শরীর যেন কাঁপুনি দিয়ে যায়। গ্লাস থেকে কিছুটা ওয়াইন নিয়ে সেটা গলাধঃকরণ করার আগেই সেখানে আগমন ঘটে লিও আর সাফরানের। দুজনের শরীরে মোটা উলের লং কোর্ট।
দুজনেই নাভানের দুপাশে ধপ করে বসে পড়লো। নাভান ভ্রুক্ষেপহীন ভাবে বসে ওয়াইনের গ্লাসে ঠোঁট লাগালো। সাফরান নাভানের পাশে বসে নিজের টুপি আর কোটটা খুলে রাখে। লিও মুখ গোমড়া করে বলে ওঠে,
-” আমাদের দেখে খুশি হওনি নাভান? ”
-” বাড়ি বয়ে চলে এসে জিজ্ঞেস করছো খুশি হয়েছি নাকি? হ্যাঁ, সাফরান কে দেখে ভালো লাগলেও তোমাকে দেখে হতে পারছিনা। তোমার এখন জিসার পাশে থাকা খুব জরুরি। ”
লিও ঠোঁট উলটে দিলো। জিসা আজকে নিজের বাবার গ্রহে গিয়েছে। সিজারের আরো পনেরো দিন বাকি। একা একা ভালো লাগছিল না দেখে নাভানের এখানে আসা। সাফরান নাভানের কথার বিপক্ষে দুর্দান্ত শটের মতো বলে উঠে,
-” স্যার, আজকে কি খুব বেশি ডিস্টার্ব লাগছে? এমনই মনে হচ্ছে আপনাকে। মনটা মনে হয় বাংলাদেশ পরে আছে। ”
সাফরানের কথায় নাভান দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল ওয়াইনের গ্লাস রেখে হতাশ দৃষ্টিতে তাকালো দুজনের পানে। অতঃপর বিরবির করে বলে ওঠে,
-” কেমন এক অস্থিরতা ধেয়ে আসছে যেন। ”
লিও নাভান কে মৃদু ধাক্কা দিয়ে জিজ্ঞেস করে,
-” তাহলে, বাংলাদেশে যাও। বাবা মা পরিবারের সাথে সময় কাটালে ভালো লাগবে তোমার। নাকি না যাবার প্ল্যান করে বসে আছো? ”
নাভান হাসলো, কেন যেন মন স্থির করতে পারছে না৷ দুজনের দিকে ওয়াইনের গ্লাস এগিয়ে দিয়ে, ফায়ারপ্লেসের খানিক জ্বলতে থাকা আগুনে দৃষ্টি স্থির করে ম্লান কন্ঠে বলে ওঠে,
-” জীবনটাই যেন কেমন। যা চেয়েছি তা পেলাম কই? যা পেয়েছি তা চাইলাম কই? আবার যটাতে মন স্থির করেছি, সেটাই মারাত্মক ভাবে ক্ষতির স্বরূপ আমার কাছে ধরা দিয়েছে। তা কি ভাগ্য? না সব আমার ভুলে কারণ? ”
গুমোট পরিবেশ যেন আরো গম্ভীরতায় ছেয়ে গেলো। লিও আর সাফরান কিছু বলার মতো খুঁজে পায় না। কিছু কিছু মানুষের জীবন টা এমনই। কিছু ভুলের মাশুল দিতে হয় অনেক। শোধরাবার চেষ্টা করলেও তা ঠিক করা যায় না। লিও মুচকি হেসে জিজ্ঞেস করে,
-” তাকে নিজের করে রাখার প্রয়াস করোনি? ”
নাভান এবারো চমৎকার হাসলো। তার হাসির মাঝে কষ্ট লুকিয়ে রয়েছে। লিওর দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে বলে,
-” ঠিক তা নয়। তাকে নিজের করে রাখায় তাকে মানানোর মুখ আমার ছিলোনা। তার কাছে ক্ষমা চাইনি। তাকে অনুরোধ করিনি আমার কাছে থাকার জন্য। যতোবার সামনে গিয়েছি, নিজেকে তার সামনে খুবই নিকৃষ্ট মনে হয়েছে। পরিশেষে চেয়েছি, তার সুখের সন্ধান করা ভুল নয়। সে সুখে থাক। তার সেটা অধিকার রয়েছে। ”
নাভান কিছুক্ষণ থেমে আবার বলে উঠলো,
-” ডিভোর্স পেপারে সাইন করার সময় গুলোতে, ইনায়ার দীর্ঘশ্বাস ব্যাতিত কিছুই লক্ষ্য করিনি আমি। দাদি মা-রা যাবার পরপরই চলে আসতে চেয়েছিলাম। কিন্তু ডিভোর্সের শেষ কার্যকর পর্যন্ত অপেক্ষা করা জরুরি ছিলো। শেষ দিন ইনায়া আমাকে কি বলেছিলো জানো? ”
সাফরান আর লিও দুজনেই তাকালো। নাভান দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফিরে গেলো সেদিনের অতীতে। তিথির বিয়ের দুইমাস পরে। একটা লেকের পাড়ে দু’জনেই দাঁড়িয়ে। সময়টা গোধূলি বিকেলের দিকে। দুজনেই হাত ভাজ করে সামনে তাকিয়ে। আচমকা নাভান জিজ্ঞেস করে,
-” আজ থেকে সম্পর্কের বোঝা নেই তোমার উপর। যা তুমি একা যাতনার সহিত বয়ে এসেছিলে? ”
ইনায়া হাসলো। কিঞ্চিত পরিমাণের বাকিয়েই হেসে উঠে। নাভানের দিকে পূর্ণ দৃষ্টি স্থাপন করে কাটকাট গলায় বলে ওঠে,
-” নয় মাস খুব কম সময় ছিলোনা। যেখানে, আপনার পর নারীর সাথে অন্তরঙ্গ মূহুর্ত প্রতিনিয়ত দেখে, নিজের আত্মসম্মান বিসর্জন দিয়ে অবলা নারীর মতো আপনার আশায় পরে ছিলাম। যেদিন বাড়ী ছেড়েছি, সেদিন কাবুলের জোরে মায়া ভালোবাসা সব শেষ করে এসেছি। এই জেনারেশনের আমার মতো এমন মেয়ে কই? যে স্বামীর আশায় এভাবে বসেছিল। হয়তো আমার স্বার্থে, আর নয়তো আমার অসহায়ত্ব নাহলে আপনার আশায়। যেগুলো আমার আত্মসম্মানে ঘাত করেছিল। যার এক কারণ মামনী। চোখ খুলতেই সেসব ছেড়ে এসেছি। ”
ইনায়া কথা গুলো বলে। পিছুফিরে একবার দেখে বলেছিলো,
-” ভালো থাকবেন নাভান। ভুল থেকে বেড়িয়ে আপনি ভালো কিছু জীবনে পাবেন। ”
নাভান ঠোঁট দুটি নাড়িয়ে অস্ফুটস্বরে বলেছিল,
-” হয়তোবা, তোমার কথাই জয় হোক। ”
পিছুটানের স্মৃতি থেকে বেড়িয়ে আসে নাভান। বসা থেকে উঠে গিয়ে দাড়ালো নিভু নিভু ফায়ারপ্লেসের আগুনের কাছে। অতঃপর গম্ভীর গলায় বলে ওঠে,
-” সেদিন আমি বলতে পারিনি। সেই নয় মাস অদিতির সাথে আমার সম্পর্ক দীর্ঘস্থায়ী ছিলো না। কারন হলো, বিয়ের পরেও তার সাথে আমি কয়কবার ফিজিক্যাল রিলেশনশিপে গিয়েছিলাম। তার আমার অতীত নিয়ে মাথা ব্যাথা ছিলো না। কিন্তু তাকে কবুল বলেও যেই পাপ অব্যাহত রেখেছি, তাই তার হৃদয়ে দাগ টেনেছে প্রচুর। যেটাকে আমি সম্মান করি। ”
লিও আর সাফরান আর কোনো কথা খুজে পেলোনা। তারা ইনায়া কে দোষও দিতে পারলো না। নাভান জ্বলন্ত আগুনে আবারও চোখ রেখে বিরবির করে বলে ওঠে,
-” “তুমি আমার জীবনের একমাত্র ধোঁয়াশা, যা হাত বাড়িয়ে ছুঁতে গেলেই হারিয়ে যাও। ”
,
,
বিয়ে কাজ সম্পূর্ণ হয়েছে। শেষ বারে মোনাজাত শেষ করে তারা মিষ্টি মুখ করায় ব্যস্ত। ইনায়া খোঁজ করে জায়ানের এখানে আসার পরে একবারও তার দেখা পায়নি। এবং কি বিয়ের আগে পরেও ইচ্ছাকৃত ভাবে কোনো দেখা দেয়নি। নিধি তিথি এই নিয়ে হাসাহাসি করেছে প্রচুর। তাদের ভাষ্যমতে, জায়ান লজ্জায় ইনায়াকে দেখা দিচ্ছে না। কিন্তু ইনায়ার মোটেই সেটা বিশ্বাস হলো না। সময় গড়িয়ে রাত হলো। ইনায়া রায়াকে ফোন করে সব জানায়। ফোনের ওপরপাশের রায়ার রিয়াকশন ছিলো মাথায় আকাশ ভাঙে পড়ার মতোন। রায়ার সাথে কথা বলতে থাকার সময় নিধি তিথি এসে ইনায়াকে নিয়ে যেতে লাগলো।
-” কোথায় নিয়ে যাচ্ছো? ”
-” গেলেই দেখতে পারবে। ”
ইনায়ার কথার উত্তরে নিধি জবাব দিলো। তারা দুজন ইনায়াকে টেনে হিঁচড়ে ছাঁদে নিয়ে আসতেই, চোখছানাবড়া হয়ে উঠলো ইনায়ার। সম্পূর্ণ ছাদ লাইটিং করা। একপাশের স্টেজটা সম্পূর্ণ কালো গোলাপে আবৃত করা। উপরের কাজে অর্কিড ফুলের সমাহার। ছোট বড়ো অসংখ্য ক্যান্ডেল লাইট বসানো সারা ছাঁদ জুড়ে। ইনায়ার মনটা পুলকিত হলো। পাশে তাকাতেই নিধি আর তিথি কে পেলো না। আচমকা চোখ যায় সামনে দাড়ানো জায়ানের পানে। কালো রঙের শেরওয়ানি কোটে তাকে প্রিন্সের থেকে কম লাগছে না। হাত বাড়িয়ে দাড়িয়ে আছে ইনায়ার দিকে। ইনায়া হাসিমুখে তার দিকে হাত স্পর্শ করে। অতিব উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে ইনায়া জায়ানের দিকে। অসম্ভব সুন্দর সুদর্শন পুরুষটি তার স্বামী। আচ্ছা ছেলেদের এতো সুন্দর হতে হয়? ইনায়ার ভাবনার মাঝে জায়ান তাকে নিজের বাহুতে জড়িয়ে ধরে পরম শান্তিতে। অতঃপর ইনায়ার কানে কানে ফিসফিস করে বলে,
-” আমার ভীতু হরিণী, আজ তো চোখে কোনো ভয় দেখতে পারছি না? ”
ইনায়া জায়ানের বুকে থেকেই স্নিগ্ধ মধুময় হাসলো। বুক থেকে মাথা উঠিয়ে কপাল ঠেকালো জায়ানের কপালের সাথে। স্মিথ হেসে বলে ওঠে,
-” তা কি আমি পারবো জনাব? আমি সারাজীবন আপনার কাছে বোকা হরিণী হয়েই থাকতে চাই। ”
জায়ান ইনায়াকে পাজো কোলে তুলে নেয়। ললাটে দীর্ঘ চুমু একে বলতে শুরু করে,
-” আমার স্বপ্ন গুলো, আচমকাই আজ আমার হয়ে ধরা দিয়েছে। আমি এই মুহূর্ত টাকে অনুভব করতে চাই। বিষণ ভাবে উপভোগ করতে চাই। ছুয়ে দেখতে চাই, তুমি আদেও আমার হয়েছো? না কি স্বপ্নেই রয়েছো। ”
ইনায়া চোখবুঁজে বিরবির করে বলে উঠলো,
-” আমি আজ আপনারই। স্বপ্ন নয় সত্যিই। ”
,
,
চলবে………….