নব্বই পাতার ডায়েরী পর্ব-৯+১০

0
276

#নব্বই_পাতার_ডায়েরী
#পর্ব_৯
#মৌরিন_জিনাত_জাহিন

শরীরের তাপমাত্রা ১০২ ডিগ্রির অধিক। তা নিয়ে রাত একটা বাজে বসেবসে ফোনে গেইমস খেলছে এনজাম। মানুষের নাকি অসুস্থ হলে ঘুম পায়। অথচ সে চোখই বুজতে পারেনা। তার উপর পাচ্ছেনা সহধর্মিণীর খোঁজ। প্রায় এক ঘণ্টা যাবৎ সে অনলাইনে নেই। না বলে তো ঘুমিয়ে পড়েনা মেয়েটা।
ফোনটা বন্ধ করে মাথা চেপে ধরে কিছুক্ষন বসে রইলো এনজাম। ইচ্ছে করলো এই মুহুর্তে বউয়ের কাছে ছুটে চলে যেতে। তার কোলে মাথা রেখে শুয়ে থাকবে। সে তার নরম হাতটা চুলের মাঝে ডুবিয়ে রাখবে। শরীরটা একটু ভালো থাকলে সে সত্যিই চলে যেত। তবে এই অবস্থাতে বাইক চালানো ঠিক নয়। বউ বাচ্চা নিয়ে একটা সুন্দর সংসার সাজানো বাকি তার। এখনি হাত পা ভেঙে বসে থাকলে তো চলবেনা।

এনজাম ভাবলো, জোর করে হলেও ঘুমোনো দরকার। এই মুহূর্তে তার সেবা করার মানুষ যেহেতু পাশে উপস্থিত নেই, সেহেতু নিজের ভালো নিজেকেই বুঝতে হবে। এই ভেবে বিছানায় পিঠ লাগানো মাত্রই কলিং বেলটা বেজে উঠলো। প্রথমবারে একটু অবাক হলো এনজাম। এই রাতের বেলা কে আসবে? হয়তোবা মনের ভুল। কিন্তু না! আনুমানিক ত্রিশ সেকেন্ড যেতেই আবারো বেল বাজে। ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে বিছানা থেকে নেমে আসে এনজাম। বাসার মূল দরজাটা খুলে সামনে তাকাতেই ভ্রুদ্বয় শিথিল হয়ে আসে তার।
শরীরে মোটা চাদর প্যাঁচানো প্রজ্ঞা ঘুমন্ত প্রণয়কে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পাশে একটা লাগেজ। এনজামকে পাশ কাটিয়ে সে ভিতরে ঢুকলো। প্রথমেই ঘরে গিয়ে বালিশে শুইয়ে দিলো প্রণয়কে। এরপর ফিরে এসে দরজা লক করলো। এনজাম তখনো হা করে তাকিয়ে আছে। জ্বরের ঘোরে সে কী জেগেজেগে স্বপ্ন দেখছে? বোধ হয় তাই। এই ভেবে ঔষ্ঠ্যদ্বয় প্রসারিত করে শুধায়,
– “বাহ! তুমি আজকাল আমার স্বপ্নেও আসো দেখছি।”

প্রজ্ঞা নিষ্প্রভ চোখে তাকিয়ে তার কাছে এসে দাঁড়ায়। হাত উঁচু করে কপাল ছুঁয়ে বলে,
– “নেমেছে জ্বর?”

চকিতে তার মুখপানে চাইলো এনজাম। হাতটা ধরে তার দিকে তাকিয়ে হতবাক কণ্ঠে বললো,
– “তুমি সত্যিই এসেছো?”

তার কথার বিপরীতে গাল ভরে হাসলো প্রজ্ঞা। এনজাম একহাতে তার বাহু চেপে ধরে বলে,
– “কার সাথে? কী করে? এত রাতে!”

– “ড্রাইভিং লাইসেন্স আছে। ড্রাইভ করতে জানি আমি।”

– “রাত একটা বাজে তুমি প্রণয়কে সাথে নিয়ে ড্রাইভ করে এসেছো? প্রজ্ঞা! আর ইউ ম্যাড?” একটু রেগেই বললো এনজাম। প্রজ্ঞা তার কথায় কর্ণপাত না করে আচমকা জড়িয়ে ধরলো তাকে। বুকে মাথা রেখে শক্ত হাতে জাপটে ধরলো। এনজাম চোখ বুজে ফেলে। এক অদ্ভুত সুখ অনুভূত হলো বুকের মধ্যিখানে। প্রজ্ঞা তাকে আঁকড়ে ধরেই বললো,
– “আর একটা বকা দিলে কথাই বলবো না। যার জন্য চুরি করি সেই বলে চোর!”

এনজাম দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে দুহাতে তার মুখটা তুলে বলে,
– “এমন পাগলামির কোনো মানে হয়? কোনো বিপদ হলে?”

– “হয়নি তো! তাহলে আর বলবেনা এই কথা।”

এনজাম মুচকি হেসে জানতে চায়,
– “বলে এসেছো বাড়িতে?”

– “প্রিতীকে বলেছি শুধু। বাকিদের বলিনি। আর কাউকে বলার কী আছে? নিজের বরের কাছে এসেছি। চুরি করতে তো যাইনি!”

প্রজ্ঞার শরীরে ঘরে পড়া সেলোয়ার কামিজ। খোঁপা করা চুলগুলো খুলে গিয়েছিলো। এনজামের থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়ে চাদরটা খুলে চেয়ারে রাখলো সে। চুলগুলো হাতখোঁপা করতে করতে জিজ্ঞেস করলো,
– “খাওয়াদাওয়া হয়েছে কিছু? নাকি সন্ধ্যা থেকে গেইম ই খেলেছো?”

উত্তর দিলোনা এনজাম। পিছন থেকে এসে তার কোমড় জড়িয়ে ধরলো। ওড়নাটা একটু সরিয়ে কাঁধের উন্মুক্ত অংশে একটা গাঢ় চুমু খেয়ে শান্ত গলায় বললো,
– “আসার ইচ্ছে থাকলে আরো আগেই আসতে। এই রাতের বেলায়! এটা কোনো সময় হলো আসার? তোমার আম্মাজান তো শুনে বলবে আমি ডেকে এনেছি।”

প্রজ্ঞা স্থির অবস্থায় তার গালে একটা হাত রেখে বলে,
– “ভালো লাগছিলো না আমার। তুমি না মানলেও আমি একটা ভালো বউ। বরের জন্য চিন্তা করি। ভেবেছিলাম সকালে আসবো। কিন্তু আর থাকতে পারলাম না। রাতের বেলা সবার ঘুম ভাঙাতে চাইনি বলেই শুধু প্রিতীকে বলে এসেছি। পারলে সবাইকেই জানিয়ে আসতাম। আই ডোন্ট কেয়ার আবাউট দ্যাট।
এখন বলো, খেয়েছো কিছু?”

– “হু…”

– “কী খেয়েছো?”

– “উফ,বললাম তো খেয়েছি। এত প্রশ্ন করো কেন?”

– “বউ আমি তোমার! আরো হাজারটা প্রশ্ন করবো। তুমি উত্তর দিতে বাধ্য।”

এক লম্বা নিঃশ্বাস টেনে তার কাঁধে মুখ দাবিয়ে রাখে এনজাম। প্রজ্ঞার একটুও ইচ্ছে ছিলোনা তাকে সরিয়ে দেওয়ার। তবে তার শরীরের তাপ অনুমান করতে পেরে দ্রুততার সঙ্গে সরে যায় তার নিকট হতে। এনজাম একটা চেয়ার টেনে বসে। তাকে আপাদমস্তক পরখ করে প্রজ্ঞা হতাশ কণ্ঠে শুধায়,
– “কত কেজি ওজন কমেছে তোমার? নিজের কী হাল করছো দিনদিন?”

– “কী করলাম?” না বোঝার ভান ধরে বলে এনজাম। প্রজ্ঞা তার দিকে রাগত দৃষ্টিতে চেয়ে বলে,
– “নাটক করবেনা। রিতীমতো নিজের উপর টর্চার চালাচ্ছো। এত কষ্ট করতে তো বলিনি আমি! দুদিন বাদে দেখা যাবে আমাকে কোলেই তুলতে পারছোনা!”

এনজাম তার কথায় ঠোঁট কামড়ে হেসে বলে,
– “এই মুহূর্তে শরীরে জোর কম। তবুও তোমায় আরামসে তুলতে পারবো। বলো,উঠবে কোলে?”

– “মজা করছিনা আমি!”
তেজি স্বরে বলে ফ্রিজের দিকে এগোয় প্রজ্ঞা। তবে ফ্রিজ খুলতেই থমকে দাঁড়াল সে। আপেল, কলা, কমলা, আম, আঙুর; সব মিলিয়ে যেন একটা ফলের বাজার বসে আছে!
প্রজ্ঞা চিৎকার করে বললো,
– “এটা কী ফ্রিজ নাকি ফলের বাগান? তুমি কী সারাদিন ফল খেয়ে বেঁচে থাকো?”

– “ফল খাওয়া স্বাস্থ্যের জন্য ভালো”, এনজাম নিরীহভাবে বললো।

– “তো আমি এখন রাঁধবো টা কী? আপুরা বাসায় নেই। বিস্কিল ব্যতীত কিছু যে রেঁধে খাওনি তা জানা আছে আমার।”

– “আম-কলার চপ বানানো যায়না? আপেলের ঝাল চাটনি, কমলার অমলেট বা আঙুর বিরিয়ানি?” একটু ভেবে বলে এনজাম। প্রজ্ঞা ফ্রিজের দরজাটা ঠাস করে আটকে জানায়,
– “অবশ্যই! তার আগে তোমার এন আই ডির নাম চেঞ্জ করবো। নতুন নাম হবে, মাইকেল ফলসূদন খান।”

এনজাম হেসে ওঠে তার কথায়। তখনি ঘর থেকে প্রণয়ের কান্নার আওয়াজ ভেসে আসে। প্রজ্ঞা ফ্রিজ থেকে কিছু ফল বের করতে করতে বলে,
– “গিয়ে পাশে শোও একটু। মাথায়,পিঠে হাত বুলিয়ে দাও। ঘুমিয়ে যাবে।”

– “জানি আমি। কাছে থাকিনা বলে কী এটুকু জানবোনা?”
প্রজ্ঞা হাসলো সামান্য। এনজাম গিয়ে বসলো ছেলের পাশে। তাকে কোলে তুলে বুকে জড়িয়ে রাখলো। ঘুমিয়ে যেতেই কানেকানে ফিসফিসিয়ে বললো,
– “বাবা মিসড ইউ জান।”

প্রজ্ঞা ঘরে এলো প্রায় ত্রিশ মিনিট বাদে, কাচের বাটিতে কিছু নিয়ে তাতে ফুঁ দিতে দিতে। ওড়নাটা একপাশ থেকে এনে কোমড়ে বাঁধা। এনজাম প্রণয়কে বালিশে শুইয়ে দেয়। বিছানায় পা ঝুলিয়ে বসে বলে,
– “তোমাকে একদম পাক্কা গৃহিণী লাগছে জানোতো?”

প্রজ্ঞা খুব একটা পাত্তা না দিয়ে তার পাশে বসে বললো,
– “পামপট্টি পরে দেবে। আগে এটা খেয়ে নাও। ফ্রুট লাভারের জন্য ফ্রুট কাস্টার্ড।”

– “তুমি এসব শিখলে কবে?”
বাটিটা হাতে নিয়ে জিজ্ঞেস করে এনজাম। প্রজ্ঞা বিপরীতে হেসে উঠে বলে,
– “লুকিয়ে লুকিয়ে রান্নাঘরে গিয়ে আমি আর প্রিতী ট্রাই করেছি একেকটা জিনিস। সব ইউটিউব দেখে। জানো একবার কী হয়েছে? লবনের বদলে হুইল পাউডার দিয়ে ফেলেছিলাম।”

একি চামচ কাস্টার্ড সবে মুখে তুলেছে এনজাম। প্রজ্ঞার কথা শুনে তা মুখে রেখেই বড়বড় চোখে তাকায়। প্রজ্ঞা তার হাবভাব দেখে বলে,
– “আরে চিন্তা নেই। এখানে ওসব দেইনি।”

হাফ ছেড়ে বাঁচলো প্রজ্ঞা। জ্বরের কারণে মুখ তেতো হয়ে ছিলো। তবুও কাস্টার্ডটুকু তৃপ্তি নিয়ে খেলো এনজাম। তার বউ বানিয়েছে বলে কথা! খাওয়া শেষে বাটিটা পাশে রাখতেই প্রজ্ঞা জিজ্ঞেস করলো,
– “ঔষধ খেয়েছিলে?”

– “হুম।”

– “কখন? গায়ে অন্তত ১০২ ডিগ্রি জ্বর আছে এখনো।”

এনজাম হাই টেনে বলে,
– “খেয়েছি সন্ধ্যাবেলায়।”

প্রজ্ঞা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে দুদিকে মাথা নেড়ে বলে,
– “গর্দভ কোথাকার! রাতে খাবেনা আরেকটা? আমি না এলে এভাবেই ঘুমিয়ে পড়তে তো? মেডিসিন বক্স কোথায়?”

এদিক ওদিক তাকিয়ে ওয়ারড্রব এর উপর থেকে ঔষধের বাক্স টা আনতে গেলেই এনজাম পিছন থেকে হাত টেনে ধরলো। উষ্ণ হাতে টানে দু কদম পিছিয়ে এলো প্রজ্ঞা। পিছু ঘুরে তাকাতেই এনজাম হালকা টানে নিজের সম্মুখে নিয়ে এলো তাকে। স্মিত হেসে মুখ লোকায় তার বুকের মাঝে। শান্ত গলায় বলে,
– “থ্যাংক ইউ।”

প্রজ্ঞা তার পিঠে হাত রেখে বিস্তর হেসে বলে,
– “বকছিলে তো নিজেই! কেন এলাম, এটা সেটা…”

এনজাম শক্ত এক ঢোক গিললো। জ্বরের ঘোরেই হোক, চোখটা বুজে করুণ স্বরে বললো,
– “যেওনা আর।”

এহেন আবদার এনজাম এর আগে কখনো করেনি। প্রজ্ঞা চারিদিকে চোখ ঘুরিয়ে সামলায় নিজেকে। দুহাতে যুবকের মাথাভর্তি ঘন চুলগুলো গুছিয়ে দিয়ে তার মাঝে ঠোঁট ছুঁইয়ে বলে,
– “যাবোনা। খুব জ্বালাবো তোমায়। ধরে নাও তোমার শান্তির জীবন এখানেই শেষ, মিস্টার এনজাইম খান।”

মেয়েটা আসলেই যায়নি। এনজাম ভুলবশত বলে ফেললেও তার কথাটা রেখেছে। একটা ছোট্ট সংসার গড়েছে নিজের। বলা চলে, তাদের একসঙ্গে থাকা, মূল সংসারের শুরুটা সেই আড়াই বছর আগের রাত একটা থেকেই।

হাতমুখ ধুয়ে এসে প্রজ্ঞার পাশে বসলো এনজাম। কম্বলে নিজেকে নাক অবধি মুড়িয়ে রেখেছে সে। টেবিলে খাবার ঢেকে রাখা এখনো, সে খায়নি। চোখদুটো কাঁপছে। সঙ্গে কাঁপছে তার পুরো শরীরটাই। এনজাম তার কম্বলে হাত দিতেই সে কাপাকাপা গলায় বলে উঠলো,
– “সরাবে না। শ শীত করছে।”

– “আলসেমি না করে এটা সরাও। ভারী কম্বল গায়ে দাও। হাত সরাও প্রজ্ঞা।”

শরীর থেকে কম্বলটা সরাতেই থরথর করে কেঁপে উঠলো সে। বাচ্চাদের মতো হাত পা গুটিয়ে রইলো। এনজাম একটা ভারী কম্বল তার বুক অবধি টেনে দিয়ে কপালে হাত রাখতেই হাতটা জ্বলে উঠলো তার। এই মেয়ের যখনই জ্বর আসে, একদম শরীর পুড়ে যায় তাপে। এনজাম উঠতে যেতেই শার্টে টান পড়লো তার। গলা এবং ঘাড়ের মাঝের অংশ টেনে ধরলো প্রজ্ঞা। এনজাম সেদিকে তাকিয়ে তার দিকে একটু ঝুঁকে জিজ্ঞেস করে,
– “শীত করছে এখনো?”

মাথা উপরনিচ করে সম্মতি জানায় প্রজ্ঞা। এনজামকে আরো কাছে টেনে তার বুকের সঙ্গে মিশে যেতে চায়। সে বাঁধা দেয়না। বরং নিজে থেকেই তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে কয়েক সেকেন্ড বাদে বলে,
– “এখন?”

দুপাশে মাথা নাড়ে প্রজ্ঞা। এনজাম মৃদু হেসে শুধায়,
– “এত জ্বর বাধালে কী করে?”

প্রজ্ঞা খিটখিটে কণ্ঠে বলে,
– “আমি জানবো কী করে? আর যে কারণেই হোক, তোমার বিরহে কিছু হয়নি।”

– “তা তো জানিই। কেঁদেকেটে সাগর গড়ার মেয়ে তো নও তুমি।”
প্রজ্ঞার শরীরটা শীতে কাঁপছিল তখনো। দাঁতকপাটি লেগে আসছিলো। এনজাম কয়েক মিনিট অপেক্ষা করলো। এরপর মৃদুস্বরে বললো,
– “ওঠো,কিছু খেয়ে ঔষধ খাও। জ্বর নামবেনা নাহয়।”

– “খেতে ইচ্ছে করেনা।”

এনজাম কিছুক্ষন ভেবে বলে,
– “পাস্তা খাবে?”

প্রজ্ঞা একটুখানি চোখ খুলে বলল,
– “ওটা ছাড়া আর পারো টা কী?”

– “আপনি ওটাই তো খান। ছাড়ো। বানিয়ে আনি।”

– “নাহ।”

– “খাবেনা?”

– “উঁহু।”

এনজাম তাকে জোর না করে বলে,
– “আচ্ছা। উঠে ঔষধটাই খাও। আলসেমি না করে একটু আগে খেয়ে নিলে এত বেড়ে যেতোনা জ্বর।”

প্রজ্ঞা এবারেও মাথা নাড়ে। এনজাম বিরক্ত হয়ে ভ্রু কুঁচকে শুধায়,
– “খাবার খাবেনা,ঔষধ খাবেনা। তো কী খাবে? আমার মাথা?”

প্রজ্ঞা চোখ তুলে বলে,
– “মাথা না!”

– “তাহলে?”

ক্লান্ত চোখজোড়া বুজে আসে প্রজ্ঞার। এনজাম তার ফ্যাকাসে মুখটার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে রয় কিছুক্ষণ। ঠোঁটজোড়া শুকিয়ে কাঠ হয়ে যায়। এনজাম ঝুঁকে এসে সেই শুষ্ক ঔষ্ঠ্যদ্বয়ের মাঝে একটুখানি সিক্ততা দান করলো। প্রজ্ঞা চোখ মেলতেই নিচু গলায় বলল,
– “আ’ম সরি…”

প্রজ্ঞা সময় নিয়ে বলে,
– “কেন? তোমার কথার ধার ধারি আমি? ভাবছো কী? কষ্ট পেয়েছি বলে জ্বর এসেছে? একদম না।”

এনজাম হেসে আরো একবার তার ঠোঁটে ঠোঁট মিলিয়ে বলে,
– “হুম…তাও সরি।”

পরমুহূর্তেই সে উঠে বসে। ঔষধ, পানির গ্লাস নিয়ে এসে পাশে রাখে। প্রজ্ঞার হাত ধরে টেনে একটু কড়া গলায় বলে,
– “নিজে থেকে ওঠো। জোর করতে বাধ্য করোনা।”

প্রজ্ঞা জিভ দ্বারা ঠোঁট ভিজিয়ে ধীরেধীরে উঠে বসে। মাথাটা এনজামের কাঁধে ঠেকিয়ে হাত পাতে। এনজাম গ্লাসটা দেয় তার হাতে। যত্ন করে তাকে ঔষধ খাইয়ে শুইয়ে দেয় আবারো। প্রজ্ঞা এবারে অন্যদিকে ঘুরে বলে,
– “আরেকটা কম্বল দিয়ে নিজের কাজ করো। যাও।”

এনজাম হুট করে বিছানা থেকে নেমে যায়। হাতে করে কিছু একটা নিয়ে এসে প্রজ্ঞার পাশে আধশোয়া হয়ে বসে। আঙুলের সাহায্যে তার কানের পাশ থেকে চুলগুলো সরিয়ে সেখানে একবার পারফিউম স্প্রে করে বলে,
– “নিউ পারফিউম। ঠিকই ধরেছিলে।”

প্রজ্ঞা অকস্মাৎ সোজা হয়ে তার কলার চেপে ধরে। ঘনঘন নিঃশ্বাস ছেড়ে রাগী গলায় বলে,
– “এটা তখন বললে কী জাত যেত?”

এনজাম স্মিত হেসে ভ্রু নাচিয়ে বলে,
– “আপনি নাকি একটুও কষ্ট পাননা ম্যাডাম? তাহলে চোখ টলমল করছে কেন? মনে তো হচ্ছে এখনি জল গড়িয়ে পড়বে!”

প্রজ্ঞা ঠোঁট চেপে মাথা নুইয়ে নেয়। এনজাম তার মসৃণ গালে হাত রেখে শুধায়,
– “বলেছিতো সরি।”

– “কেন বলেছো?”
তেঁতে উঠলো প্রজ্ঞা। এনজাম ভ্রু কুঁচকে তাকাতেই বললো,
– “আর একবারো বলবেনা। মায়া লাগে!”

হেসে উঠলো এনজাম। শুয়ে পড়লো প্রজ্ঞার পাশে। তার কানের কাছে এসে বললো,
– “তাহলেতো আরো বেশি বেশি সরি বলা উচিৎ।”

প্রজ্ঞা উত্তর দেয়না। এগিয়ে আসে তার নিকটে। কিছুটা সময়ে নিরবতার শেষে চোখ তুলে তাকায় প্রজ্ঞা। কিছুটা ঘোর লাগা দৃষ্টি। এনজামের কানের পাশে মুখ এনে আলতোভাবে ঠোঁট ছুঁইয়ে বলে,
– “মায়ায় ফেলতে ভালোলাগে খুব?”

এনজাম চোখ বুজে একটা শক্ত ঢোক গিললো। কিছুক্ষনের মাঝে নিজের শার্টের বোতামের উপর প্রেয়সীর হাতের উপস্থিতি লক্ষ্য করতেই বড়বড় চোখে তাকিয়ে বললো,
– “প প্রজ্ঞা, আই থিংক ইউ আর নট ইন ইয়োরসেলফ।”

প্রজ্ঞা কানেই তুললোনা তার কথা। শান্ত চিত্তে শার্টের উপরের বোতামটা খুলতেই এনজাম একটু গম্ভীর হলো। তার হাতটা সরিয়ে দিয়ে বললো,
– “অসুস্থ তুমি। নিজের জায়গায় গিয়ে লম্বা একটা ঘুম দাও।”

প্রজ্ঞা বিরক্তিমিশ্রিত দৃষ্টিতে তাকায় একবার। ঠোঁট ডুবিয়ে তার গালে আরো একটা চুমু খায়। এনজাম এবারেও তাকে সরিয়ে দিয়ে বলে,
– “শর্তের কথা ভুলে যাচ্ছো?”

প্রজ্ঞার চোখেমুখে বিরক্তির বদলে এবার চূড়ান্ত মাত্রার রাগ এসে ধরা দিলো। সেকেন্ডের মাঝে এনজামের উপর উঠে এসে তার কলার চেপে ধরে দাঁত কিড়মিড় করে বলে,
– “হারামজাদা,তোর শর্তের মাইরে বাপ! বউ নিজে থেকে ডাকছে তোকে, আর তুই? নাটক করিস? নিজের মধ্যে নেই, অসুস্থ তুমি, শর্ত! হ্যা,সমস্যা কী? খুব সাধু মানুষ তুই?
এতই সাধু হলে আর কটাদিন যেতে দে। নিজে যাবো। তোর ছেলেকে তো সঙ্গে নেবোই! তার সাথে…. তার সাথে এমন জিনিস কেটে নিয়ে যাবো না, জীবনে অন্য কোনো মেয়ের কাছে যাওয়ার স্কোপ ই পাবিনা।”

মাথাটা ঘুরে উঠতেই থেমে যায় প্রজ্ঞা। এনজামের কাঁধে মুখ লুকিয়ে নেয়। তার তপ্তশ্বাস কাঁধ স্পর্ষ করতেই বেসামাল হয়ে পড়ে এনজাম। প্রেয়সীকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে ঝুঁকে এলো তার দিকে। দুজনের দৃষ্টি এক হতেই ঠোঁট ডুবিয়ে দিলো তার ঠোঁটের মাঝে। প্রজ্ঞার এহেন সম্মোহনী রূপ, তার উষ্ণ শরীরের প্রতিটা স্পর্ষে নিজেকে বড্ড দিশেহারা মনে হলো। ধীরেধীরে সরে এসে তার গলা এবং কাঁধের ভাজে বারকয়েক ঠোঁট ছোয়ালো। ঘনঘন নিঃশ্বাস ছেড়ে তবুও একবার ফিসফিসিয়ে বললো,
– “ইউ আর সিক সোনা!”

প্রজ্ঞা হাতের মুঠোয় চেপে ধরলো তার চুলগুলো। বন্ধ চোখের পাশ থেকে দুফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়তেই ক্ষীন স্বরে বললো,
– “ওয়ানা বি সিকার… জাস্ট ফর ইউ।”

তার কথার প্রেক্ষিতে হার মানলো যুবকটি। ঔষধ নেওয়ার ফলে শরীরের তাপ ধীরেধীরে কমে এলো প্রজ্ঞার। সেই সাথে বৃদ্ধি পেলো তার বরের কতৃক পাওয়া স্পর্ষের মাত্রা। নব্বই দিনের শর্ত তাদের সম্পূর্ণরূপে ভেঙেই গেলো। কেবল নয় দিনের মাঝে!

#চলবে?

#নব্বই_পাতার_ডায়েরী
#পর্ব_১০
#মৌরিন_জিনাত_জাহিন

ধরনীর বুকে তখন সবে সূর্যদয় হয়েছে। ঘড়ির দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যায়,ভোর পাঁচটা বাজে। এমন সময় মুখের উপর ঠান্ডা পানির ঝাপটা পড়তেই ধড়ফড়িয়ে উঠে বসলো এনজাম। পানির উৎস খুঁজতে গিয়ে চোখ তুলতেই দেখতে পেল এক নারীর রাগত দৃষ্টি। হাতটা ভেজা তার। অর্থাৎ পানি সেই ছিটিয়েছে। দাঁত কিড়মিড় করে চেয়ে আছে এনজামের দিকে। ঘুমের রেশ তখনো কাটেনি এনজামের। চোখদুটো কুঁচকে বললো,
– “কী সমস্যা? মানুষকে এভাবে জাগায় কেউ? যদি আকস্মিক ঘটনায় স্টোক করতাম?”

প্রজ্ঞা উত্তর দেয়না। ফোঁসফোঁস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে নিজের গলার দিকে আঙুল তাক করে বলে,
– “হোয়াট ইজ দিস?”

এনজাম চোখদুটো কচলে তাকায়। মাথা নাড়িয়ে বলে,
– “কী? দেখতে পাচ্ছিনা তো।”

প্রজ্ঞা বিছানায় উঠে তার নিকটে এসে বসে। পুনরায় বলে,
– “এবার?”

এনজাম একটু লক্ষ্য করে দেখতে পায়, উজ্জ্বল চামড়ায় কিছু লালদে দাগ ফুটে আছে। হাই টেনে সে উত্তর দেয়,
– “খালি চোখে দেখে বোঝাই যাচ্ছে এটি লাভ বাইটের দাগ। ট্রান্সলেট করলে ভালোবাসার কামড়। যদিও আমি এমন আহামরি কামড়াকামড়ি করিনা।”

প্রজ্ঞা সরু চোখে তাকিয়ে শুধায়,
– “লজ্জা করেনা? বড় মুখ করে বলছো আবার? একটা অসুস্থ মেয়ে! এভাবে তার অসহায়ত্বের সুযোগ নিতে বিবেকে বাধলো না?”

এনজাম লম্বা এক নিঃশ্বাস ছেড়ে বলে,
– “ঘরে একটা সিসিটিভি ক্যামেরা লাগাবো।”

– “কেন?”
ভ্রু কুঁচকে বললো প্রজ্ঞা। এনজাম তার দিকে চেয়ে মেকি হেসে শুধায়,
– “তাহলে দেখানো যেতো, আপনি কত্ত অসহায় ছিলেন! আরে ভাই অসহায় তো আমি ছিলাম। আপনি পাত্তাই দিলেন না!”

– “নাটক করো? সোজাসুজি বলো না, নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখার ক্ষমতাই নেই!”

এনজাম মিটিমিটি হেসে তার নাকে নাক ঘষে বললো,
– “বউয়ের কাছে আবার কীসের নিয়ন্ত্রণ? যেখানে বউ নিজে থেকে ডাকে!”

প্রজ্ঞা একটু বিব্রত হলো এবার। রাতের ঘটনা তার স্পষ্টভাবেই মনে আছে। তবে হার মানলে চলবেনা। জোর গলায় বললো সে,
– “মোটেই না। আর আমি তোমার ফিউচার এক্স।”

– “তুমি আমার বর্তমান। ফিউচার টিউচার জানিনা।”
শিথিল কণ্ঠে বললো এনজাম। প্রজ্ঞার চুলের মাঝে হাত ডুবিয়ে তার কপালে কপাল ঠেকিয়ে বললো,
– “খুব ভালো একটা মুড এ আছি। যা খুশি বলে যাও। আমি কিছুই বলবোনা।”

প্রজ্ঞা একটু অবাক হয়ে জানতে চায়,
– “কেন?”

– “রাতে একটা সময় খুবই হতাশ হয়ে কাউকে বলেছলাম, ‘সকালে উঠে তো আমাকেই ঝাড়বে!’ তিনিও খুব আহ্লাদ করে বলেন, ‘শুনে নিও। বউয়ের ঝাড়ি খেলে স্বাস্থ্য ভালো থাকে।’ এন্ড ইউ নো দ্যাট, আমি স্বাস্থ্যসচেতন মানুষ।”

প্রজ্ঞার হাসি পেলো খুব। তা চেপে রেখে কড়া গলায় বললো,
– “আগে স্বিকার করো,দোষ তোমার। শর্ত ভেঙেছো, তাই আমার কথা শুনতে হবে।”

– “নো ডার্লিং, এটা তো বলবোনা। মিথ্যে বলা মহাপাপ। জানোনা?”

– “একদমই মিথ্যে নয়। ঔষধ দেওয়ার পর আবার আহ্লাদ দেখাতে কে বলেছিলো? সরে গেলেই হতো!”

এনজাম অকস্মাৎ তাকে নিয়ে শুয়ে পড়লো। কাঁধে মুখ ডুবিয়ে শক্ত হাতে জড়িয়ে ধরলো। কণ্ঠে অধিক মায়া মিশিয়ে বললো,
– “ঔষধে জ্বর কমতো। মনের কষ্ট কমতো কী?”

প্রজ্ঞা মুখ ঘুরিয়ে শুধায়,
– “কোনো কষ্টই ছিলোনা। বেশি বোঝা বন্ধ করো।”

– “করলাম।”

প্রজ্ঞা আর কথা খুঁজে পেলোনা। কিছু সময়ের নিরবতা তাকে ব্যপকভাবে অস্থির করে তোলে। বিশেষত এনজামের ক্ষেত্রে। সে কথা বলে যায়, ভালো খারাপ সব। প্রজ্ঞা তা উপভোগ করে। মাঝেমধ্যে রাগ করে।
এইতো এখন, খুব ইচ্ছে করলো ক’টা মিষ্টিমিষ্টি কথা বলতে। কিন্তু তারা একে অপরকে বিনা কারণে সময় দেওয়াই তো বন্ধ করে দিয়েছে! খুঁটিনাটি বিষয়ে কথা কাটাকাটির মাত্রা এতই বেড়ে গেছে যে দু দণ্ড একে অন্যকে শক্তভাবে জড়িয়ে ধরে ‘ভালোবাসি’ বলার সময়টাই হারিয়ে গেছে।

সেই সাত বছর আগে, আধা ঘণ্টার সিদ্ধান্তে এই ছেলেটার হাত ধরে কাজি অফিসে গিয়েছিলো সে। ঠিক-ভুল কিচ্ছু মাথায় আসেনি। কেবল ভেবেছে, তাকে না পেলে ছেলেটা পাগল হয়ে যাবে। যখন কবুল বললো, তার একবারের জন্যও দ্বিধাবোধ হয়নি। সেই এক রাতের কথা, নির্ভেজাল আকুতি, মস্তিষ্কের ডায়েরীতে সর্বদা রয়ে যাবে।

.
‘প্রেমিক-প্রেমিকা’ এই নামের সঙ্গে জড়িত হবার চারমাস পেরিয়েছে সবে। প্রজ্ঞা তখন ইন্টার দ্বিতীয় বর্ষে উঠেছে মাত্র। আর এনজাম অনার্স তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। টুকটাক টিউশনি করিয়ে নিজের হাতখরচ ঠিকঠাকভাবেই জোগাড় করে নেয়। পড়াশোনা, টিউশন, সঙ্গে নিজের নতুন প্রেমিকা নিয়ে সময়টা বেশ ভালোই কাটছিলো তার। তবে বিপত্তি বাধালো প্রজ্ঞার পরিবার। হুট করেই তার মা তাদের সম্পর্কের ব্যাপারে জেনে গেলো। বুদ্ধিমতি মা তিনি। মেয়ের গায়ে হাত তুললেন না। তবে ফোন কেড়ে নিলেন। কলেজ যাওয়া বন্ধ করে দিলেন। এনজামের সঙ্গে যোগাযোগের সবধরণের রাস্তা বন্ধ করে দিলেন। প্রিতী, প্রজ্ঞার যমজ বোন। যার সাহায্যে সে এনজামের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছিলো কিছুদিন, তার থেকেও ফোন কেড়ে নিলেন।
এনজামের সঙ্গে তার সম্পর্ক তিনি কখনোই মেনে নেবেন না। প্রজ্ঞা উচ্চবিত্ত পরিবারের মেয়ে। তার সঙ্গে অমন নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে কোনোভাবেই যায়না!
দুই বোন ঘরবন্দি প্রায় দশদিন যাবৎ। এনজাম কোনো প্রকার যোগাযোগ করতে পারেনি প্রজ্ঞার সঙ্গে। শেষমেশ এগারো দিনের মাথায় প্রজ্ঞার বাড়ির পিছনদিকের রাস্তায় এসে হাজির হলো সে। সঙ্গে নিজের সাইকেল। সন্ধ্যা ছয়টা থেকে রাত এগারোটা অবধি দাঁড়িয়েই রইলো। এই আশায়, দৃশ্যমান বারান্দায় প্রজ্ঞা একবার এসে দাঁড়াবে। তাকে দেখে ছুটে আসবে।

প্রজ্ঞা এলো, ঠিক রাত সাড়ে বারোটার দিকে। বারান্দা নয়,জানালা থেকে এনজামকে দেখেই আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠলো। মা’কে বললো,ঠান্ডার মধ্যে নিচে একটা মা বিড়াল দাড়িয়ে আছে। সে একটা পাটের বস্তা দিয়ে আসবে। তার বুদ্ধিমতি মা অপ্রত্যাশিতভাবে হ্যা বললেন। সঙ্গেসঙ্গে ছুটে নিচে চলে যায় প্রজ্ঞা। তড়িঘড়ি করে এনজামকে সরিয়ে আনে আড়ালে।
চারমাসের সম্পর্কে সে বোধহয় দু তিনবার হাত ধরেছিলো প্রজ্ঞার। তবুও তার অনুমতি নিয়ে। সেই ছেলেই স্তব্ধ নজরে চেয়ে থেকে আচমকা জড়িয়ে ধরে তাকে। সেদিনের এনজামকে দেখলে লোকজন হেসে কুটিকুটি হতো। নিশ্চিত বলতো, ‘একটা ছেলে এত ইম্যাচিউর কী করে হয়?’ তার কর্মকাণ্ড ছিলো বাচ্চাদের মতো। একেবারে কাঁদোকাঁদো গলায় বলেছিলো,
– “তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচতে পারবো না,প্রজ্ঞা। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হয় আমার। বিশ্বাস করো,পাগল হয়ে যাচ্ছি আমি। আর কটাদিন তোমার থেকে দূরে থাকলে নিশ্চিত হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলতাম।”

প্রজ্ঞা কেঁদে ফেলেছিলো তখন। কাঁদতে কাঁদতে বলেছিলো,
– “আমি কী করবো?”

এনজাম নিজেও দিশেহারা হয়ে শুধায়,
– “জানিনা। তোমার মা’কে বোঝাও। বলো, এভাবে আমার থেকে দূরে না সরিয়ে দিতে। আমাকে দুটো বছর সময় দাও। ঠিক তার পছন্দের হয়ে উঠবো। কিন্তু এই দূরত্ব শেষ করে দিচ্ছে আমাকে!”

– “মা মানবেনা। আমি চিনি তাকে। এরপর সর্বোচ্চ তোমার বাবা মায়ের সঙ্গে যোগাযোগ করবে,খারাপ আচরণ করবে।”

এনজাম হুট করে বলে ওঠে,
– “তাহলে এমন কিছু করো যাতে করে সে মানতে বাধ্য হয়। চাইলেও আমাদের দূরে সরিয়ে না রাখতে পারে।”

– “কী বলতে চাইছো?”
বিস্ময় দৃষ্টিতে চেয়ে জানতে চায় প্রজ্ঞা। এনজাম খানিকটা গম্ভীর হয় এবার। তার দু গালে হাত রেখে বলে,
– “চলো বিয়ে করে নেই আমরা।”

– “কীহ! পাগল হয়ে গেছো?”

এনজাম ছলছল চোখে তাকিয়ে বলে,
– “তোমার এনজাইম হয়েই থাকবো সারাজীবন। সত্যি বলছি, একটুও কষ্ট পেতে দেবোনা।”

– “কিন্তু এটা ঠিক নয়!”

চোখ বুজে তার কপালে কপাল ঠেকায় এনজাম। খানিকক্ষণ নিরব থেকে বলে,
– “ঠিক-ভুল ভাবতে পারছিনা। শুধু এইটুকু জানি, এ জীবনে আমার তোমাকে চাই। তার জন্য যদি ভুল করতে হয়, সেই ভুলই আমি করতে রাজি।”

নিজের নরম গালে সেই পুরুষের খোঁচাখোঁচা দাড়ির স্পর্শ পেতেই চোখ খুললো প্রজ্ঞা। এনজাম শান্ত গলায় বললো তাকে,
– “জ্বর পুরোপুরি কমেনি। অফিস থেকে ছুটি নাও আজ।”

– “কীসের জন্য? আমি একদম ঠিক আছি। বাসায় থাকার চেয়ে অফিসে যাওয়া ভালো।”

– “বাসায় থাকতে বলিনি। আমিও ছুটি নেবো। কোথাও ঘুড়তে যাবো বিকেলে।”

প্রজ্ঞা বিরক্তি নিয়ে বলে,
– “লাভ কী? সেইতো গিয়ে প্রকৃতির ছবিই তুলবে। তার চেয়ে ভালো ছুটি নিলে বাড়িতে বসে সুন্দর একটা রোম্যান্টিক সিনেমা দেখবো।”

প্রজ্ঞার কথা শুনে এনজাম সঙ্গেসঙ্গে মুখ তুললো। বিরক্তিসূচক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,
– “তোমার রোমান্টিক সিনেমাগুলো দেখে মনে হয়, নায়ক-নায়িকার বিয়ে না হওয়া পর্যন্ত আমার নিঃশ্বাস আটকে থাকবে। শেষ হলে এক টানা অক্সিজেন নিতে হবে! আর যদি তাদের মধ্যে প্রেম না হয়, তো আমি সিসিইউতে ভর্তি!”

প্রজ্ঞা নিজেও ভেংচি কেটে বলে,
– “তুমি যে খালি অ্যাকশন সিনেমা দেখো, তার বেলায়? মনে হয়, ঘরে বসে ট্যাংক চালানোর কোর্স করছো।”

এনজাম তাকে ছেড়ে উঠে বসে। আড়মোড়া ভেঙে প্রস্তাব জানায়,
– “তাহলে চলো, একটা সিনেমা বানাই। যেখানে নায়ক ফুলের তোড়া নিয়ে বাসের ছাদে বসে প্রেম নিবেদন করবে, তার পেছনে ১০টা গাড়ি ছুটবে, দুটো হেলিকপ্টার এসে ল্যান্ড করবে, আর নায়িকার স্কার্ফ উড়ে গিয়ে পাখির মতো হাওয়ায় ভাসবে।”

প্রজ্ঞা অবাক হয়ে ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে,
– “তারপর নায়িকা কী করবে?”

এনজাম নাটকীয় ভঙ্গিতে বলে,
– “নায়িকা তার শাড়ির আঁচলে বন্দুক লুকিয়ে রেখে বলবে, ‘এই প্রেমের পথ সহজ নয় প্রিয়!’
আর সেই সিনেমার নাম হবে ‘রোম্যান্টিক অ্যাকশন’। সুন্দর না?”

প্রজ্ঞা শোয়া থেকে উঠে বসে। মুখ বাঁকিয়ে জানায়,
– “তোমার মাথায় যেসব আসে, তাতে সিনেমার চিন্তা বাদ দিয়ে সাইকার্টিস্ট এর কাছে যাওয়া দরকার।”

এনজাম নাকমুখ কুঁচকে তার দিকে তাকিয়ে বলে,
– “আর তোমার রোমান্টিক সিনেমা দেখে আমার ব্যান্ডেজ কিনতে হয়। কারণ হাই তুলতে তুলতে চোয়াল ব্যথা করে!”

#চলবে?