নব্বই পাতার ডায়েরী পর্ব-৪+৫

0
373

#নব্বই_পাতার_ডায়েরী
#পর্ব_৪
#মৌরিন_জিনাত_জাহিন

– “প্রজ্ঞা,আমার টাওয়াল কোথায়?”
রান্নাঘরে নাস্তা তৈরির কাজে ব্যাস্ত ছিলো প্রজ্ঞা। এনজামের ডাক শুনে চোখেমুখে বিরক্তি ফুটে উঠলো তার। এই ছেলে নাকি থাকবে তাকে ছাড়া! নিজের একটা কাজ ঠিকঠাকভাবে করতে পারে সে? গোসলে গেছে ভালো কথা। টাওয়াল টা সাথে করে নিয়ে গেলে কী হতো? পেয়েছে এক বিনে পয়সার চাকরানী!

আরো শত কথা বিড়বিড়িয়ে বলতে বলতে বারান্দায় যায় প্রজ্ঞা। এনজামের টাওয়ালটা নিয়ে এসে বাথরুমের দরজা ধাক্কে বলে,
– “এইযে,নাও। আজই শেষ কিন্তু! এরপর তোমার আর কোনো কাজ আমি..”

কথা শেষ করা হলোনা তার। হুট করে দরজা খুলেই হাতের কব্জি ধরে এক টানে তাকে ভিতরে নিয়ে গেল এনজাম। অকস্মাৎ চমকে ওঠায় টাল সামলাতে না পেরে তার কাঁধ চেপে ধরে প্রজ্ঞা। ধীরেধীরে চোখ খোলামাত্র এনজামের দুষ্টুমিভরা হাসি দেখে কড়া চোখে তাকায়। ফোঁসফোঁস করে বলে,
– “এসব কী হচ্ছে? ছাড়ো আমাকে!”

এনজাম বিপরীতে বেশ অবাক হবার ভান ধরলো। দুহাতে শক্ত করে তার কোমড় জড়িয়ে ধরে বললো,
– “কেন ছাড়বো? রাতে যে ছাড়তে বললাম, তখন ছেড়েছিলে?”

প্রজ্ঞা বড়বড় চোখে তাকিয়ে শুধায়,
– “একটা চুমু খেয়েছি জাস্ট! এভাবে বলার কী আছে? আর ওটা তোমার গিফট ছিলো। পাস্তা ভালো বানাও,তাই।”

– “গিফট তো আমি চাইনি ডিয়ার। ওটা এক্সট্রা ছিলো। শোধ করে দেওয়া উচিৎ।”

বিপরীতে প্রজ্ঞাকে কিচ্ছুটি বলার সুযোগই দিলোনা এনজাম। একহাত কোমড়ে, অন্যহাতটা গালে রেখে নিজের পুরুষালী ঠোঁটের মাঝে আবদ্ধ করলো তার নরম,কোমল অধরযুগল। একরাশ অনুভূতির সংমিশ্রণে গভীর হলো তার স্পর্ষ। হাতদুটো আলগা হয়ে এলো ধীরেধীরে। এমনই সময়ে এক ধাক্কায় তাকে সরিয়ে দিলো প্রজ্ঞা। চোখমুখ কুঁচকে হাতের পিঠে ঠোঁট মুছে বললো,
– “এই তুমি ব্রাশ করোনি নাকি? কী বিশ্রি টেস্ট! ছিহঃ! মাউথওয়াশ দিয়ে কুলি করো আগে,যাও।”

এনজাম কোমড়ে হাত রেখে অসন্তুষ্ট চোখে তাকিয়ে বলে,
– “কী লেভেল এর আনরোম্যান্টিক! এমন রসকষহীন একটা মেয়েকে আমি কী দেখে পছন্দ করেছিলাম বলো তো?”

প্রজ্ঞা কিছুটা ভাব দেখিয়ে বলে,
– “অবশ্যই আমার রূপ!”

এনজাম নাক শিটকে বলে,
– “গোল্লায় যাক তোমার রূপ। একবার ডিভোর্স টা পেতে দাও, তারপর দেখবে কত রোম্যান্টিক একটা মেয়েকে বিয়ে করি।”

– “সেইম টু ইউ। বিয়েতে ইনভিটেশন ও দেবো তোমাকে। এসে গিলে যেও।”
বলেই হনহনিয়ে বাথরুম থেকে বেরিয়ে যায় প্রজ্ঞা। কত কাজ তার এখন! নাস্তা বানানো,ঘর গোছানো,এনজামকে বিদায় দিয়ে আবার প্রণয়কে তৈরি করা,তাকে স্কুলে দিয়ে আসা,তারপর রান্না করা। এগুলো ছেলেমানুষ চোখে দেখে কখনো?
.

রোজকার ন্যায় রাত নয়টায় বাড়ি ফিরলো প্রজ্ঞা। রুটিন অনুযায়ী আজ ছেলেকে পড়ানোর দায়িত্ব তার। এনজাম বিছানায় বসেই ল্যাপটপে কাজ করছিলো কিছু। মা তার ফাঁকিবাজ ছেলেকে অনেক বুঝিয়ে শুনিয়ে পড়তে বসালো। আদর্শলিপি বইটা খুলে তাকে মুখেমুখে পড়ালো,
– “বলো, অ তে অজগর… আ তে আম… ই তে ইলিশ…”

এনজাম হুট করেই ল্যাপটপ এর স্ক্রিনে ওয়েবসাইটের বদলে দেখতে পেলো কিছু পুরনো দৃশ্য। কম করে হলেও চারবছর আগের কথা।

ছোট্ট প্রণয় তখন সবে গুটিগুটি পায়ে হাঁটতে শিখেছে। সারা বাড়িতে তার পদচারণ। একদণ্ড বিছানায় বসিয়ে রাখা যায়না। নিজের পড়াশোনা,অফিস সবকিছুর চাপে সেবার বউ বাচ্চার কাছে যেতে বেশ দেরিই হয়েছিলো এনজামের। সেই কারণবসত প্রজ্ঞা তার উপর বেজায় চটে আছে। কিন্তু সে কী করবে? এই দুজন মানুষকে নিজের কাছে নিয়ে আসার জন্যই তো তার এত পরিশ্রম!

প্রজ্ঞা মুখ ফুলিয়ে বসে ছিলো পড়ার টেবিলে। অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের পরীক্ষা চলছে তার। যদিও মাঝে চারদিন বন্ধ আছে। তবুও, বরকে দেখাতে হবে, সেও ব্যাস্ত।
এনজাম তখন প্রণয়কে কোলে নিয়ে প্রজ্ঞার পাশে একটা চেয়ারে বসলো। ছেলেকে বসালো টেবিলের উপর। আপনমনে বললো,
– “বাবাই, তুমি পড়াশোনা করবে হুম? চলো, আমরা পড়ি কিছু।”

প্রণয় বেশ উৎসাহ নিয়ে ড্যাবড্যাব করে তাকায়। এনজাম আড়চোখে প্রজ্ঞার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে। ধীরেধীরে সুর টেনে বলে,
– “প তে কী হয় বলতো?”

প্রণয় নতুন পিপি ডাকা শিখেছে। সে কিছু না বুঝেই আধোআধো গলায় বললো,
– “পি..প্পি..”

এনজাম মাথা নাড়িয়ে বলে,
– “উঁহু। প তে প্রজ্ঞা।”

প্রজ্ঞা ভ্রু কুঁচকে তাকায় তার পানে। এনজাম সেদিকে না তাকিয়ে এবার একনাগাড়ে বলে,
– “প তে প্রজ্ঞা, আ তে আমি, ত তে তোমাকে..”

একটুখানি চোখ ঘুরিয়ে বলে,
– “ভ তে ভালোবাসি।”

প্রণয় এই একটা শব্দ চেনে। মা বাবা তাকে একসঙ্গে অনেকবার বলেছে, “আমরা তোমাকে ভালোবাসি।” সে খুশি হয়ে হাত তালি দিলো,খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো। এনজাম তার নাকে নাক ঘষে পুনরায় প্রজ্ঞার পানে চায়। অসহায় চোখে তাকিয়ে নিচু স্বরে বলে,
– “সরি না! আমি কী ইচ্ছে করে দূরে থাকবো তোমাদের থেকে? বাচ্চা নও তুমি। একটু বোঝার চেষ্টা করো! এভাবে রেগে থেকোনা প্লিজ!”

প্রজ্ঞা চোখ নামিয়ে নেয় অশ্রু আড়ালের চেষ্টায়। তবে সফল হতে পারেনা। ক্ষনিকের মাঝেই টপটপ করে অশ্রুকণা গড়িয়ে পড়ে তার হাতের পিঠে। নাক টেনে ফুঁপিয়ে ওঠে নিরবে। মাকে ফোঁপাতে দেখে ছোট্ট প্রণয়ও ঠোঁট উল্টিয়ে নেয়। নাক টানে বারকয়েক। এনজাম পড়ে যায় মহা বিপদে। ছেলেকে নামিয়ে কোলে বসায় প্রথমে। প্রজ্ঞার মুখটা নিজের দিকে ঘুরিয়ে এনে বলে,
– “দুজনে একসঙ্গে কাঁদলে আমি কাকে থামাই বলতো? তোমার এখন বাচ্চা সামলানোর বয়স। সেখানে নিজেই একটুতে কান্নাকাটি শুরু করে দাও।”

– “আমি একটুতে কাঁদিনা। ছিঁচকাঁদুনী নই আমি!”
জোর গলায় বললো প্রজ্ঞা। এনজাম বিপরীতে মৃদু হাসে। কপালে ছড়িয়ে থাকা চুলগুলো কানের পিঠে গুঁজে দিয়ে বলে,
– “বেশ,আপনি ভীষন ম্যাচিউর এক বুদ্ধিমতি নারী। তাহলে আবেগ নিয়ন্ত্রণে রাখুন। সামলান নিজেকে।”

প্রজ্ঞা সম্মুখে থাকা যুবকের চোখের দিকে তাকিয়ে শুধায়,
– “বিয়ের পর মেয়েদের দায়িত্ব হলো স্বামী সন্তানকে সামলানো। নিজেকে সামলানো নয়। তাকে সামলানোর কাজ তার বরের। যেটা আমার বর বুঝতেই পারেনা!”

এনজাম করুণ চোখে তাকিয়ে রয়। তা দেখেই সমস্ত রাগ পড়ে যায় প্রজ্ঞার। প্রণয় লেপ্টে ছিলো বাবার বুকের সাথে। প্তারই পাশে নিজের জায়গা খুঁজে নেয় সে। ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে চোখ বুজে আকুল কণ্ঠে বলে,
– “আমি থাকবোনা এখানে।”

এনজাম খানিকক্ষণ চুপ করে থাকে। দুজন মানব মানবী তখন একে অপরকে কাছে পাওয়ার তৃষ্ণায় তৃষ্ণার্ত। এ দূরত্বের ভার সইতে সইতে ক্লান্ত তারা।
এনজাম পুরুষ মানুষ। তার দায়িত্ব বউকে সামলানো। এবারে স্বান্ত্বনা দেওয়ার পরিবর্তে সে বেশ উৎসাহ নিয়ে বললো,
– “চলো পালিয়ে যাই।”

প্রজ্ঞা চোখ তুলে অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,
– “আর কতবার?”
.

– “অ তে, অজগর টি আসছে তেড়ে।”

– “ভেরি গুড। আ তে?”

– “আ তে… উমম.. আ তে..”

আটকে যায় প্রণয়। সেদিকে তাকিয়ে পুরনো চিন্তা হতে বেরিয়ে আসে এনজাম। ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসি ধরে রেখে ল্যাপটপ টা বন্ধ করে রাখে। ভাবতেই অবাক লাগে তার। একসঙ্গে থাকার জন্য যারা প্রতিক্ষণে তড়পেছে, আজ তারাই কিনা একে অন্যকে নিয়ে বিরক্ত!

– “বলো, আ তে কী বাবা?”

– “মনে পড়ছে না তো মাম্মা!”
মন খারাপ করে বলে প্রণয়। এনজাম তখনই বিছানা থেকে উঠে এসে দাঁড়ায় তার পাশে। প্রজ্ঞার দিকে তাকিয়ে চোখের ইশারায় কিছু বুঝিয়ে ঝুঁকে আসে ছেলের দিকে। তার কাঁধে হাত রেখে বলে,
– “আ তে..”

প্রণয় মা বাবার দিকে তাকাতেই দুজন হেসে ওঠে একসঙ্গে। তার দু গালে দুদিক থেকে গাল ঘষে গলা মিলিয়ে বলে,
– “আ তে, আমরা তোমাকে ভালোবাসিইইই।”

প্রণয় খুশি হয়ে দুজনের গালে চুমু খেয়ে হাত ছড়িয়ে বলে,
– “আমিও তোমাদের অন্নেকক ভালোবাসি!”

সঙ্গেসঙ্গে সে সুযোগ বুঝে নেমে যায় চেয়ার থেকে। ক্রমাগত মাথা নেড়ে অনুরোধের স্বরে বলে,
– “আর পড়বোনা মাম্মা। আমি টুচির সাথে খেলতে যাই?”

– “ওমা! কী পড়েছো তুমি? একটু আদর দিলেই বাদড় হতে হবে?”
প্রজ্ঞা কড়া গলায় বললেও এনজাম ছেলের পক্ষে রইলো। তাকে অভয় দিয়ে বললো,
– “যাও যাও। এইটুকু বয়সে এত পড়া পড়া করলে চলে নাকি? বাবাই,যাও তো তুমি।”

প্রণয় উৎফুল্ল চিত্তে ছুটে যায় ফুফির বাসায়। তার ফুফাতো বোন টুশির সঙ্গে খেলতে। প্রজ্ঞা খুব একটা অভিযোগ করলোনা। ছেলের বইখাতা গুছিয়ে রেখে বেশ গম্ভীর গলায় বললো,
– “আই থিংক,আমাদের এখন একটা সিরিয়াস বিষয় নিয়ে ভাবা উচিৎ।”

– “কী সিরিয়াস বিষয়?”

পাশের চেয়ারে বসে জিজ্ঞেস করে এনজাম। প্রজ্ঞা তার পানে চেয়ে শুধায়,
– “বিষয়টা প্রণয়। ডিভোর্সের পর ও কার সঙ্গে থাকবে সেটা নিয়ে ভাবা উচিৎ।”

এনজাম টেবিল থেকে পেনসিলটা তুলে দু আঙুলের মাঝে নিয়ে ঘোরাচ্ছিল। প্রজ্ঞার কথায় ভাবলেশহীন ভঙ্গিতে বললো,
– “অবশ্যই আমার কাছে থাকবে। ইনপুট যখন আমি দিয়েছি, ডেটাও তো আমার ই হলো।”

প্রজ্ঞা ভ্রুকুটি করে বলে,
– “কিন্তু আউটপুট আমি দিয়েছি।”

– “তাতে কী?”

– “তাতে কী মানে? আমি আউটপুট না দিলে তোমার ইনপুট এর কোনো দাম থাকতো নাকি?”

এনজাম একপেশে হেসে বলে,
– “আমি ইনপুট না দিলে তো তুমি আউটপুট দেওয়ার সুযোগটাই পেতে না। সো, ডেটা আমার।”

প্রজ্ঞা বিস্মিত চোখে তাকিয়ে শুধায়,
– “মাগোমা! ওরে বলদের ঘরের বলদ, আউটপুট ব্যতীত তুমি ডেটা পেতে কী করে? তুমিতো ইনপুট দিয়েই খালাস! নয় মাস প্রসেসিং এর পর ডেটা পেয়েছো তো আমার মাধ্যমেই।”

– “ওরে বলদির ঘরের বলদি, ইনপুট ব্যতীত তুমি প্রসেসিং করতে কী করে? আসমান থেকে আসতো? তাই, মেইন ক্রেডিট আমার। ডেটাও আমার।”

– “টেন পার্সেন্ট ক্রেডিট তোমার হলে বাকি নাইনটি পার্সেন্ট আমার। তাই,ডেটা আমার!”

– “বাবারে বাবা! কী ইনপুট আউটপুট লাগিয়েছিস তোরা? আর কীসের ডেটা?”
অ্যানির গলার আওয়াজ পেয়ে দরজার দিকে তাকায় দুজন। অ্যানি ভিতরে এসে ভ্রু কুঁচকে বলে,
– “তোরা কী নিয়ে যে এত ঝগড়া করিস বুঝিনা আমি! যাই হোক, ভাবী প্রণয়ের একটা জামা দাও তো। আইসক্রিম খেতে গিয়ে গেঞ্জিতে লেগে গেছে।”

প্রজ্ঞা উঠে দাঁড়িয়ে ওয়ারড্রব এর দিকে যেতে যেতে বলে,
– “আইসক্রিম দিওনা গো। ঠাণ্ডা লেগে আছে এমনিতেই।”

– “অল্প একটু দিয়েছি। চিন্তা কোরো না।”

প্রজ্ঞা একটা শার্ট এনে দিলো অ্যানির হাতে। সে শার্টটা নিয়েই বেরিয়ে গেলো ঘর থেকে। পরমুহূর্তেই একে অপরের দিকে আড়চোখে তাকায় দুজন। একসঙ্গে আঙুল উঁচিয়ে জোর গলায় বলে,
– “ডেটা আমার!”

#চলবে?

#নব্বই_পাতার_ডায়েরী
#পর্ব_৫
#মৌরিন_জিনাত_জাহিন

– “মিস্টার এনজাইম,আমার জন্মদিনের উপহার কোথায়?”

একটু অভিমানী কণ্ঠেই বললো প্রজ্ঞা। গতকাল তার আঠারো বছর পূর্ণ হয়েছে। একটিমাত্র উইশ ব্যতীত এনজাম আর কিচ্ছু দেয়নি তাকে। সামান্য একখানা চিঠিও না!
প্রেমিকার অভিযোগ শুনে ঠোঁট কামড়ে হাসে এনজাম। গালে হাত ঠেকিয়ে জিজ্ঞেস করে,
– “কী উপহার চাই আপনার? চেয়ে দেখুন। এখন না পারলেও মাথায় রাখবো। ভবিষ্যতে কখনো না কখনো ঠিকই দিয়ে দেবো।”

প্রজ্ঞা গাল ফুলিয়ে শুধায়,
– “গিফট কী মানুষ চেয়ে নেয়? আর আমি এমন কিছু কেন চাইবো যা তুমি দিতে পারবেনা? ভালোবেসে সামান্য কিছু দিলেই আমি খুশি হয়ে যেতাম।”

– “সেটাই তো জিজ্ঞেস করছি। সামান্য কী দেওয়া যায়?”

– “গোলাপ দেওয়া যায়, ডেইরি মিল্ক চকলেট দেওয়া যায়। অন্তত ফুচকা তো খাওয়ানো যায়!”

এনজাম তার মুখপানে চেয়ে বলে,
– “গোলাপ তো শুকিয়ে যাবে। চকলেট রেখে দিলেও গলে যাবে। আর ফুচকা যাবে পেটে। সঙ্গে তো আর রইলো না! দিলে এমন কিছু দেওয়া উচিৎ যা দশবছর পরেও থেকে যাবে।”

প্রজ্ঞা খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে তার কথা শুনে। আকাশপানে চেয়ে শুধায়,
– “দশবছর বাদে বেঁচে থাকবো কিনা তারই তো নিশ্চয়তা নেই। আর বেঁচে থাকলেও পাশে তুমি থাকবেই, এমনও কোনো কথা নেই। সেখানে বেশি স্মৃতি রেখে লাভ কী?
দিলে বরং সাধারণ কিছু দাও, যা সর্বোচ্চ একবছর টিকে থাকে। যদি তারপরও তুমি সঙ্গে থাকো, তখন নতুন কিছু নেওয়া যাবে।”

এনজাম ভ্রু কুঁচকে বলে,
– “সব বিষয়ে এত যুক্তি দেওয়ার কী আছে? যেন তুমি নিশ্চিত,কিছুদিন পর তোমার হাত ছেড়ে দেবো আমি!”

– “তা কখন বললাম?”

এনজাম প্রসঙ্গ পাল্টে শুধায়,
– “চোখটা বন্ধ করো।”

– “কেন?”

– “আহহা… করোই না!”

প্রজ্ঞা মনের মাঝে একঝাঁক উৎসাহ জমিয়ে রেখে চোখ বুজলো। এনজাম ব্যাগের চেইন খুলে কিছু একটা বের করলো। সন্তর্পণে তা প্রজ্ঞার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললো,
– “এবার চোখ খোলো।”

প্রজ্ঞা চোখ খুললো সঙ্গেসঙ্গে। হাতের দিকে তাকিয়ে দেখতে পেলো একটা মাঝারি আকৃতির ক্যানভাসের উল্টোপিঠ। এনজাম দারুণ ছবি আঁকে, জানে সে। তড়িঘড়ি করে তাই ক্যানভাস টা উল্টে দেখলো।

একদম কালো রঙের উপর তার হাস্যজ্জ্বল মুখ। ক্যানভাস থেকে চোখ তুলে হতবাক দৃষ্টিতে তাকাতেই এনজাম গলা খাকড়ি দিয়ে বলে,
– “এঁকেছি কিন্তু তোমায় সামনে বসিয়েই। টের পাওনি।”

দক্ষ হাতে আঁকা রংতুলির ছবিটির দিকে তাকিয়ে চোখ ভরে ওঠে প্রজ্ঞার। সর্বদা ছেলেটিকে বলে বেড়ায় সে, “আমি কিন্তু বিশাল অনুভূতিসম্পন্ন মেয়ে নই। সঙ্গে আছো, ভালো। ছেড়ে চলে গেলেও কেঁদে সাগর গড়বো না।”
তাকে আবেগী হতে বাধ্য করেছিলো এই ছেলেটিই। সেদিন মুচকি হেসে অষ্টাদশী রমনীর কানে ফিসফিসিয়ে বলেছিলো,
– “আজ একটা কথা দেই তোমায়,প্রজ্ঞা। ভেবে নাও একটা বাজি ধরলাম। ঠিক দশবছর পর তোমার হাত ধরে আবারো এই ক্যাম্পাসে ফিরবো। চোখের সামনে বসিয়ে এমনই একটা ছবি আঁকবো।
ততদিনে তোমার মুখের এই বাচ্চা ভাবটা হয়তো হারিয়ে যাবে। চর্চার অভাবে আঁকার হাত খারাপ হয়ে যাবে আমার। মাঝে দুয়েকজন নতুন সদস্য থাকলেও থাকতে পারে।
অনেককিছু বদলে যাবে। তবে আমি ছবিটা আঁকবোই। বাজিটা নিজের সঙ্গেই ধরলাম। দেখা যাক,সফল হই কিনা!”

চোখ মেলে এক দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে প্রজ্ঞা। পরমুহূর্তে ফিঁক করে হেসে ফেলে। এনজামের বয়স তখন বাইশ ছুঁইছুঁই। ক্লিন শেইভ করার খুব প্রচলন থাকায় তিনিও একই কাজ করতেন। দাড়ি রাখতেন না। কেমন ছোলা মুরগি লাগতো তখন!
মুখের গঠন প্রজ্ঞার কতটা বদলেছে সে জানেনা। তবে এনজামের বদলেছে পুরোটাই। অবশ্য ছেলেদের সৌন্দর্য পঁচিশের পর দ্বিগুণ বেড়ে যায়। প্রজ্ঞা তার চাক্ষুষ প্রমাণ দেখেছে।

অনেকদিন বাদে ক্যানভাসটা বের করেছিলো প্রজ্ঞা। প্রণয় রঙ নিয়ে খেলতে খেলতে একটা জায়গা দাগ দিয়ে ফেলেছে। সেই নিয়ে ছেলেটাকে বকেছেও খুব। বিপরীতে এনজাম রেগে গিয়ে বলেছে, “বকছো কেন ছেলেটাকে? মনে হচ্ছে কত অমূল্য সম্পদ!”
এই একটা জিনিসের মূল্য যে কতটা,তা সে বুঝতেই পারেনা এখন আর।
প্রজ্ঞা একটা জিনিস দেখে হেসে উঠলো খুব। ক্যানভাসের নিচের দিকটাতে লেখা ছিলো, ‘Enzam Khan’
প্রজ্ঞা বাড়িতে এসেই সেটাকে বদলে ‘Enzyme Khan’ বানিয়ে দিয়েছিলো। এখনো তা একইরকম ই রয়েছে।

রংতুলি নিয়ে বসেছিলো প্রজ্ঞা, বিগড়ে যাওয়া অংশটুকু ঠিক করতে। কিছুক্ষন বাদে তা রেখে দিলো। থাক একটা দাগ।
একটা সময় এই স্মৃতি সে রাখতে চায়নি। আর আজ তার জীবনের অর্ধেক স্মৃতিই ঐ পুরুষটিকে জুড়ে।
ক্যানভাসটা যত্ন করে আগের জায়গায় রেখে দিলো প্রজ্ঞা। ফাজিলটা দেখলে শুধুশুধুই খোঁচাবে তাকে!

তার এই শান্ত রূপ খুব বেশি সময়ের জন্য স্থায়ী হলোনা। প্রায় বিশমিনিট হতে চললো এনজাম বাথরুমে ঢুকেছে। এখনো বেরোনোর নাম নেই। সে বের হলো আরো পাঁচমিনিট পর। তাকে দেখেই প্রজ্ঞা ভ্রু কুঁচকে বলে,
– “তুমি সব সময় বাথরুমে ঢুকে বসে থাকো কেন? বাইরে তো মানুষ আছে, এটা মনে থাকে না?”

এনজাম যুক্তি দিয়ে বলে,
– “তা তো তোমার ও মনে থাকেনা।”

প্রজ্ঞা বিছানা থেকে উঠে তার কাছে গিয়ে বলে,
– “তুমি তো বাথরুমে ঢুকলেই এমন লাগে, যেন ফেসবুক লাইভ চালাচ্ছ। শোনা যাচ্ছে, প্রকৃতি তোমার জন্য অপেক্ষা করছে!!

– “তুমি যখন বাথরুমে ঢোকো, তখন কি প্রকৃতি ডাক দেয়, নাকি মিটিংয়ের কল আসে?”

– “তোমার ক্ষেত্রে তো দুটোই একসাথে হয়, প্রকৃতি আর মিটিং…একটা সেশন চলছে, আর একটা কল আসছে!”

এনজাম বিরক্তিসূচক দৃষ্টিতে তাকিয়ে চলে যায় অন্য ঘরে। ছুটির দিনেও একটু শান্তি নেই তার!
প্রজ্ঞা গেল রান্না করতে। প্রণয় বাড়িতে নেই। পিপির সাথে তার বন্ধুর জন্মদিনের অনুষ্ঠানে গেছে।
প্রায় আধাঘণ্টা পর প্রজ্ঞা একটা বড় চামচে করে একটুখানি তরকারি নিয়ে এলো এনজামের কাছে। ওড়নাটা একপাশ থেকে এনে কোমড়ে বাঁধা। এনজামের পাশে এসে দুয়েকবার চামচে ফুঁ দিয়েই বলে,
– “একটু টেস্ট করে দেখো তো সব ঠিক আছে কিনা।”

এনজাম চোখ তুলে তাকাতেই তার গালটা দু আঙুলে চেপে ধরে তরকারিটুকু মুখে ঢুকিয়ে দিলো সে। এনজাম হতবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে চোখমুখ কুঁচকে নিলো। অতিকষ্টে তরকারিটুকু গিলে বললো,
– “কী রেঁধেছো এসব? ঝাল বেশি হয়েছে আর লবন একদমই নেই!”

প্রজ্ঞা তার উত্তরে বেজায় রেগে গেল। কষ্ট করে রান্না করে সে। বিষ দিলেও তো চুপচাপ খেয়ে নেওয়া উচিৎ। আবার কিনা অভিযোগ করে! প্রজ্ঞা চোখদুটো ছোট করে কপাল চাপড়ে আহাজারির স্বরে বলতে লাগতো,
– “সব কিছুতেই দোষ! দিন দুনিয়ায় আর কোনো শান্তি নেই আমার। হাঁটতে চলতে শুতে বসতে কোথাও শান্তি নেই! সব হয়েছে তোমার জন্য।”

এনজাম তার অদ্ভুত কথাবার্তা শুনে নিজেও সোজা হয়ে বসলো। হাত নাড়িয়ে বললো,
– “তো তুমি কী করেছো? পুরো জীবনটাই হারাম করে দিয়েছো আমার!”

তাদের ঝগড়া শুরু হতেই যাচ্ছিলো, এমন সময় টিভিটা চলে উঠলো। এনজাম খেয়াল করলো তার হাতের চাপেই ভুলবশত অন হয়ে গেছে।
তবে তারা অবাক হলো টিভিতে চলতে থাকা গানটি দেখে। তাতে উচ্চস্বরে বাজছে,
– “আমার নাওয়া-খাওয়া-ঘুম হারাম করে,
তুই আমার জীবনে থাক আরাম করে…”

দুজনে হা করে তাকায় একে অপরের দিকে। সেকেন্ড কয়েক বাদে প্রজ্ঞা মুখ বন্ধ করে। রিমোট তা নিয়েই অফ করে দেয় টিভিটা। ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বুকে হাত গুঁজে বলে,
– “বয়েই গেছে আমার! আর তো ছিয়াশি দিন, যেতে দাও। তারপর আর এক মিনিট ও থাকবোনা তোমার জীবনে।”

এনজাম হঠাৎ কেমন করে যেন চাইলো। বিছানায় পা ঝুলিয়ে বসে গম্ভীর গলায় বললো,
– “কে থাকবেনা?”

– “আমি থাকবোনা।”

এনজাম এবার উঠে দাঁড়ায়। ঘাড়ে বারকয়েক হাত ঘষে আচমকা খপ করে ধরতে যায় প্রজ্ঞার হাতখানা। প্রজ্ঞা হাত সরিয়ে পিছিয়ে যায়, চামচ টা পড়ে যায় নিচে। এনজাম তার দিকে দু কদম এগিয়ে বলে,
– “আবার বলো।”

প্রজ্ঞা এবার খানিকটা বিব্রত হলো। একটু একটু করে পিছিয়ে যেতে যেতে বললো,
– “সমস্যা কী? এভাবে কথা বলছো কেন?”

– “শুনতে চাও?”
মিটিমিটি হাসে সে। প্রজ্ঞা বড়বড় চোখে তাকিয়ে রয়। এনজাম বেশ ভাবসাব নিয়েই এগোচ্ছিলো তার দিকে… ঠিক তখনই হুট করেই এক অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটলো।
প্রজ্ঞার হাত থেকে পড়ে যাওয়া চামচটা না দেখে তার উপর পা দিতেই টাল সামলাতে না পেরে ধপ করে মেঝেতে চিত হয়ে পড়ে যায় এনজাম। খাটটা ধরে ফেলায় মাথায় আঘাত না পেলেও কোমড়ের হাড়টা বুঝি মটমট করে উঠলো! তা বুঝতে পেরেই “ওমাগো” বলে চেঁচিয়ে ওঠে এনজাম। সেকেন্ড দুয়েক এর মাঝে পরিস্থিতি মস্তিষ্কে পৌঁছাতেই ঘর কাঁপিয়ে হাসতে আরম্ভ করলো প্রজ্ঞা। হাসতে হাসতে বললো,
– “এবার বোঝো ঠ্যালা! খুব হেসেছিলে না সেদিন?”

এনজাম একহাত কোমড়ে রেখে কটমট চোখে তাকিয়ে বলে,
– “ওরে নেমোখারাম! হাসা বাদ দিয়ে উঠাও আমাকে। এবার কিন্তু সত্যিসত্যি বাসা থেকে বের করবো তোমায়!”

প্রজ্ঞার একটু মায়া হলো। এগিয়ে এসে হাত ধরে উঠতে সাহায্য করলো এনজামকে। বিছানায় বসিয়ে পিঠের দিকটাতে হাত দিতে যাবে তখনি এনজাম চেঁচিয়ে বলে ওঠে,
– “না না না!”

প্রজ্ঞা ভ্রু কুঁচকে তার মুখ চেপে ধরে বলে,
– “আরে আস্তে চিল্লাও! তোমার ঐ ঝগড়ুটে বোন শুনতে পেলে আমায় এসে ঝাড়বে। বলবে, আমার ভাইয়ের সব শেষ করে দিলো এই কালনাগিনী!

আর না না কী হ্যা? তোমার নানা বেঁচেই তো নেই। আপাতত পাশে বউ আছে। বউ বউ করো।
তার আগে গলা ঠিক করো। এমন সুর টেনে চ্যাঁচাচ্ছো যেন সিনেমার কোনো সাইকো নায়ক তোমাকে কিডন্যাপ করে আটকে রেখেছে। এখন সে ধীরেধীরে এগিয়ে আসছে। আর তুমি পিছিয়ে যেতে যেতে বলছো,
‘ছেড়ে দিন! ছেড়ে দিন আমাকে প্লিজ! আমার এই সর্বনাশ করবেন না দয়া করে!”

শেষের কথাটুকু নাকি সুরে বললো প্রজ্ঞা। এনজাম বিস্মিত চোখে তাকাতেই সেই সুযোগে তার কোমড়ে হাত রাখলো। সঙ্গে সঙ্গে আবারো চেঁচিয়ে উঠলো এনজাম।
প্রজ্ঞা এবার হাতটা সরিয়ে নিয়ে বলে,
– “আসলেই লেগেছে?”

– “গোঙ্গার বাচ্চা গোঙ্গা! মনে হচ্ছে হাড়টাই ভেঙে গেলো। আর তুমি বলছো লেগেছে কিনা?”

– “মেয়েদের মতো কান্নাকাটি না করে বোসো। তোমার বোনের বাসায় গিয়ে দেখি মুভ পাই কিনা।”

বলে হাঁটা ধরেও থেমে যায় প্রজ্ঞা। মিটিমিটি হেসে তার দিকে ঝুঁকে বলে,
– “হাড় ভাঙলেই বা আমার কী? আমিতো আর থাকছিনা।”
এবার সে হাত উচিয়ে স্লোগান এর ভঙ্গিতে বলতে বলতে যায়, “থাকছিনা,থাকবোনা…”

এনজাম একহাত কোমড়ে রেখে কুজো হয়ে বসে ছিলো। তার কথায় রেগে গিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলে,
– “আমিও থাকবোনাআআ….আহহহহ!”

#চলবে?