নীড় ভাঙ্গা ঝড় পর্ব-০১

0
2510

#বড় গল্প
#নীড় ভাঙ্গা ঝড়
পর্ব- এক
মাহবুবা বিথী

বাসরঘরে তমাকে তার নববিবাহিত স্বামী বলে,
—-তোমার সাথে আমার কোনোদিন বাসর হবে না। আজ আমার জন্য অন্য একজন বাসর ঘরে অপেক্ষা করছে। সুতরাং বুঝতেই পারছো তুমি কোনোদিন আমার কাছে স্ত্রীর অধিকার পাবে না। সুতরাং যত তাড়াতাড়ি নিজেকে আমার জীবন থেকে সরিয়ে নিতে পারবে ততই মঙ্গল। আর একটা কথা পুরোবাড়ির মানুষ ঘুমিয়ে পড়েছে। আমিও আমার প্রিয়তমা স্ত্রীর কাছে চলে যাচ্ছি। দরজাটা লাগিয়ে দাও। আর একথা যেন কারো কাছে প্রকাশ করা না হয়। কথাটা ভালো করে মনে রেখো। এর ব্যতয় ঘটলে তোমাকে ডিভোর্স দিয়ে দিবো।
তমা সদর দরজা লাগিয়ে দেয়। রুমে এসে বিছানায় বসে ভাবে, ওর নববিবাহিত স্বামী কি অবলীলায় কথাগুলো বলে গেল। অথচ বাসরঘর নিয়ে ওর অনেক কৌতূহল ছিলো। কথাগুলো বলতে ওর স্বামীর মুখে একটুও আটকালো না। তমা কথাগুলো শুনে সত্যি খুব অবাক হয়। একবার ওর মনে হয়, ওর স্বামীকে জিজ্ঞাসা করা উচিত, তাহলে ওকে কেন বিয়ে করা হলো? পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নেয়। কেননা ওর ইচ্ছাতেই ওর বাবা ওকে বিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছে। তমাও এটাই চেয়েছে। ওর কাছে বিয়ের আগে প্রেম না করে বিয়ের পর প্রেম করাটা শ্রেয় বলে মনে হয়। ভেবেছিলো বিয়ের পর স্বামীর সাথে চুটিয়ে প্রেম করবে। অথচ বাস্তবতা ওকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিলো জীবন বড় কঠিন। সহজ সরল গতিপথে জীবন নদীর স্রোত কখনও প্রবাহিত হয় না।
ও সবে এইচএসসি পাশ করে গাইবান্ধা সরকারী কলেজে অনার্সে ভর্তি হয়েছে। হয়তো বিয়েটা ও দুদিন পরে করতে পারতো। কিন্তু বছরখানিক আগে ওর মা মারা যায়। আর ছ,মাস আগে ওর বাবাকে ওর ভাইয়া বিয়ে দিয়ে নিজে বউ নিয়ে ঢাকা শহরে থিতু হয়। তমা ভাবে,এই পৃথিবীতে মানুষ খুব স্বার্থপর প্রাণি। নিজের স্বার্থ ছাড়া ওরা আর কিছু বুঝে না।
একদিকে মা মারা যাওয়া অন্যদিকে বাবার নতুন বিয়ে করা তমার মনের উপর সেসময় প্রচন্ড চাপ সৃষ্টি হয়। ও মন থেকে ওর বাবার বিয়েটা মেনে নিতে পারেনি। সে কারনে ও আর বাবার বাড়িতে থাকতে চাইছিলো না। সুতরাং ও বাড়ি থেকে চিরতরে বেরিয়ে যেতে হলে বিয়ে ছাড়া ওর আর কোনো গত্যন্তর নেই। এইজন্য চটজলদি বিয়ে করতে বাধ্য হয়েছে। অথচ ভাগ্য ওকে নিয়ে কি খেলা খেললো? না, ও আল্লাহপাকের উপর থেকে ভরসা হারায়নি। নিশ্চয় এরমাঝে কোনো না কোনো মঙ্গল লুকিয়ে আছে।
আজ এই একলা বাসরে বসে ওর নতুন মায়ের কথা খুব মনে পড়ছে। বিয়ের পর থেকে এই মানুষটাকে ও আর আপন ভাবতে পারেনি। কেননা যেদিন ওর নতুন মাকে ওর বাবা বিয়ে করে আনে সেদিন ও অসুস্থ হবার ভান করে সারারাত ওর বাবাকে নিজের মাথার কাছে বসিয়ে রাখে। না,ওর নতুন মা অবশ্য এ কারনে ওকে কখনও কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দেয়নি। সেও বিশ্বাস করেছিলো তমা হয়তো সত্যিই অসুস্থ। অভিনয়টা তমা সেদিন নিঁখুতভাবে করেছিলো। ও কখনও ওর নতুন মাকে মা বলে ডাকেনি। এটা নিয়েও বেচারী কোনোদিন কোনো অভিযোগ দাখিল করেননি। এখন যদি ওর স্বামী ওকে ডিভোর্স দিয়ে দেয় তাহলে কিভাবে ও ওর বাবা মায়ের সামনে দাঁড়াবে? তার থেকে বরং নিজেকে ভাগ্যের হাতে ছেড়ে দেওয়াই ভালো। দেখা যাক ভাগ্য ওকে কোথায় নিয়ে দাঁড় করায়। সেজন্য তমা মনে মনে সিদ্ধান্ত নেয় ওর স্বামীর গোপন বিয়ের কথা ও কাউকে বলবে না।
তমা বিছানা থেকে নেমে জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। আজ আষাঢ়ের ভরা পূর্নিমা। আকাশে গোল থালার মতো চাঁদ উঠেছে। মায়ের কথা আজ তমার খুব মনে পড়ছে। মা বলত ঐ চাঁদের ভিতরে বসে চাঁদের বুড়ি নাকি চরকা কাটে। ছোটোবেলায় চাঁদের দিকে ও একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতো। তখন চাঁদের অবয়বটাকে ওর বুড়ির মতো মনে হতো। তমা আকাশের বুকে জ্বলজ্বলে একটা তারা দেখতে পায়। মা বলতো, মানুষ মরে গেলে নাকি আকাশের তারা হয়ে যায়। তমা ওর দাদীর খুব ভক্ত ছিলো। দাদী যেদিন মারা যায় এরকম এক পূর্ণিমা ছিলো। ও সেদিন খুব কেঁদেছিলো। হয়তো ওকে ভুলানোর জন্য ওর মা সেদিন মিথ্যা গল্প বানিয়ে বলেছিলো। কেন জানি আজ ওর মায়ের কথা খুব মনে পড়ছে। মা যদি বেঁচে থাকতো ওর কষ্টের কথাগুলো অবলীলায় মাকে বলতে পারতো।
মানুষের মন ভাঙ্গা আর মসজিদ ভাঙ্গা নাকি সমান কথা। আল্লাহপাক জানেন এই কথার সত্যতা। তবে ওর স্বামী সাব্বির আজ ওর মনটাকে কাঁচের টুকরার মতো ভেঙ্গে দিয়েছে। যা হয়তো কখনও জোড়া লাগানো যাবে না। নিজের অজান্তে দুচোখের কোল বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়তে লাগলো।
বাড়ি থেকে বের হয়ে সাব্বির হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। গাইবান্ধা সদরে ডাকবাংলোর পাশে ভাড়া বাড়িতে ও শিলাকে রেখেছে। চারতলা বিল্ডিং এর দোতলা ভাড়া নিয়েছে।বাইকে চেপে রওয়ানা দেয়। তমার জন্য ওর খারাপ লাগছে। তবে এই খারাপ লাগাকে ও প্রশ্রয় দিবে না। কারণ তমাকে বিয়ে করার ওর একদম ইচ্ছে ছিলো না। মায়ের জোরাজুরিতে ও তমাকে বিয়ে করতে রাজী হয়। এতে ওর মা আয়েশা খাতুন ভেবে নেন ছেলে হয়তো তার দূর সম্পর্কের চাচাতো ভাইয়ের মেয়ে শিলাকে ভুলতে পেরেছে। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। সাব্বির পারেনি ওর ভালোবাসাকে অসম্মান করতে। বাসর সেরে ফজরের আযানের আগে সাব্বির বাড়ী ফিরে আসে।
তমার বিবাহিত জীবনের ছ’মাস পেরিয়ে গেল। ও সাব্বিরের এই আচরণের সাথে নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে জীবনের সময়গুলো পার করতে লাগলো। তবে এর মধ্যে সাব্বিরকে ওর মা হাতে নাতে ধরে ফেলে। ইউরিনের চাপে রাত চারটার সময় সেদিন আয়েশা খাতুনের ঘুম ভেঙ্গে যায়। উনি ওয়াশরুমে যাবার সময় সাব্বিরকে ঘরে ঢুকতে দেখে। দরজাটা অবশ্য তমাই খুলে দিয়েছিলো। কিন্তু ঐ রাতে উনি ছেলেকে শাসন না করে তমাকে অনেক গালমন্দ করেন। পাশাপাশি এটাও বলেন এটা তমার ব্যর্থতা। ও ওর স্বামীকে ঘরের ভিতর আটকে রাখতে পারেনি। অথচ উনার ছেলে যে দিনের পর দিন তমার সাথে অন্যায় করে গেল সেক্ষেত্রে ছেলেকে উনি কিছু বললেন না। এটা দেখে তমা বললো,
—-আপনি তো আমাকে অনেক কিছু বললেন কিন্তু ছেলেকে তো কিছুই বললেন না।
—-তুমিও তো না পারলে বাচ্চা পয়দা করতে আর না পারলে নিজের স্বামীকে আটকে রাখতে।
তমাও রেগে গিয়ে বলেছিলো,
—-একা একা তো বাচ্চা পয়দা করা যাবে না। আপনার ছেলে আজ অবদি আমার সাথে বিছানা শেয়ার করেনি। তাহলে বাচ্চা কি করে পয়দা হবে?
শাশুড়ী আয়েশা খাতুন তমার গালে সাথে সাথে চড় বসিয়ে দিয়ে বলেন,
—-আমার সাথে এভাবে কথার বলার সাহস তোমার হয় কি করে? আমার চোখের সামনে থেকে দূর হয়ে যা।
এরপর থেকে আয়েশা খাতুন তমাকে আর পুত্রবধুর মর্যাদা দেয় না। তবে ঘরের এ্যাসিটেন্টের জায়গাটা তমার জন্য বরাদ্দ করেন। তমাও কোনো প্রতিবাদ করে না। সংসারের কাজ করার বিনিময়ে তমার খাওয়া পড়া জুটে। এটা নিয়ে তমার কোনো আফসোস নেই। এদিকে সাব্বির খুব বেপরোয়া হয়ে উঠে। ও এখন আর রাতের বেলা লুকিয়ে ও শিলার কাছে যায় না। বরং সবার সামনে বুক ফুলিয়ে ও শিলার কাছে যায়। এতে কিছুদিনের মধ্যে শিলা কনসিভ করে ফেলে।

চলবে