#বড় গল্প
#নীড় ভাঙ্গা ঝড়
শেষ পর্ব
মাহবুবা বিথী
অয়ন আর তমার বিয়ের বেশ কিছুদিন সময় পার হয়ে গেল। কিন্তু জিন্নাত আরা ছেলে বৌমা কারো মুখেই যেন সুখের ছোঁয়া দেখতে পেলেন না। তিনি মনে মনে ভীষণ মুষড়ে পড়লেন। সমস্যাটা কি বুঝতে পারছিলেন না।কিন্তু এই কয়দিনে তমাকে যতটুকু দেখেছেন তাতে মনে হলো,অয়নকে ও ভালোই কেয়ার করে। অয়নের জন্য মেয়েটা বেশ তটস্থ থাকে। মনে মনে নিজের ছেলের উপর খুব রাগ হলো। আগের বউটা ওকে ডমিনেট করতো। আর এখন ও তমাকে ডমিনেট করে। তমার সাথে একান্তে কথা বলার জন্য উনি মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলেন।
সেই সুত্র ধরেই একদিন সকালে অয়ন গাইবান্ধায় চলে যাবার পর জিন্নাত আরা তমাকে নিজের কাছে ডেকে নিয়ে বললেন,
—তোমার মনে আছে, বিয়ের দিন তোমাকে বলেছিলাম আমি কোনোদিন তোমার মা হতে পারবো না তবে শাশুড়ীও হতে চাই না। আমি তোমার মায়ের কাছাকাছি একজন হতে চাই।
জিন্নাত আরার কথা শুনে তমা কেঁদে ফেলে। ওকে কাঁদতে দেখে জিন্নাত আরা বললেন,
—-,কান্না তো কোনো সমাধান বের করতে পারবে না। যে কোনো বিষয়ের নিস্পত্তি করতে চাইলে ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করতে হয়।
তমা চোখের পানিটা মুছে বলে,
—মা,আমার আসলে আর বিয়ে করাই উচিত হয় নাই। স্বামী সুখ আমার কপালে লেখা নাই।
—-এতো তাড়াতাড়ি মন্তব্য করা ঠিক নয়। একটু ধৈর্য ধরো দেখবে সবকিছু ঠিকঠাক হয়ে যাবে।
তমাও হয়তো তাই ভাবলো। জীবনে কখনও হতাশাকে স্থান দিতে হয় না। আল্লাহপাকের উপর ভরসা করে ধৈর্য ধরতে হয়।
তবে জিন্নাত আরা ছেলের উপর প্রচন্ড ক্ষুদ্ধ হন। সামনে তমার পরীক্ষা। তমা পরীক্ষা দেওয়ার জন্য গাইবান্ধায় নিজের বাবার বাড়িতে চলে যায়। জিন্নাত আরা এই সুযোগে অয়নকে জিজ্ঞাসা করে,
—-তোমার সমস্যাটা কি আমায় বলতে পারো?
—-তুমি কোন সমস্যার কথা বলছো?
—-কেন না জানার ভাব করছো?তুমি ঠিকই বুঝতে পারছো আমি কোন বিষয়ে কথা বলছি?
—আম্মু আমি আসলেই বুঝতে পারছি না।
—তমার সাথে তোমার সমস্যাটা কি? মেয়েটা কোন দিক থেকে তোমার অযোগ্য? তুমিই তো প্রথম ওর কথা আমায় বলেছিলে। সে কারনেই তো আমি তোমার সাথে ওর বিয়ের ব্যবস্থা করলাম।
—তোমাকে আরো কটাদিন সময় হাতে নিতে বলেছিলাম।
—একটা কথা শুনে রাখো তুমি কটাদিন কেন হাজার বছর সময় নিলেও কোনো কাজ হবে না কেননা তুমি যতক্ষণ নিজেকে পরিবর্তন করবে না ততক্ষণ তোমার জীবনের কোনো কিছুর পরিবর্তন ঘটবে না। মেয়েটা দেখতে ভালো,বয়স কম,তোমাকে বেশ মেনে চলে,ভালো রাঁধতে পারে কোন দিক থেকে তোমার অযোগ্য বলতে পারো?
অয়ন মায়ের কথা শুনে কিছুক্ষণ নিরব হয়ে থাকলো। তারপর কেশে গলাটা পরিস্কার করে বলে,
—-তুমি তো ওর সাথে একই রুমে থাকো না তাই তুমি বুঝবে কি করে? প্রচন্ড অগোছালো থাকে। যেটা আমার ভীষণ বিরক্ত লাগে। যখনি ওয়াশরুমে যাবে ওয়াশরুম ভিজিয়ে ফেলবে। তাছাড়া সাজশয্যাতেও একটু যেন কেমন?
জিন্নাত আরা ছেলের উপর মনে মনে আরো ক্ষেপে গেলেন। কিন্তু বাইরে সেটা বুঝতে না দিয়ে বেশ গম্ভীর হয়ে বললেন,
—তুমি যে কারণগুলো বললে আপাত দৃষ্টিতে এগুলো কোনো সমস্যাই না। আর সাজশয্যার কথা যেটা বললে সেটা তুমি এতো তাড়াতাড়ি ভুলে গেলে? মনে নেই আগের জনের ক্ষেত্রে প্রতিমাসে পারলারে তোমাকে কতো টাকা গুনতে হতো? এসব সাধারণ বিষয় বাদ দিয়ে ওর সাথে নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করো। ও অগোছালো থাকে এখন থেকে তুমিও অগোছালো থাকবে। একটা কথা তোমায় বলি আবারও যদি তোমার ডিভোর্স হয় এরপর তোমার কাছে আর কোনো মেয়ে আসতে চাইবে না। কথাটা মনে রেখো।
জিন্নাতআরার এই কথাটা যেন অয়নের জীবনে ওষুধের মতো কাজ করলো। এরপর থেকে অয়ন তমার সাথে আস্তে আস্তে নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলো। বিয়ের চারমাসের মাথায় তমা কনসিভ করলো। কিন্তু একটু অসাবধানতায় মিসক্যারেজও হয়ে গেল। এতে তমা মানসিকভাবে বেশ ভেঙ্গে পড়ে। অয়নেরও মনটা বেশ খারাপ থাকে। সে কারণে জিন্নাত আরা অয়নকে ডেকে বললেন,
—-তোমরা দুজনে দেশের বাইরে থেকে ঘুরে আসো দেখবে মনটা অনেকটা ভালো হয়ে যাবে।
মায়ের কথাতে অয়ন অফিস থেকে সাতদিনের ছুটির ব্যবস্থা করে। দু’দিন পর ১৪ই ফেব্রুয়ারী। ঐ দিনেই তমাকে নিয়ে থাইল্যান্ডে উড়াল দেওয়ার প্লান করে। অয়নের কাছে থাইল্যান্ডে ঘুরতে যাওয়ার প্লান শুনে তমা মনে মনে ভীষণ খুশী হয়। শাশুড়ী জিন্নাত আরা তমাকে নিয়ে শপিং এ যায়। জিন্স প্যান্ট, লং ফতুয়া ম্যাচিং করে হেজাব,সানগ্লাস কিনে দেয়।
নিদিষ্ট দিয়ে অয়ন তমাকে নিয়ে এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেয়। বোডিং পাস, ইমিগ্রেশন ক্রস করে তমা আর অয়ন প্লেনের জন্য অপেক্ষা করে। হাতে ঘন্টা খানিক সময় আছে। দুপুর বারোটায় থাই এয়ারওয়েজে ওরা রওয়ানা দিবে।অয়ন এয়ারপোর্টের কফিশপ থেকে দুকাপ কফি আর দুটো স্যান্ডউইচ অর্ডার করে। ওরা দুজনে কফি খেয়ে কিছু ফটোশুট করে। অয়ন তমার দিকে তাকায়। মেয়েটাকে আস্তে আস্তে ওর ভালো লাগতে শুরু করেছে।ওর সবচেয়ে যে গুনটা অয়নকে আকর্ষণ করে সেটা হচ্ছে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করা। নিজেকে পরিবর্তন করা। এই কয়মাসে তমা নিজেকে অনেকটাই পরিবর্তন করেছে। ডেনিম জিন্স প্যান্টের উপর সাদার জমিনে নীল সুতো দিয়ে কাজ করা একটা লং ফতুয়া সাথে নীল সাদা প্রিন্টের একটা হেজাব মাথায় দিয়ে চোখে সানগ্লাস আর পায়ে কেটস সব মিলিয়ে মেয়েটাকে অপূর্ব লাগছে। তমাও আড়চোখে অয়নের চোখের মুগ্ধতাকে উপভোগ করছে। আর মনে মনে ভাবছে একটু ধৈর্য ধরলে আসলেই জীবনে অনেক ভালো কিছু অপেক্ষা করে। তমার দৃষ্টিতে আজ একরাশ মুগ্ধতা। ব্লাক জিন্সের সাথে হালকা আকাশী রংয়ের ফুলস্লিপ শার্টের হাতাটা গোটানো, কব্জিতে রোলেক্স ঘড়ি,পায়ে কেটস, চোখে সানগ্লাস তমার কাছে অয়নকে নায়কের মতো লাগছে। প্লেনে উঠার সময় হয়ে এলো। অয়ন একহাতে তমার হাত ধরে অন্য হাতে হ্যান্ড লাগেজ নিয়ে ইকোনমিক ক্লাসে নিজের নিদিষ্ট সীটে আসন গ্রহন করলো। অয়নের যদিও প্লেনে কয়েকবার চড়া হয়েছে কিন্তু তমার এই প্রথম। অয়ন তমার সীট বেল্টটা বেঁধে দিলো। প্লেনটা যখন উড়তে শুরু করলো তমার একটু ভয় হতে লাগলো। অয়ন আলতো করে পিছন দিক থেকে তমাকে জড়িয়ে ধরে রাখলো। অয়নের এই কেয়ারিং তমার মনটাকে আন্দোলিত করে দেয়।
এদিকে ছেলে আর বউকে এভাবে একসাথে হাসি মুখ করে বেরাতে যেতে দেখে জিন্নাত আরার চোখ দুটো আদ্র হয়ে উঠে। আসলে সন্তানের পরিপূর্ণ সুখটাই বাবা মাকে সুখী করে দেয়। অয়ন আর তমা চলে যেতেই জিন্নাত আরা কোমর বেঁধে ছেলের ঘর পরিস্কারের কাজে নেমে পড়ে। যেহেতু তমার এক্ষেত্রে একটু কমতি আছে সেটা জিন্নাত আরা নিজের শ্রম দিয়ে পুষিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। কারণ উনি নিজেও খুব পরিস্কার পরিছন্ন থাকতে পছন্দ করেন এবং দুই ছেলেকে সেভাবেই গড়ে তুলেছেন। ছেলের রুমের ফ্যান পরিস্কার থেকে শুরু করে আলমারী, ক্লসেট,খাট রুমের সমস্ত ফার্ণিচার ভিজা কাপড় দিয়ে মুছে ধুলো পরিস্কার করে দেয়। এরপর কাজের অ্যাসিসটেন্টকে সাথে নিয়ে বাথরুম ক্লিন করে দেয়। ওদের বিয়ের পর থেকেই যখনি তমা আর অয়ন কোথাও বেরাতে যায় এই সুযোগে ছেলের ঘর পরিস্কারের দায়িত্ব নিজের হাতে তুলে নেয়। প্রতিবারই তমা এসে লজ্জাবনত চোখে বলবে,
—-মা আমাকে দেখিয়ে দিলে আমিই তো পরিস্কার করতপ পারতাম। তাছাড়া আমার চোখে তো ময়লা ধরা পড়ে না। আপনারও তো কষ্ট হয়।
জিন্নাত আরাও মুচকি হাসি দিয়ে বলে,
—-আমি আর কতদিন করবো। একসময় তোমাকেই সব বুঝে নিয়ে করতে হবে।
জিন্নাত আরাও জানেন তমাও একসময় শিখে যাবে। কারণ নারী যখন স্ত্রীতে পরিনত হয় তখন তাকে সবকিছুই শিখে নিতে হয়।
সায়ানের মেডিকেল কলেজ বন্ধ হওয়াতে বাসায় ফিরে আসে। সকাল থেকে মাকে এভাবে ভাবির ঘর পরিস্কার করতে দেখে বলে,
—-তোমার মতো শাশুড়ী পাওয়া আসলেই ভাগ্যের ব্যাপার।
জিন্নাত আরা হাসিমুখ করে বলেন,
—ভাগ্য কিনা জানি না তবে জগতের প্রতিটি মায়ের কাছে সন্তানের সুখটাই সবচেয়ে প্রাধান্য পায়।
ঘন্টা তিনেকের মধ্য তমা আর অয়ন থাইল্যান্ডে পৌঁছে যায়। সেখান থেকে একটা গাড়ি ভাড়া করে পাতায়ার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেয়। পথে একটা রেস্টুরেন্টে ওরা হালকা কিছু খেয়ে নেয়। হোটেলে পৌঁছাতে ওদের সন্ধা হয়ে যায়। আজ ১৪ই ফেব্রুয়ারী। তমা অধীর আগ্রহে অয়নের মুখ থেকে কিছু রোমান্টিক কথা শোনার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে। কিন্তু অয়ন এযুগের ছেলে হলেও ওর ভিতরে এই ধরণের আবেগ খুব কম। হোটেলে পৌঁছে ক্লান্ত শরীরে বিছানায় গা এলিয়ে দেয়। অয়ন ওকে লক করে কিছু খাবার কিনতে বাইরে চলে যায়। তমার চোখটা একসময় লেগে আসে।
অয়ন তমার পাশে এসে দাঁড়ায়। এরপর তমাকে পাঁজা কোলে করে তুলে গোল হয়ে ঘুরতে থাকে। তমাও খিল খিল করে হাসতে থাকে। একসময় তমাকে কোল থেকে নামিয়ে দিয়ে তমার হাঁটুর কাছে পা ভাঁজ করে বসে একটা গোলাপ ফুলের তোড়া এগিয়ে দিয়ে বলে
—আই লাভ ইউ মাই ডিয়ার।
তমাও ফুলের তোড়াটা হাতে নিয়ে বলে,
—-আই লাভ ইউ টু।
অয়ন তমার দিকে তাকিয়ে বলে,
—-এটুকুতেই আমি সন্তষ্ট হবো না। আমাকে কিস করতে হবে।
তমার লজ্জায় মাটির সাথে মিশে যেতে থাকে। তমার লজ্জাবনত মুখ দেখে অয়ন মিটি মিটি হাসে। এরপর তমাকে জড়িয়ে ধরে বলে,
—-আজ তোমাকে শিখিয়ে দিবো কিভাবে কিস করতে হয়?
তমা ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয়। সাথে সাথে ওর ঘুম ভেঙ্গে যায়। অয়ন ওর ধাক্কা খেয়ে বলে,
—-কি ব্যাপার আমাকে এভাবে ধাক্কা দিলে কেন?
অয়নকে দেখে তমা আরো লজ্জা পেয়ে যায়। স্বপ্ন যে এতো জীবন্ত হতে পারে সেটা ভেবে ও খুব অবাক হয়। এরপর অয়ন তমাকে জড়িয়ে ধরে বলে,
—-আমাকে নিয়ে বুঝি স্বপ্ন দেখছিলে?
তমা নিজেকে একটু স্বাভাবিক করে বলে,
—আজ তো ভালোবাসা দিবস।
তমার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে অয়ন বলে,
—-শুধু একটা বিশেষ দিন নয় আমার কাছে প্রতিটি দিন হবে ভালোবাসা দিবস আর প্রতিটি রাত হবে বাসর রাত।
অয়ন তমার ঠোঁটের দিকে নিজের ঠোঁটটা এগিয়ে আনতেই তমা লজ্জা পেয়ে অয়নের বুকে মুখটা লুকায়। আর ভালোবাসার অমৃত সুধায় ওর ডুবে যেতে বড্ড ইচ্ছে হয়।
সমাপ্ত