নীড় ভাঙ্গা ঝড় পর্ব-০৫

0
501

#বড় গল্প
#নীড় ভাঙ্গা ঝড়
পর্ব-পাঁচ
মাহবুবা বিথী

সেদিন অয়ন চেম্বারে রুগী দেখছিলো। হঠাৎ ফোনটা বেজে উঠলো। ও একটু অবাক হলো। এই সময়টাতে ওকে যারা চিনে তারা কেউ ফোন দেয় না। সবাই জানে,ও এই সময়টাতে চেম্বারে বসে। মোবাইলের স্ক্রীনের দিকে তাকাতেই চোখটা যেন আঁটকে গেল। নামটা সকালের রোদের মতো জ্বলজ্বল করছে। ও একমুহুর্ত অপেক্ষা না করে ফোনটা রিসিভ করে সালাম দিয়ে বললো,
—-কেমন আছেন?
তমা একটু অবাক হলো। হা এটা ঠিক ও ফোন নাম্বার দিয়ে এসেছিলো। কিন্তু উনি যে সত্যিই ওর ফোন নাম্বারটা মোবাইলে সেভ করে রাখবেন সেটা তমার ধারণার বাইরে ছিলো। তমা নিজেকে সামলে নিয়ে বলে,
—-ভালো আছি।
—-তা হঠাৎ কি মনে করে ফোন দিলেন?
—-আব্বুর প্রেসারটা অনেক বেশী। আপনার চেম্বারে আব্বাকে নিয়ে আসতে চেয়েছিলাম।
—ওকে, নিয়ে আসুন।
এরপর থেকে তমা প্রায় ওর বাবাকে নিয়ে অয়নের চেম্বারে যায়। অয়ন যেহেতু মেডিসিনের ডাক্তার পাশাপাশি কার্ডিওতে এমএস করেছে সে কারনে তমা ওর বাবাকে অয়নের তত্তাবধানে চিকিৎসা করাতে লাগলো। ওর বাবার হাইপারটেনশন সাথে কার্ডিয়াক সমস্যাও ধরা পড়েছে। ডাক্তার সন্দেহ করছে ব্লক থাকতে পারে। অয়নই এনজিওগ্রাম করাবে। সেই সুত্র ধরে ওদের মাঝে একটা বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে উঠে। মাঝে মাঝে ম্যাসেঞ্জারেও আলাপও হয়।
ওর বাবার হার্টে দুটো ব্লক ধরা পড়েছে। অয়ন তমাকে বলেছে, ওর বাবাকে যেন ঢাকায় নিয়ে চিকিৎসা করানো হয়। ঢাকায় ইউনাইটেট হাসপাতালে ডাক্তার ফাতেমা আপুর কাছে অয়ন তমার বাবাকে রেফার করেছে। যেদিন তমার বাবার হার্টে রিং পরানো হবে তার একদিন আগে তমা ওর বাবাকে নিয়ে ঢাকায় চলে আসে। ওর ভাইয়ের বাসায় উঠে। অয়নও ঢাকায় এসে ইউনাইটেট হাসপাতালে তমা আর ওর বাবার সথে দেখা করে। তমার ভাইয়ার সাথে অয়ন পরিচিত হয়। তমার বাবার হার্টে রিং পরানো খুব সুন্দরভাবে সমাপ্ত হয়। বিশেষ করে অয়ন তমার বাবাকে নিজের আত্মীয় হিসাবে পরিচয় দেওয়াতে ডাক্তার স্পেশাল কেয়ার নেয়। অয়নের বিনয়ী আচরণ ভালো ব্যবহারে তমা এবং ওর বাড়ির সবাই খুব মুগ্ধ্।
অয়নের তমাকে বেশ ভালো লাগে। মাঝে মাঝে রাত জেগে ওর সাথে কথা বলে। নিসঙ্গতা এখন ওকে আর গ্রাস করে না। হতাশা ওর জীবনটাকে আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে রাখে না।
যার ফলে অয়নের মাঝে বেশ পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। এখন ও বেশ হাসি খুশী থাকে।
জিন্নাত আরা লক্ষ্য করেছে অয়ন মাঝে মাঝে রাত জেগে কার সাথে যেন ফোনে কথা বলে। সেদিন রাত দুটোর সময় জিন্নাত আরা ওয়াশরুমে যাওয়ার সময় অয়নকে ফোনে কার সাথে যেন কথা বলতে দেখে। মনে হলো খুব কাছের কারো সাথে যেন অয়ন কথা বলছে।
অয়নের ছোটোভাই সায়ানের কাজ থেকে জিন্নাত আরা তমা সম্পর্কে জানতে পেরেছেন। ওদের দু’ভাইয়ের সম্পর্ক বন্ধুর মতো। দু’জন দু’জনের কাছে সব কথাই শেয়ার করে।
জিন্নাতআরা ছেলের পরিবর্তন দেখে মনে মনে ভীষণ খুশী হলেন। তাই সেদিন নাস্তার টেবিলে অয়নকে বললেন,
—এভাবে আর কতদিন চলবে? এবার তো বিয়ে করে থিতু হতে হবে।
তখন অয়ন তমার কথা জিন্নাত আরাকে জানায়। জিন্নাত আরাও আর দেরী করতে চাইলেন না। জিন্নাত আরার তাড়াহুড়ো দেখে অয়ন বললো,
—-এতো তাড়াহুড়ো করার দরকার নেই। আরো কটাদিন যাক।
কিন্তু জিন্নাত আরা আর অপেক্ষা করতে চাইলেন না। যদি ছেলের মত পাল্টে যায়। সে কারণে তমার সাথে পরিচিত হওয়ার কথা বলে অয়নের কাছ থেকে তমার ফোন নাম্বার নিয়ে নেন।
অয়নের সাথে যেদিন তমার কথা হয় সেদিন ও খুব ফুরফুরে মেজাজে থাকে। বিষাদে ভরা চোখ দুটো ঘোর লাগা স্বপ্নে তখন বিভোর থাকে। যদি ও অয়ন এখন পর্যন্ত ওকে কিছু বলেনি। তবে তমা বুঝতে পারে অয়ন ওকে খুব পছন্দ করে।
দুবছর সময় পার হয়ে গেল। সামনে সাবসিডিয়ারী পরীক্ষা শুরু হবে। পড়াশোনা নিয়ে বেশ ব্যস্ত সময় পার করছে।এখন ও আর নিজের জীবন নিয়ে আক্ষেপ করে না। তবে ডিভোর্সী বলে ষাট বছরের বুড়ো থেকে শুরু করে মানসিক প্রতিবন্ধি, অসুস্থ রোগী, শিক্ষিত অশিক্ষিত সব ধরণের প্রস্তাব আসছে। তখন মনটা ভীষণ বিষন্ন লাগে। নিজেকে বড্ড অপাংতেয় মনে হতে থাকে। ওর ছোটো মা ওকে সাহস দিয়ে বলে,
—-এতো ভেঙ্গে পড়ো না। বিয়ে তোমার হবে। তবে এবার দেখে শুনে নিবে আর নিজের পায়ের তলার মাটিটা শক্ত করে নিবে।
ছোটো মাকে তমার ভালো মা বলে ডাকতে ইচ্ছা করে। আসলে ছোটো মা ওর কষ্টটা পরিপূর্ণ উপলব্ধি করতে পারেন। নিজেও তো ঘর পোড়া। তাই অন্যের ঘর পুড়ে গেলে কতোটা বেদনার জল তার হৃদয়ের নদীতে বয়ে যেতে পারে তিনি তা বুঝে নিতে পারেন। মুখ ফুটে তমাকে তেমন কিছুই বলতে হয় না। তমা গাইবান্ধা সরকারী কলেজে সোসিওলজিতে অনার্স পড়ছে। কলেজে যায় আর যেটুকু সময় বাড়িতে থাকে ওর ছোটো মাকে কাজে সাহায্য করে। ছোটো বোন ঐশীর দেখাশোনা করে।
ছোটো মা বিধবা ছিলেন। বিয়ের দুবছরের মাথায় উনার স্বামী হঠাৎ হার্ট এ্যাটাক করে মারা যান। তারপর বাবার বাড়িতে পাঁচবছর ছিলেন। বাবা মা বেঁচে না থাকাতে ভাইয়ের সংসারে অনেক গঞ্জনা উনাকে সহ্য করতে হতো। সে কারনে তমার ক্ষতের জায়গার কষ্ট উনি উপলব্ধি করতে পারেন। উনি সবসময় তমার মন বুঝে কথা বলেন।
এতো কিছুর মাঝে অয়নের সাথে ওর যখনই কথা হয় সেই মুহুর্তে বসন্তের মাতাল সমীরণ যেন ওকে ছুঁয়ে যায়।
অয়ন ও ডিভোর্সী তাহলে ওর জন্য কি তমার মতো এরকম বিভিন্ন জায়গা থেকে প্রস্তাব আসে নাকি ছেলে বলে সাত খুন মাফ হয়ে যায় তমার খুব জানতে ইচ্ছা করে। কিন্ত সাহস করে বলে উঠতে পারে না। অয়ন অবশ্য তমার জীবনের কথা জানতে চেয়েছিলো। তমা অল্প স্বল্প বলেছে। পুরোটা বলতে পারেনি। আসলে স্বপ্ন ভাঙ্গার কষ্ট কাউকে বলা যায় না। কারণ যতবার বলবে ততবারই যে সে আঘাত প্রাপ্ত হবে। একারণে অয়নের কাছে তমা ওর জীবনের বিষাক্ত অতীতের কথাগুলো শুনতে চায় না। খারাপ স্মৃতিগুলো ভুলে যেতে হয়। নিজেকে ভালো রাখার জন্য ভুলতে হয়। তমা সেই চেষ্টাই করছে প্রতিনিয়ত।
রাতে খাবার খেয়ে সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। পুরো বাড়ি নিরব হয়ে আছে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে রাত এগারোটা বাজে। তমা ওয়াশরুমে গিয়ে ওজু করে এসে এশার নামাজ আদায় করে নিলো। সামনে পরীক্ষা, কিন্তু চোখ দুটো বার বার মোবাইলের স্ক্রীনের দিকে চলে যাচ্ছে। আজ চারদিন হয়ে গেল অয়ন ওকে ফোন দেয় না। ওর গলার ভয়েসটা শোনার জন্য তমার কানদুটো যেন অস্থির হয়ে আছে। ফোনটা বেজে উঠলো। তমা ফোনটার দিকে তাকিয়ে দেখে আননোন নাম্বার থেকে ফোন এসেছে। ধরবে না ভেবেও কি মনে করে যেন ফোনটা ধরে বলে,
—-হ্যালো কে বলছেন?
ফোনের অপর প্রান্তের মানুষটা ওর কথার উত্তর না দিয়ে বললো,
—-তমা বলছো?
গলার স্বরটা এতো কোমল। তমার মনটায় ভালো লাগা ছেয়ে গেল। গলার স্বরটায় এক ধরণের মায়া লুকানো আছে। তমা প্রত্যুত্তরে বলে,
—-জ্বী বলছি,
—-আমি অয়নের আম্মু বলছি।
—-আন্টি আসসালামু আলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহি বারকাতুহু।
—-খুব সুন্দর করে সালাম দিলে,ভীষণ ভালো লাগলো। কেমন আছো?
—-আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি।
—-আগামীকাল তোমার সাথে দেখা করতে সায়ানকে নিয়ে গাইবান্ধা আসছি। তবে অয়নকে জানিও না। তোমার বাবা মায়ের সাথে পরিচিত হতে আসছি।
তমা কি বলবে বুঝতে পারছে না। তুতলিয়ে কোনো রকমে জিজ্ঞাসা করলো,
—-কাল কখন আসবেন আন্টি?
—-,আসরের নামাজের পর আসবো। বেশী ব্যস্ত হবে না। তোমার মা বাবার সাথে পরিচিত হতে আর তোমাকে দেখতে আসবো।
ফোনটা রেখে তমা যেন আবেগে আপ্লুত হয়ে গেল। কেমন যেন সবকিছু স্বপ্নের মতো লাগছে।

পরদিন খুব ভোরে তমার ঘুম ভাঙ্গলো। ফজরের নামাজ আদায় করে রান্নাঘরে গিয়ে অয়নের মা আসার কথাটা জানালো। ওর ছোটো মা শুনে ব্যাতিব্যস্ত হয়ে বলে,
—-এই গুরুত্বপূর্ণ সংবাদটা তুমি রাতেই জানাতে পারতে।
—-কোনো সমস্যা নেই। আন্টি বলেছে আমাদের সাথে শুধু এককাপ চা খাবে।
—-তাই বললে কি হয় মা? তোমার বাবাকে বাজারে পাঠাতে হবে। তুমি চা বানাও আমি তোমার বাবাকে খবরটা জানাচ্ছি।
তমা মাথা নেড়ে সায় দিলো। তমার কাছে আজকের সকালটা অন্য রকম লাগছে। বহুদিন এরকম স্নিগ্ধ সকাল ওর জীবনে আসেনি। উঠোনটা সকালের নরম রোদে ভাসছে। পাখির কিচির মিচির শব্দ আর পায়রার খোপে বাক বাকুম ডাকে ওর মনের আঙ্গিনায় এক অন্যরকম সুর ভাঁজছে। যে সুরে আছে এক নতুন জীবনের জয়গান।

চলবে